ফল্গু বসুর গুচ্ছকবিতা

3

[ কবি ফল্গু বসুর কীটপতঙ্গ বিষয়ক সিরিজ কবিতার আজ প্রথম পর্ব (১০ টি কবিতা) প্রকাশিত হলো । পরবর্তীতে আর একটি পর্বে ২৫টি কবিতার এই পুরো সিরিজটি প্রকাশিত হবে । -সম্পাদক, চারবাক । ]

টিকটিকি

টিকটিকি আমার ভাই কিন্তু স্বভাবে অনেক চাপা
ভালো মানুষের চেয়ে ভালো ওৎ পেতে বসে আছে
কারো সাথে কথাই বলে না । আমি কথা বলি খুব
পাহাড় বোঝাতে গিয়ে আশ্রয় বুঝিয়ে বসে থাকি

তথাপি মুখের মিল দেখে অনেকেই ধরে নেয়
টিকটিকি আমার ছেলে অথবা নিজের ছোট ভাই
কাচের ভেতরে থাকা যে কোনও পদার্থ স্বল্পাধিক
বড় মনে হতে পারে যদি তা ভিজিয়ে রাখা হয় ।

মরা কোলে ঘাটে গেলে মাংস ফুল জল মুদ্রা নীল
পাঁচ মাসে কে এসেছে অতিরিক্ত হাসি মাখা ঠোঁটে?
অসমর্থ পা দুটোকে তুমি ঝুলিয়ে রেখো না পুত্র
আরও সরু হয়ে যাবে, বন্ধুদের ঘরে বসতে বলো ।

আজকেও ছুটি নিয়ে বাড়ি থাকব তোমাদের সাথে ।

আরশোলা

ঘণ্টা নাড়ো জোরে জোরে ঘণ্টাটি বাজাও
আমি ক্ষুদে পোকা খেয়েছি ঘুমের বড়ি
পল্লীর প্রবেশমুখে আন্দাজে এসেই
গ্রামটিকে বন্ধুদের গুহা মনে হয়

অণ্বেষণ শব্দটিকে প্রাণপনে খুঁজি
প্রাপ্তিযোগ যুগে যুগে উচ্চাশায় ভোগে
অন্ধকার থেকে আমাকে উদ্ধার করো
উচ্চাশার মায়াজালে আমি চতুর্ভূজ

ধরাধামে এসে ঝামেলায় পড়ে গেছি
মালের গুদামে থাকি গুরটুর খাই
তেলের পিপের পাশে নিজের চেহারা
অনুমান করি মাত্র আনন্দে পুলকে

নিমেষে ঘণ্টার সঙ্গে বৃথা তর্কে মেতে
কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে মনুষ্য সমাজ
হায় রে নদীর গতি অন্যদিকে চোখ
ঘুমঘোরে হেঁটে যাওয়া মানুষকে আমি

সুরসুরি ছাড়া কিছু দিতেই পারিনি ।

গিরগিটি

ইচ্ছে ছিল ঘুরে ঘুরে দেখব যুগের হাল প্রত্যেকের খুঁটিনাটি দেখে
দোষ ও গুণের কথা সবিস্তারে লিখে যাব যাতে অনেকে অন্যের সাথে
কিছু মিল খুঁজে পায় । নিজে সে অভ্যাসমত লক্ষ্যের আওতায় পড়ে না
বহুরূপে সন্মুখে থেকেও নিজেই অদৃশ্য থেকে যায় । নিজেকে চেনার
অনেক উপায় আমি মনে মনে ঠিক করে অতঃপর পথে বেরিয়েছি
অন্তর্যামী গিরগিটি আমার মনের ভাব জানে বলে মনে হলো… তবু
তাকে আমি জিজ্ঞেস করিনি দ্রুত সমবেত সকলেই সহমর্মী কিনা
নৈতিক শিক্ষাকে তারা কতখানি গ্রহণ করেছে তাও শুধোইনি তাকে ।

আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি গিরগিটির বিজ্ঞান কেমন নির্ভুল হয়
সে উদ্বাস্তু কলোনীতে ভাষণ দেবার আগে দুদিন আছাড় খেয়েছিল
ফলে সেই ভাষণের প্রতিটি অক্ষর থেকে সেও আর আলাদা থাকেনি

অভিজ্ঞতা দোষে ক্রমে আমিও জনৈক সেজে যুগের মিছিলে মিশে যাই
গিরগিটির মতই শত্রুকে মিত্র বানিয়ে এগোই স্ট্রাগল করে করে …

এ্যানাফিলিস

সুকোমল ধ্বনি ওঠে পবনতরঙ্গ ভিজে যায়
এ্যানাফিলিস রোদ্দুরে লক্ষ করে নিজের ছায়াকে
এখন ঘুমন্ত কেউ পরিচয় না দিলেও তাঁর
তরল বিদ্যুৎপান নিতান্ত সহজ কাজ নয়
আয়ুষ্কাল বাজি রেখে তবু মাংসে লিপ্ত হতে হবে
রক্তের আগুন টানে লিপ্ত হতে হতে একদিন
সম্পর্ক নির্দিষ্ট হয়ে যায় । আয়োজনে ত্রুটি নেই
শুধু বাতাস বিরুদ্ধে গেলে সহজাত ভালোবাসাসহ
লিপ্ত হতে বেশ অসুবিধা । জ্বরের নিবিড় গন্ধ
অনেকের ভাল লাগে অনেকে ধ্বনিকে ভয় পায় ।
এ্যনাফিলিস কারুর দিকে না তাকিয়ে নিজেকেই
খুঁটিয়ে দেখার পর ভেতরে ভেতরে খুশী হয় ।

মথ

যা আছে খোলাই আছে আমি ডানা মুুড়তে পারি না
বিবেচনা না করেই দুঃসাহসে ঢুকি, প্রকৃতির
নির্বাচন বিষয়ক একটি সুবিধে শুধু পাই
যে কোনও রঙেই অবিকল মিশে থাকতে পারি

বুুড়োদের কাছে আরো বুড়ো হই, ছেলেদের কাছে
পুরো বাচ্চা বনে যাই । নিরপেক্ষ সহ্য করে বেশি
ঘাতকের ছুরি আর পুলিসের হুলিয়া এড়িয়ে
হস্টেলের ছাত্র সেজে থাকি প্রার্থনার গান গাই ।

মাঝে মাঝে চোখ বুজে দেখি ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যায়
ফিরে আসে মিনু, বেণীতে রিবন বাঁধা জলে ছায়া
আকাশে আগুন জ্বলে । ডিমের কুসুম কেউ রাগে
সারা মাঠে ছড়িয়ে দিয়েছে । আমি হন্যে হয়ে খুঁজি

খুঁজে খুঁজে ক্রুদ্ধ হই আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে ক্রোধ ফেটে পড়ে

কৃমি

সহজে বোঝার নয় এমনও দুর্বোধ্য কৃৃমি সহজেই বোঝে
শুধু কৃৃমির বিষয়ে সকলের দুর্বোধ্যতা কিছুতে বোঝে না
অন্ত্রের ভেতরে থাকা আমাদের যতখানি সোজা মনে হয়
অতটা সহজ নয় কেন না পরের অন্ত্র তাই অহর্নিশ

প্রতিটি মূহুর্তে তাকে সতর্ক থাকার কথা ভেবে যেতে হয়
এমন নিষ্ঠুর দিন যেন তার শত্রুদেরও কখনো না আসে
প্রতিটি প্রাণীর জমা সিংহভাগ পাপকীর্তি গ্রহণ করেও
মলমূত্র মেখে তাকে দুর্নাম কুড়িয়ে যেতে হয় আজীবন

কৃমিকে বোঝে না কেউ আস্ত পরজীবীরাই কিছুতে বোঝে না
জল মানে শামুকের চোখ শিকড়ে আসল শক্তি ঢালা আছে
তবুও পরের অন্ত্র তাই অহর্নিশ সারাক্ষণ ধরে তাকে
সন্ত্রস্থ থাকার কথা ভেবে যেতে হয় মিথ্যে দুর্নাম কুড়িয়ে ।

ছুঁচো

কেত্তন জমেনি দেখে ছুঁচোরাই খুব দুঃখ পেয়ে
সুরের বিষয়ে দ্রুত কথা বলতে বলতে ফিরে গেল
যে যার নিজের গর্তে… ফিরিস্তিতে কারো চক্ষু খোলা
কারো চোখ অর্ধেক মুদিত । আদতে গোবিন্দ সাক্ষী
যে এখন আটক কোথাও, যখন তখন মাঠে
হৈ চৈ লেগে থাকতো বলে এই মাঠ মাঠ নয়
সম্প্রতি ময়দান হয়েছে । উদ্যোগী ছুঁচোরা সব
টাকার পেছনে ছুটে স্বদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল
এই তত্ত্ব তথ্য দিয়ে কিছুতেই প্রমাণ হবে না
আবেগ প্রবল হলে দাঁত হয় নরুন সমান
সত্যবোধ সকলেই জানে, এখনও বিলম্ব কেন
গোবিন্দ নিজের হাতে শিখিয়েছে ওষ্ঠ ব্যবহার

কেত্তন জমেনি দেখে বিমর্ষ হবার কিছু নেই।

গুটিপোকা

নিজেই নিজের জালে জড়িয়ে পড়ার মত আর কোনও সৃষ্টিসুখ নেই
ইচ্ছা মেদ ভয় রূপ অসুখের নীল লালা সব থাকে জালের ভেতরে
শুধু স্পষ্টবক্তা বলে কিছুটা দুর্নাম তার আকাশে বাতাসে রটে যায়

বিষ সকলেরই আছে সে বিষ নিজের দিকে অথবা নিজের মত কারো
প্রতি ঢালা ক্ষতিকর, এই চিন্তা গুটিপোকা বহু কষ্টে আয়ত্ব করেছে
পরিচয় যদি তাকে অন্যদের চেয়ে আরো বেশি বড় করে তোলে

এত বড় যাতে তার নড়াচড়া হাসি আড্ডা সব কিছু ঢাকা পড়ে যায়
তাহলে তো পরিচয় না থাকাই ভালো, আকাশে নতুন পাতা ওড়ে
তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে দেশে বা বিদেশে যদি তুমুল আলোচনার নামে

বাণিজ্যে বসতি হয় তাহলেও গুটিপোকা বিন্দুমাত্র পরোয়া করে না
কোনও কোনও বৃত্তিবান অন্ত্যজ জ্ঞানের ঘোরে তার নিঙরানো শরীরকে
তন্তুজাল আখ্যা দিয়ে থাকে ।

ভ্রমর

ছাপোষা ভ্রমর আমি সেই কালোভ্রমর নই গো
কিশোর বয়সে শুধু কিছুকাল ইচ্ছে হয়েছিলো
ঈগলের জাল থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করে যাবো
ইচ্ছে না রোমাঞ্চ তাও ভালো করে বুঝতে পারিনি

ঈগল ক্ষমতাবতী পাখি ভূগোল ধরেছে ঠোঁটে
তবু আমি অন্ধকারে বহুদিন দেওয়াল লিখেছি
কি লিখেছি মনে নেই তবে জালের বিরুদ্ধে বেশ
সাড়া পরে গিয়েছিলো সেইবার । তারপর দেশে

অনাবৃষ্টি হলো খুব ঈগলের অঙ্গুলিহেলনে
একদিন শালিখেরা বোনটাকে তুলে নিয়ে গেল
ফুলের ভেতর থেকে । ভাইকে শাসিয়ে গেল…যদি

দাদার রাস্তায় যাও ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে ।
সেই থেকে আমি রোজ ফুলে ফুলে শিক্ষা নিতে আসি
যে কোনও বিষয়ে নিস্পৃহ থাকার সব শিক্ষা তাই
ফুলেদের কাছ থেকে শিখি ।

শামুক

গোপনে বিপ্লব করে, ঘুঁসির সিনেমা দেখে দেখে
দু’দুটো প্রজন্ম হেজে গেল । আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরি
থানার দেওয়ালটাকে একবার পাক মেরে দেখি
ফাটলের চারাগাছ কেউ উপড়ে ফেলেছে কি না ।

চারাগাছ ভালো আছে দেখে থানার দেওয়াল থেকে
ইচ্ছে করে পড়ে গিয়ে আরো বেশী শক্ত হতে চাই ।
দু’দুটো প্রজন্ম গেল আর নেতৃত্ত্ব অংশত শেষ
পুরানো চালের ভাত কত বেশী বাড়তে পারে ভাবি

শেষে বাচ্চার পেচ্ছাপ মাখা বিছানায় শুয়ে থাকি
ঘাঁটি এলাকার কথা যারা ভাবতো তারা এখন
ধাপার মাঠের নিচে আছে । সব ঘাট চষে ফেলি
শ্যাওলা ডিঙিয়ে যাই, শুড় বার করে দেখি, তবু

প্রাক্তন নকশাল বলে কেউ আর সমীহ করে না ।

লেখকবৃত্তান্তঃ
ফল্গু বসুু । কবি ।
জন্ম ১৬ মে ১৯৫৬ । শিক্ষাঃ শান্তিপুর ও রাণাঘাট কলেজ ।
কবিতার বইঃ
১. অবাধ্যের পুঁথি                ২. অক্ষরবল্কল
৩. ভূভারত সুধাময়            ৪. মৃদুচিহ্ন
৫. স্বভাববর্ণ                     ৬. হাঁঁটছে হাতের লেখা
৭. করতলে ভাগ্যরেখা নেই

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

শেয়ার