গোলকধাঁধায় ক্লান্ত হোর্হে লুই বোর্হেসের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সিজার ফার্নান্দেস মোরেনো // অনুবাদ : খালিকুজ্জামান ইলিয়াস

0

সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি যা আজো মনে পড়ে তা হল একটি বাগানের, একটি গ্রিলের দরজার, একটি রঙধনুর; কিন্তু প্লেট নদীর কোন পাড়ের স্মৃতি এ সব তা আজ আর মনে করতে পারি না। হতে পারে এ সব পালার্মোর শহরতলির কিংবা এ্যাদ্রোগে আমাদের গ্রামের বাড়ির স্মৃতি; কিংবা এগুলো অন্য এক গ্রামের স্মৃতিও হতে পারে। মন্তেভিদোর পাসাদেলমলিনোয় থাকতেন আমার এক চাচা, ফ্রান্সিসকো হিদো। হতে পারে সেই বাড়ির স্মৃতিও।
আমার স্মৃতিশক্তি ওই রকমই, একেবারে ঝাপসা। আর নদীর কোন পাড়ের স্মৃতি এগুলো— উরুগুয়ের না আর্হেন্তিনার, তা-ও মনে নেই।
— ঠিক কবে থেকে আপনার বুয়েনস্ আইরেসের কথা মনে পড়ে?
বোর্হেস : আমার জন্ম হয় তুকুমান স্ট্রিটে সুইপাকার এক প্রান্তে একই পাড়ায় যেখানে আমার পিতামহের এক চাচা এস্তানিস্লাও দেল্ ক্যাম্পো শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এরপর আমি আর একবার মাত্র সেই বাড়ি গিয়েছিলাম। কিন্তু সে সম্পর্কে এখন আমার কিছুই মনে নেই। আমার প্রথম স্মৃতি অবশ্য সেই বাড়ি নিয়ে নয়। আর দশটা বাসার মতোই ছিল ওই বাড়ি। কিংবা সংক্ষেপে বিনয় করে বলা যায়, ওই বাড়ি বরং ছিল এখনকার আর্হেন্তিনার লেখক সোসাইটির অফিস-বাড়িটির মতো। পাশাপাশি দু’টো উঠান, প্রথমটি টালি দিয়ে দাবার ছকের মতো করে সাজানো, সঙ্গে একটি ইঁদারা। পরে লক্ষ করি যে ইঁদারার তলায় সব সময় একটা কচ্ছপ বাস করে। ওকে না-কি রাখা হয়েছিল পানি বিশুদ্ধ করার জন্য। পরে মা’র কাছে শুনি যে তখনকার দিনে যদি কোনো বাড়ি ভাড়া দেওয়া, কি বিক্রি করা হত, তো লোকে জিজ্ঞেস করত বাসার কুয়োয় কচ্ছপ আছে কি না। বাড়িঅলাও ঝটপট উত্তর দিত, ‘জ্বি হ্যাঁ, ঘাবড়াবেন না, কচ্ছপটচ্ছপ সবই আছে।’ তখন লোকে বিশ্বাস করত যে কচ্ছপ পানির কিটপতঙ্গ খেয়ে মোটামুটি একটা ফিল্টারের কাজ করে। কিন্তু শ্রীমান কচ্ছপ যে পানি কেবল বিশুদ্ধ করত না তাই নয়, বাস্তবিক তা পানিয়-জল অতিশয় দূষিত করে তুলত— এই ব্যাপারটিও কারো মাথাব্যথার কারণ হত বলে মনে হয় না। অবশ্য মন্তেভিদোর কথা আলাদা। সেখানে লোকে জিজ্ঞেস করত কুয়োয় ব্যাঙ আছে কি না। হ্যাঁ, সেখানে ব্যাঙ-কচ্ছপ সবই ছিল, এবং বহুবছর আমার মা আর আমি দিব্যি সেই কচ্ছপ-ধোয়া পানি খেয়েছি। যেহেতু সবাই তাই খেত, আমরাও এ ব্যাপারে কখনো অস্বস্তি বোধ করিনি। কিন্তু মনে হয় এখন সেই কচ্ছপ-জল পেলে আমি আর খেতে চাইব না।
— কিন্তু কচ্ছপ আর ব্যাঙ এত শক্ত পাথুরে জীব…।
বোর্হেস : তা ঠিক, কিন্তু কিছুটা দুর্বোধ্যও তো বটে।
— আমাদের এই আলোচনা যেহেতু আর্হেন্তিনার পাঠকদের উদ্দেশ্যে নয়, সে জন্য আমি আপনার জীবন এবং সাহিত্যকর্মের ওপর যতটা সম্ভব দীর্ঘ আলোচনা করব।
বোর্হেস : ঠিক আছে, সাহিত্যকর্ম বলতে চান বলুন, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ‘কর্ম’ শব্দটিকে আমি বন্ধনি চিহ্নের ভেতরই রাখব, কারণ ব্যাপারটা আমার কাছে স্রেফ মেটাফোর বা উৎপ্রেক্ষা।
— আপনি নিজেই উপমা উৎপ্রেক্ষার একজন বিশেষজ্ঞ। সুতরাং যদি শব্দটিকে ওইভাবে গ্রহণ করতে চান তো ধরে নেব তা কোনো-না-কোনো ভাবে বাস্তবমুখি।
বোর্হেস : আপনার এমন মন্তব্য কিন্তু অতিরঞ্জন বলেই মনে হচ্ছে।
— আমার মনে হয় অতিরঞ্জন বলতে শব্দটি যে অর্থে অত্যুক্তি আপনি সেই অর্থই বোঝাতে চাইছেন। হবেও-বা। কিন্তু এ-ও তো এক সমস্যা : কবিরা কি বাস্তবতার অতিশয়োক্তি করেন, না-কি এর হুবহু নকল করে থাকেন, না-কি কোনো গভীরতর বাস্তবতার কথা ব্যক্ত করেন যে বাস্তবতা নিজেই অতিরঞ্জিত? ধরুন আপনাকে এটাই আমার প্রথম প্রশ্ন।
বোর্হেস : হ্যাঁ, একজন কবির পক্ষে আপনার শেষ প্রশ্ন গ্রহণ করাই সবচেয়ে সুবিধার। কবিতা তো মূলত সত্য, এ জন্য আপনার বক্তব্য অনেকটা আরিস্তোতলের বক্তব্যেরই সমার্থক : কবিতা ইতিহাসের চেয়ে বেশি সত্য। অবশ্য বাস্তবে একজন কবি যতটুকু পারেন ততটুকুই করে থাকেন। যা ইচ্ছে করেন তাই তো আর করতে পারেন না।
— আপনি তাহলে বলতে চান যে কবিতার উদ্দেশ্য হল বাস্তবতা সম্পর্কে সত্যবাণী উচ্চারণ করা, উচ্চারণ করা এর গভীরতম বাস্তবতার স্বরূপ, সত্যই কতটুকু তা।
বোর্হেস : হ্যাঁ। আমি মনে করি না যে কবি নতুন কিছু বলে থাকেন, অথবা তাঁর নতুন কোনো বক্তব্য থাকা উচিত। বরং লোকে জীবনের কোনো-না-কোনো পর্যায়ে যা অনুভব করেছে, কিংবা করবে সেটাই তাঁর প্রকাশ করা উচিত। অর্থাৎ তাঁকে এক ধরনের বাচনিক সুর খুঁজতে হয়, চেষ্টা করতে হয় সেই সব অতি-প্রয়োজনিয় ভাবানুভূতি প্রকাশের যা মানবজীবনের অবিচ্ছিন্ন অংশ। এ ছাড়া অন্য সব কিছু কেবল সাধারণ চমক, এবং এই চমক কেবল সাহিত্যের ঐতিহাসিকদেরই কৌতূহল জাগায়, খোদ সাহিত্যের জন্য এতে উৎসাহিত হবার কিছু নেই।
— তাহলে তো এক অর্থে বলা হচ্ছে সাহিত্যে মৌলিকতার স্থান গৌণ।
বোর্হেস : হ্যাঁ, অবশ্য বস্তুর মৌলিকত্ব অর্থাৎ অত্যাবশ্যকিয় মৌলিকত্ব নিয়ে কাজ করে যে স্বকিয়তা অর্জন করা যায়, সেইটে ছাড়া অন্য কোনো মৌলিকতার স্থান সাহিত্যে নগন্যই বটে। চেস্টারটন বলেন, কেউ যদি উদ্ভট রকমে মেহগনি কাঠ খেয়ে বাঁচতে চায় তো সেই ব্যাপারটা সে কবিতায় প্রকাশ করতে পারবে না। কিন্তু কেউ যদি ধরুন ঘটনাক্রমে ভালবাসে এবং প্রতিদানে ভালবাসা না পায়, অথবা যদি সে কারো অনুপস্থিতি কিংবা মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে, তাহলে কবিতায় তার অনুভূতি বেশ নিপুণভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব কারণ এসব একেবারেই নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এবং এ জন্যই কবিতার প্রয়োজন। কবিতা সেই সব চিরন্তন সত্য প্রকাশ করে যা কেবল কবির অভিজ্ঞতার সঙ্গেই যুক্ত নয়, বরং পাঠকের আবেগময় অভিজ্ঞতাতেও সম্পৃক্ত।
— ‘কর্ম’ শব্দটি তো আপনি বন্ধনিচিহ্নের মধ্যে রেখে এক রকম বাতিল করে দিলেন। তাহলে আপাতত সে প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে আমরা বরং ‘জীবন’ শব্দটি নিয়ে আলোচনা করি, কেমন? আপনার বাল্যকাল সম্পর্কে আরো কিছু বলুন। সেই বাল্যকাল, যাকে আপনি একটা লাইব্রেরিতেই কাটিয়েছেন বলে একবার স্মৃতিচারণ করছিলেন। আপনি বলেছিলেন ‘প্রায় অসংখ্য ইংরেজি বইয়ের লাইব্রেরি সেটা’।
বোর্হেস : হ্যাঁ, তা সত্যি বটে। আমার বাবার খুব বড় একটা লাইব্রেরি ছিল। সেখানে যে কোনো বই, এমনকি বাচ্চাদের জন্য নিষিদ্ধ বইপত্র পড়ারও আমি সুযোগ পেতাম। যেমন ধরুন, ক্যাপ্টেন বুর্টোনের অনুবাদ ‘সহস্র ও এক রজনির বই’। ওই বয়সে পুরো বইটিই আমি পড়ে ফেলি। এখন দেখি তা অশ্লিলতায় ভরা। অবশ্য তখন পড়ার সময় এ সবের কিছুই চোখে পড়েনি। তখন হাজার ও এক রাত্রির কুহকে আমায় পেয়ে বসেছিল। সেই ইন্দ্রজালে এমনই মোহাবিষ্ট ছিলাম যে অন্য কোনো অর্থ খেয়াল না করেই আমি পুরো বইটা পড়ি। কিন্তু বহু বছর পর এখন বুঝতে পারি যে সেই লাইব্রেরি থেকে কখনোই আমি মুক্ত হইনি, এবং মনে হয় আজো ওই সব বই আমি পড়ছি। ‘কিহু’তে বইটির ব্যাপারে আমার এমন ঘটেছিল। এই বই পড়েছিলাম গার্নিয়ার সংস্করণে। আপনার মনে আছে কি না জানি না, বইটির দুই খণ্ড ছিল লাল রঙের মলাটে সোনালি হরফ। পরবর্তীকালে আমার বাবার লাইব্রেরিটা নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য অন্য এক সংস্করণেও আমি ‘কিহু’তে পড়েছিলাম। কিন্তু পড়তে পড়তে আমার মনে হল যেন আসল ‘কিহু’তে সেটা নয়। এরপর আমার এক বন্ধুর কাছে আমি গার্নিয়ার সংস্করণটি চাই। ও যখন বইটা হাতে দিল অবাক হয়ে দেখি আরে সেই একই ইস্পাতখোদিত, একই পাদটিকা চিহ্নিত, অসংখ্য মুদ্রণপ্রমাদ সংবলিত বই। আমার কাছে এই সমস্তই ছিল বইটির অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই বই এখন আমার কাছেই রয়েছে, এবং আমার বিশ্বাস আসল ‘কিহু’তে এটাই।
— কি করে হঠাৎ প্লেট নদীর এ পাড় কিংবা ও পাড় থেকে ইউরোপ চলে গেলেন?
বোর্হেস : বাবা অন্ধ হয়ে গেলে তাঁকে অবসর গ্রহণ করতে হয়। তখন আমাদের পরিবার ইউরোপ ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় বিশ্বের ঘটনাবলি এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা এমনই অন্ধ ছিলাম যে ১৯১৪-য় আমরা রওনা হয়ে যাই, এবং গিয়ে উঠি সুইজারল্যান্ডে। ইতালি যাওয়ার জন্য সে সময় আমাকে একবার সুইজারল্যান্ড ছাড়তে হয়েছিল। ইতালি আমার খুব একটা পছন্দ হয়নি কারণ তখন আমি একেবারেই বালক। অবশ্য সে সময় সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে বেশ ভালমতোই পরিচিত হই এবং দেশটাকে ভালও বাসি।
— তা সম্ভবত ১৯২৭-এর দিকে। সময়টাকে আপনি বর্ণনা করেছেন, ‘বৃষ্টিধূসর এবং থমথমে’বলে।
বোর্হেস : হ্যাঁ, সে অনেক দিনের কথা। এখন তার বিশেষ কিছুই মনে নেই। এবার দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর সুইজারল্যান্ডে ফিরতে গেলে আমি গভীর আবেগ আর রোমাঞ্চে আপ্লুত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমি যেন নিজ বাসভূমেই ফিরছি। যৌবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা তো আমার সেখানকারই। বুয়েন্স আইরেস্-এর চাইতেও জেনেভা শহরকে আমি ভালমতো চিনি। আর জেনেভাকে জানাও সম্ভব কারণ ওই শহর, বলতে পারেন, স্বাভাবিক আকৃতির। অপরপক্ষে, বুয়েন্স আইরেস্ ইতিমধ্যেই এত বড় হয়ে গেছে যে একে সম্পূর্ণ জানা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। এখন, বিশেষত যখন আমার দৃষ্টিশক্তি কমে যাচ্ছে এবং গত বার বছর হল আমি লিখতে পড়তে পারছি না, আমার বুয়েন্স আইরেস্ও ছোট হয়ে এসেছে। বুয়েন্স আইরেস্ সম্পর্কে এখন আমি যতটুকু জানি তা তার উত্তরাংশ থেকে রেকোলেতা নদী পর্যন্ত। দক্ষিণাঞ্চলও আমার বেশ ভালই জানা আছে— কনস্তিসিওন এবং বারাকাস আমার পরিচিত স্থান। তারপর পশ্চিম দিকে ওয়ান্স্ পর্যন্ত আমার মনে আছে কারণ ওখানে আমাকে অনেক বক্তৃতা দিতে হয়েছে। এরপর ওই দিকে শহরের এমন অনেক অংশ আছে যা আমি বহুকাল দেখিনি। যেমন, পালার্মো। পালার্মো এমন বদলে গেছে যে ওখানে আর কখনো যাব বলে মনে হয় না। কিছু কিছু পুরোনো রাস্তাঘাট অবশ্য এখনো রয়ে গেছে, কিন্তু তা মাত্র কয়েকটি। দু-তিন বছর আগে মা’র সঙ্গে এ্যাদ্রোগ গিয়েছিলাম। কিন্তু ওখানেও সবকিছু এমন পাল্টে গেছে যে আমাদের ফিরে আসতে হল। দেখি পুরোনো জায়গাগুলো বহুধাবিভক্ত, গাছপালা সব উধাও, স্বাভাবিকভাবে সেকেলে বগিগাড়িগুলোও বিলুপ্ত হয়েছে। সমস্ত শহর রেডিও আর মোটর সাইকেলের কবলে।
— কিন্তু জেনেভা কি পাল্টায়নি?
বোর্হেস : না, পুরোনো অংশগুলি পাল্টায়নি। ইউরোপে শহরকে যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়।
— সুযোগ পেলে কি আপনি ইউরোপে থাকবেন, না কি বুয়েনস্ আইরেসের সঙ্গেই স্থায়িভাবে গাঁটছড়া বাঁধা বলে মনে করেন?
বোর্হেস : হ্যাঁ, আমি মনে করি বুয়েনস আইরেসই আমার শেষ গন্তব্য। তবে লন্ডনে, এডিনবার্গে থাকতে কি বেড়াতে, কি দু’এক ঋতু কাটিয়ে আসতে আমার আপত্তি নেই। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলো ভারি মনোরম। হ্যাঁ, তারপর স্পেনের এক শহরও জানি না কখন আমার মনের গভীরে দাগ কেটেছে। সেই শহর সান্তিয়াগো দ্য কম্পোস্তেলা। এর কারণ প্রথমবার যখন ভ্রমণে বের হই তখন আমরা ব্যালেয়ারিক দ্বীপপুঞ্জের কাস্তিল শহরে এবং আন্দালুসিয়ায় ছিলাম। আর তখন উত্তরাংশ দেখার কোনো সুযোগই হয় নি। অন্যদিকে, পর্তুগাল আমার কাছে বাস্তবিকই খুব চিত্তাকর্ষক বলে মনে হয়েছে। গ্যালিসিয়ার মতো পর্তুগালও খুব বিষণ্ন দেশ।
— আপনি, যিনি এত স্বাদেশিকতা মুক্ত মানুষ…
বোর্হেস : না, না, আমি মোটেও স্বাদেশিকতা মুক্ত নই।
— নন? তা সত্ত্বেও আমরা যতটুকু আলোচনা করেছি তাতে আপনাকে জাতিয়তার সংস্কারমুক্ত বলে মনে হবে এই অর্থে যে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বাস করার, বিভিন্ন দেশকে ভালবাসার এবং বোঝার ক্ষমতা আপনার রয়েছে। যাই হোক যা বলছিলাম— প্যারিসের কথা কিন্তু বাদ পড়ে গেল।
বোর্হেস : সত্যি বলতে কি, লজ্জার কথা হলেও বলি, প্যারিস আমাকে অন্যান্য শহরের তুলনায় কম টানে। আমি জানি এই কথার দ্বারা প্রমাণিত হবে যে আমি খুব একটা আর্হেন্তিনিয় মনোভাবাপন্ন নই। আর্হেন্তিনার লোকে প্যারিসের খুব ভক্ত। প্যারিস সম্পর্কে, সেখানকার বন্ধুবান্ধব সম্পর্কে আমার কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি আছে বটে, কিন্তু শহরটি সম্পর্কে তেমন কিছু নেই শহরের কোনো প্রতিকৃতিই আমার মনে পড়ে না। এর কারণ হয়ত এই যে প্রথমবার যখন প্যারিসে ছিলাম তখন সেই থাকাটা ছিল সাময়িক। আর দ্বিতীয়বার যখন গেলাম তখন তো আমার দৃষ্টিশক্তিই প্রায় লোপ পেয়েছে…
— মাদ্রিদে আপনার দিনগুলো সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনার বয়স তখন ঊনিশ। এখন বিদেশে আপনি আর্হেন্তিনার সংস্কৃতির একজন প্রতিনিধি। মাদ্রিদ আপনার কেমন লেগেছে?
বোর্হেস : প্রথমবারের মাদ্রিদ ভ্রমণ আমার মনে রাখার মতো ব্যাপারই বটে, কারণ তখন আমি দেশে ফিরছিলাম। সময়টা ছিল বেশ দীর্ঘ। আমার কেবল কবিতা আর অনুভূতির কথাই মনে আছে, তারিখগুলো খেয়াল নেই। মাদ্রিদে আমি আন্দালুসিয়ার মহান ইহুদি কবি রাফায়েল কান্সিনোস এসেন্সের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাই। তখন ইউরোপকে বিদায় জানাচ্ছি, কিন্তু কান্সিনোস এসেন্সের মধ্যে আমি প্রায় সব-সংস্কৃতিরই দৃষ্টান্ত লক্ষ করি— কেবল পাশ্চাত্যই নয়, পূর্বদেশিয় সংস্কৃতিরও। তাঁর সঙ্গে আলাপ করা মানে পৃথিবীর বেবাক লাইব্রেরির সঙ্গে আলাপ করা। এর ওপর তিনি ছিলেন একজন উদার ও অমায়িক ভদ্রলোক। তাঁর একমাত্র দোষ হল, তাঁর চেয়ে অনেক নিম্ন-মানের লেখকদেরও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা। তিনি সচরাচর একাই থাকতেন, কিন্তু আলাপের সময় খুব জাঁকালো আলাপ করতে পারতেন। সাধারণত প্রত্যেক শনিবারে ক্যাফে কালোনিয়ালে মিলতাম। আমাদের আলোচনা শুরু হত— স্পেনের পক্ষে বেশ সকাল-সকালই বলতে হবে— প্রায় মধ্য রাতে, এবং ভোর না হওয়া পর্যন্ত তার বিরাম ছিল না। আমাদের আলোচনার বিষয় কেবল সাহিত্য। মতামতের ব্যাপারে অবশ্য কান্সিনোস কিছুটা একনায়ক ছিলেন। বিনীত ও উদার একনায়ক, অনেকটা ডক্টর জনসনের মতো। তিনি কাউকেই অসন্তুষ্ট করতে চাইতেন না। এ জন্য আলোচনার সময় কোনো লেখকের নাম উচ্চারণ করা থেকে তিনি বিরত থাকতেন। আমরা যে-কোনো একটা বিষয় বেছে নিতাম— ছন্দ, উৎপ্রেক্ষা, কাব্য, মৃত্যু, সমুদ্র, শহর— যে কোনো, এবং তা নিয়ে চলত তুমুল আলোচনা, যতক্ষণ না যেমন কাম্পেদিলা বলতেন, ‘দিপের আলোর মধ্য দিয়া দিবস আসিত’, এবং তারপর আমরা কান্সিনোস এসেন্সকে ভায়াদাক্তের কাছে তাঁর মরেরিয়া স্ট্রিটের বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতাম। খুব ছেলেবেলা থেকেই আমাদের বাসায় সাহিত্য আসরের সঙ্গে আমার পরিচয়। প্রতিবেশি এভারোস্তা ক্যারিয়েগো আমাদের পরিবারের বন্ধু ছিলেন। সেই সময়কার কার্লোস দ্য সুন্তেস, মার্সেলো দেল্ মাজো এবং অন্যান্যদের কথাও আমার মনে পড়ে। জেনেভায় আমি চার বছর কাটাই এবং সেখানেই হাই স্কুল পাশ করি। কিন্তু সে সময় সাহিত্যিক সমাজে আমার তেমন যাওয়া আসা ছিল না। আমার সাহিত্য-জগতে প্রবেশ ঘটে স্পেনে, এবং চল্লিশ বছর পর এবার স্পেনে গেলে আমাকে যে স্পেনদেশিয় আতিথেয়তা দেওয়া হয়, তখনও কিন্তু এই ধরনের সংবর্ধনার পরিচয় পেয়েছিলাম। এবার গিয়ে সেই একই ধরনের আতিথ্য, একই রকম সাহিত্যিক পরিবেশ, এবং এখানে যার অভাব, সেই পুরোনো একচেটিয়া সাহিত্য আলোচনার দক্ষতা দেখতে পেলাম। অনেকে হয়ত বলবেন যে বুয়েনস আইরেসে তখন যে সাহিত্যিক উত্তেজনা ছিল (মেসিদোনিও ফার্নান্দেসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় আমি এই ব্যাপারটি উপলব্ধি করি) তো সেই সাহিত্যিক উত্তেজনা এখন হয়ত অনেকে বলবেন যে রাজনৈতিক উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে। সাহিত্য সম্পর্কে বলার মতো লোক এখন পাওয়া দুষ্কর। বিশেষত সেই ধরনের লোক যাঁরা নিছক আনন্দ ও সুখের খাতিরেই সাহিত্য-আলোচনায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু স্পেনে গিয়ে আমি তা পেয়েছিলাম, যদিও সত্যি বলতে প্রথমবার যখন স্পেনে যাই, মনে হয়েছিল যেন দেশে ফিরছি। অধিকাংশ আর্হেন্তিনাবাসির মতো আমার রক্তেও তখন প্রচুর স্পেনিয় প্রভাব ঢুকে পড়েছে। এই প্রভাব তখন আরো বেশি করে অনুভব করলাম কারণ জেনেভা থাকাকালিন আমি ফরাসি বলতে শিখেছিলাম। ফরাসি ভাষার আমি খুব প্রশংসা করি, কিন্তু চার-পাঁচ বছর পর যেখানে দেশি ভাষায় কথা বলা হয় এমন একটি দেশে ফেরা এবং ফরাসির মতো চমৎকার হলেও একটি বিদেশি ভাষা বলা থেকে রেহাই পাওয়া— যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ব্যাপারই বটে।
— তখনকার সেই ‘উত্তেজনাময়’প্রথম দিকের লেখা কবিতাগুলোর খবর কি?
বোর্হেস : সেই সময়কে আমি বন্ধুত্ব এবং কৌতূহলের কাল হিসেবে মনে করি। তখন যা লিখেছি, আমার মনে হয় সে সব খুব একটা মৌলিক সৃষ্টি হয়নি।
— আপনি তখন যা লিখেছেন, ইদানিং কি সে সব আবার পড়ে দেখেছেন? ‘আলট্রা’সমালোচনা সংগ্রহ খুলে দেখেছেন কি?
বোর্হেস : আমি যা লিখেছিলাম, সত্যি তা খুব বাজে হয়েছিল।
— তাই কি?
বোর্হেস : হ্যাঁ, একেবারে বাজে।
— অবশ্যই সেগুলো ছিল প্রথম জীবনের রচনা। তাই বলে খুব নিম্ন-মানের হয়েছে বলে তো মনে হয় না।
বোর্হেস : না, না, আমার প্রথম কবিতা ছাপা হয় সেভিলিয়ানের একটি পত্রিকায়। এর নাম দিয়েছিলাম ‘সাগরস্তোত্র’ এতে আমি হুইটম্যানকে অনুকরণের চেষ্টা করেছি। কিন্তু বৃথাই। সম্প্রতি সাগরকে নিয়ে আরেকটি কবিতা লিখেছি। আশা করি এই কবিতা আগেরটির মতো নয়।
— দু’টোর মধ্যে তুলনা করছেন?
বোর্হেস : না।
— তো আপনার কি মনে হয় না এই কবিতায় আগেরটির কোনো সাদৃশ্য আছে?
বোর্হেস : না, না, না, আমি আশা করি তা নেই। না, আমাদের এতটা নৈরাশ্যবাদি হয়ে কাজ নেই। আমি ভাবলাম প্রথমটিতে হুইটম্যানের প্রভাব আছে। হ্যাঁ তা আছে, কিন্তু সান্তোস চোকানোর প্রভাব তাতে সামান্যই।
— অন্যদিকে আমি কিন্তু মনে করি আপনার এই সাম্প্রতিক কবিতাটি সমুদ্রের মতো।
বোর্হেস : আমার মনে হয় না এতে সমুদ্রের অনুরূপ কিছু আছে। তবে এই কবিতা সম্ভবত কোনো পৌরাণিক সমুদ্রেরই অনুকরণ করে।
— ১৯২১ সালে স্পেনের প্রথম বছরগুলো কাটিয়ে যখন বুয়েনস আইরেস্ ফিরলেন, আপনি তখন গভীর ভাবাবেগে আপ্লুত হয়েছিলেন। সে সময়ের কবিতায় এ কথা বেশ পরিষ্কার ধরা পড়েছে। ফ্রান্সেসকো লুই বার্নার্দেস আমাকে বলেছেন যে সেই সময় আপনি বলতেন, ‘আপনার ল্যাটিন পদ্ধতি ম্যালদোনাদোর স্রোতে ফেলে দিয়েছেন।’কথাগুলো আপনার মনে আছে? কিংবা সেই স্রোত— এখন যাকে মাটির অভ্যন্তর দিয়ে প্রবাহিত করা হয়েছে?
বোর্হেস : হ্যাঁ, সে সব কথা মনে আছে বৈ কি। কিন্তু আমার মনে হয় লাতিনিয় বিশুদ্ধতা আমি কিছুটা উদ্ধার করতেও সক্ষম হয়েছি, ভাগ্যিস। আর ওই সব কথা ভাগ্যক্রমে সেই পরিখার সঙ্গেই চুকেবুকে গেছে। আমার তখনকার উচ্চারিত শব্দগুলো ছিল মুহূর্তের জাতীয়তাবাদ-সঞ্জাত, যাকে নিছক সংকীর্ণতাও বলতে পারি। কিন্তু তখন যা বলেছি তা সত্ত্বেও ম্যালদোনাদোর কিছু জলকাদা তো অবশ্যই আমাকে আলোড়িত করেছিল। নইলে গুয়াস্তাভিনো এবং এ্যাস্তোর পিয়াজোলার জন্য সম্প্রতি কয়েকটা মিলোঙ্গা রচনা করব কেন? এই রচনাগুলো মিলোঙ্গা এবং টাঙ্গো গানের জন্য রচিত গীত। সুতরাং স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি যে ম্যালদোনাদোর ব্যাপারে আমার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এ ছাড়াও আমি মনে করি আতিথেয়তা আর্হেন্তিনিয় চেতনার একটি বিশেষ গুণ। অর্থাৎ বলা যায় আমরা বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উৎসাহি হতে পারি। যেমন ধরুন, ভিক্তোরিয়া ওকাম্পোকে যখন তাঁর বিদেশ প্রীতির জন্য দোষারোপ করা হল এবং বলা হল যে তিনি ‘আর্হেন্তিনিয়’নন, তখন ওকাম্পো যথার্থই বলেছিলেন যে তিনি খাঁটি আর্হেন্তিনার মানুষ বলেই বিদেশ সম্পর্কে বেশি উৎসাহি। আমি মনে করি এটি আমাদের এক বড় গুণ। আমার ধারণা আমাদের দেশ সংকীর্ণ নয়, কিংবা সংকীর্ণ হওয়া কি আবেগসর্বস্ব আঞ্চলিকতাবাদিতে পরিণত হওয়া আমাদের উচিত নয়, যদিও আমাদের কবিতা থেকে আঞ্চলিকতা একেবারে ঝেড়ে ফেলারও পক্ষপাতি আমি নই। আমি বিশ্বাস করি আমাদের এখানে বর্তমান কি ঘটে কেবল তাই নয়, বরং সব রকম হতে চেষ্টা করা, কি যে কোনো মূল্যে সব কিছু বোঝার চেষ্টা করা উচিত।
— যুক্তরাষ্ট্রে আপনার একজন বন্ধু সম্পর্কে এক গল্প শুনেছি। বন্ধুটি আপনাকে কিছু টাঙ্গো শোনাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আপনি এই ভেবে ভয় পাচ্ছিলেন যে হয়ত তিনি আপনার অপ্রিয় টাঙ্গোগুলোই শোনাবেন।
বোর্হেস : হ্যাঁ, বন্ধুটি প্যারাগুয়ের ডক্টর ইন্স্ফ্রান, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সহকর্মী ছিলেন। তো একদিন আমাকে তাঁর বাসায় টাঙ্গো শোনার আমন্ত্রণ জানালেন। আমি গেলাম কিন্তু আমাকে সেই সব টাঙ্গোই শুনতে হল যেগুলো আমার বিশেষ অপছন্দ—La Cumparsita, Caminito, Flaca, Fane y descangallada…। আর আমার মনে হল এ সমস্তই ভীষণ কাঁচা, রদ্দিমার্কা এবং একেবারে মূল্যহীন। আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল কারণ বন্ধুটি বাস্তবিকই ওই সব শুনিয়ে আমাকে একটু আনন্দ, একটু আবেগানুভূতি দান করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি তখন ভাবছি কি করলে ডক্টর ইন্স্ফ্রান বুঝতে পারবেন না যে ওই টাঙ্গোগুলো আমার কাছে বিরক্তিকর এবং আবেগসর্বস্ব বলে মনে হচ্ছে। তখন হঠাৎ মার্টিন ফিয়ারের মতো আমি অনুভব করলাম ‘দু’টি বিশাল অশ্রুবিন্দু আমার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।’অর্থাৎ বলতে পারি যে বিচারবুদ্ধি ছাড়াও তখন আমার মধ্যে কিছু একটা ছিল যা আমার মতামতকে ছাড়িয়ে অনেক গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিল, এবং সেটিই আমাকে ওই টাঙ্গোগুলো উপভোগ করতে সাহায্য করে।
— আপনি লিখেছেন যখন বুয়েনস আইরেস্ ফিরলেন, ইউরোপের বছরগুলো মনে হল…
বোর্হেস : মনে হল যেন স্বপ্ন, হ্যাঁ, সত্যি।
— আর লিখেছিলেন যে আপনি সব সময়ই বুয়েনস আইরেসে থাকবেন।
বোর্হেস : হ্যাঁ, তা অবশ্য আমি বলে থাকতে পারি। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না যে এইখানে বুয়েনস আইরেসে অনেক কিছুরই অভাব?
— তবুও ভুলবেন কি করে যে এখানেই আপনি মেসিদোনিও ফার্নান্দেস-এর সঙ্গ পেয়েছিলেন?
বোর্হেস : হ্যাঁ, তিনিই আমার মনে সবচেয়ে গভীর দাগ কেটেছেন। মেসিদোনিও ফার্নান্দেস সম্পর্কে বলতে অবশ্য আমার বরাবরই খুব ভাল লাগে। সত্যি বলতে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে আমি আলাপ করেছি, কিন্তু কয়েকজন স্বনামধন্য মহিলা ছাড়া তাঁদের কেউই মেসিদোনিও ফার্নান্দেসের মতো আমার মনে এমন দাগ কাটতে পারেননি। মেসিদোনিও একদিকে যেমন আলাপি মানুষ ছিলেন, তেমনি সহজে মুখও খুলতে চাইতেন না। ওয়ান্স্ স্কোয়ারে জুজুই এবং রভিদাভিয়ার প্রান্তে কফিঘরে তাঁর আড্ডার কথা এখনো বেশ মনে পড়ে। ওই সব আড্ডা কান্সিনোস এসেন্সের আড্ডার মতোই প্রতি শনিবার বসত। সে সময় আমি খুব পড়াশোনা করতাম এবং বাইরে বেরুতাম খুবই কম। কিন্তু সারা সপ্তাহ আমার মন ভরে থাকত এই চিন্তায় যে শনিবারে মেসিদোনিওর আড্ডায় যাব। মেসিদোনিও আমার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তিনি থাকতেন আমাদের বাসার খুব কাছেই। এ জন্য যে কোনো দিন ইচ্ছা করলেই তাঁকে আমি দেখতে পেতাম। কিন্তু সেই সঙ্গে আমার এ-ও মনে হত যে যখন তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার অধিকার আমার নেই। মেসিদোনিওর শনিবারকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার জন্যই বলতে পারেন তাঁকে সপ্তাহের অন্যান্য দিনে একরকম উপেক্ষা করেই চলতাম। তো এই ছিল তাঁর সঙ্গে আমার দেখা করার ধরন। আমাদের মধ্যে এমন অনেকে থাকত যারা কেবল তাঁর কথা শোনার জন্যই আড্ডায় যেত। আর্হেন্তিনার সেই সব সন্ধ্যায়, অর্থাৎ স্পেনের সন্ধ্যার চেয়ে ছোট, একেবারে শেষ পর্যন্তও মেসিদোনিও তিন কি চারবার কথা বলতেন, এর বেশি নয়। তিনি বেশ ঝুঁকি নিয়ে একটা মন্তব্য করতেন। মোটেও বক্তব্যমূলক মন্তব্য নয়, বরং এক মুখচোরা প্রশ্নের আকারে করতেন তা। এবং তা-ও সরাসরি আমাদের উদ্দেশ্যে বলতেন না। বরং পাশের লোকটির দিকে ফিরে বলতেন, তুমি কি বল হে, তাই না…? ব্যস, এরপরই প্রশ্ন, এবং সেই প্রশ্ন একাই আমাদের আলোচ্য বিষয়ের ওপর চোখধাঁধানো আলোক সঞ্চার করত। বৃদ্ধ মেসিদোনিওর পাশ থেকে দু’একটি মন্তব্যই ছিল যথেষ্ট। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি মার্ক টোয়েন কিংবা পল ভালেরির মতো চোখ তুলে তাকাতেন। তাকে মনে আছে— ধূসর চুল, পাকানো গোঁফ। মার্ক টোয়েনের সঙ্গে তুলনা করা হলে তিনি ভীষণ ফুলতেন (মার্ক টোয়েনের একজন ভক্তও ছিলেন তিনি)। অন্যদিকে ভালেরির জন্য কখনই খুব বেশি উৎসাহ দেখাননি। মেসিদোনিও কিছু সংখ্যক লেখা রেখে গেছেন। এর বেশির ভাগই প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল। কিছুটা আমি ছাপার ব্যবস্থা করি, এবং রেইয়েস কর্তৃক তা প্রকাশিত হয়। তিনি কিছু নোট এবং কিছু কবিতাও রেখে গেছেন। এই সব উৎকৃষ্ট ও সুখপাঠ্য লেখা লিখলেও, আমার মনে হয় মেসিদোনিও নিজেকে সাহিত্যকর্মে পরিপূর্ণভাবে নিবেদন করেননি। আমার বিশ্বাস, আসল মেসিদোনিওকে পাওয়া যায় তাঁর আলাপচারিতায়। তিনি খুব বিনয়ি জীবন যাপন করতেন। মনে পড়ে একদিন আমাকে বললেন : ‘আমার শেষ ঠিকানা অমুক স্থানের লিবার্টি স্ট্রিট।’ যখনই উঠে বাইরে যেতেন, টেবিলের দেরাজে রেখে যেতেন এক বিপুলাকার পাণ্ডুলিপি। এ তথ্য আমার জানা ছিল। আমরা তাঁকে বলতাম সব লেখাই এ ভাবে নষ্ট করে ফেলা তার পক্ষে মোটেও ঠিক হচ্ছে না। তখন মেসিদোনিও খুব আন্তরিকভাবে আমাকে বলতেন, ‘শোনো, তুমি কি ভাবো আমার খুব বড় বড় ধ্যান-ধারণা আছে? সত্যিই কি তুমি মনে কর কিছু হারাবার মতো আমি যথেষ্ট ধনি? বুঝলে, আমি হরদম এই নিয়ে ভাবছি, খোয়াবার মতো আমার কিছুই নেই।’এইভাবে অজস্র পৃষ্ঠা হারিয়ে গেছে। ব্যাপারটা দুঃখজনক বৈকি। আর এর জন্য দায়ি নিজের সৃজনক্ষমতায় মেসিদোনিওর চরম আস্থাহীনতা।
— বলা হয় ‘এলেনা বেলামুয়ের’কবিতাটি কুড়ি বছর পর তাঁর এক বন্ধুর কেক রাখার ভাণ্ডে আবিষ্কৃত হয়। তিনি যে এই রকম জিনিসপত্র, সাহিত্যকর্ম সব একসঙ্গে ফেলে রাখতেন, তাতে কি আপনার মনে হয় নিজের পাণ্ডুলিপির কিছুমাত্র দাম তিনি দিতেন?
বোর্হেস : না, আমার মনে হয় মেসিদোনিওর ঝোঁক ছিল সত্য আবিষ্কারের দিকে। এই ব্যাপারে উইলিয়াম জেমসের সঙ্গে তাঁর মিল লক্ষ করি। আমার মনে আছে উইলিয়াম জেমস এক জায়গায় লিখেছেন, যৌবনকালে কখনো কখনো সমস্ত রাত তিনি চিন্তা করে জেগে কাটাতেন— বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কি? সময় কি? জীবন কি? আমি কে? মনে হয় মেসিদোনিওরও এই অভ্যাস ছিল। সত্য আবিষ্কার করতে তিনি ভালবাসতেন। আমাকে একবার বলেছিলেন তাঁর সন্দেহ হয় সত্য আদৌ প্রকাশ করা সম্ভব কি-না। আমাকে বলেন, তাঁর ধারণা— বার্কলে এবং শোপেনহাওয়ার এবং কান্ট সত্য আবিষ্কার করেছেন বটে, কিন্তু তা পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারেননি। তাঁর বিশ্বাস, অবশ্য এ সব তাঁর অতিন্দ্রিয় ধ্যান-ধারণা— সত্যকে প্রকাশ করা এবং বোধগম্য করা সম্ভব নয়। মূসা নবি যখন ঈশ্বরের নাম জিজ্ঞেস করলেন, ঈশ্বরের উত্তর ছিল এ রকম : ‘আমি আমিই।’এই কথাকেই অন্যভাবে বলা যায় যে বাস্তবিকই সত্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু মেসিদোনিও বিশ্বাস করতেন যে সত্য আবিষ্কার করা এমন কিছু দুরূহ কর্ম নয়। ব্রহ্মা-সম্পর্কিত সত্য যে কোনো মুহূর্তেই আমাদের কাছে ধরা দিতে পারে। একসময় তিনি আমাকে বলেছিলেন যে গ্রামদেশে যদি খোলা মাঠে শুয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, মেসিদোনিও ফার্নান্দেস, বার্কলে, শোপেনহাওয়ার, মেটাফিজিক্স ইত্যাদি সমস্ত ভুলে কিছু সময় অতিবাহিত করতে পারতেন তো কোনো এক মুহূর্তে সবকিছু উপলব্ধি করা তাঁর পক্ষে হয়ত সহজ হত। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এ-ও বললেন যে তাঁর মনে হয় না সেই সব অভিজ্ঞতা কখনো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। পরে কোনো এক ব্যাপারে আমার ধারণা হয় যে বাক্যে কেবল খণ্ডিত অভিজ্ঞতারই আঁচ করা সম্ভব। যেমন ধরুন, আমি হলুদ রঙের কথা উল্লেখ করলে আপনি তা বুঝবেন কারণ আমরা জানি হলুদ রঙ কেমন। অন্যদিকে, ঈশ্বর কিংবা সত্য প্রসঙ্গে (এ সব একই ব্যাপার) যদি কোনো অতিন্দ্রিয়বাদির নতুন কোনো অভিজ্ঞতা হয়, তিনি নিজের সেই অভিজ্ঞতা অন্যের কাছে বোধগম্য করে তুলতে পারবেন না, কারণ তাঁর ব্যবহৃত বাক্য তো কেবল সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গেই যুক্ত। অন্যের কাছে তা কিছু দুর্বোধ্য আভিধানিক শব্দ ছাড়া আর কি?
— হ্যাঁ, আমার মনে পড়ে মেসিদোনিওর মতের সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত আপনার এই মত লুগোনিসের ওপর লেখা বইয়ে আপনি ব্যবহার করেছেন। সেখানে আপনি লুগোনিসের আত্মহত্যার পেছনে যে কারণ অনুমান করেছেন তাহল, তিনি যে লুগোনিস এই বাচনিক সত্য তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। আপনার কথা ধার করেই বলা যায়, এই সত্য ‘অকথনীয়’এবং ‘অদম্য’ এই ভাবে সত্য প্রকাশে কথার অক্ষমতা উপলব্ধি করেই তিনি নিজের সিদ্ধান্তের যথার্থতা খুঁজে পান।
বোর্হেস : হ্যাঁ, আমার মনে হয় শেষ পৃষ্ঠায় আমি ওই রকমের কিছু একটা লিখেছি। সত্যের অনেকাংশই বাচনিক, তবে সমস্ত সত্যই বাচনিক নয়। আমার বিশ্বাস লুগোনিসও সে কথা উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি যে উপলব্ধি করেছিলেন তা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। তাঁর দুঃখ যদি প্রকাশ করতে চাইতেন, কি প্রকাশের চেষ্টাও করতেন তা হলে বরং ভাল হত। লুগোনিসের সমস্ত পাতাই আমার মুখস্ত ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে লুগোনিস ছিলেন একজন নির্জন, একগুঁয়ে মানুষ। তিনি মোটেও সাদামাটা লোক ছিলেন না যে আপনি তাঁকে সম্পূর্ণ জানতে পারবেন। উপরন্তু আমার মতো বেগানা এক ছোকরাকে নিজের সব কথা খুলে বলারও তাঁর কোনো কারণ ছিল না। লুগোনিসকে জানার চাইতে মেসিদোনিওকে জানা বরং অনেক সহজ ব্যাপার। মেসিদোনিও ছিলেন সন্দেহবাদি মানুষ, আর লুগোনিস নিশ্চয়তাবাদি। লুগোনিস বাকবিধি তৈরি করতে ভালবাসতেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ করা ছিল রীতিমতো অসুবিধাজনক। সব কিছুকে একই বাক্যে ধারণ করার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। সেই বাক্য হত অলংকারে ভরা এবং তা দিয়ে বলতে গেলে একটা পুরো অনুচ্ছেদই তৈরি হয়ে যেত। তারপর আপনাকে আবার অন্য কোনো আলোচনা শুরু করতে হত যার সমাপ্তিও ঘটত ওই রকম আর একটি দশাসই বাক্যের মাধ্যমে। আমার মনে আছে আমার এক বন্ধু নেস্তর ইবারা নিগ্রোদের নাচগান এবং স্পিরিচুয়্যালে খুব উৎসাহি ছিলেন। তিনি লুগোনিসের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চেষ্টা করছিলেন। লুগোনিস তাঁকে যে একটি বাক্যে উত্তর দিয়েছিলেন তা হয়ত সংক্ষিপ্ত, কিন্তু নিগ্রো নাচগান কি স্পিরিচুয়্যালের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কই ছিল না। সম্ভবত লুগোনিস এ সব ব্যাপারে কিছু জানতেনও না। তিনি বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে, এ ব্যাপারে আলোচনা করা যাক : আসলে জানেন কি, নিগ্রোগুলো হচ্ছে এক-একটা উল্লম্ফমান শয়তান।’বাক্যটি হয়ত শুনতে মনে হবে বুদ্ধিদিপ্ত, কিন্তু নিগ্রো গানবাজনা, স্পিরিচুয়্যালের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? কিন্তু এই বাক্যে অলংকার আছে, যদিও এরপর আর ও বিষয়ে কোনো আলোচনা এগোয় না। ওই এক বাক্যেই সমস্ত ব্যাপারটির সমাপ্তি ঘটেছিল। তখন অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করলে লুগোনিস একই একগুঁয়ে পদ্ধতিতে তারও মিমাংসা করতেন। কথাবার্তায় তাঁর চমক থাকলেও, ক্লান্তিকর মনে হত।
আমার মনে হয় লুগোনিসের চাঁচাছোলা উক্তিগুলো তাঁর নিজের নয়। বরং অসাধারণ কিছু একটা বলার তাগিদেই তিনি বলতেন। যেমন একবার ইংরেজি কিংবা ফরাসি চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন। ওই সব ছবি তিনি দেখেননি, কিন্তু তা হলে হবে কি, তাঁর তো মতামত জানানো চাই, এবং কোনো রকম আমন্ত্রণ ছাড়াই তিনি মন্তব্য করে বসতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘না, সিনেমার ব্যাপার পুরোপুরি মার্কিনিদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, যেমন ফ্যাশন ছাড়তে হবে ফরাসিদের ওপর।’ব্যস, খতম। আমার মনে হয় ওই আলোচনা শেষ করতে চাইছিলেন বলেই তিনি ও ভাবে বলেছিলেন, কেননা ও রকম বললে আমরা চলচ্চিত্র সম্পর্কে আর কেউ কিছু বলতে পারব না। তখন বড় জোর তাঁকে জিজ্ঞেস করা যেত আমেরিকার কোন ছবি তাঁর পছন্দ। কিন্তু আমাদের আশংকা ছিল খুব বেশি ছবি তিনি দেখেনও নি…।
— তাই নিরবতাই ছিল একমাত্র বক্তব্য। এবং অন্য কথায়, বোর্হেসের মুখে ছিল না রা।
বোর্হেস : না, লুগোনিসের মুখে।
— দুঃখিত, আশা করি আশেপাশে কোনো মনোবিজ্ঞানি নেই।
বোর্হেস : অন্যদিকে, আপনার বাবা ফার্নান্দেস মোরেনোর সঙ্গে বৈঠক হত অত্যন্ত সহজ এবং মনোজ্ঞ, কারণ তিনি যে সব বিষয়ে সম্মতি দিতেন সে সম্পর্কে কখনোই খুব নিশ্চিত হতেন না। কিংবা বলা যায়, মেসিদোনিও ফার্নান্দেসের মতো হয়ত তাঁর এক ধরনের নিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু তিনি যেহেতু খুব বিনয়ি ছিলেন, সে জন্য প্রশ্নের আকারে সে সব প্রকাশ করতেন। ‘এইটে এ রকম’ না বলে তিনি বলতেন, ‘কিন্তু যদি…? …. হয়ত? … তাই নয় কি… ?’ অথবা. ‘আপনিও কি একই কথা বলবেন না…?’
— এইবার আমাকে বলুন কি করে মেসিদোনিও ফার্নান্দেস এবং লুগোনিসের মতো দু’জন একেবারে সমসাময়িক মানুষকে ব্যাখ্যা করা যায়। এমনকি একই বছর জন্মগ্রহণ করলেও তাঁদের কোনো সাদৃশ্য নেই, কোনো মিলই নেই।
বোর্হেস : ওঁরা কিন্তু খুব অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন।
— এটি আমার কাছে সংবাদ বটে। কিন্তু কি করে এমন দুই মেরুর মানুষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পরস্পর বন্ধু হলেন?
বোর্হেস : ওঁরা অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। কিন্তু পরে কেন জানি না মেসিদোনিও কেটে পড়লেন। বিস্তারিত কিছু আমার জানা নেই, তবে এ টুকু জানি যে মেসিদোনিও ক্রমেই লুগোনিসের কাছ থেকে সরে পড়তে শুরু করেছিলেন। আমার মনে হয় মানসিক দিক দিয়ে মেসিদোনিও একজন কর্মঠ লোক ছিলেন, কিন্তু লেখক হিসেবে ছিলেন মহাঅলস। অন্যদিকে লুগোনিস জীবনধারণ করতেন লিখেই। যেমন, তিনি যদিও আধুনিকতাবাদি সব উচ্ছৃঙ্খল লেখকের সঙ্গে মিশতেন এবং যদিও দারিও এবং জেমস ফ্রেইর ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তবুও তিনি যে খুব নিশাচর ছিলেন তা আমার মনে হয় না। সাহিত্যসভা এবং ভোজ অনুষ্ঠানে তাঁকে বড় একটা দেখা যেত না।
মেসিদোনিও ফার্নান্দেসকে লেখক হিসেবে যত না, চিন্তাবিদ হিসেবে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। আমার তো মনে হয় তিনি, তাঁর চিন্তাধারা আমার প্রচুর উপকার করেছে, তাঁর অনুকরণ করেই আমার সাহিত্য-জীবন শুরু হয়। কিন্তু আমার বিশ্বাস মেসিদোনিও ফার্নান্দেসের প্রকাশভঙ্গি এবং বিশেষ কিছু সংস্কার আমার যথেষ্ট ক্ষতিও করেছে। তিনি চেষ্টা করতেন ‘জীবন’সম্পর্কে না বলে ‘জীবিকা’সম্পর্কে বলতে, ‘স্বপ্ন’প্রসঙ্গে না বলে ‘স্বপ্ন দেখা’প্রসঙ্গে বলতে, এবং চেষ্টা করতেন অবিরাম ‘chore’ শব্দটি ব্যবহার করতে, বাস্তবিকই অবান্তরভাবে ব্যবহার করতেন কোনো নতুন শব্দ বা মত। যেমন ধরুন ললিতকলা সম্পর্কে স্প্যানিশে সাধারণভাবে বলা হয় bellas artes; বেশ, কিন্তু মেসিদোনিও কাব্যকলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে belarte বলাই বেশি পছন্দ করতেন। অথচ সত্যি বলতে এ দ্বারা নতুন কিছুই যোগ হল না, হল কি? তবুও ওই রকম ধারাই তিনি পছন্দ করতেন। তারপর, তিনি চেয়েছিলেন, এবং এ বিষয়ে আমার কাছে প্রস্তাবও করেছিলেন যে আমরা সবাই ‘জন ডো’নামে স্বাক্ষর করব এবং নিচে লেখা থাকবে, ‘বুয়েনস আইরেসের একজন শিল্পি’বাস্তবিকই মেসিদোনিও এ রকম হাস্যকর জাতিয়তাবাদি চেতনায় ভুগতেন। যেমন, তিনি বিশ্বাস করতেন যে উনামুনো তখন থেকেই চিন্তা করতে শুরু করেন যখন জানতে পারেন যে তাঁর রচনা বুয়েনস আইরেসে পাঠ করা হয়। এ এক উদ্ভট ধারণা। তিনি বলতেন— কিন্তু এই যে, আপনি কি মনে করেন পেরেকও আজকাল চিন্তা করতে শুরু করেছে কারণ ওরা জানে যে এখানে আমরা ওদের লেখা পড়ব?
— কিন্তু তিনি তো ব্যাঙ্গার্থেও এ কথা বলতে পারেন?
বোর্হেস : না, না, তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়েই বলতেন। মায়ের কাছে শুনেছি, মেসিদোনিও প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধানেরই খুব তারিফ করতেন কারণ রাষ্ট্রপ্রধানেরা নির্বাচিত হন, এবং নির্বাচনের রায়ে আর্হেন্তিনাবাসিরা কখনো ভুল করতে পারে না। মেসিদোনিও আমাকে বলতেন ইরিগোয়েন বাস্তবিকই একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি। এরপর ইউরিবুরোর বিপ্লবের তিন-চারদিন পরই তাঁকে দেখে মন্তব্য করলেন— ‘বেশ, বৎস, আমার মনে হয় ইরিগোয়েন এক আজব চিড়িয়া।’এখন তিনি আজব হয়ে গেলেন কারণ তাঁকে উৎখাত করা হয়েছে। এরপর মেসিদোনিও ইউরিবুরোর মহাভক্ত হয়ে উঠলেন। কারণ একই— আর্হেন্তিনাবাসিরা কি ভুল করতে পারে? একইভাবে তিনি জনপ্রিয় ভাঁড় পারাভিসিনিকে মনে করতেন এক বিরাট অভিনেতা। জীবনেও মেসিদোনিও তাঁর অভিনয় দেখেননি, কিন্তু যেহেতু তিনি এত জনপ্রিয়…। তিনি মার্তিনেস হুভিরিয়ার লেখা না পড়েই খুব প্রশংসা করতেন। বাজারে হুভিরিয়ারের বইয়ের কাটতি ছিল দারুণ।
— জনসাধারণকে যে কোনো মূল্যে বিশ্বাস করা এক ধরনের রোমান্টিকতা। এ জন্য আর্হেন্তিনার এক সাহিত্য-সমালোচক অ্যান্দারসন ইমবার্ত তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসে মেসিদোনিওকে এক উদ্ভট ব্যক্তিত্ব বলে বর্ণনা করেছেন।
বোর্হেস : হ্যাঁ, তাঁর ক্ষেত্রে আগাগোড়াই একটা উটকো ব্যাপার ছিল। কিন্তু এ রকম তো আরো আছেন— ব্লেক, সুইনবর্ন্। এঁদের দুজনকেই বোধ হয় একই গোত্রে ফেলা যায়, না কি?
— জীবিতাবস্থায় মেসিদোনিওকে খুব একটা আমল দেওয়া হয়নি, এবং তাঁকে উন্মাদ প্রকৃতির বলেই মনে করা হত। কিন্তু এখন তাঁর পুনর্মূল্যায়ন, পুনর্পঠন, এবং নতুন করে সমালোচনা হয়েছে। এবং এখন মেসিদোনিওকে একজন প্রতিভাবান লেখক হিসেবেই গণ্য করা হয়।
বোর্হেস : তা ঠিক, কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর প্রতিভা এমন যা কেবল হাতেগোনা কিছু লেখাতেই দেখা যায়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর লেখা সক্রেতিসের শিক্ষার মতো এক ধরনের প্রভাব ফেলুক।
— কিন্তু আর্হেন্তিনার সাহিত্যে তাঁর প্রভাব তো প্রচণ্ড।
বোর্হেস : আপনি মনে করেন তিনি খুব প্রভাবশালি?
— হ্যাঁ, তাঁর লেখা প্রচুর পাঠ করা হয়, অনুকরণ করা হয়। উপরন্তু আমার বিশ্বাস প্রকাশভঙ্গি এবং চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাবের অনেকাংশই আপনার মাধ্যমেই ছড়িয়েছে। আমি লক্ষ করেছি আর্হেন্তিনায় ফেরার আগে স্পেনে বসে আপনি যা লিখেছেন এবং যে লেখাগুলোকে এখন বরং দুর্বল এবং মুদ্রণের অযোগ্য বলে মনে করেন, সে সব লেখায় কিন্তু এই গুরুর প্রভাব খুব স্পষ্ট। একটু আগেও বোধ হয় আপনি তা জানতেন না।
বোর্হেস : না, কিন্তু প্রভাবের কথা বললে আপনাকে দেখতে হবে আমাদের দু’জনের ওপর উনামুনোর প্রভাব কতখানি তা। অবশ্য আমার মনে হয় না প্রকাশ কৌশলের ব্যাপারে উনামুনো খুব একটা উৎসাহি ছিলেন। তিনি কবিতা সম্পর্কে এমন এক তত্ত্ব পোষণ করতেন যা এখন দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ ভুল। তিনি লিখেছেন ‘সনিদিতো’বা শ্রুতিমধুর শব্দে তাঁর আগ্রহ কম। কিন্তু আমার বিশ্বাস কবিতায় শব্দ খুবই জরুরি, মতাদর্শের চেয়েও জরুরি।
— বেশ, আমার মনে হয় উনামুনোর যুক্তিকে আপনি ভালই খণ্ডন করেছেন।
বোর্হেস : কিন্তু সম্পূর্ণ ব্যাপারটিই স্বতঃপ্রমাণিত। উনামুনোর লেখায় তেমন মতাদর্শও নেই।
— তেমনি পাবেন না প্রচুর শব্দসম্ভারও।
বোর্হেস : হ্যাঁ, কিন্তু এখানে দেখুন, এই চরণে কি সুরও জেগে ওঠেনি? আমার মনে হয় কাব্যে সুরেরও প্রয়োজন রয়েছে। আপনি যদি বলেন : La princesa esta palida en su silla de oro— বেশ সুন্দর একটি চরণ। কিন্তু যদি এভাবে বলেন : en su silla de oro esta palida la princesa— এমন কিছু বেশি ভাব প্রকাশ করতে পারলেন না, না কি?
— হ্যাঁ, সুরের কথা বললে নিঃসন্দেহে প্রথম চরণখানিই শ্রোতাকে আনন্দ দেবে। আমার কাছে একে উনামুনো যেমন বলেছেন, ‘শ্রুতিমধুর শব্দ’, সে রকমই মনে হয়। তবুও আমি মনে করি সুরই সব নয়। কবিতা নিশ্চয়ই এর চেয়েও বেশি কিছু দিতে পারে।
বোর্হেস : ও, অবশ্যই। ‘স্বর্ণাসনে বিষণ্ন রাজকুমারি’র চেয়ে অনেক বেশি কিছু দেয় কবিতা। কিন্তু তা কি ওই ভঙ্গিতে? আমার বিশ্বাস একজন স্পর্শকাতর ব্যক্তি স্প্যানিশ ভাষায় ওই চরণটিকে বেশ শ্রুতিমধুর বলেই মনে করবেন। উপরন্তু মনে হবে যেন চরণটি এক রকমের আবেগজড়িত মুহূর্তের ব্যাখ্যাও দিচ্ছে, যেন এক ধরনের একঘেয়েমি, ফিরে যাবার ব্যাকুলতা বিশ্লেষণ করছে…। সেদিন ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাশে স্টিভেনসন থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছিলাম। তো তখন হঠাৎ মনে হল যে উদ্ধৃত চরণগুলো আমি অনুবাদ করতে পারব না, কেননা তাদের শক্তি নিহিত ছিল এক প্রকার ইস্পাততুল্য অনুরণনের মধ্যে। এ তো আপনি বুঝতে পারেন, নয় কি?
Under the wide and starry sky
Dig the grave and let me lie,
Dig the grave and let me lie,
And I laid me down with a will.

This be the verse you grave for me:
Here he lies where he longed to be!
Home is the sailor, home from sea,
And the hunter home from the hill.
নক্ষত্র খচিত খোলা আকাশের তলে
কবর খনন কর আমি শোব বলে
কবর খনন কর আমি শোব বলে
ইষ্টিপত্র নিয়ে আমি শায়িত এ গোরে।

এ ক’টি চরণে যেন লেখা হয় আমার কবর :

এখানে শায়িত সে যে তারই কাক্সিক্ষত ধূলি ’পর!
নাবিক ফিরেছে গৃহে, সাগর ভ্রমণ শেষে ঘর,
শিকারি এসেছে ফিরে পর্বতাভিযান শেষ করে।
লক্ষ করুন, চরণগুলো ইস্পাতের মতো বাজে। একে স্প্যানিশে অনুবাদ করে দেখুন—Alegre vivi y alegre he muerto (সুখে আমি ছিলাম জীবনে, সুখে মৃত্যুকে পেলাম) — কিছুই হল না। কিন্তু দেখুন—
Glad did I live and gladly die,
And I laid me down with a will…
— ওই সব তীক্ষ্ন শব্দরাজি, ওই সব এক আক্ষরিক পদ, বচন…।

‘আপনার প্রকাশভঙ্গির আলোচনায় ফিরে যাওয়া যাক। প্রাক-মেসিদোনিও এবং মেসিদোনিওর কালে, কিংবা ধরুন যখন আপনি মাদ্রিদে তখন এবং আর্হেন্তিনায় ফেরার পরে আপনার রচনা কৌশলে আমি তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য বৈসাদৃশ্য খুঁজে পাই না। এমনকি, আপনার রস-অভিব্যক্তিতেও নয়। মেসিদোনিও এবং আপনার মধ্যে প্রচুর সাদৃশ্য দেখা যায়।’
বোর্হেস : মেসিদোনিওর ব্যবহৃত বলে কথিত অনেক শব্দ পর্যন্ত আছে যা আমার এক জ্ঞাতিভাই-এর কল্পনাজাত। মেসিদোনিও পরবর্তীকালে সেই সব শব্দ ব্যবহার করেন। কিন্তু এতে দোষের কিছু নেই, কারণ মেসিদোনিওর সংস্পর্শে না এলে আমার জ্ঞাতিভাই ওই শব্দগুলো কল্পনাই করতে পারতেন না। যেমন ধরুন বক্তৃতা-সভা বা কনসার্ট সম্পর্কে সেই বাক্যটি— ‘আসরে এত কম লোক উপস্থিত ছিল যে কোনো অনুপস্থিত ব্যক্তির পক্ষে সভায় ঢোকাই সম্ভব হত না।’
— কিন্তু এ তো গুইলারমো হুয়ানের কথা, মেসিদোনিওর নয়।
বোর্হেস : না, যদি মেসিদোনিওর সঙ্গে গুইলারমো হুয়ানের আলাপ না থাকত, তিনি কখনো ওই বাক্য কল্পনা করতে পারতেন না, এবং সব সময়ই যেমন হয়, বাক্যালাপের একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গি থাকে আর এ ক্ষেত্রে সেই ভঙ্গি মেসিদোনিওই চালু করেন, সতের বছরের একজন বালক নয়।
— আপনি সব সময়ই কোনো-না-কোনোভাবে আগাগোড়া মেসিদোনিওপন্থি ছিলেন, বিশেষ করে লেখার স্টাইলে। আর মতবাদের কথা বলতে গেলে— আপনি যখন স্পেনে, যখন যুবক, জার্মান প্রকাশবাদের প্রভাব কি তখন খুব প্রবলভাবে অনুভব করেননি?
বোর্হেস : হ্যাঁ, সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে আমার মনে হয় প্রকাশবাদই সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অন্যান্য মতবাদ যখন ফ্রান্সে কেবল প্রকরণবাদি কলাকৌশল দেখাতে ব্যস্ত ছিল, তখন প্রকাশবাদ পরাবাস্তববাদের মতো অতিন্দ্রিয়বাদে, ম্যাজিকে এবং ইহুদি কাবালায় উৎসাহ দেখিয়েছে। তাতে এক ধরনের শান্তিবাদও যুক্ত হয়েছিল…। প্রকাশবাদ ছিল মরমিবাদি। অবশ্য আমি এ কথা বলব না যে মেসিদোনিও একে অনুকরণ করেছিলেন। তবে বার্কলে যা চিন্তা করেছেন, শোপেনহাওয়ার এবং হিন্দু দার্শনিকেরা যা ভেবেছেন, মেসিদোনিও সে সবই আবার ভেবে দেখেছেন। কিন্তু তিনি অবশ্যই সেই ধারণা পছন্দ করেননি। একে তিনি স্রেফ পণ্ডিতিপনা বলেই মনে করেছেন।
— কোন ধারণা?
বোর্হেস : অন্যান্য সাহিত্য এবং যুগের ধারণা। তিনি ভাবতেন একজন মানুষ নিজের চেষ্টায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৌঁছতে পারে।
— আর এই বিশ্বাসের ফাঁকে মেসিদোনিও নিজের দর্শনশিক্ষা অবহেলা করলেন। আচ্ছা, তাঁকে কি দর্শনের আদি-মানব বলা যায়? না কি তিনি ছিলেন এক মহান সংস্কৃতির মানুষ যিনি প্রচুর পড়াশোনা করেছেন।
বোর্হেস : না, মেসিদোনিও কিন্তু খুব বেশি লেখাপড়া করেননি। কিন্তু যে ক’টি বই তিনি পড়েছেন সে সব খুব ভাল মতোই পড়েছেন। তিনি বার্কলে, শোপেনহাওয়ার, উইলিয়াম জেমস পড়েন। পরে একসময় আমরা তাঁকে বার্গসঁও পড়তে দেখি। প্রথমে বার্গসঁ পড়তে অনীহা বোধ করেছেন এ জন্য যে আগে তিনি কখনো বার্গসঁ পড়েননি। কিন্তু মেসিদোনিও খুব রাজভক্ত মানুষ ছিলেন। বহু দিন পর্যন্ত তিনি এই মত পোষণ করতেন যে ওয়াল্টার স্কট বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের একজন। সত্যি বলতে স্কট আমাকে কোনো দিনই টানেননি। কিন্তু আমার মনে হয় মেসিদোনিও ওরকম বলতেন কেবল এই কারণে যে ওয়াল্টার স্কট তিনি অপেক্ষাকৃত কম বয়সে পাঠ করেন।
— অথবা হয়ত কেবল এ জন্য যে মার্তিনেস হুভিরিয়ার মতো স্কটও ছিলেন জনপ্রিয় লেখক।
বোর্হেস : এ-ও একটি কারণ, হ্যাঁ, তিনি জনপ্রিয় ছিলেন।

‘আমার বাবার সেই লাইব্রেরিতে আমি প্রচুর গল্প-উপন্যাস পাঠ করি। কিন্তু গল্প আমার প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও বহু দিন পর্যন্ত লেখক হিসেবে গল্পকে গ্রহণ করার ব্যাপারে নিজেকে অযোগ্য মনে করেছি। এরপর আমি এক দুর্ঘটনায় পড়ি এবং একটা সময় আমাকে বহু বিনিদ্র রাত আর দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়। পরে শুনেছি, প্রায় মরতে বসেছিলাম। আমাকে অস্ত্রোপচার করা হয়, এবং যখন হাসপাতাল ত্যাগ করছি তখনো জানতাম না আমার মানসিক ভারসাম্য আবার ফিরে পাব কি না। ইতিমধ্যে আমি অল্প কিছু কবিতা এবং কয়েকশ ক্ষুদ্র সমালোচনা লিখেছিলাম। আমি ভাবলাম— এখন যদি একটা ছোট সমালোচনা লিখতে চেষ্টা করি এবং ব্যর্থ হই তো বুঝব বুদ্ধিগত দিক থেকে আমি ব্যর্থ; অথচ কোনো নতুন আঙ্গিকে লিখতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে তা এমন কিছু খারাপ হবে না। কারণ, আমাকে যে গল্প লিখতেই হবে এমন কোনো কারণ নেই। উপরন্তু এই ব্যর্থতা এই সত্যকেও গ্রহণ করার জন্য আমাকে প্রস্তুত করবে যে আমি আর লিখতে পারব না। এভাবে আমার প্রথম গল্পটির জন্ম হল।

— ১৯৪৫ সালে এক ভাষণে আপনি বলেছিলেন যখন…
বোর্হেস : হ্যাঁ, কিন্তু ১৯৪৫ সালে আমি বোধ হয় আজকের আমি ছিলাম না। সুতরাং তখন কি বলেছি না বলেছি সে জন্য কিন্তু এখন আমাকে দায়ি করা চলবে না। অবশ্য ১৯৪৫-এর বোর্হেসের কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই নিতে এবং তার সঙ্গে একমতও হতে পারি।
— ঠিক এই কথাটিই আপনাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম— অর্থাৎ আপনার বিভিন্ন সত্ত্বার ভেতর সংঘাত। এখন যা বললেন, সেই সময়ও এই কথাটিই বলেছিলেন যে আপনি নিজে অনুভব করেন যেন কখনো বাবার লাইব্রেরি কক্ষ আপনি ত্যাগ করেন না। এবং তখন নিজেকে জিজ্ঞেসও করেছেন— যে সব বই আমি পড়েছি এরপর সে সব থেকে আহরিত, কল্পনাজাল বোনা আর খুলে ফেলা ছাড়া আর কি করতে পারি? তবুও আপনার পরবর্তী ক্রমবিকাশ এ কথাই প্রমাণ করে যে গীতিকবিতায় আপনি বিপুল উৎসাহ নিয়ে, সম্ভবত ১৯২১ সালের চাইতেও বেশি উৎসাহ নিয়ে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
বোর্হেস : এখন আমি যেসব কবিতা লিখি তাদের সঙ্গে বিপ্লবি প্রবণতার কোনই যোগ নেই। এই সব কবিতা আশা করি স্প্যানিশ কাব্যের ধারাতেই রচিত এবং অবশ্যই দারিও ও লুগোনিস, আপনার বাবা ফার্নান্দেস মোরেনো, বাঙ্কস্ এবং অন্যদের সাহিত্যকর্মও একই ঐতিহ্যের আওতায়। সুতরাং আমার মনে হয় না আমি নতুন কিছু করছি। সম্ভবত এর পেছনে শারীরিক কারণটির কথা আমি বলেছি। সত্যি বলতে কি আমি এমন লোক যে নিজের রচনার ব্যাপারে প্রচণ্ড যত্নশিল। সে জন্য বলতে পারেন আমার ঘরে কেবল পাণ্ডুলিপির স্তূপ। কিন্তু গত বার বছর আমি পড়াশোনা করতে পারি না, লিখতে পারি না। এ জন্যও আমার মনে অনেক রচনার পাণ্ডুলিপি জমে আছে। অবশ্য মনে মনে একটা গল্প লিখে ফেলা খুবই কঠিন কাজ। কবিতায় যে ফিরেছি এ-ও তার একটি কারণ। আমি যে সমিল কাব্যে প্রত্যাবর্তন করলাম তার কারণ কেবল এই নয় যে আমার কাছে মুক্ত ছন্দ সমিল ছন্দের চাইতে কঠিন মনে হয়, বরং ছন্দ এবং মিল স্মৃতি সহায়ক বলেই সমিল কাব্যে ফিরলাম। অন্যকথায় বলা যায়, আমি ফ্লোরিডা সড়ক ধরে নামছি, অথবা সুড়ঙ্গ সড়ক বেয়ে আসছি, অথবা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে শান্ত, ভদ্র পরিবেশে বিচরণ করছি, কিংবা বারাকাসের আশেপাশে হাঁটছি— ওই অঞ্চলে বেড়াতে আমার খুব ভাল লাগে কারণ আমি যদি রেল ইস্টিশানের দেয়াল হাতড়ে চলি তা হলে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তার এক ধার থেকে অন্য ধারে যাওয়ার সমস্যা— যা এড়ানো কখনো কখনো অসম্ভব হয়ে পড়ে— তা থেকে মুক্ত হয়ে পথ চলতে পারি। এ জন্য আঙ্গিক বৈচিত্র্যের খোঁজে আমি সনেট রচনায় প্রবৃত্ত হই এবং সম্ভাব্য সব রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করি। আর এই কাজে যখন কমবেশি একটা গ্রহণযোগ্য প্রকরণ রপ্ত করেছি— সাধারণত কমই হয়— তখনই তা শ্রুতিলিখনের জন্য বলে যাই। সপ্তাহখানেক পর আমি আরেকবার তাতে ঘসামাজা করি। এরপর ছাপতে দিই। আমি যা বলতে চাই তা হল একজন প্রায়-অন্ধ ব্যক্তির পক্ষে ছন্দবদ্ধ রচনা সৃষ্টি, বিশেষত যখন তা সমিল, গদ্য রচনার চেয়ে অনেক সহজ। গদ্যের একটা দীর্ঘ অনুচ্ছেদ মনে রাখা অত্যন্ত কঠিন। অথচ কবিতার চরণ খুব সরল, বিশেষ করে কেউ যখন বিষয়বস্তু রপ্ত করে নিজেই রচনা করছে। তবুও আমার মনে হয় বর্তমান দৃষ্টিশক্তির দুর্বলতা না এলেও, এই প্রায়ান্ধ অবস্থা না হলেও, আমি কোনো-না-কোনো ভাবে সমিল কাব্যচর্চায় প্রবৃত্ত হতাম কারণ সমিল কবিতা আমার কাছে বেশি কাজের মনে হয়। অবশ্য এ দ্বারা এ কথা বোঝায় না যে মুক্তছন্দ আমি একেবারে খারিজ করে দিচ্ছি। আমার মনে হয় কেবল ভিন্ন এক আঙ্গিকে সাধারণ গদ্যের চেয়ে বেশি কিছু হতে গেলে মুক্তছন্দ সৃষ্টিতে প্রয়োজন একজন স্তোত্রকারের কি একজন ওয়াল্ট হুইটম্যানের তাগিদ। এ জন্য আমি মুক্তছন্দে খুব বেশি কবিতা লিখি না। যেটুকু লিখি তা বহু আশংকা নিয়ে, পরিণতি সম্পর্কে খুব একটা বিশ্বাস না রেখেই। অন্যদিকে, সমিল কাব্য রচয়িতা আঙ্গিকের নিরীক্ষায় প্রায় বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। উপরন্তু যখন তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন, যখন কোনো একটি চরণ সম্পূর্ণ হয়েছে, তখন আপনাকে তা আপনিই পরবর্তী চরণে নিয়ে যাবে যার সঙ্গে প্রথম চরণের মিল। আর যেহেতু মিলের সম্ভাবনা অসীম নয়, সে জন্য কাজটিও সহজ হয়ে পড়ে, বিশেষ করে যখন এই ব্যাপারে আপনি কিছুটা দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও অর্জন করেছেন।
— সমিল কাব্যে ফিরে আসা প্রসঙ্গে আপনার দৈহিক অসুবিধা এবং আপনার আরোপিত সমিল কাব্যের বাস্তব সুবিধাগুলো আলোচনার মাধ্যমে আপনি নিজের সঙ্গত এবং প্রায় অজেয় বিনয় দ্বারা আমাদের একটি চমৎকার কৈফিয়ত দিয়েছেন। কিন্তু এরপরও এমন ধারণা আমরা কেন পোষণ করতে পারি না যে আপনি গীতিকবিতায় ফিরলেন কারণ জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজেকে আপনি একজন ব্যক্তি হিসেবে প্রকাশ করার গভীর প্রয়োজন অনুভব করেন এবং সাহিত্যকর্মে নিজেকে জীবন্ত ও অনুরণিত দেখাতে চান— যা মনে হয় আপনার প্রবন্ধ এবং গল্পে সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি আমরা পাঠকেরা আপনার লেখা থেকে এ ধরনের অনুভূতিই পেয়ে থাকি। আপনার সাম্প্রতিককালের লেখা সনেটে এবং তাদের দুর্বল কাঠামোর আড়ালে বোর্হেসের ব্যক্তিসত্তা বেশ স্পষ্ট। অথচ এতকাল আপনার বিভিন্ন লেখার শাব্দিক জৌলুসের নিচে এই ব্যক্তি বোর্হেস কোনো-না-কোনো প্রকারে চাপা ছিল।
বোর্হেস : বেশ, আপনার উদার ব্যাখ্যার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
— এ তো ব্যাখ্যা নয়, বোর্হেস, একটা অনুভূতি।
বোর্হেস : যাই হোক, কিন্তু কেন জানি না আমি অবাস্তব গল্প লেখা ছেড়ে দিয়েছি। বদলে সচেষ্ট হয়েছি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে। অর্থাৎ সেই সব অভিজ্ঞতা কবিতায় যেভাবে বর্ণনা করা যায় কেবল সেভাবেই, তার মানে বাচালতাও নয় আবার গুরুগম্ভীরও নয়। আর এতে যদি সাফল্য আসে তো ভাল। কারণ এখন চোখের সামনে দেখছি সম্ভাব্য এক দীর্ঘ কবিতার সারি। এই সব কবিতার সব কটিই খুব আন্তরিক, এমনকি আপাত সত্য যোগ এবং চাঁচাছোলা সত্য বিয়োজনের জন্য তাতে উপযুক্ত পরিবেশও সৃষ্টি করা যেতে পারে।
সম্প্রতি এক গল্প লিখেছি (এই গল্প এল্ এ্যালেফের এক সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে, নাম— ‘অবাঞ্ছিত’)। অন্যান্য গল্পের চেয়ে এটা লিখে আমি বেশি তৃপ্ত। গত শতাব্দির শেষ ভাগের কোনো অনির্দিষ্ট তারিখে বুয়েনস্ আইরেসের পঞ্চাশ মাইল দূরের একটি ছোট্ট শহরের ঘটনা নিয়েই এই গল্প। একটি পুরোনো কাহিনি বেছে নিলাম কারণ এর আগে আমি অনেক সাহিত্যিক বন্ধুকে বলেছি যে সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে কখনো লেখা উচিত নয়। যদি কেউ লেখেন তো তাঁর সমকালিন লোকজন সঙ্গে-সঙ্গে ছিদ্রান্বেষণে বার হবে। যেমন হয়ত তারা বলবে ওই ধরনের লোক যারা ওই সব মদের দোকানে যাতায়াত করে, কি ওই সব রাস্তাঘাটে চলাফেরা করে তারা ঠিক ওভাবে কথা বলে না। কিছুদিন আগে এক যুবকের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি সুইপাকা এবং জাংকালের একটি নির্দিষ্ট চায়ের দোকানের পরিবেশ হুবহু ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আমি সাবধান করে দিয়ে বললাম যে লোকে কিন্তু এসে বলতে শুরু করবে : ‘কি তাজ্জব ব্যাপার মশায়, বলুন তো শহরের ওই অংশে কস্মিনকালেও কেউ ও ভাবে কথা বলে?’ অন্যদিকে আমার ওই গল্পে আমি বলেছি যে ঘটনাটা ঘটেছিল তার্দেরায়। গল্পের কাহিনি আমি এমন এক মরা-অতীতে স্থাপন করেছি যা এই শতকের শুরুও হতে পারে, আবার গত শতকের শেষও হতে পারে। আর যেহেতু কেউ জানে না, অবশ্য আমি নিজেও জানি না, তখনকার লোকজন কেমন ছিল, সে জন্য লেখকের পক্ষে অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কাহিনি বর্ণনা করা সম্ভব।
— যাই হোক, এই বক্তব্যে মনে হয় না কেউ কোনো ছিদ্র খুঁজে পাবে।
বোর্হেস : না, কিন্তু লেখক যদি দ্বীপের অধিবাসিদের নিয়ে কোনো উপন্যাস লিখতে চান অন্যদের পক্ষে সহজেই তাতে ভুল আবিষ্কার করা সম্ভব। ‘দন্ সেগান্দো সমব্রার’মধ্যে ছিদ্রান্বেষণে এক ধরনের ভদ্রলোক তাঁদের সমস্ত সময় উৎসর্গ করেছেন। যেমন বলা যায়, অমুকের পক্ষে দোকানে ঢুকে এক ‘গাদা’ সিগ্রেট চাওয়াটা বোকামি। কিন্তু আসলে তো ব্যাপারটা সত্যিও হতে পারে, কেননা ছেলেবেলায় আমি নিজেও একজনকে এক ‘বান্ডিল’সিগ্রেট চাইতে শুনেছিলাম। কিন্তু তাতে কি?
কিপলিং সম্পর্কে এক ইংরেজ লেখকের একটি মজার উক্তি মনে পড়ছে। উক্তিটা এ রকম : ‘তিনি হচ্ছেন একজন খাঁটি ইংরেজ সৈনিক (অবশ্যই মৃত সৈনিক)…।’স্বাভাবিকভাবেই, যেমন কোনো নির্ভেজাল ‘গউকো’বা আমেরিন্ডিয়ান কাউবয় নেই, তেমনি নেই কোনো খাঁটি ইংরেজ সেপাই। কিন্তু অমুক স্থানে বসবাসকারি জনাব অমুক তো আছেন। শ্রীমতি অমুক হলেন একজন খাঁটি সামাজিক মহিলা। হ্যাঁ, তিনি তা হতে পারেন বটে। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের খোঁজ নিতে গেলে দেখা যাবে যে তিনিও একজন পুরনারী নন। বরং অমুক অমুক স্থানে বেড়িয়েছেন এমন একজন সাধারণ অমুক, অন্য কোনো মহিলার বোন, কারো আবার জ্ঞাতি-ভগিনি। আমি বুঝতে পাচ্ছি ক্রমেই আমরা আরিস্তোতল এবং প্লেতোর তর্কের দিকে এগোচ্ছি— প্রতিক সত্য, নাকি কেবল ব্যক্তিই?
— কোন আঙ্গিকে আপনি বেশি আরাম বোধ করেন? গল্পে কি?
বোর্হেস : আর কিছু সনেটে। আমার বিশ্বাস স্পিনোজার ওপর লেখা আমার একটি সনেট একেবারে খারাপ হয়নি। আর একটি কবিতাও— নাম ‘দানের কাব্য’— অন্ধত্ব নিয়ে লেখা। এ ছাড়া আমার অন্য আরো কিছু রচনা আছে যেগুলোকে আমি বিশেষ মূল্য দিইনি, তবুও তো মানুষের যতটুকু সাধ্য তা সে করে থাকে। সাম্প্রতিক প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ‘প্রাচীর ও পুস্তক’ নামের রচনাটিকে আমার বেশ ভাল মনে হয়। এক চিন সম্রাটের ওপর লেখা এই প্রবন্ধ। সেই সম্রাট একই সঙ্গে চিনের প্রাচীর নির্মাণ করতে এবং অতীত মুছে ফেলার জন্য সমস্ত বইপুস্তক পোড়াতে চেয়েছিলেন।
আসল কথা হল, একজন লেখকের সমগ্র সাহিত্যকর্মের মাত্র চার কি পাঁচ পৃষ্ঠাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। তাই কারো সাহিত্যসংগ্রহ সেই লেখকের মহা-উপকার করে। কোনো পাঠক যখন একজন লেখকের সাহিত্যসমগ্র পাঠ করেন তখন তার কাছে সাধারণত লেখকের বিশেষ কিছু বলার থাকে না, আর পাঠকও উপলব্ধি করেন যে কয়েকটি পাতায় যা সুন্দর করে বলা হয়েছে, হায় রে, অন্য পাতায় সে সবেরই পুনরাবৃত্তি।
এখন থেকে আমি বেশ কিছু বাস্তবভিত্তিক গল্প লিখব বলে ঠিক করেছি।
— বাস্তবভিত্তিক?
বোর্হেস : হ্যাঁ। গোলকধাঁধায় আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আর আয়নায়, শ্বাপদে, কিংবা ওই ধরনের যাবতিয় কিছুর উপমায়— বিশেষত অন্যরাও যখন ওই সব উপমা ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
— আপনি সম্ভবত এই সব ‘অন্যদের’ নিয়েই বেশি পরিশ্রান্ত হয়েছেন।
বোর্হেস : অনুকরণকারিদের ওই এক মস্ত সুবিধা। ওরা একজন লেখকের যতগুলো সাহিত্যিক দোষ থাকে তার অন্তত একটি স্খালন করে। কারণ, সাহিত্যিক তখন ভাবেন, অনেকেই তো আজকাল ওই সব নিয়ে লিখছেন। অতএব ও সবের আর দরকার নেই। অন্যরা সেগুলো নিয়ে লিখতে থাকুক, আমি এখন কেঁদে বাঁচি।
— বাস্তবতায় প্রবেশ আপনার বেশ একটা সুন্দর প্রয়াস বলেই মনে হয়। কিন্তু ‘অবাঞ্ছিত’ গল্পটির ক্ষেত্রে আপনি এই ব্যাপারে কিন্তু খুব একটা সত্য পথে নেই। কারণ, গল্পটির কাহিনি আপনি ঘটিয়েছেন তার্দেরায়, আর সময়ও বেছে নিয়েছেন এমন যা সম্পর্কে আপনি নিজেও জানেন না। তাই বলি কি, চরিত্রগুলো বাস্তব হলেও গল্পটি কিন্তু অবাস্তব।
বোর্হেস : কিন্তু আমার তো মনে হয় ওই সব চরিত্র আমি রীতিমতো অনুভব করি। উপরন্তু এই গল্পের চরিত্রগুলো গুণ্ডাপাণ্ডা হওয়া সত্ত্বেও ওতে আপনি একটিও সংঘাতের ঘটনা, কি শক্তি প্রদর্শনের কাহিনি, কি ‘দৃশ্য বর্ণনা’পাবেন না। লম্পটদের নিয়ে এমন একটি গল্প লিখে আমি বাস্তবিকই তৃপ্ত। সত্যি বলতে, গল্পটি ‘লাল মোড়ের মানুষ’নামের গল্পটির একেবারে বিপরিত। ওই গল্প আমার ভীষণ অপছন্দ।
— সমুদ্র নিয়ে লেখা আপনার প্রথম কবিতায় যেমন, হয়ত ‘লাল মোড়ের মানুষ’গল্পেও আমরা একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি। যতদূর জানি, এটাই আপনার প্রথম গল্প।
বোর্হেস : তা ঠিক। ওই গল্প আমার খুব পরিকল্পিত রচনা। Milonga de Albornoz কবিতার প্রথম সংস্করণে— প্রথম সংস্করণ একটা হয়েছিল বটে— তো আপনি লক্ষ করবেন ওতে আমি প্রচুর আঞ্চলিক রঙ চড়িয়েছি। লিখেছি— কেমন লাগে দেখুন তো?

en el bajo del Retir
ya la han perdido la cuenta
de amores y de trucadas
hasta el alba y de entreveros
a fierro con los sargentos,
con sureros y norteros.
রেতিরো নদীর তীরে
বহুকাল হল তারা
ভুলে গেছে তার ভালবাসা, আর
প্রভাত পর্যন্ত চলা জুয়া আর
উত্তর ও দক্ষিণ পাড়ার গুণ্ডাপাণ্ডা নিয়ে
ছোরা ও বিতর্কে জমা তাসের মহড়া।
হতে পারে sureros y norteros বেশ পুরোনো শব্দ। বুয়েনস আইরেসে এখন আর কেউ sureros অথবা norteros নিয়ে আলোচনা করে না। সে জন্য একে পাল্টিয়ে লিখলাম con propios y forasteros— তার নিজের এবং প্রতিদ্বন্দ্বি দলবল নিয়ে।
বাহ্, এই তো অনেক বেশি স্বাভাবিক শোনাচ্ছে। sureros y norteros আপনার বর্ণিত একদিনের ঘটনার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। একদিন আপনি বলছিলেন যে প্রথমদিকের কবিতাগুলো লেখার জন্য আপনি আঞ্চলিক শব্দের একটি ডিকশনারি কিনেছেন।
বোর্হেস : আর্হেন্তিনার আঞ্চলিক শব্দের ডিকশনারি, হ্যাঁ, সত্যি। ছেলেবেলায় মানুষকে sureros এবং norteros জাতিয় শব্দ ব্যবহার করতে শুনেছি। কিন্তু এখন আর ওভাবে কেউ বলে না। বদলে আমার মনে হয় non propios y forasteros জাতিয় কথায় বাক্যের প্রাঞ্জলতা আসে বেশি। অথচ sureros norteros আপনাকে মুহূর্তের জন্য হলেও হোঁচট খাওয়ায়। তখন ব্যাপারটি বোঝার জন্য আপনাকে কসরত করতে হয় এবং ভাবতে হয় ওই শব্দগুলো বুয়েনস আইরেসের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলেরও বটে। একে রীতিমত চিন্তা করে বার করতে হয়, কিন্তু আমার নতুন ব্যবহারে বোধ হয় তেমনটি করতে হয় না।
— আমার তো মনে হয় সহজিকরণ এবং স্বচ্ছলতার ওই এক পথ, এবং এই পথ সব লেখকই জীবনের কোনো এক পর্যায়ে গ্রহণ করেন। আচ্ছা, আপনি যে সব কবিতা ভালবাসেন তার মধ্যে কি কোনওক্রমে আপনার বহুল পঠিত ‘বুয়েনস আইরেসের পৌরাণিক আবিষ্কার’কবিতাটিও আছে?
বোর্হেস : না, না ওটা একটা বাজে কবিতা।
— বাজে তো নয়ই, বরং খুব উন্নতমানের বলুন।
বোর্হেস : উন্নতমানের? বলেন কি? ওটা সত্যি একটি অতিশয় পাতানো কবিতা।
— কবিতাটি একটি ধারণাকে ঘিরে রচিত, এবং তা একটি আদর্শ বুয়েনস আইরেস্কেই প্রকাশ করে, কল্পলোকের বুয়েনস আইরেস্। কিন্তু তবুও সেই মূল—
বোর্হেস : আপনার কথা আমিই শেষ করে দিচ্ছি চেস্টারটনের একটা উদ্ধৃতি দিয়ে : ‘আমি সারাজীবন কাটিয়ে দিলাম অন্যেরা ঠিক— এই দেখে দেখে।’ ব্যাপারটা নেহায়েৎ মন্দ নয়, আর খুব বাহাদুরিরও বটে, না কি বলেন?
— সত্যি, আত্মশুদ্ধির এই এক উপায়।
বোর্হেস : কিন্তু দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়, লুগোনিস কখনো ও রকম বলতেন না।
— ঠিক, তিনি কখনোই ও কথা বলতেন না। এমনকি বলা যায়, যেন না বলতে হয় সে জন্যই লুগোনিস আত্মহত্যা করেছিলেন।
বোর্হেস : হ্যাঁ, তা সত্যি। লুগোনিস ছিলেন ভয়ানক অহংকারি।
— আংগিক প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ করার আগে আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি কখনো গল্পের বদলে উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছিলেন, কিংবা কখনো ইচ্ছা হয়েছিল?
বোর্হেস : না কখনোই নয়।
— কেন?
বোর্হেস : কারণ আমি পারিনি। আমি ভয়ানক অলস। স্বাভাবিকভাবেই একটি উপন্যাসে মেলা মালমসলা ভরতে হয়। আমার লেখার মাত্র তিন পাতাতেই যদি সব পূর্তি ঘটে যায়, তাহলে তিনশ পৃষ্ঠা তো সেই সবেই ঠাসা হবে। স্টিভেনসনকে আমি সবসময়ই উদ্ধৃত করি। তো তিনি বলতেন অলংকার সব সময় প্রয়োজনের সঙ্গে মিশে যাবে। অথবা যাকে বলে সংযোগকারি কৌশল— তার আদর্শ হবে বাকি অংশের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। আচ্ছা এভাবে বলা যাক, ধরুন আপনার দু’টি প্রয়োজনীয় দৃশ্য এবং দু’টি প্রয়োজনীয় পরিচ্ছেদ আছে। এদের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করার জন্য আপনার আরো পরিচ্ছেদ দরকার। আদর্শগতভাবে কোনটি সংযোগসূত্র তা আপনি বলতে পারবেন না। ব্যাপারটা খুবই জটিল। আর যত দীর্ঘ এই কাজ, ততই তার জটিলতা।
— আদর্শগতভাবে, সব কিছুরই তখন দরকার হবে।
বোর্হেস : সব কিছুরই দরকার, হ্যাঁ। উপরন্তু এখন আমার দৃষ্টি-সমস্যাও একটি ব্যাপার। আমার পাণ্ডুলিপি শ্রুতিলিখিত। তাই আমি সাধারণত ছোটখাটো লেখাই লিখি।
— কিছুকাল আগে হলে হয়ত আপনি উপন্যাস লিখতে পারতেন।
বোর্হেস : আসলে উপন্যাস আমাকে কখনোই গল্পের মতো টানেনি। যেমন ধরুন লেখক হিসেবে কিপলিংকে আমার খুব পছন্দ। তাঁর উপন্যাসের চেয়ে গল্পই আমার বেশি ভাল লাগে। কিন্তু এ দ্বারা আমি এ কথা বলি না যে ‘কিহু’তের চেয়ে সার্ভেন্তেসের গল্পই আমার বেশি পছন্দ। না, অতখানি উন্মাদ আমি নই। যাই হোক, উপন্যাস হল এমন এক ধরনের আঙ্গিক যা মরে যেতে পারে, নিঃসন্দেহে মরে যাবে। কিন্তু গল্পের ব্যাপারে আমার সে রকম মনে হয় না।
-কেন?
বোর্হেস : গল্পের ধারা খুব প্রাচীন।
— গল্প কি বেশি দরকারি, বেশি মানবিক, বেশি প্রয়োজনিয়?
বোর্হেস : এত সত্ত্বেও গল্প লেখা যদি থেমেও যায় তো গল্প বলা কিন্তু কখনোই থামবে না। উপন্যাস দ্বিতীয়বার বলা যায় বলে আমার মনে হয় না, আপনার? আচ্ছা, ভাল উপন্যাসের দৃষ্টান্ত হিসেবে না হয় ‘কিহু’তেকেই ধরি। ‘কিহু’তে ভীষণ পাঠযোগ্য। সত্যি বলতে কি বার বার এই বই পড়া চলে। কিন্তু মুখে মুখে একে বর্ণনা করা যায় বলে কখনো শুনিনি। মুখে বলার চেষ্টা করা বরং বোকামিই হবে। কিংবা ধরা যাক ‘কিহু’তে পড়ে কেউ খুব উৎসাহের বশে এ সম্পর্কে বলতে এল। আমার মনে হয় না সে কিছু বলতে পারবে। যেটুকু সে বলতে পারবে তা হবে খুব নিুমানের— শোনাবে প্রায় একটা গোয়েন্দা কাহিনির মতো।
— তাহলে আপনার ধারণা এই যে গল্পকে মুখে মুখে বলা চলে? কিছুক্ষণ আগেই আপনি ‘অবাঞ্ছিত’গল্পটি সম্পর্কে বলেছেন। আমি অবশ্য এই গল্প এখনো পড়িনি। কিন্তু আপনার বলার পরও ‘অবাঞ্ছিত’সম্পর্কে আমার ধারণা এত অস্পষ্ট যেন আপনি আমাকে ‘দন কিহু’তের কাহিনি শুনিয়েছেন।
বোর্হেস : সত্যি বলতে গল্পটির কিছুই আপনাকে বলা হয়নি। কিন্তু মনে হয় বলতে চাইলে আমি ঠিকই পারতাম। যেটুকু আপনাকে বলেছি তা খুবই সংক্ষেপে। এককালে যেমন মনে করা হত যে মহাকাব্যের রচয়িতা, কি পাঁচ অংকের নাটকের লেখক অন্যান্য আঙ্গিকের লেখকের চেয়ে সেরা, তেমনি আজকাল ঔপন্যাসিকদের সম্পর্কে সে রকম মনে করা হচ্ছে…।
— প্রসঙ্গত আপনার প্রভাব এবং আপনার অনুকরণকারিদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি— অন্যের ওপর আপনার মূল প্রভাব কোনটি বলে মনে করেন, বিষয়বস্তু না শৈলি?
বোর্হেস : আমার রচনাশৈলি। আমার বাতিকগ্রস্ত কাহিনি ও চরিত্র।
— চমক-লাগানো?
বোর্হেস : জাঁ ককতো হলে বলতেন tics বা খিঁচুনিগুলো।
— ওগুলো যা অবধারিত সে দিকেই তো নিয়ে যায়।
বোর্হেস : লুগোনিসের অনুকরণকারিদের বেলাতেও এটা ঘটেছিল। এরপর তাদের ভাগ্যে যা ঘটে— ওরা নিজেদের প্যারডি করেই শেষ হয়ে যায়।
— ওরা পরস্পরের অনুকরণ করেও শেষ হয়।
বোর্হেস : আর যেহেতু এ ব্যাপারে কোনো রাখঢাক করে না, সে জন্য শেষে ওরা নিজেদেরই প্যারডি করতে থাকে।
— আপনার রচনাশৈলি অত্যন্ত প্রভাবশালি। আমার বিশ্বাস আর্হেন্তিনার প্রতিটি লেখক, এমনকি যাঁরা আপনার প্রতিপক্ষ, তাঁরাও আপনার কাছ থেকে শেখা কৌশলেই লিখে থাকেন। এই কৌশল প্রতিষ্ঠিত অসঙ্গতি ও মিতব্যয়িতার ওপর। আপনি নিজেই তো বলেছেন যে প্রথমে আপনি খুব ‘মৌলিক’ও আঞ্চলিক রঙ চড়ানো লেখা লিখতেন। এরপর sureros y norteros জাতিয় কথাকে propios y forasteros দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে আরম্ভ করলেন। এই কৌশল একেবারেই বাহুল্যবর্জিত, এবং রক্ষণশিলতা আর ভাবাবেগের সংযমের জন্য একেবারে খাঁটি আর্জেন্টিনার জিনিস।
বোর্হেস : একটা কিছু লেখার পরই ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম। ওই সব শব্দের জন্যই তখন আর তা ফিরে দেখতে, কি উচ্চকণ্ঠে পাঠ করতে সাহস হত না। তখন বুঝলাম যে ওইভাবে তো লেখা চলবে না।
— এমার্সনকে নিয়ে লেখা একটি সনেটে মনে হয় আপনি তাঁকে এমন একজন মানুষ হিসেবে বুঝতে চেয়েছেন যিনি প্রকাশে ছিলেন অক্ষম, কেননা শেষে আপনি তাঁকে দিয়ে বলিয়েছেন : ‘আমার জীবন আমি যাপন করিনি, আমি বরাবর হতে চেয়েছি অন্য কেউ।’
বোর্হেস : আমি তখন এমার্সনের Days কবিতাটি নিয়ে ভাবছিলাম। সেই কবিতায় তিনি বলছেন দিনগুলো তাঁর সামনে ঘোমটা-দেওয়া মেয়েদের মতো সার বেঁধে বসে আছে এবং তাঁকে সব কিছু দিতে চাইছে, একেবারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড দান করছে। কিন্তু তিনি কেবল কিছু খড়কুটো আর এক ফোঁটা জল গ্রহণ করলেন। এরপর দিনগুলো উধাও হল এবং তিনি আলো দেখতে পেলেন। একই বিষয়ের ওপর লেখা ইয়েট্সের একটি কবিতার সঙ্গে এর মিল দেখতে পাই। ওই কবিতায় ইয়েটস্ও এত কম বাঁচার জন্য এবং এত কম অভিজ্ঞতায় এত বেশি সাহিত্য নিয়ে তৃপ্ত হওয়ায় দুঃখ করেছেন।
— আচ্ছা, ব্যাপারটা কি জীবন এবং সাহিত্যের বিরোধ? কিন্তু তাহলে তো অনেকেই এ রকম বিরোধ অস্বীকার করেন এবং বলেন যে জীবন শিল্পকলার সঙ্গে একাত্ম।
বোর্হেস : সাধারণভাবে আমি মনে করি সাহিত্য এবং বাস্তবতা পরস্পর বিচ্ছিন্ন— এমন ধারণা করা ঠিক নয়। সম্প্রতি আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাস্তবতার প্রতি কবির দায়িত্ব আছে কি না। তো উত্তরে বলেছিলাম দুর্ভাগ্যক্রমে কবি নিজেও তো বাস্তব, সুতরাং কবির নিজের স্বপ্ন এবং কল্পনাও বাস্তবতারই অংশ। এ প্রসঙ্গে ছোট কিন্তু খুব প্রয়োজনিয় একটি বইয়ের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। বইটি আমি কয়েকবার পড়েছি— ফ্লবেয়ারের সালাম্বো। আমার মনে আছে ফ্লবেয়ার এর একটি উপন্যাস দিয়েছিলেন, ‘কার্থেজের উপাখ্যান’। তিনি কার্থেজে যান এবং বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেন। এর ওপর সম্ভাব্য সব ধরনের বই পড়েন, জার্মান পণ্ডিত ফ্রেনারের সঙ্গে বিতর্কে নামেন, জয়ী হন এবং তারপর ওই বিখ্যাত বইটি লেখেন। উপন্যাসটি কার্থেজের পিউনিক যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে লেখা। এর চরিত্রগুলোও সব কার্থেজেরই লোকজন। কিন্তু বইটি কেবল ঊনবিংশ শতাব্দির ফ্রান্সেই লেখা সম্ভব ছিল। এই উপন্যাস সেই যুগের বাস্তবতার এবং সেই সংস্কৃতিরই কিছুটা প্রকাশ করছে। এ জন্য আমি মনে করি না একজন কবির বাস্তবানুগ হওয়া কিংবা বাস্তবতা পরিহার করে চলার কোনো প্রয়োজন আছে। বাস্তবতা পছন্দ করি বা না করি, আমরা সবসময় বাস্তবতায় একেবারে জবজবে (শব্দটা অশালিন হয়ে গেল, কিন্তু উপায় কি, এই মুহূর্তে অন্য কোনো শব্দ মনে আসছে না) হয়ে আছি। আমরা হলাম বাস্তবতার একটি অংশ এবং বাস্তব ও সমকালিন না হয়ে তো আমাদের গত্যন্তর নেই। আমরা অমুক কি তমুক শতকের মানুষ— এ ধরনের কথার তেমন ভিন্ন অর্থ নেই। যেমন একজন খুনির অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলা যায়— খুন করতে কেমন লাগে? দস্তয়েভস্কি যখন অপরাধ ও শাস্তি নামের বই লেখেন— খুবই বাস্তবভিত্তিক বা বাস্তবতাধর্মী উপন্যাস, তখন শেক্সপিয়র লেখেন কিংবা বলা যায় পুনরুদ্ভব করেন ম্যাকবেথ এবং তিন ডাইনি বা বিধিত্রয়ির কাহিনি। দু’টো রাস্তাই কিন্তু সমান সচল। আমার মনে হয় দুজনেই এক খুনির বিবেকে ঢুকতে পেরেছেন— একজন সেই খুনিকে সমকালিন হিসেবে কল্পনা করে, অন্যজন স্কটল্যাণ্ডের এক ঐতিহাসিক কাহিনি অবলম্বন করে। অন্যভাবে বলা যায়, আমরা যে সব প্রতিক ব্যবহার করি তার প্রয়োজন খুবই কম। প্রয়োজন যা তাহল ওই প্রতিকগুলোকে আবেগ দিয়ে ভরানো এবং পাঠকেরও নিজের আবেগ দিয়ে ওদের পূরণ করে লেখকের সঙ্গে সহযোগিতা করা।
— আপনি এখন কি লিখছেন?
বোর্হেস : কয়েকটি গল্প লিখব ভাবছি। দেখা যাক, ‘অবাঞ্ছিত’জাতিয় গল্প, গুল্ডাপাণ্ডাদের নিয়ে আরো কিছু গল্প যদি লিখতে পারি।
— তাহলে বাস্তব গল্প লেখার মতে আপনি অবিচল।
বোর্হেস : আমি ‘অবাঞ্ছিত’ লিখেছিলাম কারণ তখন আমি কিপলিং-এর প্রথম দিককার গল্পগুলোর কথা ভাবছিলাম, শেষেরগুলোর কথা নয়। শেষের গল্পগুলো ভীষণ জটিল এবং আমার সাধ্যের বাইরে। আমার মনে ছিল কিপলিং-এর প্রথম গল্পগুলো যেগুলো তিনি জীবনের দ্বিতীয় দশকে রচনা করেন। আমি চিন্তা করে দেখলাম— আমাদের দেশের লোকদের যদি গল্পে ওইভাবে আনতে পারি তাহলে চার-পাঁচ পাতার কিছু গল্প আমি লিখতে পারব। তখন মোঁপাসার কথাও মনে হল এবং তাঁর কয়েকটি গল্প পড়লাম। এইভাবে আমি এঁদের পথেই কিছু একটা করার চেষ্টায় এগোচ্ছি। এঁদের পথে বলতে আমি আঙ্গিকই বোঝাতে চাই, বিষয়বস্তু নয়।
— যা কি না ক্রমেই খুব আঞ্চলিক হয়ে পড়ছে।
বোর্হেস : কিপলিং ভারত নিয়ে লিখেছেন, মোঁপাসা লিখেছেন নরম্যান্ডি এবং প্যারিস নিয়ে। পালার্মো এবং তার্দেরা নিয়ে লেখা আমার গল্পগুলো খুব একটা একই রকম হচ্ছে না, না কি?

বর্ষ ৩, সংখ্যা ৫, ফেব্রুয়ারি ২০০৪

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার