হোসে দোনোসোর সাক্ষাৎকার || গ্রহণে— ফের্নান্দো আইনসা || ভাষান্তর : আসমা চৌধুরী

0

[চিলির লেখক হোসে দোনোসো লাতিন আমেরিকার শীর্ষস্থানিয় ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম। ১৯২৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ইংরেজি সাহিত্যে শিক্ষকতা এবং বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত স্পেনে বসবাস করেন, অতঃপর ফিরে আসেন চিলিতে। তাঁর লেখা অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর ইংরেজিতে অনূদিত লেখাগুলোর মধ্যে রয়েছে The Obscene Bird of Night (1979), A House in the Country (1984) এবং The Garden Next Door (1992)। বর্তমান সাক্ষাৎকারে তিনি সমাজে লেখকের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ফের্নান্দো আইনসা। ২০০১ সালের ৭ ডিসেম্বর ৭২ বছর বয়সে চিলির রাজধানি সান্তিয়াগোতে মারা যান তিনি।]

আইনসা : ষাটের দশকে লাতিন আমেরিকায় উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে ‘বিস্ফোরণকালে’ সমালোচক পাঠক উভয়ের মনে উপন্যাসগুলো যে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল বর্তমানে তা আর নেই, যদিও ওই সময়ের শীর্ষস্থানিয় লেখক যেমন, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, কার্লোস ফুয়েন্তেস, মারিয়া ভার্গাস য়োসা এবং আপনি নিজেও এখনও নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন এবং লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশেই একঝাঁক লেখক তৈরি হয়েছে।

হোসে : একদিকে ষাটের দশকের বিস্ফোরণকে ঘিরে স্পষ্ট কুরুচিপূর্ণ ও বাণিজ্যিক প্রবণতা এবং অন্যদিক থেকে তৎকালিন লেখকদের মধ্যে বিরাজমান ‘সামগ্রিক’ উপন্যাস রচনার মহাকাঙ্ক্ষার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রচনা করা দরকার। আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ (Historia personal del ‘boom’, 1972)-এ এর ধ্বংসাত্মক বাণিজ্যিক দিকটির নিন্দা করছি। তবে একথা নিশ্চিত যে, সমাজের জন্য এক ধরনের ব্যাপক নীলনকশা সৃষ্টির যে স্বপ্ন ষাট ও সত্তর দশকের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জীবনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল তা লাতিন আমেরিকান ঔপন্যাসিকেরা বিগত দশকে পরিত্যাগ করেছেন। ওই নীলনকশাগুলো ছিল এক মহাবৈশ্বিক আদর্শবাদের আঞ্চলিক অঙ্গ। এ আদর্শবাদ এক চিরন্তন, সার্বজনীন ও বৈপ্লবিক সমাধানের প্রস্তাব দেয় এবং তা মননের ক্ষমতার ওপর প্রশ্নাতীত বিশ্বাস থেকে উদ্ভূত।
লাতিন আমেরিকার সেই সময়কালকে ওই মহাদেশের সাহিত্যিক ঐক্য বিষয়ে ‘বলিভিয়’ স্বপ্ন দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। একই সঙ্গে প্রতিটি উপন্যাসের তখন লক্ষ্য ছিল জ্ঞানের বিশ্বকোষিয় সংযোজনের মাধ্যমে একটি সাহিত্যিক ‘অতি প্রয়োজন’ হয়ে ওঠা। ১৯৮০’র দশকে এবং বিশেষত বর্তমান দশকে ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক উল্টো। আমাকেসহ আমার প্রজন্মের লেখকেরা জীবন সম্পর্কে যে ধ্রুব ও সর্বব্যাপি দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে ব্যস্ত ছিলেন তা এ প্রজন্মের উপন্যাসে পরিত্যক্ত হয়েছে।

আইনসা : তবে আপনিতো কখনো নিশ্চিতের দিকে ঝুঁকেননি। আপনি সর্বদাই সন্দেহ, ব্যর্থতা আর বৈপরিত্য নিয়ে লিখেছেন—

হোসে : উপন্যাসে ইতিহাসের একটি বিশেষ ক্ষণের যে বৈপরিত্য ও সন্দেহ, ইতিহাসের এক নির্দিষ্ট মুহূর্তের প্রতিনিধিত্ব করে— যে মুহূর্তের বিশেষত্ব ও একক প্রকৃতি আমাদের নিকট সন্দেহাতীত ছিল, সে বৈপরিত্য ও সন্দেহ আবশ্যিকভাবে আমাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষি স্বনিয়োজিত দায়িত্বের অংশ ছিল। কিন্তু এখন ইতিহাসকে বিষয়িনির্ভর হিসেবে প্রত্যক্ষ করা হয় এবং ব্যক্তিত্ব মাধ্যমে তার স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়। নিশ্চিতিকে হারিয়ে তা ঝুঁকে পড়েছে আপেক্ষিকতার দিকে। আজকের ঔপন্যাসিক আঁকেন ব্যক্তির জীবনচিত্র। যা কমবেশি প্রতিনিধিত্বশিল হতে পারে কিন্তু তাতে পাঠককে উপদেশদানের কোনো প্রবণতা থাকে না। এদের চরিত্রগুলো অসহায় এবং অনেকসময় নিঃসঙ্গ এবং দোদুল্যমান। আগের মতো বিশেষ ভাবাদর্শ ম্লান করে উজ্জিবিত হওয়ার সুযোগ এখন আমাদের নেই। অতিন্দ্রিয় সত্যের আশ্রয়ে জীবনের সংকট থেকে নিরাপত্তালাভের উপায় আর আমাদের নেই, আমরা এখন খোলামেলা জীবনের মুখোমুখি। আমি এ ঘটনাকে ইতিবাচক হিসাবেই দেখি।

আইনসা : চরিত্রগুলোর জন্য সেটা সত্যি হতে পারে, কিন্তু লেখকদের জন্য কি হবে? তাদের আদর্শ কি হবে? হাজার হলেও মানুষকে তো কিছু না কিছু বিশ্বাস করতেই হয়—

হোসে : আদর্শগুলোর স্থান আজ দখল করেছে সাহিত্য ও শিল্পতত্ত্ব। ইতিহাসে তা এই যে প্রথমবার ঘটল তা নয়। এই মুহূর্তে আমার Paradise Lost-এর কবি জন মিল্টনের কথা মনে পড়ছে। তিনি একদিকে রেনেসাঁ আর অন্যদিকে পিউরিটানিজমের দ্বৈতশক্তির টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে গেছেন। নিজের সাংস্কৃতিক রেফারেন্স তিনি তাঁর সময় থেকেই নিয়েছিলেন। সম্প্রতি পুনঃআবিষ্কৃত গ্রিক এবং লাতিন কবিকুল, চার্চ-এর পাদরিদের রচনা, আর বাইবেল, এসব ছিল তাঁর উৎস আর তাঁর পাঠককুল ছিলেন ধর্মগ্রন্থের অনুগামি মানুষেরা। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসি মানুষেরা নয়। আসলে সংকটের মুহূর্তে যখন চারদিকে শূন্যতা বিরাজ করে তখন পুরোনোদিনের সাহিত্যিকদের বুননকৃত জালই নতুন লেখকদের রক্ষা করে। এ সেই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার যা তাঁদের বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অতীতের সেই লেখাগুলোই আমাদের প্রকৃত শক্তি ও স্থায়িত্ব। সেগুলোর ওপর ভর করেই আমরা নতুন কিছু লিখতে শিখি। বিশেষত, সেইসব মুহূর্তে যখন অন্যসব নিশ্চয়তার ভিতগুলো কম্পমান হয়ে ওঠে।

আইনসা : কিন্তু এ সংকটতো এ-ও প্রমাণ করে যে ব্যক্তিমাত্রেরই নিজেকে নিজের খোলসে গুটিয়ে নেয়ার, নিজের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় সৃষ্টি করার প্রবণতা রয়েছে। সবকিছু এটাই নির্দেশ করে যে আমরা নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছি, যাকে জনপ্রিয় আমেরিকান ভঙ্গিতে বলা যায় ‘কোকুনিং’।

হোসে : ব্যক্তিক ‘কোকুনিং’ না সামাজিক ‘কোকুনিং’, যা ভাবতাত্ত্বিক নিশ্চয়তাবোধের দ্বারা আমাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারত— এর মধ্যে কোনটা ভাল তা আমি জানি না। তবে যাই হোক, একটা ভাল দিক হল যে আগের কিছু কিছু বাধা এখন ভেঙে গেছে এবং অনেক পুরনো বিশ্বাস এখন চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন। বিশেষ করে আমি ফ্রয়েড থেকে লাকাঁ কিম্বা মার্ক্স থেকে আলথুসার পর্যন্ত সৃষ্ট বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভাবশিষ্যদের দ্বারা সৃষ্ট ছোট ছোট স্বব্যাখ্যাত শব্দগুলোর কথা বলছি যেগুলো আধুনিক চিন্তাধারার ওপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে।

আইনসা : লেখকদের সব উত্তর জানতেই হবে এমন কোনো কথা আছে কি?

হোসে : এটাই বোধ হয় লাতিন আমেরিকান বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের একটি বৈশিষ্ট্য। চারপাশের বাস্তবতায় অবরুদ্ধ হয়ে এখানকার লেখকেরা অনবরত কোনো একটি ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা বোধ করি। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হচ্ছে যে এদের মধ্যে অনেকে আবার নিজ দেশে এবং সারা বিশ্বে যা কিছু ঘটে তার সবকিছু সম্পর্কেই নিজস্ব মতামত দেয়াকে একটি ‘দায়িত্ব’ হিসাবে মনে করে। এ অঞ্চলের বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন যাঁরা অর্থনীতি থেকে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মতো সর্ববিষয়েই তাঁদের চিন্তাধারা নিঃসংকোচে প্রকাশ করেন এবং যেগুলোর ওপর বিবৃতি দিতে তাদের কুণ্ঠা হয় না। অন্যদিকে ইউরোপের লেখকেরা নিজ নিজ কাজেই সমস্ত মনোযোগ নিবদ্ধ করেন। তাঁরা সার্বিকভাবেই বিশ্বাস করেন যে, নিজের কাজটি সঠিকভাবে করাটাই জীবনের প্রধান দায়িত্ব। আমাদের এ অঞ্চলে, যে বিষয়ে বিন্দুমাত্র জানেন না সে বিষয়ে আলোচনাকারি প্রচুর ‘পয়গম্বর’-এর আবির্ভাব ঘটেছে।

আইনসা : তাহলে কি ধরে নিতে হবে যে কিছুকাল আগেও লাতিন আমেরিকার বাস্তবতাভিত্তিক যে ভাবধারার প্রতি লেখককুল এত আসক্ত ছিলেন তা আজ বিপন্ন?

হোসে : প্রত্যেক লেখকই আপন সময়ের অনিশ্চয়তাকে বরণ করে নিতে বাধ্য হন। একথা সবার জন্যই সত্য, শুধু লাতিন আমেরিকার জন্য নয়। প্রতিটি সাহিত্যেরই মূলে লুকিয়ে রয়েছে এক প্রশ্ন। ‘আমরা কে?’ তবে একথা স্মরণ রাখতে হবে যে লেখকেরা সর্বদাই, অন্তত কিছুদূর পর্যন্ত বহিরাগত। যদি তারা স্বভাবতই তা হন তবু সে গুণ তাদের আয়ত্ত করতে হবে, এমনকি ব্যক্তিগত মূল্যের বিনিময়ে হলেও। কোনো বিশেষ ভাবাদর্শ, শ্রেণি অথবা তাঁদের দেশের সঙ্গে একাকার হওয়া চলবে না। তাঁদের অন্যের আজ্ঞাবহ হলে চলবে না। বহিরাগত হলে কোনো কিছুর ভিন্ন মূল্যায়ন করা যায়। এজন্য সবাই বলে যে, আমার বইয়ের প্রান্তিক চরিত্রগুলো এরকম যে, তারা যেন ‘জীবনের ভোজসভা থেকে বিতাড়িত’।

আইনসা : চিলির লেখকদের বেলায় আমরা দেখতে পাই যে, দুরূহ পরিস্থিতিতে, এমনকি স্বৈরতান্ত্রিক পিনোচেট সরকারের অন্ধকার সময়টিতেও, তারা সর্বদাই নিজের দেশের সঙ্গে আবেগঘন সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। আপনার ‘গার্ডেন নেক্সট ডোর’ উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই শৈশবের কথা আর গৃহকাতরতার কথা। এ বোধটা আপনার সকল লেখারই পটভূমি তৈরি করেছে।

হোসে : এটা সত্যি যে চিলির লেখকদের নিজ দেশের সঙ্গে একটা বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। এমনকি আমরা যারা বহু বছর বাইরে থেকেছি ও কাজ করেছি এবং তার ফলে আন্তর্জাতিক লেখকদের বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছি, তারাও কতকগুলো ছবি ও স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছি। আমাদের হৃদয়ের গভীরে রয়েছে একটি বাগান যেখানে বাস্তব জীবনের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুদ্ধ সময়গুলোতে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজি। আপনারা জানেন যে, আমি এখন আমার নিজের দেশে ফিরে এসেছি এবং কাজ করছি। আমি এখন Sparrows Sing in Greek নামে একটি উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে আছি। উপন্যাসটির পটভূমি রচিত হয়েছে লোটা (Lota) কয়লা খনি অঞ্চলে। এ গ্রন্থে আমি খনিশ্রমিকদের কথাবার্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে… taut ভাষা ব্যবহার করেছি।

আইনসা : আপনি কি সেজন্যই ১৯৮০ সালে চিলিতে গিয়েছিলেন যখন স্বৈরতন্ত্র তুঙ্গে ছিল?

হোসে : সেটা হল অনেক কারণের একটা মাত্র। আমার মধ্যে একটা বোধ তখন প্রধানত কাজ করছিল যে ইউরোপে যা কিছু করা সম্ভব তা করা হয়ে গেছে এবং যা করার আছে তার জন্য আমার মতো লোকের দরকার নেই। সেই old world–এ আমার পদচিহ্ন রেখে যাবার আর কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু চিলিতে এখনও অনেক কিছু করার রয়েছে। অবশ্য ইউরোপে একটা বিশেষ সুবিধা হল, সেখানে আমি অজ্ঞাত নানারকম ‘মুখোশ’ পরে নিজেকে আড়াল করে অলক্ষে থাকতে পারতাম। কিন্তু চিলিতে মানুষের কাছে আমার যে ইমেজ তৈরি হয়েছে তার বাইরে আমি যেতে পারছি না। সবকিছু এখানে পূর্বনির্ধারিত হয়ে আছে। এখানে লেখক হিসেবে আমাকে দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। কিন্তু তা অতি সহজ নয় বিশেষত যেখানে আমি সন্দেহ ও অনিশ্চয়তার শিকার। কিন্তু আপনার প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় যে, আমার চিলিতে ফিরে আসার প্রাথমিক কারণ ছিল গৃহকাতরতা। যা বয়সের সাথে সাথে বেড়ে যায় আর এর কোনো প্রতিষেধকও নেই।

আইনসা : ১৯৮১ সালে স্প্যানিশ ভাষায় রচিত ‘The Garden Next Door’ উপন্যাসটিতে আমরা দেখতে পাই এক নির্বাসিত জীবনের বেদনাময় সুর। আবার ওদিকে ১৯৮৫ সালে রচিত আপনার ‘Despair’ উপন্যাস প্রকাশিত হয় যেখানে গৃহ-প্রত্যাবর্তনের ছবি ফুটে ওঠে। এ দু’টোতে কি কোনো আত্মজৈবনিক উপাদান রয়েছে?

হোসে : নির্বাসিত জীবনের বিষয়কে ঘিরে নানান কল্পকাহিনি ছড়িয়ে রয়েছে। আসলে মানুষ যেখানেই যাক, যাই করুক না কেন, সঙ্গে নিয়ে যায় তার মাতৃভূমিকে, তাঁর আপন শহরকে। কোনো কোনো মানুষ এ ধারণার বিপরিত যাই ভাবুক বা দাবি করুক না কেন, আসলে আপন সত্তা থেকে স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়ার পথ নেই। এমনকি সবচাইতে আন্তর্জাতিক মানসিকতাসম্পন্ন ভ্রমণকারিও শেকড়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বাঁধা থাকে। গ্রিক কবি কনস্টান্টিন কাভাফি যেমন তাঁর কবিতায় বলেছিলেন,
                    ‘এই শহরই তোমার শেষ গন্তব্য।’

আমরা তাঁর পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করতে পারি:
                    তুমি বলেছিলে, ‘আমি যাব অন্য কোনো দেশে, যাব
                    অন্য কোনো সমুদ্রতীরে,
                    এবং খুঁজে নেব এর চেয়ে শ্রেয় অন্য এক নগর’
                    কিন্তু তুমি পাবে না খুঁজে নতুন এক দেশ,
                    পাবে না অন্য এক সমুদ্রতীর।
                    এ নগর সর্বদা তোমার পিছু নেবে।
                    তুমি একই পথে হাঁটবে, বড় হবে একই
                    পরিবেশে, একই গৃহে
                    তুমি একদিন বুড়ো হয়ে যাবে।
                    এ শহরই তোমার শেষ গন্তব্য। অন্য
                    কোথাও অন্য কোনো
                    কিছুর আশা রেখ না:
                    (তবুও) তোমার শেষ গন্তব্য হবে এই
                    শহরই…
                    তোমার জন্য নেই কোনো জাহাজ, নেই
                    কোনো পথ।

আইনসা : তাহলে শেষ পর্যন্ত নিজের ‘শিকড়’ ও গৃহ থাকা কোনো মন্দ জিনিস নয়?

হোসে : আমি কখনও বলিনি যে এটা মন্দ, যদিও চিলিবাসিদের শিকড় দক্ষিণে যত গভীরেই প্রোত্থিত থাকুক না কেন, তারা অবশ্যই ইউরোপের প্রতি একটা টান অনুভব করে। আসলে সবকিছুর সঙ্গে ইউরোপও তাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ। এই ইউরোপ-যাত্রা চিলির ঔপন্যাসিকেরই জীবন ও লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে। যেমন হোয়াফিন এদওয়ার্দম বেইয়োর Criollos en Paris, আলবের্তো ক্লেস্ত গানার Los trasplantados কিংবা ঊনবিংশ শতকের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ইউরোপের দিকে ‘initiatory voyage’-এর ঐতিহ্য। চিলির শ্রেষ্ঠ কবিরা সর্বদাই আবার শ্রেষ্ঠ পর্যটক: পাবলো নেরুদা, ডিসেন্তে উইদোব্রো, এমনকি গাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল যাঁর নিজ দেশের বাস্তবজীবনের সঙ্গে ছিল গভীর সংযোগ। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রৌদ্র-জল-হাওয়ায় ঘুরলে যেমন করে মানুষ নিজ দেশের উষ্ণতা আরো বেশি টের পায়। সেজন্যেই আমরা এখন দেশান্তরে গমনেচ্ছু আর দেশের প্রতি বন্ধন, এ দুয়ের, টানাপোড়েনজনিত এক সুখকর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।

বর্ষ ১, সংখ্যা ১, ফেব্রুয়ারি ২০০২

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার