উইলিস বার্নস্টোন-এর সাথে হোর্হে লুইস বোর্হেসের সাক্ষাৎকার ৤ অনুবাদ : জি এইচ হাবীব

0

বার্নস্টোন : বোর্হেস, যদিও আপনি অন্ধপ্রায়, তারপরেও, যে ঘরে বা বাড়িতে আপনি থাকেন সেটার গুণাগুণ সম্পর্কে মন্তব্য করেন আপনি। আপনার ক্ষীণদৃষ্টি দিয়ে কি করে দেখেন আপনি, আর আজকে এই হলঘরে কেমন লাগছে আপনার?

বোর্হেস : বন্ধুত্ব অনুভব করছি আমি। অনুভব করছি খুবই নিখাদ এক সাদর অভ্যর্থনা। লোকজন পছন্দ করছে আমাকে, ভালবাসছে, বুঝতে পারছি। পারিপার্শ্বিকতা আমি অনুভব করতে পারছি না কিন্তু একেবারে সারবস্তুটিকে অনুভব করতে পারছি। জানি না কি করে করি কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমি ঠিকই বলছি।

বার্নস্টোন : প্রায়ই ভালবাসার সঙ্গে বন্ধুত্বের তুলনা করেন আপনি। দু’টোর মধ্যে পার্থক্য কি, অনুগ্রহ করে বলবেন?

বোর্হেস : ভালবাসা বড্ড অদ্ভুত এক জিনিস, আশংকায় ভরা, আশায় ভরা আর ওগুলো হয়ত সুখের প্রত্যাশি। কিন্তু বন্ধুত্বের মধ্যে পথভ্রষ্ট করার কিছু নেই, কোনও আশা নেই, কেবলই এগিয়ে চলে ব্যাপারটা। এখানে ফ্রিকোয়েন্সির কোনও দরকার নেই, কোনও স্মৃতি-চিহ্নের দরকার পড়ে না আমাদের। কিন্তু আমরা জানি যদি আমরা বন্ধু হই আর অন্য লোকটি যদি বন্ধু হয়, সেক্ষেত্রে বন্ধুত্ব সম্ভবত ভালবাসার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত। কিংবা হয়ত ভালবাসার আসল কাজ, আসল কর্তব্য হচ্ছে বন্ধুত্বে পরিণত হওয়া। যদি তা না হয়, ব্যাপারটা আমাদের মাঝপথে থামিয়ে দেয়। কিন্তু দু’জনেরই উচিত একে অন্যকে প্রচণ্ডভাবে ভালবাসা।

বার্নস্টোন : অভিজ্ঞতা আর কবিতা সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

বোর্হেস : আমার মনে হয় একজন কবিকে (মাঝে মাঝে নিজেকে তাই ভাবি আমি) সব কিছুই দেয়া হয়েছে সেগুলোকে কবিতায় পরিণত করার জন্যে। কাজেই দুঃখ আসলে দুঃখ নয়। এমনকি ছুরি যেমন হতে পারে একটা হাতিয়ার, তেমনি দুঃখও আমাদেরকে দেয়া একটা হাতিয়ার। সব অভিজ্ঞতাই কবিতায় পরিণত হওয়া উচিত, আর আমরা যদি সত্যিই কবি হতাম (আমি আসলে কবি নই। আমি ভান করি আমি কবি), কিন্তু সত্যিই যদি আমি কবি হতাম, তাহলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকেই সুন্দর বলে ভাবতাম, যদিও তখন হয়ত সেটাকে সেরকম মনে হচ্ছে না। কিন্তু স্মৃতি শেষপর্যন্ত সবকিছুকেই সৌন্দর্যে পরিণত করে। আমাদের কাজ, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে দুঃখের আবেগ, অনুস্মৃতি, এমনকি স্মৃতিকেও সৌন্দর্যে পরিণত করা। সেটাই আমাদের কাজ। আর একাজের বড় সুবিধে হচ্ছে, কাজটা শেষ হয় না কখনো। সবসময়ই আমরা কাজটা করে যেতে থাকি।

বার্নস্টোন : ‘ড্রিমটাইগার্স’-এর ‘দ্য প্যারাবল অভ দ্য প্রিন্স’-এ-

বোর্হেস : এটার কথা মনে করতে পারলে ভাল হত।

বার্নস্টোন : স্মৃতি আসলে ভোলার জন্যেই।

বোর্হেস : পুরোপুরি ভুলে গেছি আমি এটার কথা।

বার্নস্টোন : কবির উত্তরসূরিরা তখনও মহাবিশ্বকে ধারণ করে থাকা শব্দটা খুঁজছে এই অবস্থায় শেষ হয়েছে প্যারাবলটা। আপনি কি কোনও শব্দ, কোনও মানসিক অবস্থা, কোনও অনুভূতি, কোনও বোঝাপড়ার খোঁজ করছেন? মারা যাওয়ার আগে কি খুঁজছেন আপনি—অবশ্য আসলেই যদি ব্যাপারটা এমন হয় যে আপনি কিছু খুঁজছেন?

বোর্হেস : আমার মনে হয়, সঠিক শব্দটা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে সেটা না খোঁজা। বর্তমান মুহূর্তে বাঁচা উচিত মানুষের। এরপরে হয়ত শব্দটা দেয়া হবে আমাদের। হয়ত হবে না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর ভুল-ভালের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে আমাদের। ভুল করতে হবে, আবার শোধরাতেও হবে সেগুলোকে। আর সেটা অবশ্য সারাজীবনের কাজ।

বার্নস্টোন : ব্যক্তিগত ঈশ্বরে আপনার বিশ্বাস নেই, কিন্তু তারপরেও অন্য কোনও প্রতিক বা উপমার অভাবে কবিতায় আপনি প্রায়ই ‘ঈশ্বর’ কথাটা ব্যবহার করেন। আপনি কি এমন কিছুতে বিশ্বাসি বা এমন কিছু খোঁজেন যা কার্যকারণ সম্বন্ধকে এড়িয়ে যায়। আপনি কি এমন কিছুতে বিশ্বাস করেন যা অতিপ্রাকৃত?

বোর্হেস : অবশ্যই। আমি বিশ্বের রহস্যে বিশ্বাসি। লোকে যখন ‘ঈশ্বর’ শব্দটা ব্যবহার করে, জর্জ বার্নার্ড শ’র কথা মনে পড়ে যায় আমার। যদ্দূর খেয়াল করতে পারছি, কথাটা এই : ‘ঈশ্বর এখনও নির্মিয়মাণ’। আর আমরাই হলাম নির্মাতা। আমরা জন্ম দিচ্ছি ঈশ্বরকে। যতবার সৌন্দর্য অর্জন করি ততবারই ঈশ্বরকে সৃষ্টি করি আমরা। পুরস্কার আর শাস্তির ব্যাপারটা হচ্ছে হুমকি আর ঘুষ। ওগুলোর দরকার নেই আমার। ব্যক্তিগত ঈশ্বরে আমি বিশ্বাসি নই। কিন্তু একজন ব্যক্তিগত ঈশ্বর কেন এমন এক ঈশ্বরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হবেন— আজ আমি একটা প্যান্থেসটিক মুডে আছি — যিনি আসলে আমরা সবাই? এক অর্থে ঈশ্বর আমরা সবাই। আর আমি মনে করি আমি একজন নীতিবান লোক। কিংবা বলা যায়, আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি নীতিবান লোক হতে। আমার ধারণা আমি সঠিকভাবে কাজ করেছি, আর সেটাও যথেষ্ট হওয়া উচিত। ব্যক্তিগত কোনও ঈশ্বরে আমি বিশ্বাস করতে পারি না। আর দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমার পূর্ব-পুরুষরা ছিলেন মেথেডিস্ট পাদ্রি। বাইবেল আমার দাদির মুখস্ত ছিল; প্রত্যেকটা চ্যাপ্টার আর শ্লোক জানতেন তিনি। কিন্তু সেই সঙ্গে ডিকেন্সও তাঁর মুখস্থ ছিল। আর সেটা ঐ বাইবেল মুখস্থ থাকার মতোই ভাল ব্যাপার।

বার্নস্টোন : আপনি আমার পরের প্রশ্নটা অনুমান করতে পেরেছেন। ডিকেন্স সম্পর্কে কি বলতে চাইছেন আপনি?

বোর্হেস : ডিকেন্স সম্পর্কে কেউ যখন চিন্তা করেন, তিনি আসলে একটা জটলার কথা চিন্তা করেন। আমি বলছি বটে ‘ডিকেন্স’ কিন্তু ভাবছি আমি মি. পিক্উইকের কথা, আর্টফুল ডজার-এর কথা, নিকোলাস নিকলবি-এর কথা, মার্টিন চাজল উইটের কথা, আর ‘মার্টিন চাজল উইট’-এর খুনটার কথা। ডিকেন্সের কথা ভাবি আর তারপরই কিন্তু সত্যিই মানুষের একটা জটলার কথা ভাবতে থাকি আমি। আর স্বয়ং ডিকেন্স-এর কথা বলতে গেলে বলতে হয়, তিনি ঠিক তাঁর স্বপ্নের মতো সুন্দর নন। কথাটা অবশ্য ডিকেন্সের প্রশংসা করেই বলা হল। ঠিক একইভাবে, যখন বলি ‘শেক্সপিয়র’, তখন আমি মানুষ উইলিয়াম শেক্সপিয়র এর কথা ভাবি না। ভাবি ম্যাকবেথের কথা, উইয়্যরড সিস্টার্স-এর কথা, হ্যামলেটের কথা আর সনেটগুলোর নেপথ্যের রহস্যময় লোকটার কথা। ডিকেন্সের বেলাতেও, বেশকিছু লোকের কথা ভাবি আমি। আর অগুনতি সেই লোক, যারা ডিকেন্সের স্বপ্ন ছিল কেবল, প্রচুর সুখ দিয়েছে আমাকে। বারবার পড়ি আমি বইগুলো।

বার্নস্টোন : ব্যক্তিগত ঈশ্বরের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আপনি কি নস্টিক (gnostic)?

বোর্হেস : আমি অ্যাগনস্টিক।

বার্নস্টোন : না, নস্টিক।

বোর্হেস : হ্যাঁ, তা হতে পারে। আজ নস্টিক, আবার কাল অ্যাগনস্টিক হলে ক্ষতি কি। দু’টো একই জিনিস।

বার্নস্টোন : আর আপনার এথিক্স-এর ভিত্তি?

বোর্হেস : আমার ধারণা, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের বাছাই করতে হয়। হয় একভাবে নয় অন্যভাবে কাজ করতে হয় আমাদের। ড. জনসন যেমন বলেছেন, সারাক্ষণই আমরা নীতিবাদি, জ্যোতির্বিদ বা উদ্ভিদবিদ নই।

বার্নস্টোন : এত লোকজন থাকতে আপনি বোর্হেস হলেন কি করে? জীবন যে আপনাকে বাছাই করল তাতে কি আপনি অবাক হননি? ব্যক্তিক সচেতনতার ব্যাপারটা আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

বোর্হেস : বোর্হেস হওয়ার জন্যে আমি বিস্মিত ও লজ্জিত। অন্য কেউ হওয়ার জন্যে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সফল হইনি। বোর্হেস হওয়া মোটেই পছন্দ করি না আমি। আপনাদের যে কোনও একজন হতে পারতাম যদি!

বার্নস্টোন : আপনার লেখার কথায় আসি। হাতে না লিখে তার বদলে কবিতাগুলো ডিক্টেট করায় আপনার লেখা কবিতাগুলো কি বদলে গেছে?

বোর্হেস : আমার মনে হয়, বদলে গিয়ে কবিতাগুলো আরো ভাল হয়েছে। কারণ, ওগুলো এখন আগের চেয়ে ছোট।

বার্নস্টোন : যাদের আপনি কবিতাগুলো ডিক্টেট করেছেন— আপনার মা, আনালিসে ভন দার লিপেন, মারিয়া কোদামা— যিনি আজ এখানে আছেন—

বোর্হেস : তারা ওগুলোর ব্যাপারে কোনও আপত্তি দেখিয়েছেন কি না? বহুবার। কিন্তু আমি বড্ড একগুঁয়ে। আমি চালিয়ে যাই।

বার্নস্টোন : তাঁদের আপত্তি আর মতামত কি কবিতাগুলোর সত্যিকারের লেখাকে প্রভাবিত করেছে?

বোর্হেস : হ্যাঁ, তা করেছে, তারা আমাকে সাহায্য করছেন, সারাক্ষণ। মনে আছে, ‘দ্য ইন্ট্রুডার’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম। দুই গুণ্ডা দুই ভাই— এক মহিলাকে খুন করে কারণ তারা একে অন্যকে ঈর্ষা করে। মহিলার হাত থেকে নিস্তার পাবার একটা উপায় ছিল তাকে ছুরি মারা। শেষ বাক্যে চলে এলাম আমি। আমার মা লিখে নিচ্ছিলেন গল্পটা। গোটা ব্যাপারটাই অপছন্দ করলেন তিনি। গুণ্ডাপাণ্ডা আর ছুরিটুরি তাকে অসুস্থ আর বিরক্ত করে ফেলেছিল। তখনই সেই মুহূর্তে এলাম যখন বড় ভাই ছোট ভাইকে বলবে সে সেদিন সকালে মহিলাকে ছুরি মেরেছে। কিংবা গলাটিপে মেরেছে, আমি জানি না-অত রক্তাক্ত খুঁটিনাটিতে যাবার দরকার কি? তাকে কথাটা বলতে হবে আর আমাকে কথাগুলো লিখতে হবে। তখন আমি মাকে বললাম, ‘লোকটা কথাটা বলবে কি করে?’ মা বললেন, ‘ভাবতে দে আমাকে’ এটা সকালের ঘটনা। তারপর, হঠাৎ একেবারে ভিন্ন গলায় মা বলে উঠলেন, ‘আমি জানি লোকটা কি বলেছিল।’ আমি বললাম, ‘বেশ তো, লিখে ফেলো।’ মা লিখে ফেললেন আর আমি তাঁকে পড়ে শোনাতে বললাম। মা পড়ে শোনালেন, কথাগুলো ছিল, ‘ভাই, কাজ করার জন্যে আজ সকালে ওকে মেরে ফেলেছি আমি।’ তো, মা আমার হয়ে ঠিক কথাগুলো লিখে দিলেন। শেষ হয়ে গেল গল্পটা। একটা কি দু’টো বাক্য যোগ করছিলাম আমি। মা তখন আমাকে এসব খুন-খারাবির গল্প লিখতে বারণ করলেন। ক্লান্তি আর বিরক্তি এসে গিয়েছিল তাঁর এসবের ওপর। কিন্তু তিনি আমাকে কথাগুলো জুগিয়ে দিয়েছিলেন, আর সে মুহূর্তে এক অর্থে তিনি আমার গল্পেরই এক চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন, আর তিনি এ ব্যাপারটায় বিশ্বাস করতেন। তিনি বললেন, ‘আমি জানি লোকটা কি বলেছিল’, যেন ঘটনাটা আসলেই ঘটেছিল। ‘দ্য ইন্ট্রুডার’ গল্পটার মূল কথাগুলো তিনি দিয়েছিলেন আমাকে, ওটাই সম্ভবত আমার সেরা গল্প বা হয়ত ঐ একটাই লিখেছি আমি এ পর্যন্ত।

বার্নস্টোন : যৌবনে আপনি দক্ষিণ আমেরিকার বর্ণসংকর রাখালদের (gaucho) সঙ্গে উত্তরে গিয়েছিলেন। সে অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলবেন? আপনার আর আপনার লেখার ওপর সেটা কি রকম ছাপ ফেলেছিল?

বোর্হেস : ১৯৩৪-এ ব্রাজিল আর উরুগুয়ের সীমান্ত অঞ্চল ভ্রমণ করি আমি। আর সেখানেই আমি আর্জেন্টিনার অতীত পেয়ে যাই। পেয়ে যাই সমভূমি গাউচৌ-সে সব জিনিস যা আমার দেশে আর পাওয়া যাবে না। ওগুলো আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল, কিংবা অন্তত ওখানে অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। দশ দিনের মতো ছিলাম আমি ওখানে। একঘেয়েই লাগছিল একরকম। তবে একটা লোককে খুন হতে দেখেছিলাম, আগে কখনো এ ধরনের ঘটনা দেখিনি আমি। লোকটা ছিল উরুগুয়ের এক বুড়ো গবাদি পশু ব্যবসায়ি। এক নিগ্রো খুন করে তাকে। রিভলবার দিয়ে দু’বার গুলি করে সে। লোকটা মারা যায়। আমি ভাবলাম, কি দুঃখজনক। তারপর আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না আমি। কিন্তু উরুগুয়ে আর ব্রাজিল সীমান্তের সান্তা আনা দো লিভরামেন্তো-তে সেই দিন দশেক কাটিয়ে আসার বেশ কয়েক বছর পর জায়গাটার কথা মনে পড়ল আমার, সেই সঙ্গে মনে হল, ঘটনাটা। আমি ভুলতে পারছি না এক মুহূর্তের জন্যেও। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। মোটামুটি সারাবিশ্বই ঘুরেছি আমি। দেখেছি বড় বড় শহর। সম্ভবত দেখেছি রাজধানি শহর নিউইয়র্ক, আরো দেখেছি লন্ডন, আর রোম আর প্যারিস। কিন্তু তারপরেও কেন জানি না আমার মন ব্রাজিল সীমান্তের সেই নোংরা ছোট্ট শহরটায় ছুটে যায়, আর যখন আমি লিখি, মনে হয়, শহরটা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। তারপরেও সেই সময় কিন্তু ব্যাপারটাকে খুব একটা ইন্টারেস্টিং বলে মনে হয়নি। পুরো ব্যাপারটা আসলে ঘটেছে পরে, স্মৃতিতে।

বার্নস্টোন : ছেলেবেলায় যখন পড়তেন, তরুণ হিসেবে—

বোর্হেস : সারাক্ষণই পড়েছি আমি।

বার্নস্টোন : কি কি পড়েছেন প্রথমে?

বোর্হেস : সম্ভবত প্রথম পড়ি আমি গ্রিম ভাইদের রূপকথা, চেস্টারটনের ভাষায় যেটা জার্মানির সেরা বই। আর তারপর পড়েছি ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ আর ‘থ্রু লুকিং গ্লাস’। সেই থেকে বই পড়ে চলেছি আমি, সেই ১৯০৬ কি ১৯০৫ থেকে। পড়েছি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার সায়েন্স ফিকশন, ওয়েলস-এর বোনা সেই দুঃস্বপ্নগুলো। পড়েছি ‘দ্য টাইম মেশিন’, ‘দ্য ফার্স্ট ম্যান ইন দ্য মুন’, ‘দ্য আইল্যান্ড অভ ডা. মরো’, ‘দি ইনভিজিবল ম্যান’, ‘দ্য ফুড অব দ্য গডস’, ‘দ্য ওয়ার অভ দ্য ওয়ার্ল্ডস’। আর আমি সেই অন্তহীন বইটাও আবিষ্কার করি, অনেক দিক দিয়েই বইটা অন্তহীন। কারণ, এটা এমন একটা বই যেটাকে বড় হতেই হত, নামটার মর্যাদা রাখার জন্যে। গ্যালান্ড-এর ফরাসি সংস্করণের একটা ইংরেজি অনুবাদে। প্রথম ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ পড়ি আমি। তারপরে এডওয়ার্ড উইলিয়াম লেন-এর অনুবাদ, ক্যাপ্টেন বাটনের অনুবাদ আর জার্মান ভাষায় লিটম্যানের অনুবাদের খোঁজ পাই। আর দু’বছর আগে পড়ি মেক্সিকোর এ্যাগুইলার থেকে প্রকাশিত ইহুদি-আন্দালুসিয় লেখক রাফায়েল কানাসিনোস আসেনস-এর করা একটা খুবই চমৎকার অনুবাদ। পেয়েছিলাম একটা উপন্যাস, কিন্তু প্রথমে সেটায় দাঁত ফোটাতে পারিনি বললেই চলে, তার কারণ ভাষাটা ছিল একেবারে অন্যরকম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি করে যেন ঢুকে গেলাম সেটার ভেতর, তারপর চালিয়ে গেলাম পড়া। বইটা অবশ্যই সারভান্তেস-এর ‘দন কিহোতে’। প্রথমবারের মতো পড়লাম বইটা, আর তারপর থেকে ওটা পড়েই চলেছি। ওয়েলস-ও পড়ে যাচ্ছি আমি। পড়ছি লুইস ক্যারোল-এর ওই বই দু’টো। তো এই হচ্ছে আমার প্রথম দিককার পড়াশোনা। তবে আরো দু’টো বই পেয়েছিলাম। ওগুলোর দিকে এখন আর তাকাই না বললেই চলে কারণ একই লেখকের অন্য বইগুলো পড়ছি আমি। রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর ‘জাস্ট সো স্টোরিজ’ আর দু’টো জাঙ্গল জাঙ্গল বুকস’-এর কথা বলছি। আমি কিপলিং ভালবাসি। আরেকটা বই পড়েছি সে সময় যেটা মোটামুটি অপরিচিত। এটার পরিচিতি হওয়া উচিত। একটা বললেও বই আসলে দু’টো, মার্ক টোয়েন-এর ‘রাফিং ইট’ আর ‘দ্য ফার্স্টডেজ ইন ক্যালিফোর্নিয়া’। তারপর আমি চলে যাই ‘হাকল্বেরি ফিন’-এ। তারপর পো’র গল্পে আর সেই সঙ্গে জুলভার্ন-এ।

বার্নস্টোন : মিল্টনের ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ কখন পড়েছেন?

বোর্হেস : ১৯১৪-তে আমার বাবা-মা যান ইউরোপে। তাঁরা এতটাই অজ্ঞ ছিলেন যে, জানতেনই না যে আরেকটা যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে সে মুহূর্তে। সেই সময় মিল্টন সাহিত্যসমগ্র’র একটা লাইব্রেরি সংস্করণ পাই, এভ্রিম্যানের। আর প্যারিস দেখার বদলে— পনেরোর মতো বয়স তো হবেই তখন আমার— আমি থেকে গেলাম হোটেলে, আর পড়ে ফেললাম প্যারাডাইজ লস্ট, স্যামসন অ্যাগোনিস্টিজ আর সনেটগুলো। আর সে জন্যে আমার কোনও আফসোস নেই।

বার্নস্টোন : প্রাচীন ইংরেজি কবিতাগুলো প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করার পর আপনার নিজের লেখালেখি আর আপনার ওপর সেগুলো কি রকম প্রভাব ফেলেছিল?

বোর্হেস : প্রাচীন ইংরেজি কবিতা যখন আবিষ্কার করি, সেটা একটা নাটকিয় মুহূর্ত হতে পারত। কিন্তু আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি ব্যাপারটাকে নাটকিয় না করতে। সেটা ১৯৫৫ সাল, পড়াশোনা করার দৃষ্টিশক্তি হারাই আমি সে বছর। আর আমি যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলাম, আমি আমার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলাম, কখন আমরা বিষয়টা সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে কিছু জানার চেষ্টা করব? বাড়িতে সুইট-এর অ্যাংলো-স্যাক্সন রিডার আর অ্যাংলো-স্যাক্সন ‘ক্রনিকল’-এর দু’টো কপি ছিল আমার। আর তখন আমরা শুরু করলাম পড়তে আর প্রেমে পড়ে গেলাম দু’টো শব্দের। আর সেই শব্দ দু’টো হচ্ছে লন্ডন আর রোমের স্যাক্সন নাম। লন্ডন হচ্ছে Lundenbugh, Burgh, Borough or Burg-এর মতোই, এডিনবার্গ, হামবুর্গ, গ্রাটেনবার্গ ইত্যাদির মধ্যে যে Burgos শব্দটা পাচ্ছেন সেটা। আর রোমের নামটাও সত্যি খুব সুন্দর কারণ, এর অর্ধেক ল্যাটিন, বাকিটা স্যাক্সন। রোম-কে অ্যাংলো-স্যাক্সনরা বলতো Romaburgh। আমরা এই শব্দ দু’টোর প্রেমে পড়ে গেলাম, আর অ্যাংলো-স্যাক্সন ‘ক্রনিকল’-এ পেলাম একটা সুন্দর বাক্য। বাক্যটা হচ্ছে : জুলিয়াস সিজার বা জুলিয়াস দ্য সিজারই হচ্ছেন প্রথম রোমান যিনি ব্রিটেনকে খুঁজে বের করেন। কিন্তু প্রাচীন ইংরেজিতে বাক্যটা আরো সুন্দর শোনায় : Gaius Iulius se casere aerest Romana Brytenland gesohte। আর তারপর আমরা ‘ইউলিয়াস সি সিজার…’ বলে চেঁচাতে চেঁচাতে বুয়েনস আয়ার্স-এর পেরু নামের এক রাস্তা ধরে ছুটতে লাগলাম। লোকজন সব চেয়ে রইল আমাদের দিকে। আমরা গা করলাম না। সৌন্দর্য পেয়ে গেছি আমরা তখন। তো আমি পড়া চালিয়ে গেলাম আর এখন আমি ঢুকছি ‘ওল্ড নর্স’-এ। এটাই ঘটে সবসময়। শুরু করবেন আপনি ওল্ড ইংলিশ দিয়ে আর, যদি ভাগ্যবান হন, পেয়ে যাবেন ওল্ড নর্স।

বার্নস্টোন : খ্যাতি নিয়ে দু’একটা প্রশ্ন। আপনি এখন আপনার খ্যাতিকে একটা সম্ভাব্য ভুল হিসেবে মনে করেন।

বোর্হেস : ব্যাপারটা বিলকুল তাই। তবে এটা একটা মহৎ ভুল।

বার্নস্টোন : তরুণ বয়সে বুয়েনস আয়ার্স-এর প্রাদেশিক লাইব্রেরিতে যখন কাজ করতেন, প্রকাশনা আর খ্যাতি নিয়ে কি ভাবতেন, আর পরবর্তী বছরগুলোতে আপনার চিন্তাভাবনা কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে?

বোর্হেস : খ্যাতির কথা কখনো ভাবিনি আমি। আমার যৌবনে খ্যাতির ব্যাপারটা অপরিচিত ছিল বুয়েনস আয়ার্সে। যেমন ধরুন, লিওপোল্ডো লাগোনেসকে যথার্থ কারণেই আর্জেন্টাইন প্রজাতন্ত্রের প্রথম কবি হিসেবে ভাবা যেতে পারে। আমার ধারণা, তার বইগুলো পাঁচশো কপির মতো চলে, এবং তিনি বিক্রির কথা ভাবেননি কখনো। প্রকাশনা লেখকের নিয়তি বা ক্যারিয়ারের কোনও অংশ নয়— এমিলি ডিকিনসন-এর এই কথাটা পড়েছিলাম, মনে আছে। ডিকিনসন কখনো লেখা ছাপাননি। আর আমাদের চিন্তাভাবনাও ছিল একই রকমের, একই ধারার। আমরা কোনও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠির জন্যে লিখতাম না, সংখ্যাগুরু বা সাধারণ লোকজনের জন্যেও না। আমরা লিখেছি আমাদের নিজেদের আনন্দ দেবার জন্যে। কিংবা সম্ভবত আমরা লিখেছি কারণ কিছু চিন্তাভাবনার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া দরকার ছিল আমাদের। মেক্সিকোর মহান লেখক আল ফেনসো রেইস আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা লেখা প্রকাশ করি এ জন্যে যাতে খসড়াগুলো সংশোধন করতে না হয়। আর আমি জানি তিনি ঠিকই বলেছিলেন। আমরা বই প্রকাশ করি একটা বই-এর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে। বইটা বের হলেই সেটার ব্যাপারে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেলতাম আমরা। আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, লোকজন আমার ওপর পঞ্চাশ-ষাটটা বই লিখেছে, ওগুলোর একটাও পড়িনি আমি। কারণ, বিষয়টা সম্পর্কে আমি রীতিমতো অনেক কিছু জানি, আর সেটার ওপর আমি ত্যক্ত, বিরক্ত।

বার্নস্টোন : আপনার লেখায় আপনি বলেন, আপনি আপনার পূর্বপুরুষদের মতো সাহসি নন। বলেন, আপনি শারীরিকভাবে একটা কাপুরুষ—

বোর্হেস : হ্যাঁ, আমি তাই। আমার ডেন্টিস্টরা পুরো ব্যাপারটা জানে।

বার্নস্টোন : আর আপনার চোখের ডাক্তার?

বোর্হেস : আমার চোখের ডাক্তার আর সার্জনও জানেন। সবাই জানে ব্যাপারটা। এটা এমন কোনও গোপন খবর নয়।

বার্নস্টোন : কিন্তু তারপরেও সামাজিক জীবনে আপনি সবসময়ই পাবলিক প্যাশন-এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।

বোর্হেস : অবশ্যই বলেছি।

বার্নস্টোন : আর আপনি কখনো আপনার নিজের সুবিধের জন্যে কোনও মন্তব্য করেননি। এখন আমার মনে পড়ছে, আপনি একবার বলেছিলেন, যখন একটা ডাকাত আপনাকে বলেছিল, ‘হয় টাকা নয় প্রাণ’ আপনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘জীবন’ আর লোকটা এতই ভয় পেয়েছিল যে সে উল্টো ঘুরে দৌড় দিয়েছিল।

বোর্হেস : আমি চেয়েছিলাম লোকটা আমাকে খুন করুক, কিন্তু লোকটা সেটা করতে চায়নি।

বার্নস্টোন : এবার বলুন বোর্হেস, আপনি কি কাপুরুষ না সাহসি?

বোর্হেস : আমার ধারণা, শারীরিক দিক দিয়ে আমি একটা কাপুরুষ, কিন্তু মানসিক দিক দিয়ে নই। ক্ষমতার জন্যে বা জনতার বিরুদ্ধে কখনো কুটনামি করিনি আমি। আমার ধারণা আমি একজন সাহসি লোক। সত্যিকার অর্থেই, সামরিক অর্থে নয়। যদিও আমাদের সবাই ছিল সামরিক লোকজন। কিন্তু নিজেকে আমি একজন সাহিত্যিক ব্যক্তি বলে ভাবতে পারি না। নিজেকে আমি একজন সৈন্য বা ব্যবসায়ি বা আরো যেটা খারাপ, একজন রাজনীতিবিদ বলে ভাবতে পারি না।

বার্নস্টোন : জাপানে থাকাকালিন আপনি অত্যন্ত সভ্য সন্ন্যাসিদের দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন যারা আনুষ্ঠানিকভাবে ধ্যান করে থাকেন।

বোর্হেস : ধ্যানকালিন একটা বিষয় ছিল এরকম ধ্যানকারি ভাবার চেষ্টা করবেন যে তিনি বুদ্ধ। আর আমরা যদ্দূর জানি, তিনি তা হতে পারেন। কিংবা তিনি সব চিন্তা দূর করার চেষ্টা করবেন আর সেটাও তাকে সাহায্য করবে। এক বৌদ্ধমঠে এ ধরনের কথাই বলা হয়েছিল আমাকে। জাপানে আমি প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হচ্ছিলাম। আমার কাছে প্রতিটি দিনই ছিল একটা উপহার। যদ্দূর বুঝতে পারি প্রাচ্যই বিশেষ করে জাপানই হয়ত রক্ষা করবে আমাদের কারণ দু’টো সংস্কৃতি আছে দেশটার : আমাদের পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, এর নিজস্ব সংস্কৃতি আর সেই সঙ্গে দেশটার ওপর পড়া চিনাসংস্কৃতির উজ্জ্বল ছায়া। খুবই মনোরম দেশটা। মাত্র তিরিশ দিন কাটিয়েছি ওখানে কিন্তু আমি জানি সেই দিনগুলো অনেক অনেক দিন আমার সঙ্গে থাকবে। আমি সেই স্মৃতি রোমন্থন করছি।
বার্নস্টোন : যে দেশ প্রতি দিনই আপনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ সে দেশে অবস্থানের ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কি?

বোর্হেস : খুবই, খুবই কৃতজ্ঞ আমি। আর আমেরিকাতেও আমি সারাক্ষণই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। লোকজন আমার প্রতি এত সদয় আর এত ক্ষমাপরায়ণ। এই যে আপনি, আপনি আমাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। নিজেকে আমি গুরুত্ব দিই না, আর আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, কিন্তু আমার মনে হয় আপনার ভুল হয়েছে।
বার্নস্টোন : নিজের ভেতরে তাকালে কি দেখতে পান আপনি?

বোর্হেস : নিজের ভেতরে তাকাবার চেষ্টা করি না আমি। কিংবা দশ মিনিট আগে শিকাগো’র সেই শোফার যেমন বলেছিল, স্মৃতিকে আমি ঘৃণা করি। লোকটার এই কথাগুলো সেনেকার হতে পারত। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার, একজন সৈন্যও ছিল সে।

বার্নস্টোন : আজ, সম্ভবত ষাট বছর পর, আপনি আপনার প্রথম জীবনের জেনেভাবাসি বন্ধু সিমোঁ জিক্লিনিস্কি আর মরিস আব্রামোউইচ সম্পর্কে কি ভাবেন? তাঁদের সঙ্গে কি যোগাযোগ রেখেছেন আপনি?

বোর্হেস : হ্যাঁ, রেখেছি। পঞ্চাশ বছর পর তাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার কিন্তু সময়টা কোনও ব্যাপার নয়। তাঁদের সঙ্গে দেখা হল আমার, আমরা হেঁটে বেড়ালাম, সেই একই বিষয় ফরাসি প্রতিকবাদিদের নিয়ে আলাপ করলাম, মাঝখানে যে পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে সে কথা মনেই হল না আমাদের। চমৎকার এক অভিজ্ঞতা সেটা। মাঝখানের সময়টার ব্যাপারে কোনও কথা হয়নি। সাহিত্য নিয়ে, ল্যাটিন, জার্মান, ইদ্দিশ ভাষা নিয়ে কথা বলে গেছি আমরা।

বার্নস্টোন : কি কি বই লিখতে চান আপনি বোর্হেস?

বোর্হেস : ‘উপহার’ নামে একটা গল্প লেখার ইচ্ছে আছে আমার। দশ দিন আগে স্বপ্নে পেয়েছিলাম গল্পটা। মনের মধ্যে আমি এটাকে নাড়াচাড়া করছি। জানি, লিখে ফেলব গল্পটা। সুইডেনবার্গ-এর ওপর একটা বই লিখতে চাই আমি। আর চাই সম্ভবত কয়েকটা গল্প আর বেশকিছু কবিতা লিখতে। মনের মধ্যে আমি এগুলো নাড়াচাড়া করি। মারিয়া কোদামা’র সঙ্গে আমি অ্যাঞ্জেলাস সিলোসিয়াসও অনুবাদ করছি। এখন আমরা প্রথম খসড়াটা শেষ করছি। তারপর আরো ভাল জিনিসে হাত দেব।

বার্নস্টোন : যা আপনাকে ঘুম পাড়ায়, জাগায়, নিঃশ্বাস নিতে দেয়, মরতে দেয়, যার মধ্যে আপনার মন সারাক্ষণ বাস করে সেই মানবশরীর সম্পর্কে আপনার সোজাসাপটা বক্তব্য কি? আপনার দেহ সম্পর্কে কিছু বলুন আমাদের।

বোর্হেস : এটাকে আমি এক জবরজঙ্গ যন্ত্র বলে মনে করি। মিল্টন আগেই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছিলেন যে আমাদের দৃষ্টিশক্তি নির্ভর করছে, তাঁর ভাষায় ‘সেই দুই কোমল গোলক’ অর্থাৎ চোখ দু’টোর ওপর। সারাশরীর দিয়ে কেন দেখবেন না আপনি? তারপর আমরা অন্ধ হব। পুরো ব্যাপারটাই করা হয়েছে জবরজঙ্গভাবে, কিন্তু শরীর আমাদের আনন্দ দেয়, আর সেই সঙ্গে, দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, দেয় নরক। শরীর আমাদের যন্ত্রণা দেয়। শারীরিক যন্ত্রণা সত্যিকার অর্থেই অসহনিয় হতে পারে। আমার ধারণা, সেরা সমাধানটা নস্টিকরাই দিয়ে গেছে : জবরজঙ্গ এক ঈশ্বরের ধারণা, সেই ঈশ্বর যে তার নিজের কাজ খুব একটা ভালভাবে করছে না। এই একই ধারণা ওয়েলস-এর ‘অনির্বাণ অগ্নি’ নামের এক চমৎকার উপন্যাসেও পাওয়া যাবে, সেই ঈশ্বরের ধারণা যে ঈশ্বর তার একটা অমার্জিত, যথার্থতাহীন উপাদানের সাহায্যে সাধ্যমতো তার কাজ করে যাচ্ছে। আর বার্নার্ড শ’র কাছে ফিরে গেলে, ঈশ্বর এখনও নির্মিয়মান, আর আমরা সেই নির্মাণের অংশ। আমাদের হওয়া উচিত ঈশ্বরের অংশ।

বার্নস্টোন : এমিলি ডিকিনসনের কবিতা সম্পর্কে বলবেন কিছু? আমেরিকার কবিদের মধ্যে এমিলি ডিকিনসন সম্পর্কে কি মনে করেন আপনি?

বোর্হেস : যে সব মহিলা লেখালেখি করেছেন, এমিলি ডিকিনসন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে প্যাশোনেট। এ মুহূর্তে আমার কেবল এই নিরস লাইনগুলো মনে পড়ছে— যদিও লাইনগুলো মোটেও নিরস নয়, চিরন্তন : ‘পার্টিং ইজ অল উই নো অভ হেভ্ন/এ্যান্ড অল উই নিড অভ হেল’। দ্বিতীয় বাক্যটি নিখুঁত। ‘নিড’ শব্দটা এই কনটেক্সটে একটা নিখুঁত শব্দ। সারাজীবন লিখেই কাটিয়েছেন তিনি, কি লিখছেন সেকথা বিস্মৃত হয়ে, রেখে গেছেন খসড়া খাতাগুলো, আর এখন তিনি বিখ্যাত। সেটা অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি যেন ব্যক্তিগতভাবে চিনি তাঁকে— এরকম মনে হয় আমার তাঁর সম্পর্কে। তাঁর সম্পর্কে ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা আছে আমার, ব্যক্তিগত ভালবাসা আছে আমার এমিলি ডিকিনসনের প্রতি।

বার্নস্টোন : আমেরিকার অন্যান্য কবিদের মধ্যে তাঁকে কোথায় স্থান দেবেন আপনি?

বোর্হেস : আমার মনে হয়, ‘শ্রেষ্ঠ’ বা ‘প্রথম’ এই শব্দগুলো কারো ব্যবহার করা উচিত নয় কখনো, কারণ শব্দগুলো কোনও বিশ্বাস বহন করে না, আর কেবলই ঠেলে দেয় বিতর্কের দিকে। সৌন্দর্য বিরল কিছু নয়। সবসময়েই সৌন্দর্যের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। যেমন ধরুন, হাঙ্গেরিয় কবিতা সম্পর্কে কিছুই জানি না আমি, তারপরেও আমি নিশ্চিত, হাঙ্গেরিয় কবিতায়, একজন শেক্সপিয়র, একজন দান্তে, একজন ফ্রে লুই ডি লিত্তঁ আমি অবশ্যই পাব, কারণ আমি জানি সৌন্দর্য একটা কমন জিনিস। সারাক্ষণই মানুষ সৌন্দর্য সৃষ্টি করে চলেছে। আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির ওপর একটা কবিতা লিখে, লাইব্রেরিটা যে পুড়িয়ে দিয়েছিল সেই ওমরকে উৎসর্গ করেছিলাম আমি সেটা, তাকে দিয়ে এভাবে চিন্তা করালাম আমি, এখানে শব্দের একটা স্মৃতি রয়েছে। এখানে রয়েছে আমাদের সমস্ত কবিতা, সমস্ত স্বপ্ন, মানবজাতির সমস্ত কথাসাহিত্য। বেশ, এবার আমি লাইব্রেরিটা ধ্বংস করে দেব, বইগুলো ভস্মে পরিণত হবে, কারণ আমি জানি, যথাসময়ে অন্য লোকজন এই বইগুলোই লিখবে আবার, সত্যিকার অর্থে হারাবে না কিছুই।

বার্নস্টোন : দয়া করে সময় সম্পর্কে কিছু বলুন আমাদের।

বোর্হেস : আমার ধারণা, সময় হচ্ছে এক অপরিহার্য রহস্য। অন্যান্য জিনিস রহস্যপূর্ণ হতে পারে। স্থান (space) গুরুত্বপূর্ণ নয়। স্থানহীন একটি বিশ্ব আপনি কল্পনা করে নিতে পারবেন। যেমন ধরুন, সংগীতের তৈরি একটি বিশ্ব। আমরা অবশ্য শ্রোতা। কিন্তু সময়ের ক্ষেত্রে সংজ্ঞার একটা সমস্যা রয়েছে আপনার। সেন্ট অগাস্টিন যা বলেছিলেন সে কথা মনে পড়ছে আমার : ‘সময় কি? কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস না করে সেক্ষেত্রে আমি জানি সে কি। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে, আমি অজ্ঞ, জানি না আমি।’ আমার ধারণা, সময়ের সমস্যাটাই হচ্ছে ‘আসল’ সমস্যা। সময়ের সমস্যার সঙ্গে অহমের সমস্যাও জড়িত। কারণ, শত হলেও অহম কি? অহম হচ্ছে অতীত, বর্তমান, সেই সঙ্গে আগামি সময়ের, ভবিষ্যতের পূর্বভাবনাও অহম। কাজেই এই দুই রহস্য, এই দুই ধাঁধা-ই দর্শনের অপরিহার্য বিষয়, আর আমাদের জন্যে সুখের ব্যাপার হচ্ছে, এ সমস্যার সমাধান হবে না কখনো, কাজেই চিরকাল আমরা এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারি। অনুমান করে যেতে পারি আমরা— সেই অনুমান করার কাজটিকে আমরা বলব দর্শন, যা সত্যিকার অর্থেই অনুমান মাত্র। বিভিন্ন তত্ত্ব বুনে যাবে। আমরা আর মজা পেয়ে যাব সেগুলোতে আর সেগুলোকে খুলতে আর নতুন করে ফের বুনতে থাকব।

বার্নস্টোন : আপনি এক অদ্ভুত স্মৃতিশক্তির অধিকারি।

বোর্হেস : হ্যাঁ, আমি যদ্দূর জানি, আমার স্মৃতিকে অদ্ভুত বলা যেতে পারে, কারণ, আমি আমার অতীত ভুলে যাই। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা ভুলে যাই আমি, আর আমার বন্ধুরা ভাল করেই জানে— প্রচুর কোটেশন মুখস্ত আছে আমার। তবে আমার মন খুব সমৃদ্ধ। স্প্যানিশ, ইংরেজি, প্রাচীন ইংরেজি, ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, জার্মান আর ওল্ড নর্স-এরও প্রচুর লাইন বলে যেতে পারব আমি আপনাকে, অবশ্য ইটালিয়ানেও পারব, কারণ, ‘ডিভাইন কমেডি’ আমি পড়েছি, বারবার পড়েছি, প্রায় ছ’বার পড়েছি। কবিতার লাইনে ভরা আমার স্মৃতি, কিন্তু তারিখ আর জায়গার নামে নয়। ওসব আমি ভুলে যাই, আমার জীবনে যা ঘটে তার ঘটনাপরম্পরা আমি ভুলে যাই। কিন্তু কি করে যেন শব্দ আমার সঙ্গে সেঁটে থাকে বা, আমি সেঁটে থাকি সেগুলোর সঙ্গে।

অডিয়েন্স : একটা বই, ‘ইনকুইজিশন্স’, ১৯২৫ সালে বের করেছিলেন আপনি। আমি পড়েছি যে আপনি বইটার পুরোনো কপিগুলো জোগাড় করেছেন পুড়িয়ে দেবার জন্যে। বিষয়টা ব্যাখ্যা করবেন?

বোর্হেস : দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে কথাটা সত্যি। রীতিমতো বাজে ছিল বইটা। একই সঙ্গে আমি লিওপোল্ডো, ডন ফ্রান্সিসকো ডি কুইভেদো আর স্যার টমাস ব্রাউন হতে চেয়েছিলাম, আর বলাই বাহুল্য, ব্যর্থ হয়েছিলাম। বইটা অদৃশ্য হয়ে যাবে, আশা করছি।

বার্নস্টোন : আপনার প্রথম কবিতার বইটা সম্পর্কে কিছু বলবেন?

বোর্হেস : আমার প্রথম কবিতার বই ‘ফার্ভার ডি বুয়েনস আয়ার্স’ বেরোয় ১৯২৩ সালে। আসলে ওটা আমার চতুর্থ বই, ওটা প্রকাশ করার আগে আমি তিনটে বই নষ্ট করে ফেলি। তারপর আমার বাবাকে বলি— উনি বেশ বিদ্বান লোক ছিলেন— বইটা পড়তে, কিন্তু উনি বললেন, না, তুমি নিজেই ভুল করবে আর সেই ভুল ঠিক করবে। আর তিনি মারা যাবার পর সে বইটার একটা কপি পাই আমি। কাটাকুটিতে ভর্তি ছিল বইটা, বাতিল করে দেয়া হয়েছিল সবগুলো কবিতা, আর তারপর ‘ওব্রাস কমপ্লিটাস’, ‘বোর্হেস’র রচনাসমগ্র’ বইটাতে আমি আমার বাবার সংশোধিত সংস্করণটা ব্যবহার করি। ওটার জন্যে আমি আমার বাবার কাছে ঋণি। কখনোই উনি দেখাননি আমাকে বইটা, একটা কথাও বলেননি এটার সম্পর্কে, কিন্তু সেই বইটা দেখার পর— সেই সংশোধিত কপিটা, আমার বাবার হাতে সংশোধিত হয়ে আরো ভাল হয়ে ওঠা বইটা দেখার পর বুঝতে পেরেছিলাম আমি যে ওটার সম্পর্কে তার অনুভূতি কেমন ছিল।

বার্নস্টোন : আচ্ছা, এটা কি সত্যি, জনাকীর্ণ স্থানে আপনি বইটার কপি সমালোচকদের রেইনকোটের পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে পরে মন পরিবর্তন হওয়ায় সেগুলো আবার ফেরত নেবার চেষ্টা করেছেন?

বোর্হেস : হ্যাঁ, এটা একটা সত্যি কাহিনি। এটা এতই অস্বাভাবিক যে ঘটনাটা সত্যি। আসলেই ঘটেছিল ব্যাপারটা।

অডিয়েন্স : আপনি বলেন, সাহিত্য আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আপনার নিজের সাহিত্যের ক্ষেত্রে—

বোর্হেস : আমার নিজের সাহিত্য, না, আমি বলব অন্য লোকজনের সাহিত্য। তবে আমি মনে করি বই অনুপ্রেরণা জোগায়। বই পড়া একটা অভিজ্ঞতা, অনেকটা বলতে পারেন কোনো নারীর দিকে তাকানোর, প্রেমে পড়ার, রাস্তা ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতার মতো। বই পড়া এক অভিজ্ঞতা, সত্যিকারের এক অভিজ্ঞতা।

অডিয়েন্স : আসলে, অন্য শিল্পগুলো আপনাকে অনুপ্রাণিত করে কি না সেটা জানতে প্রশ্নটা করেছিলাম, কারণ, আমি Para las seis cuerdas (ফর সিক্স কউস, মিলোঙ্গা প্রথম ট্যাঙ্গোর জন্যে লেখা একটা কবিতার বই)-এর উৎসটা জানার ব্যাপারে আগ্রহি।

বোর্হেস : আমি ট্যাঙ্গোটা অপছন্দ করি, আর আমি পছন্দ করি ‘মিলোঙ্গা’, সে কারণেই মিলোঙ্গার জন্যে গীতিকবিতাগুলো লিখেছিলাম, আর আমি চেষ্টা করেছি লোকাল কালার এড়িয়ে যেতে কারণ লোকাল কালার একটা ভূয়ো ব্যাপার, আর চেষ্টা করেছি আমি স্ল্যাং এড়িয়ে যেতে কারণ, স্ল্যাং আসে আর যায়। স্প্যানিশ ভাষার মৌলিক শব্দগুলো ব্যবহার করেছি আমি। আমার ধারণা এটা একটা ভাল বই, এই ‘Para las seis cuerda’ মিউজিক সম্পর্কে শুধু এটুকু বলতে পারি আপনাদের, আমি আদোলফো বিওয়ে কাসারেস-এর সঙ্গে কাজ করি, আর তাঁর স্ত্রী সিলভানা ওকাম্পো গ্রামোফোনে রেকর্ডগুলো বাজান, আর আমরা দেখলাম, কিছু রেকর্ড আমাদের কোনও কাজে আসেনি, অন্যগুলো অবশ্য বেশ কাজে লেগেছিল। দেখলাম আমরা, যেসব রেকর্ড আমাদের অনুপ্রাণিত করেনি সেগুলো দেবুসি’র, আর যেগুলো করেছিল সেগুলো ব্রামস-এর, কাজেই আমরা ব্রামস নিয়েই রইলাম।

অডিয়েন্স : আর্জেন্টিনা আর আর্জেন্টিনার জনগণ সম্পর্কে কি ধারণা আপনার? আর্জেন্টিনা আজ যে পথে এগোচ্ছে তার কারণ কি আপনি বুঝতে পারেন বলে মনে করেন?

বোর্হেস : আমার ধারণা আর্জেন্টাইন প্রজাতন্ত্র মহাবিশ্বের মতোই রহস্যময়। আমি একে বুঝতে পারি না।

বর্ষ ৩, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৪

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার