খুনিয়ারা, নিঃক্ষত্রিয় ও অন্যান্য || আরশাদ সিদ্দিকীর কবিতা

0


নিঃক্ষত্রিয়

সবাই নয়। হয়ত কেউ কেউ
মৃত্যুর মত কিংবা মৃত্যুর কাছাকাছি কিংবা মৃত্যুর চেয়ে ভয়ঙ্কর। অপমানে-অপমানে অবগুণ্ঠিত হয়েছি। ফের জেগেছি। জলে-ডাঙ্গায়
কেউ কেউ নয়। হয়ত একা
সবাই নয়। হয়ত কেউ কেউ
অবুঝ পাতার মত গুটায়ে নিয়েছি। সিঁটায়ে গিয়েছি। লজ্জায়-লজ্জায় নিজের ভেতরে নিজে। নিজেকে ফের মেলেছি। লজ্জাবতী লতা
কেউ কেউ নয়। হয়ত একা
সবাই নয়। হয়ত কেউ কেউ
নিজেকে বিকাতে বাজারে তুলেছি। সবজীর দরে। শেকড়ের মান ভুলে। সবুজের চেয়ে সামান্য দামে। বিকায়েছি নিজেকে। হাটে-আড়তে-ফুটপাথে
কেউ কেউ নয়। হয়ত একা
সবাই নয়। হয়ত কেউ কেউ
বেভুল স্রোতের টানে ভেসে গেছি। ক্ষয়ে ক্ষয়ে ফুরায়েছি। বুকে ভর দিয়ে সরীসৃপের মত আগায়েছি। শেষ রেখা পারিনি ছুঁতে
কেউ কেউ নয়। হয়ত একা

 

 

জীবাত্মা

যাকে ঠিক হৃদয় নয়। ভেবে বসেছিলাম আত্মা। সেই আত্মা কখন হৃদয়ের খাঁচা ছেড়ে উড়ে গেল।
এখন আমি শুন্য খাঁচার দিকে তাকায়ে থাকি। সেখানে আর কোন স্পন্দন পাই না।
এখন আমার দৃষ্টি শ্মশানের দিকে তাকায়ে থাকে। আমি শুধু বিভ্রমের মত কিছু বিস্ফোরণ দেখি।
কেউ কেউ আমার দিকে অজস্র অভিযোগের বিষ মাখানো শর-বল্লম-বর্শা ছুঁড়ে দেয়। আমি রক্তাত হই।
খিদে পেলে শ্মশানরক্ষী একথালা ভাত এনে সানকীতে তুলে দেয় নিতান্ত অনিচ্ছায়।
দলা দলা ভাতগুলি। ধীরে ধীরে গলা জড়িয়ে নামে। আমার ভীষন তেষ্টা পায়। ভীষণ তেষ্টা পায়।
শ্মশানরক্ষী আড় চোখে আমাকে দেখে। ক্ষত বিক্ষত শরীর থেকে রক্ত ঝরতে থাকে। ঝরতে থাকে।
ফোটা ফোটা রক্ত কণিকা ক্ষতবিক্ষত শরীরে জমাট বাঁধে। আমার তাকে দেখা শেষ হয় না।
নিতান্তই আমি শরবিদ্ধ হতে চেয়েছি। জল তেষ্টায় ছাতি ফাটা কষ্ট চেয়েছি। শরীরে অজস্র ক্ষত চেয়েছি।
এই যে খাঁচাটুকু। এই যে শরীর। এই যে শ্মশানরক্ষী। এই যে সানকীতে একদলা বরাদ্দ ভাত।
এই যে ক্ষতবিক্ষত শরীর। এই যে শ্মশানের দোরগোড়ায় এতটুকু আশ্রয়। আমিও ওইটুকুই চেয়েছি।
কেন যে হৃদয় এবং আত্মার খেলায় একদিন খানিকটা বেসামাল হয়েছিলাম। ভাবলেই ধন্ধ জাগে।
অনন্তকাল ক্ষতবিক্ষত বেঁচে থাকার। সুখে কাতর একটা গহ্বর হয়ত আছে। যাকে আমি খুঁজছি।

 

 

খুনিয়ারা

সবকিছু অন্যরকম
কারুকর্ম্মের মত
তাদের কাছে যারা নিভৃতে খুন করে

প্রকাশ্যে টেনে ছিঁড়ে নেয়
শ্বাসনালী, মাথার খুলী ভাঙ্গে
বাদামের খোসা ভাঙ্গার সহজ দক্ষতায়

বলতে পারে, ও আর এমনকি

সবই ইতিহাস
অতীতের কাসুন্দি

সবকিছু অন্যরকম
তাদের সুবিমল
আঙ্গুলের ডগায়

হার মেনে হুমড়ি খায়
গোক্ষুরের বিষফনা

কত জাদু বিস্ময়
লুকানো থাকে
কত ভেলকি তারা
জমিয়ে রাখে সঙ্গোপন মুদ্রায়

খুনের খেলা
গোপন ইতিহাস হয়ে যায়

বিচারক তাজ্জব, কে দেবে রায়

জুয়ার শেষ বাজি
তারাই অনায়াসে জিতে যায়

 

 

পর্য্যুদাস

স্বাধীনতা বলতে ওরা বুঝত
গুহার ভেতরে অন্ধকার
মুক্তি বলতে ওরা বুঝত
সনদে স্বাক্ষরিত দলিল
সত্য বলতে ওরা বুঝত
অন্ধত্বের কাছে নতজানু থাকা
বিপ্লব বলতে ওরা বুঝত
মুখস্ত বোলীর ঠিকাদারী

আগুনমুখার জলন্ত মোহনা
হাতের মুঠোয় নিয়ে আমি
ফিরে এসেছিলাম আমার
উদ্বাস্ত পিতার কাছে

আমার সকল পরাজয়
জানতেন সেই অসহায় মানুষটা

 

 

অর্ব্বাচীন

অজস্র কীটের ভিড়ে ও দংশনে সেও কি হয়ে ওঠেছিল বিষের ভয়াবহ কুণ্ডলী
জীবনের পরতে পরতে পরাজয় উৎযাপন শেষে ফিরত জঘন্য আঁস্তাকুড়ের ঠিকানায়
চারপাশে তার হাজার হাজার জীবন্ত মৃত্যুকূপ খুঁড়ে রেখেছিল যে প্রিয় স্বজনেরা
অনায়াসে তারা বলতে পারত, এই তো ভালবাসা, স্নেহ-পর্ব্ব, প্রণয় উপাখ্যান
ভীষণ উল্লাসে তাদের দাঁতগুলো থেকে খসে পড়ত অভিমানের কুৎসিত লালা
তাদের সাজানো গেরস্থালিতে বিষবৃক্ষ পুষত খেয়াল খুশিমত
ওইসব কুৎসিত সাজে ওরা ভুলে যেতে থাকত একটা কীটের জীবন
যদিও সেখানে মৃদুলয়ে বাজাত প্রেত ও প্রেতাত্মার প্রিয় যন্ত্রের সুর
ওদের একটাই মানবজন্ম সার্থক করার সহস্র বাসনা মৃতের খুলীর ভেতরে রাখত জমিয়ে
অদ্ভুত বিপন্ন পৃথিবীর গোলকধাঁধায় সেলাই করত অসম্মানের টুকরা রুমাল
এইসব কীটেদের ভিড়ে সেও একদিন হয়ে ওঠেছিল নিতান্তই বিষের ভয়াবহ কুণ্ডলী

 

 

আরশাদ সিদ্দিকী
সম্পন্ন করে চলছেন এমন এক জীবন-পরিক্রমা, যেখানে আলো আছে সত্য; তবে বিষ-কণ্টকই অশেষ সেইখানে! ভারতভাগের আঘাতে বিপর্য্যস্ত হয়েছে তাঁর পিতৃপুরুষের জীবনের ভেতর-বাহির! সেই আঘাতের অপরিমেয় দংশন তাঁকেও সইতে হয়েছে! পেতে হয়েছে বিষ-জরজর শৈশব ও কৈশোর! এমনকী এই যে এখন জীবনের মধ্যাহ্নে তিনি— এখনও প্রতি কদমে তাঁর জন্য বরাদ্দ হয়ে আছে কেবলই কাঁটার মুকুট! প্রচল-প্রথা-প্রতিযোগিতার প্রতি তুমুল অনীহ তিনি! এইসবকিছু তাঁকে ক্রমে নির্জন থেকে নির্জনতম করে তুলেছে ঠিকই; তবে সমষ্টির কল্যাণ বিমুখ করে তুলতে পারেনি কখনো! সমাজ-বিপ্লবের স্বপ্নতাড়িত আরশাদ সিদ্দিকী— প্রথম তারুণ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছেন সক্রিয় রাজনীতিতে। দেখেছেন সেই বিশ্বেও কত রকমের ক্রুর নির্ম্মমতা বিরাজ করে! এবং সেই ক্রূরতা কত রকমে তাঁকে আক্রান্ত করার শক্তি রাখে!

অলঙ্করণ: হিম ঋতব্রত
প্রচ্ছদ: মেহেরাজ হাসান শিশির

{খুনিয়ারা, নিঃক্ষত্রিয় ও অন্যান্য || আরশাদ সিদ্দিকীর কবিতা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভব) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার