একাকি সমাবেশ
(হুমায়ূন আজাদ, ধন্য তার সাহচর্যের স্মৃতি)
আমরা এক সত্যবাদীর সমাধি খুঁজতে বের হই
সত্যিই এক সত্যবাদীর স্বপ্ন দেখতে বেড়াতে যাই
বুঝি, সত্য শুধু ঘটমান, সমাধি তার নাই
খুঁজে পাই রাঢ়িখাল, ছড়ানো শিউলি ফুল
শাদা শাদা কথায় মুখর আড্ডা বসে থাকা;
সময় আমাদের চুরি হয়ে যাচ্ছে অন্ধ এক সুড়ংয়ে
কে বলত, কে?
– কবর যার কালো ডোরা শাদা এক বাঘ।
এই আমাদের কাল, সে কলি, না কালো
হিসেব করেনি সে
সময়কে সে বুঝেছিল পুরাকালের মর্মে
কিন্তু সময় ছিল কালো এক চিতা
আর তার বুলি, কলি কালের বাহানা;
সমকালের আত্মার চিৎকারে পুরা থাকে পুরাকালের অভিজ্ঞান
কে জানতে পেলো, কে ?
– মৃত্যু যার প্রশ্নের মিছিল, সমাধি যার একাই সমাবেশ;
ক্ষীণস্তনা মেয়েদের রাধা বলতে দ্বিধা
করতো কে ?
– স্বপ্ন যার বিদ্ধ হলো চিতার কালো দৃষ্টিতে
কয় পুরুষ ধরে আমরা মাথায় করে করে
কয়টি মাত্র শব্দের অর্থ দাঁড় করলাম
পিছনে ছিল অন্ধ চিতার অভিশাপ
কে দেখতে পেলো সবচে’ ভালো, কে ?
– কবর যার বকুলতলা, বক্তব্যভরা দু’খানা বই।
তরল মন্দিরা
We were fluttering, wandering, longing creatures
A thousand years before the sea and the wind in the forest
Gave us words
Now how can we express the ancient of days in us
With only the sounds of our yesterdays?
– Sand and foam, kahlil Gibran
সহজ
প্রকৃতপক্ষে যা সোজা সহজতা
মনীষীরা বলেন তা যৌন পুর্ণতা
শরীরের মধ্যিখানে ঠিক মাঝখানে
একটি ভোমর-ঘুম মেতে থাকে গানে
আলোর আ-বেগ গুণে গতি আসে তার
ডানায় আনন্দ আসে যত বলাকার
মাটিতে ব্যর্থ হলো যেসব মিলন
তাদের জিহ্বাগুলো কল্পনাপ্রবণ
তারা উৎসব করে মেঘে ভাসমান
জলের ভিতরে তারা সৌর সন্তান
বালির ভিতর থেকে এক জন্ম ওঠে
রৌদ্র খায় মাথাভরা পত্র যেন জোটে
হাওয়ায় হাউস করে অন্য জীবন
উড়ে যায় পুড়ে যায় বেআকুল মন।
সপ্তশ্বাস
আমি শ্বাস নিই আর অন্তর্গত এক মুহূর্তের জল
ভিতরে ভরে ওঠো তুমি,
নিঃশ্বাস ফেলি
বাইরে বিস্তৃত হয় তোমার অভিমান পরাহত
থির অধীরতা।
আমি শ্বাস নিই আর ভেতরে ভরে ওঠে ধাতুরূপে ক্রিয়াশীল
অভিধানগুলি,
নিঃশ্বাস ফেলি
সম্পর্কিত হতে থাকে শব্দমূল কর্মে ও কারকে
সমাসবদ্ধ হতে থাকে জন্ম , অধিজন্ম।
আমি শ্বাস নিই আর ফোলে ওঠে গোপন কৌটাটি
অস্তিসমুদ্রের গভীরে যে পড়ে থাকে
পরাবাস্তবতায়
পড়ে থাকে কোডে ও ডিজিটে
মাইটোক-্রয়িায়,
নিঃশ্বাস ফেলি
আর খুলে যায় তার ছিঁপি
ভাষা পেয়ে যায় ভুলে যাওয়া সব মেটাফর
রক্তে, অভিজ্ঞানে, ধমনি-শিরায়, শুক্রে, বীজে, ক্রোমোজোমে
চক্রে চক্রে সমাসবদ্ধ হতে থাকে
ধাতুরূপী ক্রিয়াভিত্তিক ন্যারেটিভগুলি।
আমি শ্বাস নিই আর ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে
দূরবর্তী সব জন্মের বিস্মরিত বর্ণলিপি
নিঃশ্বাস ফেলি
ফিরে পাবার আনন্দে ফুটতে থাকে উপাখ্যানগুলি
প্রাচীন পুঁথির ছন্দে শহরময় বর্ণমালার ক্যারিওগ্রাফি
এভাবেই লেখা হয় আমাদের অভিন্ন আত্মজীবনী।
আমি শ্বাস নিই আর ধৈর্যের মতো ধুসর রঙের চাবিগুলো
তালা ঝুলায়ে দেয় মেঘেদের মুখে
আর ধৈর্যকে ধারণ করে বজ্রের হৃদয়
শীতে জমতে থাকে বজ্রের ফণা ও অস্থিরতা,
নিঃশ্বাস ফেলি
পাড়া ভরে ছড়িয়ে পড়ে বজ্রপুত্র আর বৃষ্টিভাষার কন্যারা।
এদের মুখে কে আঁটে আর চাবি
এদের পায়ে কে পরাবে রীতির বাড়াবাড়ি
ধৈর্য্যকে ওরা হারিয়ে কেবল ফেলে।
আমি শ্বাস নিই আর সমস্ত ঢেউ ও বাঁকসহ এক নদী
ঢুকে পড়ে ঘরে, নিজেরি ঘরে
আমি সাঁতরে কিনারা পাই না আর
ভেসে যেতে থাকে আমার খেয়ে না-খেয়ে কেনা সব বইপুস্তক
ভেসে যেতে থাকে কায়ক্লেশে গুছিয়ে তোলা ছন্ন গেরস্থালি,
নিঃশ্বাস ফেলি
আমার বিহ্বলতার নীচে বেহুলার মতো ভেসে ওঠো তুমি।
আমি শ্বাস নিই আর জল, অঙ্গ এক কণা
মগজে মুগ্ধবোধ তুমি,
(উম্মিলিত শস্যের রেণু সপ্রকাশ্যে নৃত্যপর
যেন ইচ্ছাফড়িং এক ভাবনাহীন খেলে যায়
উম্মাতাল বাযুচক্রে লীলাচ্ছলে খেলে যায়
সারাগায় ইচ্ছাফড়িং এক খেলে যায়),
নিঃশ্বাস ফেলি
ভেতরে জয়শঙ্খ বেজে ওঠে মুগ্ধডানা উড়ার উৎসবে।
জলবনহুর
এক ফোঁটা অঙ্গ জল তুমি নিয়ে এসেছো আমায় এই ধাবমান নদীর কিনারে; তুমি উন্মোচিত করে দিয়েছো আমার সুমহান অভিমান, এক ফোঁটা অঙ্গ জল তুমি দুর্দান্ত ডিগবাজি খাও আমার মাথার খাড়িতে, নেমে আসো খাড়া এই গ্রীবা বেয়ে কালো কশেরুকায়; তুমি জল, অঙ্গ এক কণা, নেচে নেচে চলে যাও, করো না পরোয়া কোনো আমার আবদার, অথচ আমার ঘুম পুড়ে যায়, তোমার নাচের প্রতি মূদ্রা আমাকে পেঁচিয়ে ধরে নাড়িতে শিরায়; মেরু পথে জমে থাকো জল, এক ফোঁটা অঙ্গ, তুমি অনঙ্গ সাধনারত, বসে থাকো পিঠ জুড়ে অটল, অথচ আমি সত্তাময় শ্রী জ্ঞান খুঁজি, হয়েছি অতীশ।
শৈশব উন্মোথিত হয়ে ওঠে রম্য কোলাহলে, তোমারো যোগে আছে নৈঃশব্দের সৃষ্টিমুখ এক অর্থময় স্মৃতিসম্ভার, হিরন্ময় ইচ্ছাজুড়ে বেজে ওঠে তরল মন্দিরা, নাচের আয়োজন করে বৃষ্টি ও ডাহুক।
ভাবনার সাথে সাথে ঘন হয়ে আসে জল, জলাঙ্গ এক ফোঁটা, জমে ওঠে বেশ ভাবুক; আর গা ভর্তি অনুভুতি নিয়ে গড়াগড়ি যায় যেন পুরোনো গলির গান বেজে চলে বরযাত্রীর নৌকায়।
একটি শৈশব উঠোনে লুটোপুটি খেতে খেতে, দৌড়োতে দৌড়োতে, হেলে দোলে জিকিরের মতো পড়া মুখস্ত করতে করতে ধরে ফেলে কৈশোরকে; আর মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে ঢেউ খেতে খেতে কেমন ডিঙিয়ে যায় কৈশোর অনায়াসে, ঠোঁটের উপর লাগিয়ে নেয় এক গোছা কালো চিকন ফিনফিনে গোঁফ; রহস্যগল্প পড়তে পড়তে, চুরি করে সময়কে নিজের পকেটে পুরতে পুরতে ভিতরে ভিতরে নিজেই হয়ে ওঠে দক্ষ এক চোর;
জলবনহুর।
জলশীর্ষ যুবরাজ
রজো-নীরে রজনিশ করিছে ধেয়ান
কত জলবিনয়ে;
অটল জলের রূপকথা।
খাজুরাহু স্থপতিরা জলশীর্ষে উত্থিত নীল নীল ঘোড়া,
খিজিরাহু, পানির যুবরাজ;
কর্মধারয়, বহুব্রীহি, ফেনার কোরাস।
সর্বনাম
সমস্ত প্রতীকেরই নিজস্ব ও একান্ত উদ্ধৃতিময় প্রতীতি আছে
প্রতিটি মুহূর্ত ব্যক্তিত্ববান-
এক কণা কাল সে উঠে আসে মঞ্চে
আর জানিয়ে দেয় তার অসম্ভব ইচ্ছার কথা
ভালো ভাষায়;
কৈশোরের কল্পবৃষ্টির ভেতর ঝাঁকের কৈয়ের মতো উঠে আসে
রোদপোহনো বই-পুস্তক
তস্করের দল
আর
বোধোদয় হরকরা;
রঙমহলের কোনো এক নর্তকীর নৈসর্গিক ডুমুরবালক যেন নৃত্যপর গেয়ে চলে কালের কোরাস;
সর্বনাম, নামের বসন খোলে অপেক্ষমান উরুর মতন বালিহাঁস।
আদিজন্ম
বছর বুঝি না আমি, বুঝি জন্ম
প্রতিটি ঘুমের জঠর থেকে প্রতি প্রভাতে
উঠে আসে স্মৃতিপূর্ণ অন্য এক জীবনের ঢেউ
এভাবে ছয়’শ কোটি ঢেউয়ের আত্মজীবনী
আমাদের যৌথতার গল্পে ভরা…
মুহূর্তগুলো অঙ্গময় চৌকুস ঘন্টা হয়ে বাজে
আমি হারিয়ে এসেছি ধর্ম আমার, সর্বপ্রাণবাদ
আজ তাই স্মরণ মাগি এই প্রাকৃতিক জন্মপ্রবাহে
জীবিকাবর্ষের অতীতে
লজ্জাহীন
নিকাশবিহীন
পরিচ্ছদ ছাড়া
পূর্ণপ্রেম-
আদিজন্ম ;
ফলশ্রুতি
যখন অনেক দূরবর্তী কোন জন্ম তার
রৌদ্র ও সন্তাপ নিয়ে মনে পড়ে যাচ্ছিল
যখন প্লাবনের পুরাকীর্তি নিয়ে
স্মরণীয় কোনো নদী ঢুকে পড়ছিলো কাব্যভাবনায়
যখন প্রকৃতি খুলে দিচ্ছিল তার
একান্নবর্তী যৌথতার সবুজ চড়াই
যখন সময় ঝরে পড়ছিল অন্তহীন সময়প্রপাতে
আর জল সঞ্চয় করছিলো কিছু চুম্বন আর জিজ্ঞাসার বিদ্যুত
একটি গলিত সূর্যাস্ত ঢাকা পড়ছিলো ভোরের হুল্লোরে;
যখনো নদীরা কোনো স্ত্রীবাচক নামে খন্ডিত হয়ে যায়নি
সর্বোপরি মানুষের মাঠ ছিলো মৌমাছির প্রজাতন্ত্র ;
যখনো গোত্রের সকল পুরুষ ছিলো
আমাদের বাবা আর সকল যুবতী মা
যখনো চুম্বনই ছিলো মানুষের সবচেয়ে গভীর স্বীকৃতি
যখনো পাঁজরের হাড় ভেঙে মানুষেরা গড়ে নিত প্রাজ্ঞ প্রতিমা
পানির প্রহারে-নাচা রমনীর শিৎকারে লাল হয়ে যেতো রাতের বাতাস
বৃষ্টির পীড়নে চিরে যেতো জুঁইফুলের মধ্যরাত্রি;
যখনো মাঠে মাঠে সবুজ বিপ্লবের মতো ছিলো
ঘাসেদের গল্প বলার তাড়না
মেয়েদের উড়ন্ত যৌবনে ছিলো লতার কল্পনারীতি
আর পাতার উড়ে থাকার সবুজ অভিলাস লেগে থাকতো তাদের
গোল গোল দুধে
হরিণপ্রহরে তারা কুড়িয়ে নিত বাতাসের হাতখরচ;
যখনো কবিতা হয়ে ওঠেনি কোকিলের কানকথা
শব্দেরা কাকের কালো রঙই কেবল গায়ে পরতো না
ধারণ করতো তার কড়া সত্যবাদিতা;
তখন আমার ধমনীর লাল অন্ধকারে বেজে ওঠে পাঠশালার ঘন্টা
আর যৌথতার সফেদ চুক্তির মতো লেখা হয় চিরবর্ষার গীতিকা
এ কোনো উদবোধন নয়
নয় নূতন কোনো পরিচয়।
নিদালি
(বর্তমান বিকৃতমস্তিস্ক অর্থাৎ বিকল্প নির্বেদে শায়িত প্রিয় বন্ধু শাহনুরকে)
এই ঘর, ঘরের অন্তর, বাহিরে আকাশ অন্ধকার
পৃথিবীর পথে পথে, পৃথিবীর ঘরে ঘরে, নদীতে, মাঠে, দালানে
বৃক্ষে, বৃক্ষের ফুলে, ফলে, ফলের বীজে
পাতায় পাতায় ছায়া। সর্বত্র আকাশের ছায়া
নিরাকার চত্বরে লেপ্টে শুয়ে আছে ছায়াময় রাত
নদীতে কাদার ঘুম, জল নেই
আমার মুখের ছবি নিরাকার ছায়ার রজনী
কী সুরেলা সরোদ বাজে শিশিরের বিনয়ের মতো নির্জন ছায়া
ছায়া, মায়ালোক, মাংশের রাত, অনন্ত চিন্তার ঘোর
ঘুমন্ত উনুনে ছাই চুপচাপ বেড়ালের মতো ফোলায় পশম
শীতের কুয়াশা এসো করোটির ভিতর
সাইনাস, সাইনাস, তুমি ছোট্ট স্নেহের নদী
সব ক্ষোভ, বিস্বাদ, ভয়, স্মৃতি
প্রেমিকার চিঠি, সব, সব সমর্পন করো নির্বেদ, নিদ্রিত
করোটির অন্ধকার মোহনায়
হে সাইনাস, তুমি ছোট্ট স্নেহের নদী।
আমার আলস্য হোক রাত্রির বিখ্যাত আকাশ
আমার নির্বেদে শান্ত হোক পৃথিবীর সকল ব্যস্ততা
আমার নিদ্রা বেছে নিক নক্ষত্রের করুণ নৈঃসঙ্গ্য
আমার রাত্রিরা হোক রজনীর মতো একা অন্ধকার নরম আর বাতাসের গান
এখানে, বুকের মাঝে মুখ রাখো, এখানে আগুন আছে, প্রত্যহ সিদ্ধ হয় তোমার জন্য জল রুটি আমিষ আর আত্মার আঁধার, কই গো খলিলের মা, তোর ছেলের চিঠি এলো? কী সব দেখি যে খোয়াবে, হ্যা গো মেয়েটির ক’মাসের পেট, অ সানু এ বেলা একটু উঠে বোস, সন্ধ্যা হলো যে, তোমার এ মাথার রোগ কবে যে সারবে, ছেলেটার জামা ছিঁড়ে গেছে, আল্লাহ, আমীন, আমার মাথার উপর বাজপাখি, শুধু ঠোকর মারে, কত আর, চিঠিতে কি লিখেছে গো, ঠিকমতো খানাপিনা করে তো, যা উদাস মাথা, গোসলের ঘাটে লুঙ্গিটা সাবানটা এই মনে থাকে না, কী লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, হাতের কলম মাথার টুপি সব ভুলে যায়, ওর কোন অমঙ্গল হবে না তো, সানু তোর কিচ্ছু মনে নেই? সারাদিন খলিলের সাথে, সারাদিন কবিতা,সীমানার খাল, মাছ ধরা, কিচ্ছু মনে নেই?
সব মন্ত্র ব্যর্থ হয়
এভাবেই
এইভাবে
সব ঘুম সব অন্ধকার জেগে থাকে
জেগে থাকে বুকের ভিতরে রোদ, বাসি গন্ধলাগা আঁষটে খাবার
আমাকে তো লিখতে হবে, কিসের লেখা? ফাঁকি –
ফাঁকির রোদ ফাঁকির দিন
যা গেছে তা ভুলতে দিন
বুকের ভিতর অজগর
জীবন বাজে গররগর
কে যায় গো মুক্তা না?
ঘুম আসে না, ওমা, মা।
কী তীব্র সবুজ রঙের দিন মিনারের আজানের মতো
পাখির শিসের মতো বালকের অস্থির আঙুলে কথা কয়ে ওঠে
অন্ধকারে বেত্রবতী যেনো গো চলছে ভেসে
কী যেনো কইছে কথা কী যেনো গো।
লাশ পোড়া ডোবা। তিন ফুঁ’র জল। আহম্মদপুর গ্রাম। সাহাদের কিনুদের ঝাল আর মুড়ি। তিন পুকুরের কড়ি। দাদার কবরে মোম। ফাঁকির রৌদ্রে সেঁকা রুটির দুপুর। আমুর। আমুর। আর পাঞ্জেগানা মসজিদের আলিফ-বে’র সকাল। এর নাম কৈশোর। আমার কৈশোর।
আমরা খেলেছি কেলি জলকেলি মদন পুকুর
চিকন গোপাট শিরি সানুদের নিশ্চিন্তপুর
রূপবান আর টাকার খেলা
ভাঙার পাড়ে বোশেখ মেলা
আয় দূর্গা অপু আয়
রেলগাড়িতে বয়স যায়
মন্ত্রতে ফাঁক ইস্কুলে ফাঁক
রাজ্য ঘুমাক নিদ্রা যাক
এবং আরব্য পথে অরূপ রতন মুক্তার বার আর পান্নার চোখ
চলে গেছে, গিয়াছে চলিয়া, তাই ঘর বার কাল আর সকলি বিমুখ।
তবুও মানুষের নাম মনে হয় নক্ষত্রের মতো
মেঘের নেশা আর প্রেমিকার চিঠি পকেটের অসুখের মতো
বয়সের রোদ বসে টেবিলে খাতায় আঁকে গোধূলি শোণিমা
মর্ত্যরে মানুষ আমি হতে চাই পরিপূর্ণ পুর্ণিমা।
আয় ঘুম শান্তি আয় নির্বেদের জল
পকেটে হতাশা আছে চক্ষুতে তরল
আয় নিদ্রা আয় ঘোর শব্দহীন খাতা
চোখে তো অসুখ আছে লাল নীল সাদা।
প্রিয়সর্পিনী
স হৈতা বানাস যথা স্ত্রীপুবাংসৌ সম্পরিস্বক্তৌ
স ইমামেবাত্মানং দ্বেধাপাতয়ৎ ততঃ পতিশ্চ পত্নী চাভবতাং
তস্মাদিদর্ধবৃগলমিব।
-শতপথ ব্রাহ্মণ
ন বা অরে পত্যুঃ কামায় পতিঃ প্রিয়ো ভবত্যাত্মনস্ত
কামায় পতি প্রিয়ো ভবতি।
-বৃহদারণ্যক উপনিষদ
১.
আমি বহুকাল ধরে এতকাল ধরে যে তুমি ভেবেই পাবে না জ্বলেছি ভিতরে ভিতরে শ্বাসরুদ্ধ বায়ুশূন্য পুড়েছি ভেবেই পাবে না কীভাবে বিশুদ্ধ হয়েছি বিশুদ্ধ গ্যাস আমার সত্তা বায়ব জ্বালানী আগুন হয়েছি ভেবেই পাবে না কীরকম তরল আগুন তেল বিশুদ্ধ ভেষজ হয়েছি আমার রক্ত আগুনের ধারা ভিতরে তাহার কৃষ্ণ তারকা ভেবেই পাবে না হাড়ে মাংশে জ্বলনে পুড়নে কয়লা হয়েছি কালো আগুন আমার শরীর অগ্নিগিরির লাভাবিশেষ কঠিন শিলা পাথর হয়েছি আমার কষ্ট কঠিন আগুন জমতে জমতে পাহাড় হয়েছে মরুভূ হয়েছে মালভূ হয়েছে ভেবেই পাবে না তবুও জল আমি তো আদপে জলই ছিলাম পাহাড় ফুঁড়ে পানির নহর বেরিয়ে পড়েছি ঝর্না হয়েছি নদী হয়েছি ভেবেই পাবে না কীভাবে আগুন কীভাবে পাথর কীভাবে মাটি অথচ আদি অকৃত্রিম সেই জলই আছি…
২.
বৃষ্টিময় খোয়াবের তীরে না খোয়াবী বৃষ্টিতে
জলঘাসে না ঘাসজলে
ভুলে আছি না ডুবে আছি
বলো না প্রাচীনা নদী মৃত্তিকা সন্ধ্যা
বলো না বেহুলা মান্দাসিনী
বলো না
আমার আকাঙ্ক্ষা স্রোতী গোমতী বৈকি
আমার কামনা না হয় কালিন্দীর কায়া ছুঁয়েছিল
কালীর জিহ্বা বেয়ে অন্ধকারে এসেছিল বেত্রবতী সখি
আমার পুরান কথা অসুরী মহিষী
আদিম পদ্মমুখ পদ্মশিখা আগুন ফানুস
মনসা গো মাতা দাও না মণির প্রভা
তারে আমি আগুনে জুড়াই
ফুঁ মন্তর ফুঁ মন্তর ফনায়ু যৌবন
তেত্রিশ কশেরু কক্ষ আকুলিত মন
স্মৃতির প্যাঁচানো পথ মস্তক কুন্ডুল
জীবের বহুধা তত্ত্ব যৌনচক্র মূল
সাতটি আকাশ আর তের মাটি পর
আমার স্বপ্নরাজ্য বেহুলা বাসর
শরীরে জলের ধারা মাথায় আগুন
প্রিয় সর্পিনী সখা আমোদে নিপুন
মেঘের গহীন ডাকে জেগেছে গোমতী। অগণ আকাশ
গায়ে গায়ে মৈথুনে মেতেছে। আমার ঘুমেল সত্তা বিভাজিত
মন্দ্রিত মেঘের ঘেরে জলে ও আগুনে। কী বিশাল সর্পিনী
নদীটি গোমতী যুবতী রমনী প্রিয়া জেগেছে কোলের কাছে
দ্বিদলবীজী লতা। মিশেছে মাটিতে। এঁকেছে সর্পিল রেখা
নগ্ন সঞ্চারে। রক্তের সঞ্চিত সুরা ঢেলেছে সরিসৃপী
আগুনে আমার। নিমেষী বিজলী সত্তা প্রাণ পায়, প্রাণ পায়
সজল সবায়ু দেহ মায়াজালে জাগে-
৩.
আয় কামরূপ কলিঙ্গি থেকে এ কলিযুগে বঙ্গে জলাঙ্গী
সুরেলা রেখার পথে গঙ্গা হয়ে পদ্মা মেঘনায়
যত অগ্নি মেরুদণ্ড
বিজলী বিদ্যুৎ
সর্প সাধন তপে
জল বর্ষা হোক
আসুক চক্র পথে
অমিয় আগুন
অজস্র জন্মের স্মৃতি
বিবিধ কানুন
সাধন সঙ্গিনী তুমি
মনুর স্তাবকী
আও না বিষের দণ্ডী
সর্পিনী পানখী
কতটা জন্মের অন্তর এই আমাদের বৈদ্যুতিক বিচ্ছেদে
অপরিমেয় জল মাটিতে আকাশে
আমরা তবুও তো জলজ হইনি
কত শাপে সাপের সাধনা তুমি নিয়েছো কপালে
আর কত তপস্যার তাপ জ্বেলেছে কুণ্ডুলিনী শিখা
কত কক্ষ অক্ষে অক্ষে ঘোরেছো যৌবন রথে
বন্দে অয়ি, আমারো বত্রিশ গিঁটে জল ধরে আছে
মেরুদণ্ড বেয়ে ওঠে আলোময়ী কামনা প্রতিভা
তুমিতো সার্থক তাপসী ও সর্পিনী ও বোন প্রিয়া
তোমার মাথায় আজ জ্বলজ্বলে মণিকা প্রতিভা
ডেকেছোই যদি এই ঘুমন্ত সর্পে বহুবর্ণে-রূপে
দাও না চার্জিত চুমু, মন্ত্রণা দাও না
মাথার মণিকা তুমি ছোঁয়াও কপালে
ছোঁয়াও দু’চোখে আর বুকেতে নাভিতে
আঁধার সম্মোহন
কলকল গোমতীর জল অতল পাতাল থেকে ফুঁসে ওঠে
উঠিছে ফুঁসিয়া, শরীরের তন্ত্রী বেয়ে বিস্তারিছে বিদ্যুতের ফণা
একটি নিপুন প্যাঁচ ও পদ্মিনী তোমার কোমর ঘিরে
একটি দারুণ প্যাঁচ ও শঙ্খিনী কুণ্ডুলিত কানুর সাধন।
৪.
ইচ্ছে করো তুমি আমায় ইচ্ছে করো আমি তোমার প্রাত্যহিকী প্রহরভর্তি আগুন আছি ইচ্ছে করো ইচ্ছে করো তোমার জন্যে শোবার ঘর মর্জিমতন উষ্ণ আছি ইচ্ছে করো তুমি আমায় ইচ্ছে করো তোমার জন্যে বর্ষা আছি ভেঙে আছি ফোঁটায় ফোঁটায় ইচ্ছে করো তোমার জন্যে চুর্ণ চুর্ণ আমি আছি তোমার জন্যে শীতনিদ্রা জন্মে জন্মে জমে আছি ইচ্ছে করো ইচ্ছে করো তোমার জন্যে পুলসেরাত মৃত্যুসেতু পেরিয়ে পেরিয়ে বিস্ফোরিত হতে চেয়েছি ইচ্ছে করো তুমি আমায় ইচ্ছে করো তুমিই আমার একমাত্র জোড় অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা তুমিই সেই আগুন কণিকা তোমার জন্যে জ্বলতে জ্বলতে কৃষ্ণ হয়েছি শূন্য হয়েছি…
ইচ্ছে করো তুমি আমায় ইচ্ছে করো…..তোমার জন্যে…
তোমার জন্যে আকাশময় ব্রহ্মপ্রদীপ একটিমাত্র তারকা আমি
আদিম অক্ষে ঘূর্ণি আলোক জ্বলেছি
ঘুরেছি সহস্রবার সত্তর হাজার আলোকবর্ষ
আপন স্বপ্ন ঘিরে; তোমার জন্যে
শব্দ হয়েছি ইথারে ইথারে বাঙময়
দোতারা গীতালি
চৌষট্টি হাজার মোহিনী রাগে বেজে ওঠেছি
ব্যাকুল বীণ; তোমার জন্যে
রূপ ধরেছি, শব্দ থেকে দৃশ্য আগুন থেকে আধার
মাথায় তাজ কর্ণে দুল
স্বর্ণ পেখম আদিম ময়ূর
তোমার জন্যে
অগ্নি
শব্দ
জল
মৃত্তিকা
গতি
ছন্দ
চিন্তা
প্রতীক্ষা
ইচ্ছা ইচ্ছা ইচ্ছা
জ্ঞান
বোধি
সত্তা
সহস্রার
তোমার জন্যে বাসনা
এই বিপুল আবেগ
কামনা
কামনা
কামনা
৫.
এমনি বিষের তন্তু চক্রমুখে উঠে আসে প্রতিটি জন্মে
হাজার জন্মের স্তরে হাজারো রন্ধ্রপথ
অসংখ্য স্বপ্নদোষে দূষিত মগজ
প্রতিটি বরফযুগে সঞ্চিত সাধন গলেছে স্বপ্নের দাহে
আও কবিতা লতা ডাল বেয়ে উঠে আসো পাতার শয্যায়।
পড়ো মন্ত্র দাহো মুখ
স্ত্রোত্র সংস্কার স্বপ্ন সুখ
পুচ্ছ শিখায় তুচ্ছ জ্ঞান
জ্বলো জপোতপোধ্যান
আনো জন্ম গুপ্তকাল
অগ্নি মাথা জয়-মশাল।
আমার দেহটি ঘিরে প্যাঁচ দাও
জ্বলে ওঠো চক্রে চক্রে আগুন বালিকা
আমার পৈথান পুড়ে গড়ে তোলো বোধের মিনার
আমার শিথান জুড়ে জ্বেলে রাখো ঘুমন্ত শীতল আগুন।
পালকাপ্য
আমাদের পিতা ছিলো অসুর বঙ্গৃদ
কন্যা আর ধান্য ছিলো পণ্য আমাদের
গঙগারিডি সমতল গাভীর স্তন্যে ভরে
গৌরী মাতৃদেবী বাঘের ভগিনী
হয়েছে উর্বরা নারী সুজল-সুফলম
আমার মায়ের ঘর ধর্মে পুত্রে ধানে
মৎসে বস্ত্রে ভরা বাণিজ্য বহর।
আমাদের স্বপ্ন ছিলো বলীরাজার চোখে
সুদেষ্ণার অমিত স্নেহ শক্তি আমাদের
জয়তু অনার্য বঙ্গ স্বরাজ হট্টুস
হাতির পোষক পিতা বিখ্যাত হট্ট
উত্তর উজান জয়ী কারুতে বয়নে;
বাঙালি বাণিজ্য জানে এই তথ্য সত্য হলে
পালকাপ্য পিতা হন হাতির মাহুত।
১.
প্রাচীন লিপিতে ছিল স্বস্তিচিহ্নবাহী
প্রাকৃত দাওয়াই
হস্তির অস্থির শীত পান করে
গাঢ় অনুধ্যান- চলেছেন উত্তরের
অভিজাত শীতে, উত্তর পশ্চিম মুখে
মুনী এক-
পালকাপ্য;
লোথালের রাজা বিন্নির ফির্ণিতে
মাতোয়ারা হয়েছেন কিনা জানা নেই
ইতিহাস রাখেনি লিপিকা, তবু
বরেন্দ্রভূমির মাটি প্রাচীন প্রতিভাধর
মনে হয়
কালের অনেক শীতে বরফের নীচে
লুপ্ত সভ্যতার আলো রতি জন্মের মহোৎসবে
দূর এক ভবিষ্যের উত্তরের পানে
হস্তির বিপুল পদযাত্রা–
এইসব আলপীয় আহ্লাদ বহুদূর গড়িয়েছে
সিন্ধুর সনাতন নাগরিক শীতে
হাতির পদচ্ছাপ
ইতিহাসে আলো জ্বালিয়েছে।
২.
দেখা যাচ্ছে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে
কৃষ্ণ সাগরের কনকনে উপকূলে
ভাটির কুমার বীর অসুর দাঁড়িয়ে
লড়ছেন কলচিয়ানদের সঙ্গে
মহারাজ জেসনের পরাক্রান্ত সেনাবাহিনীতে
হরপ্পার হাড়গুলো পুড়ে শেষ হওয়ারও
বহু আগে।
আর যে আনাতলিয়া
হিট্টী নামে যে প্রাচীন রাজত্ব
তাওতো এই হট্টদেরই; শ্বেতাঙ্গ মরুচারীদের
ইতিহাসে হস্তির সুস্থির উপনিবেশ।
এইসব রেখাচিত্রময় আলোপথ
আলমগীরপুর হয়ে মহেঞ্জোদারোর
কারুময় নগর তোরণে
বঙ্কিম শূঁড় তোলে
অসুরের বিনীত অভিবাদন।
৩.
পাতালে পাতিয়া কান রয়েছি উৎকর্ণ হয়ে
শোনা যায় বৃংহিত গজপদধ্বনি
পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে দুলিতেছে
অভিযানগুলি
ভাওয়াইয়া বিচ্ছেদ বুঝি বাজিতেছে
পথময় রহিয়া রহিয়া–
সেই দূর ঊষাকালে হট্টের দল
মরুদূর আকাঙ্ক্ষার পাড়ে
হেঁটে যেত; দেখিতেছি হিমালয়
হিমের অধিক শীত বুকে নিয়ে
কাঁপিয়া কাঁপিয়া ওঠে।
আজ এই আলোকিত পণ্যসমুদ্রের কালে
এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপি
আমার হাড়েও যেন শীত বিঁধিয়েছে
হাজার হাজার বছর পড়ে আছে বরফের নীচে
শিলীভূত উৎসাহের পৌরাণিক লিপিতে;
এইসব অজানা উৎসাহের ধ্বনি
প্রশান্ত মহাসাগর ছেড়ে দূর মহাদেশ জুড়ে
আন্দোলিত বাণিজ্য বাতাসে
তুলিবে তো কণকতারা ধানের ব্যাঞ্জনা–
রৌদ্রমন্ত্র
প্রথম প্রহর
জন্ম প্রস্থানের পথে মন্ত্র খুঁজি
মন্ত্র খুঁজি প্রাকৃতিক স্মরণের-
হাঁটতে হাঁটতে জন্ম পেরিয়ে যাই
প্রাচীন পদচিহ্ন চিনে চিনে
যাই জন্মান্তরে।
জানি কোনো পূর্ণ গ্রহণই সম্পন্ন অন্ধকার নয়
পূর্ণতাও একধরণের তত্ত্ব
শুদ্ধতার অপেক্ষই মাত্র।
যেতে চাই গহীন দিনের উদ্বোধনে
জীবিকা বর্ষের অতীতে
মৃত্তিকা ঋতুতে-
জন্মের চারিপাশে ঘিরে থাকা প্রাচীন রাত্রির পেটে
উদ্বোধন ভালোবেসে।
জন্মও তো উদ্বোধন
রৌদ্রের লিঙ্গলিপ্তির অভিষেক।
পৃথিবীটা যেনো এক আবহমান রৌদ্রের র্যা লি
কেলি করে ফিরিতেছে ঋতুমতী মৌসুমী হাওয়া
জন্ম প্রস্থানের পথে তবু মন্ত্র খুঁজি
সময়ের সারণী বেয়ে নীচে অন্ধকারে
অচিহ্নিত রাত্রীযুগে
যেতে চাই
– প্রাচীন বরফ যুগে
নিজের পায়ের কাছে পড়ে থাকি আদি আসুয়াদ
ভক্তি করি
ভালবাসি
দুইহাতে জাপটে ধরে মিশে যেতে চাই
ধূলায়
আঁধারে;
চুমু খাই
পাথর হজম করে মাটি হয়ে যাই
অঙ্কুরের মন্ত্র খুঁজি
তবু কেন অন্য এক উদ্বোধন পেয়ে বসে
খুঁজে ফিরি অন্য আমাকে
রৌদ্রের লিঙ্গলিপ্তির দ্বিতীয় রূপকে।
দ্বিতীয় প্রহর
এই তবে পূর্ণ গ্রহণ
নিজের ছায়ার মধ্যে নিজেকে হারানো
এই সচকিত অন্ধকারে
অনির্ণিত অভিজ্ঞান তুলে আনে প্রত্নপাঠ
স্রোতের নদীর নীচে
গুহামানবের চিৎকার ও দুঃসাহসের
বেলাভূমি
আর
জলের পতন প্রবাহের গুরুতর অর্থভেদ
বদলে যাওয়া সময়ের বিচিত্র নৈতিক দৈর্ঘ্য
আর
মানবিক ইশতেহারের সমূহ উল্কাপতন
রৌদ্রের দৃশ্যমান বরযাত্রার বিবিধ কৌতুক
এবং অনেক অশ্মীভূত জৈবনীতিমালা
প্রাচীন নদীর তীরে রতিলিপ্ত সর্পিনীর
কম্পিত লাল জিহ্বা
নৃগর্ভস্থ প্রত্নসমুদ্রের জীবিত ওঙ্কার
আর মাতৃতন্ত্রের কণিকা
এবং অনেক অশ্মীভূত দৈবনীতিমালা
বাতাসে আসমানী বাণী চারিদিকে জাল বুনে আছে
কেবল ভূমিতে নিজের ছায়ায় ঢাকা মাটির মুহূর্তে
কোন ভেদ নেই
তত্ত্ব জ্ঞান নেই।
তৃতীয় প্রহর
হা ঈশ্বর। গানের ওপ্রান্তে এত কান্না ছিল
জানিনি তা
আমি তো বেশ মাড়িয়ে এসেছি মাঘে ফাল্গুনে
মান্দারের ঝরে পড়া মেরুণ রঙের গানগুলো
বেশ ভুলে গেছি মৌসুমের শেষে
শুকিয়ে যাওয়া খালের পেটের মধ্যে গেঁথে থাকা
সামান্য জলের
দুস্থতা
হা ঈশ্বর! তবু গান থেকে যায়
রেখায় – আকারে
উথলে ওঠে ধোঁয়া ধুসর রাষ্ট্রতন্ত্রের রতি
শ্রমের বছর গোণার মাল্টিকালার ক্যালেন্ডার
আর নিউক্লিয়ার ওয়ারের বিপরীতে
জমে ওঠা কাল্পনিক ওজোনের স্তর।
লোহার লিঙ্গের গিঁটগুলো
প্রাগৈতিহাসিক ঘোড়ার গতিতে
চিরে ফেলে বঙ্গীয় ভেড্ডিড বালিকার
কোমল মাতৃকা
আর গান বেজে ওঠে চিৎকারের সত্য ছাপিয়ে
ভারতীয় সতীত্বের বাণীচিত্রে।
ভোরে কুয়াশার ধুসর দরোজা দিয়ে
সার বেঁধে কলকল মেয়েগুলো ঢুকে পড়ে
বাণিজ্যিক সুড়ঙে;
সংখ্যায় চিহ্নিত এপ্রোনের সাদা কবরের গর্ত থেকে
রাত নয়টায় চৌদ্দ ঘন্টা চর্কির পর
উগরে পড়ে গানগুলো রাস্তায় রাস্তায়।
হা ঈশ্বর! গানের ভিতরে এত নির্বিচার পণ্যনীতিমালা।
পথের কুকুর আমাকে অভিবাদন জানিয়ে মেলে ধরে
তার চিহ্নিত ড্রেগার আর বাদামি পটাশ পুড়ে
উড়ে যায় তৃণমূল কর্মীর হাত; শহরময় ছড়িয়ে পড়ে
অদ্ভূত উল্কি আঁকা অর্ধ বাহুগুলো
আর মোলায়েম মাউস টিপে রাত জেগে চর্চা হয়
বৈধ স্বরলিপি
ইস্পাতের রিডগুলো আঁচড়ে কামড়ে বের করে
অবৈধ সঙ্গীত।
আহা গানের ভিতরে এত সন্ত্রাস
সাদা নিরপরাধ ডিমের ভিতরে বেড়ে ওঠে
গ্রহান্তিক তথ্য প্রযুক্তির অতিকায় ডাইনোসর
আর বালির ভিতরে ঘুমের প্রোটিন খেয়ে
ফুঁসে ওঠে সামাজিক প্রকল্পের দুর্দান্ত ধুন্ধু
তার নিশ্বাসের সর্বনাশা বাযু
ব্যর্থ করে দিচ্ছে শস্যলিঙ্গের চেতনা।
– আহা মাতৃ যুগের সবুজ শস্যের গান
নিম্নমুখী আকাঙ্ক্ষিত মনোযোগ আমার
এই সচেষ্ট ভোলার আবেগ ধারণ করো গানে
এই উদ্ভ্রান্ত যৌবনের প্রান্তে মেলে ধরো
পরাগের উচ্ছ্বসিত গর্ভ মোহনা
আমাকে অভিভূত করো শস্যজন্মের বিস্তারিত পূর্ণিমায়
দূর করো এইসব প্রকল্পিত গানের দুস্থতা।
আহা জলাশয়! মেঘপুঞ্জের বিকৃত আকরণ
উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে নিজ প্রেরণায়
গান হয়
ফেনা ওঠে কামনার তপে
জপে জপে জলাশয় জমে ওঠে
মাছের জলসায়
হা ঈশ্বর! গানের ভিতরে এত জৈবনীতিমালা।
ধানসত্য কবিতা সিরিজ
এক
পিছনে জমিন যায় সোহাগী বিহান যায়
হাটিয়ার সুখ আর মুলিয়ার বাঁশি
সাগরগঞ্জের আলু যায় বেহাগ যায়
বিবাগী বৈকালী
তাই বটে বসে আছে
জীবন বিছায়েছে
পাড়ে নদীয়ার
নির্জনে বাজিয়ে মঞ্জরী ধূপরেণু করছে আরতি
রাখো গো গঙ্গা মাতা, রাখো মোরে এ মিনতি
আমার রক্তের রেণু বিছায়েছি পদে গো তোমার
জলেতে জীবন ধন জলেই মরণ
সে দেখেছে জল বড় উর্ধ্বগামী হয়
জলের আকার নেই
এই কথা কে তাহারে করাবে বিশ্বাস।
দুই
তাহারা পানির প্রাণ, তাহাদের মন থাকে
মটকীর ভিতর; জাবারের ধান থেকে
পোনার ঝাঁকের মতো পয়দা হয় শিশুদের প্রাণ
যেন সে কুণ্ডুলিনী, কলকল
পানির নহরখানি ধরে রাখে। সঞ্জীবনী ধান
তোমার গোমরখানি ফাঁক হলে
এ নদী শুকিয়ে তবে খাক।
এ ভরা আষাঢ় মাস, ধানের বৃষ্টির তোড়ে
নেমেছে রাধিকা বর্ষা এ গাঁয়ে।
সকল কিষাণজন
ধরেছে ধান্য ভজন
মাড়াইয়ের চক্রাকার একাগ্র সাধনে।
আসিবে আশ্বিন মাস,ক্ষীণস্তনা বৃদ্ধা রাধিকা এ গ্রাম যবে
মনুর মন্ত্রের মতো ধান ভবে বিশল্যকরণী হবে।
তিন
মেঘেরা মিকাঈল সেজে হাঁকে ডাকে দেবতা মিকাঈল
বৃষ্টির পুরুষ তিনি, তার দয়া
বর্ষা হয়, ফর্সা ফর্সা জল
কলকল ধেয়ে চলে শিয়ান পুঁটির মতন
অথবা শিয়ান পুরীর মতন ঢলোঢলো
যৌবন বিছায়ে থাকে কণকতারা ক্ষেত
লক্ষ্মীর তুষ্টিতে গাঢ় হলুদ রঙে পুষ্ট হয় ধান
কণকতারার তনু কিষাণের সোহাগী বিহান
তার মন এক মণ ধান দিয়ে কিনে নেয়া যায়
তার ধান মন্ত্র শ্লোক, আলিফ লাম মিম
তার ঘরে লক্ষ্মী থাকে ডোলের ভিতর
ব্রহ্মাণ্ড-মোরগ তারে ডাক দিয়ে তুলে আনে মাঠে
লক্ষ্মীর মসৃণ পেটে হাত রেখে দিনান্তের ঘরে
নিশ্চিন্তির ঢেঁকুর তুলে ঘুমিয়ে পড়ে
ওঁ ধান্যাঞ্জলি, মাতা গঙ্গা, দেবতা মিকাঈল
তোমাদের দয়ার শরীর
কী মাটির শরীর নিয়ে খেলা তোমরা খেলো না দিনরাত।
চার
নদীর ভিতর থেকে উঠে আসে কাদাজলে ভেজা
তবে তারা মাছ নয়, মানুষ, মাছের মতন
জল পেলে খলবল করে উঠে মাছের ভাষায়
আর তারা প্রেম করে
সাদা কাচকির মত পুষ্ট পুষ্ট ভাত তারা একথালে খায়
নারীর নাভির নিচে ফুলে ওঠে তরতাজা ডিম
ধানের গরম গন্ধে ওম দিয়ে ফোঁটায় ডিম্বক।
গাভিন গাভীর সাথে চিরদিন সখ্য তাহাদের
দুই মুঠো ভাত তার মুখে দেয় দিনের প্রসাদ
পৈঠা পবিত্র করে গোবরে লেপে;
এই মতো পুজা তার
গরুর পুজা তারা করিতেছে বংশ বংশ ধরে
জীবন্ত গৃহের দেবী
স্তন তার ধান তার সন্তান-ভরা এই সংসার তাহার।
পাঁচ
মাজরা পোকায় তার কলিজাটা কুরে কুরে খায়
চোখে ওঠে সর্ষে ফুল, বিবিধ জণ্ডিস
পোকার জননখেলা মাঠ ভরে এমন সন্ত্রাস
তার হাড় খোঁড়ে খোঁড়ে একেবারে খেয়ে নেয় শাঁস।
শুকনো গাঙের মতো গাঁওখানি ফাটা গাও চাটে
ধানের গল্প তারা খায়, চিবায়, জাবর কাটে
গ্রাম ছেড়ে ঘুম যায়, উঠান পেরিয়ে আসে ওলাউঠা বিবি
নাভি ধরে মোড়া দেয়, যেন খোদ আজরাঈলের ছবি
শীতলা দেবীর নামে ভোগ মানে তারা
ফলার শিন্নি দই ট্যাক্স দেয় তিনমুখো কালে
তাতেও ভরে না যেন ব্রহ্মার মন
বারবার চৈত্র আসে বসন্তের কলাই মাথা করে
মসজিদে মিসকিন খায় খতমে ই’নুস
আল্লা যদি মুছে দেয় বাল্লা মসিবত
উল্টো অঞ্জলি করে মিকাইল ভজে
শীতলার ভয়ে জপে আসতাগ ফিরুল্লাহ।
ছয়
তাহার সকল বিপদ কাকগুলো মুখে নিয়ে ওড়ে
এইসব আর্যকাক, তুর্কি, ইংরাজ কাকের কন্ঠে থাকে
শনির আছর।
একটি কাকের ডাক
তার বাড়াভাতে কালি মেখে যায়
তাই তারা ভিখ দেয়
সকল উচ্ছিষ্ট ফেলে কাকেদের মুখে।
তাদের খোকন ছেলে গরু নিয়ে কোন মাঠে গেছে
না জানি কাকের ছায়া পড়ে তার গায়ে
বিহানে কাকের ছায়া মাড়ানো তো পাপ
এই পাপে ধান নাশ, পুত্র নাশ, ধর্ম নাশ হয়।
নিজের পাতের ভাত একনলা তুলে দেয় বিড়ালিনীটিরে
ষষ্ঠীরে ঘরে ধরে, ইতুর মুখের দিকে মুখ করে পাও চাটে
ইতু তারে ধন দেয়, প্রেম দেয়
ভবানী ধানের মত হৃষ্টপুষ্ট পুত্র এনে দেয়।
সাত (বীজচৈত)
আল্লা মেঘ পানি ফল আজ বীজ চৈত
বীজের ভিতরে ঘুম ওমে তাতি মুই
সইলো বিহানী মন চৈতের ভুঁই
ফেটে আছি অষ্টাঙ্গ কষ্ট জ্বালা রৈদ।
দিও না চুলার মুখে ভুলেও কড়াই
আষাঢ়ে আশার ধান পুড়ে হবে ছাই।
এক ঘটি জলে ভিজে আম নিম পাতা
সারাদিন বীজেমন্ত্রে ঘটকালি স্মৃতি
পৈঠা সাজায়ে বসে গাও বীজগীতি
আও গো নারায়ণং লক্ষ্মীধন মাতা।
ফেলেছি গঙ্গায় ঘট সন্তানের ভোগ
ধান্য ওমায়ে যালি দইভাতা খাও
পড়শি পরমজনা কাঁচা পিঠা নাও
আমাদের ঘটকালি শাস্ত্রমন্ত্রযোগ।
বজ্রযান
জেনেছি তুমি আলোর অভিধান
আর জেনেছি তোমার সম তাপ
প্রতি জন্মে নির্ধারিত পাপ
বজ্রে আমার এমনি উদ্গান।
যেমন জল আদপে জল নয়
তেমন তুমি জানার বিস্ময়
তোমারি এক পরম হাহাকার
আমি, তাই তোমার অধি-আকার।
বজ্র অর্থ জেনেছি শূন্যতা
আমার গান জেনেছি বজ্রযান
আমি কি তবে শূন্যেরই ভিন্নতা
আমার গতি বজ্রে বহমান?
বিদ্যুতের ভিতরে যাওয়া যাক
কেবল গতি শুধুই ঘূর্ণন
একটি ‘আমি’ অন্য ‘আমি’র মন
বলেছেন তো প্রফেসর ডিরাক।
শূন্য হইতে আমি শূন্য হলে
বজ্র অর্থ পরম নির্বাণ
দিব্যজ্ঞান আলোর মতো জ্বলে
অগ্নিমন্ত্রে বুদ্ধ ভগবান।
একটি আলবাট্রস, তার গান
একটি ঘন গান বিস্তারিত হয়ে
সংসার ছাড়ে
ভাষার ভারহীন বেদনা বোধগুলো
হাওয়ায় বাড়ে
১.
বাতাস গতির বৃত্ত ভেঙে ভেঙে দিচ্ছে সমুদ্রের সাহস
উপকূলে ভেঙে পড়ছে তরঙ্গের সকল তত্ত্ব
আর আলোর বালুতে বাতাসের অবসরমালা
পিছনে বনভূমির ভেতরে এক দেশ
আলবাট্রস পাখিদের আলোকপ্রাপ্তির অধ্যাবেশ
ঘূর্ণিবাতাসের মুখ থেকে ছিনিয়ে আনা গানগুলো
গাছের শিকর জুড়ে শিহরণ তোলে।
এখন মৌসুম পাখিদের। অসংখ্য সাদা পাখি
ভাসছে দাঁড়িয়ে- ঢেউয়ের উপর পা রেখে
তারা উপভোগ করছে সাগরের উত্তল পেটের মসৃণ আদর
আর স্ফূর্তির ফেনার থেকে বর্ণগুলো খুলে নিয়ে নগ্ন হয়ে
উঠে আসছে বেলাভূমির বালুতে।
ডানা ছড়িয়ে দাঁড়াবে সারিবদ্ধ আলবাট্রস পাখিরা
শুরু হবে পুরুষ পাখিদের চর্যাবর্ত কোরাস
মেয়ে পাখিদের উর্ধŸমুখী অনুধ্যান।
প্রতি দ্বিতীয় বছরে এই আয়োজিত স্বরন্যাস
গ্রহণে পাতার ঝোঁপে লাল ব্যাঞ্জনা ওঠে
গীতিব্যাঞ্জনের এই প্রসিদ্ধ চুম্বন চিহ্নে জমা হয় বজ্র ও কিরণ।
গানের পিপাসা এত তীব্র জিহ্বায় জীবাশ্ম কেঁদে ওঠে
প্রতীক্ষাগুলো নেমে আসে পালকের মহান প্রবাসে
আলবাট্রস পাখিদের প্রতীক্ষা সাগরে ঢেউ ভেঙে
আটাশ দিন যায়;
একবার অপেক্ষার মাত্রাভেদ হলে
সাগরের সম্মোহন আমরণ বিস্তীর্ণ বাতাসে
সময়ের সাদা ঘুম চির বিরহের অধিবৃত্ত আঁকে।
২.
আলবাট্রসের উড়ালস্তরের কিছুটা উপরের আকাশে
একা শিস তোলেছে গান পরাহত এক পাখি
তার গানের অভিজ্ঞান সমুদ্রের মনস্তাত্ত্বিক ভাপে ভরা।
সে পাখি- দারুণ আলবাট্স
সময় ও দূরত্বের উপর সে ভাসমান
সে ভালোবাসে ঢেউ আর বাতাসের বাস্পকণায় চিন্তার রেণু
ভেঙে ছড়িয়ে দেয়া
সে পেয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত বাতাসের মৌলিক স্মরণ
আর বর্ণহীন বাতাসের নীল যোনিপথ
সে তার অস্তিত্বকে বিলিয়ে দেয় বাস্পীভূত জলে
আর কুড়াতে থাকে আগুন প্রতিটি কণিকার গতির ভিতর।
অয়ি উচ্ছ্বসিত বাযু আয়ুহীন আমার আগুনের বান্ধবী
তুমি আমার মস্তকের চুল্লিতে জাগরণ হও, ঢেউ ওঠো
আর নেমে আসো হাড়ের ভিতরে;
পরিপূর্ণ হাওয়াময় হাড় আমার প্রকৃত স্মরণ
মেঘের মধ্যে জলীয় বাতাস, আগুনের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হাওয়া
ঢেউয়ের মধ্যে বহমান বায়ু আর জীবনের মধ্যে অনিবার্য আশ্বাস।
এখানে হাওয়ার মধ্যে তুমি বেজে ওঠছো
চেতনার ঈভ
আমরা
নাচ হচ্ছি
গান হচ্ছি
জলের ছায়ায় ডিম পোহাচ্ছি
আর বেড়াচ্ছি বাতাসের বিপরীত বিহার
ওঃ কী নির্জন অঙ্গারের অহংকার হয়েছি আমি
কী সত্য এই পৌরাণিক মনোনিবেশ।
তুমি হারিয়ে গিয়েছো আর বাড়িয়ে দিয়েছো আমার হিমাংকের রেখা।
আমি ধারণ করেছি জীবাশ্মের শীত
পেয়েছি মৃত্যুর অভিনিবেশ।
৩.
বজ্রের বিদ্যুৎ থেকে ছিটকে পড়া জলজ গতিটি
তার পালকের নীচে আঁশ বুনছে আকাঙ্ক্ষার
আদিগন্ত কুয়াশার ভেতর অশ্মীভূত নৃত্যের রেখা
প্রত্নসংসারের আখ্যান হয়েছে;
তবুও বাতাসভর্তি বরফকণার মতো লিবিডো
গোপন কশেরুপথে আসা যাওয়া করে।
কুয়াশাদগ্ধ আলবাট্রস তার পাখনায় তুলে নেয়
অস্তিত্বের মৌলিক মতবাদ
কতো শৈত্য ভেঙে পড়ে গানের শিসে
আর কতো ঋতু স্বপ্নের ডিমসহ চাপা পড়ে হিমাংকের নীচে
প্রথার মিরাকলে উজ্জ্বল বরফের মতো শুক্রমঙ্গলে সে ভেসে বেড়ায়
শূন্য- অভিব্যক্তিহীন।
বাতাস তার চেতনার উপর বিছিয়ে দেয় শীত বিস্মৃতির
অশ্মীভূত নৃত্যের রেখাগুলো উল্কি আঁকে হাওয়ায় আর
ঢেউয়ের উপরে জমতে থাকে সাদা সাদা বিবরণ।
জাহাজের সাংকেতিক রশ্মিগুলো পূণ্যের জন্যে
বরফের উপর দাঁড়িয়ে থেকে ভুলে যায় তার ঘন গাণিতিক বোধ
ঘনত্ব হারায়ে তবু জমে থাকা যায়
প্রতœবোধে প্রোথিত হয় অন্য সমীকরণ;
হয়ে ওঠে সবাই মেরুকেন্দ্র, গান পরাহত পালকের ধৈর্য্য
ঘন হয়, উত্তীর্ণ হয় শিল্পে ও শিশিরে।
৪.
পৃথিবী এখানে বসে থাকে পুরাবৃত্ত জলচিহ্নে
রিসার্চ টেবিলে নড়ে ওঠে কুয়াশার হাত
জলের বিগ্রহ গাঢ় বর্শা হাতে নিয়ে পক্ষি শিকারে মাতে
আলোর ছায়াকে কালো সংখায় চিহ্নিত করে গবেষক লেন্স
ফুটন্ত ফেনার পাঁপড়িতে চুমু খায়
আর উথলে ওঠে পাখিদের দুঃখহীন শোক।
আহ্ নির্বোধ উড়াল ভরা প্রকৃত বেদনা
আহ্ আমার বয়স সমান ক্রন্দনের সাদা বাস্বতা
পাখার প্রতিজ্ঞা, আহ্ হাওয়ার কোহল
দুঃখ করো; বরফ সমতলের উপর আছড়ে পড়ে
মাতম করো ঢেউয়ের মতো
জীবাশ্মের মতো তীব্র বোধগুলোকে ছড়িয়ে দাও মেরুর বাতাসে
অস্তিবাদী লাল জিহ্বার উত্তাপে ভেঙে পড়ো অস্থির সমুদ্রে।
এখানে নিস্পৃহ অক্ষরের বোকা কবিতা
কোনই ব্যাঞ্জনা তোলে না, গীতি বিন্যাস-
সম্পর্কের নীল মন্থন ছাড়া উদাসীন শোক।
ঘন জ্যামিতির মতো বহুমাত্রিক বোধ হাত পা ছড়িয়ে জিহ্বা মেলে
ভেসে বেড়ায় বাতাসে
তার স্বচ্ছ চোখের অবারিত বিতৃষ্ণায়
জ্বলে যায় নিষিদ্ধ সকল গ্রহণের কাল।
৫.
বিস্মৃতির ভাষা তৈরী করে প্রচুর পরাবাস্তব প্রতিভাষ
বাতাসের গভীর উপত্যকার ভিতরে ডুবে যেতে যেতে
আলবাট্রস খুঁজে পায় শূন্য যাপনের অনন্ত মেটাফর
অনুভব দূরাগত অপেক্ষার ছায়ামূলে মনোভাব হয়।
শতাব্দীর শেষ হাওয়া যেমন কবিতার শব্দে আরোপ করেছে
মহাবৃত্তের ধ্বনিসংকেত, উড়ালের সাদা মোহে প্রিয় পাখি
বুঝিতেছে ঘূর্ণিরাত অন্ধকার পাখনার শুধু গান নয়
প্রকৃত ব্রহ্মচারী স্মৃতিগ্রস্ত নৈতিকতা মানে না, তার ব্রত শূন্য।
যখন মিলিয়ে যাই আমার দৃষ্টির মধ্যেকার অন্ধকার বোধে
আর আমি বেশ অন্ধ হয়ে দেখি তাকে, জীবিত জলের মতো
বজ্র ভেঙে উড়ে আসে মেয়ে; আঃ পাখি, বজ্রদগ্ধ আলবাট্রস
তুমিও কি উড়ে আসো দর্শনের শূন্যময় বোধে, স্মৃতির বালুতে।
স্ত্রীনিষদ
শাস্ত্রকথন-১
এনেছি বহন করে তাই তুমি হলে বধূ
চোখে হোমাগ্নি লহো মন বেঁধে রাখো ঘরে
কথা বাক্য পাপ জেনো আর্যসত্য পুরুষের
হোম যজ্ঞ শাস্ত্রপাঠ না অসুরী অধিকার
এই যে বিজয়দণ্ড খাড়া করে রাখিলাম
তোমাকে গ্রন্থিত করে বেদবাক্য ভাষা পাক
একটি দারুণ বৃত্ত রক্ত রেখায় অংকিত
তার মধ্যে ফুঁটে থাকো দণ্ডমুণ্ডে ফুলপরী
কষ্ট লুকানো ভালো নষ্ট হবে অন্যথায়
ভাগ্যের শনিগ্রহে অগ্নিবলয় সর্বদা
করো ধন্য দেবতার স্বামীপ্রাণা নারী সব
পদ চুম্বনে স্বর্গ বৃত্তমধ্যে আবির্ভাব
প্রথমে প্রসব করো যুদ্ধাপুত্র বীরনর।
ওম শান্তি বলো শান্তি জপো নামা হরিহর।।
শাস্ত্রকথন-২
জন্মের পাপ তার আগুন পূজার দাহ
সহমরণ মেনে অসহ জীবন দেয়
ভেদ ও অভেদ কিছু বুঝিবার না-পারিয়া
পাপের কঠিন মর্ম মর্মে মর্মে বিঁধিয়াছে
দেখা হোক শাস্ত্রবিধি বেদবিদ্যা জ্ঞানকোষ
ইমস্য যৌবন তার স্তন্যদুগ্ধ নমঃ নমঃ
মাতৃ অমৃত সত্য জমা থাক কৃতজ্ঞতা
তাহার মাহাত্ম্য নিয়ে লেখো বীররসে কাব্য
আর এ সতীর জন্য শিবসত্য শিরোধার্য
গ্রহ ও নক্ষত্র ভেদে গতিবিধি পণ করা
‘তোহেরি নিঅ ঘরিনী’ মত সহজ সুন্দরী
সহজিয়া পিয়া সে, অধ্যাত্ম আন্ধার ঘরে
বাঁধাবুলি যোগচর্চা, স্বাসেবা ধর্ম সিদ্ধি।
চিতায় যুগল জ্বলা জাত কুলে পূণ্য বৃদ্ধি।।
শাস্ত্রকথন-৩
এরাও গাভীরই মতো দুগ্ধ বাছুর চাষাবাদ
খুবই মোলায়েম মাংশ শরীর স্বাস্থ্য সুন্দর
ঐ যে মেয়েটি তারে বকনা বালিকা বলি
আমার দন্ডের তলে সে ফলাবে সংস্কার
দেবতা সূর্য বাপ মাফ করো পুত্র পাপ
আমাদের ঘর ভরে দাও বকনা বালিকা
হোমের আগুনে পুড়ে শাস্ত্রসিদ্ধ করে নেবো
গরম শৃঙ্গার রস জিহ্বায় চেটে খাবো
শুক্রের সফেদ জলে ভরবো জমিন তার
ঋতুমতী রমণী সে আর্যরক্ত ধারাবাহী
বিয়োবে বছর শেষে অশ্বশক্তিধর পুত্র
যজ্ঞের অগ্নিশিকে আর্য টীকা দেবো তার
সূর্য একমাত্র পিতা পুরুষসত্য পিতৃদেব।
বধূরা মাতৃশিক্ষা দেবে উলু ধ্বনিতে।।