ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দুইশততম জন্ম বার্ষিকীতে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাব ভেবেছিলাম৷ মানসিক দ্বন্ধ আর ব্যস্ততার কারণে হয়ে উঠেনি৷ একটা ব্যাপারে অবাক হয়েছি, বেশির ভাগ শিক্ষিত জন বিদ্যাসাগরকে বাংলা লিপির প্রবর্ত্তক মনে করেন৷ এছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও ‘বিদ্যাসাগর’ খেতাব আরও অনেকে পেয়েছিলেন৷ অনেকজন বিদ্যাসাগরের মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্রই আজ বিদ্যাসাগর বলে সর্ব্বজন বিদিত৷
বিদ্যাসাগর বাংলা লিপির প্রবর্ত্তক ছিলেন না, সংস্কার করেছিলেন৷ জীবিতাবস্থায় স্বেচ্ছায় হোক বা তৎকালীন সমাজ বাস্তবতার কারণে হোক, তিনি ইংরেজ রাজনীতির শিকার ছিলেন৷ তার কর্ম্মে, তার রচনায় তাই ইংরেজ তোষণ লক্ষ্যণীয়৷ বর্ত্তমানেও তিনি রাজনীতির শিকার হয়েই রইলেন৷ বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার, শিক্ষা বিস্তার, নারী শিক্ষা, বিধবা বিবাহ চালু অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলেও সেকালে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে৷ একালে এসে সমালোচিত হচ্ছেন ব্রাহ্মণ্যবাদ বিরোধীদের কাছে৷ একালীয়দের দাবী বিদ্যাসাগর অধ্বঃপতিত ব্রাহ্মণ্যবাদকে সংস্কার করেছিলেন বাঁচিয়ে তোলার জন্য৷
কলকাতা থেকে প্রচারিত সংঘীদের একটা পোষ্টার ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ তারা বাংলাদেশের বাংলাকে বাংলা বলে মানতে নারাজ, বরং বিদ্যাসাগরী সাধু বাংলাকে তারা সনাতনী বাংলা বলে দাবী করেছে এবং সে বাংলাকে পুনপ্রবর্ত্তন করতে চায়৷ এরা আসলে বিদ্যাসাগরকে ডুবাতে চাইছে৷
প্রকৃতপক্ষে সনাতনী বাংলা বলতে যদি কিছু থেকেও থাকে, সেটা বাংলাদেশী বাংলাতেই বহাল আছে৷ বিদ্যাসাগরী সাধু (ব্যবসায়ী, বেনিয়া) বাংলা ছিল কৃত্রিম৷
বাংলা ভাষার বিকাশ শুরু হয়েছিল পালযুগে৷ এরপর সেনযুগে বাংলা পরিণত হয়েছিল ব্রাত্য ভাষায়৷ বাংলার প্রথম রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের যুগে৷ তিনি তার সালতানাতের নাম রেখেছিলেন বাঙ্গালাহ৷ বঙ্গ শব্দের ফারসী রূপ বাঙ্গালাহ৷ অনেকে মনে করে বঙ্গ শব্দের সাথে আল যোগ হয়ে বঙ্গাল হয়েছিল৷ এটা সঠিক মনে হয় না৷ বঙ্গের অধিবাসীরা বঙ্গাল নামে পরিচিত ছিল৷ এই বঙ্গালেরা আর্য ছিলেন না, তাই অন্যরা এদের খাটো চোখেই দেখতেন৷ এই যুগে এসেও দক্ষিণ ভারতীয়সহ অন্য অনেক ভারতীয় বাঙ্গালীকে বঙ্গাল বলে তাচ্ছিল্য করে থাকে৷
মূলত সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ বঙ্গালদের বাসভূমির নাম রাখলেন বঙ্গালাহ৷ ফারসীর পাশাপাশি বঙ্গালদের ভাষাকেও সরকারী ভাষার মর্য্যাদা তিনি দিয়েছিলেন৷ অন্যান্য মুসলিম শাসকদের মতো বঙ্গাল হিন্দুদেরকেও সরকারী কাজে নিযুক্ত করলেন এবং বঙ্গালদের সাহিত্যকে প্রণোদনা দিলেন৷ সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহকে আধুনিক বাঙ্গালার জনক বললেও বলা যায়৷
সরকারী দপ্তরে ফারসীর পাশাপাশি বাংলার ব্যবহার, বঙ্গাল মুসলিমদের দৈনন্দিন ব্যবহারে ফারসীর প্রভাব, চাকরীর সুবাদে হিন্দুদের ফারসী শিক্ষা,— ইত্যাদি সব কারণে বাংলা ভাষার বিকাশে যুগে অনেক ফারসী শব্দ বাংলায় স্থান করে নিয়েছিল৷
বিদ্যাসাগরের বাংলা সংস্কারের অন্যতম নিদর্শন হল, তিনি তার গুরুর নির্দ্দেশনায় বাংলায় ব্যবহৃত ফারসী শব্দগুলোকে সংস্কৃত শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন৷ বিদ্যাসাগরের লেখায় এক শতাংশ ফারসী শব্দও পাওয়া যাবে না৷ লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, বিদ্যাসাগরেরা বাংলা থেকে ফারসী শব্দকেই বিতাড়িত করেননি, তারা বাংলার দেশীয় শব্দগুলোকেও অশিষ্ট বলে বর্জ্জন করেছিলেন৷ বিদ্যাসাগর আর তার সহযোগীদের ফারসী শব্দ বর্জ্জন ও সংস্কৃত শব্দের প্রচলনের কারণে দীর্ঘকাল বাংলাকে সংস্কৃতের দূহিতা বলে মনে করা হত৷ মূলত, বাংলা সংস্কৃতের দূহিতা ছিল না৷ আমার এই দাবীর সপক্ষে প্রমাণ পাওয়া যাবে আঠারো শতকের আগে লিখিত বাংলা সাহিত্য ও চিঠিপত্রে৷
তবু বিদ্যাসাগরের অবদানকে ছোট করে দেখি না৷ কিন্তু এও মানি না যে বিদ্যাসাগরের বাংলা আর বাংলাদেশের বাংলা আলাদা কোন ভাষা৷ বাংলায় জল-পানির দ্বন্ধ যখন থেমে গেছে, তখন সংঘীরা নতুন করে সনাতনী বাংলা ফর্মূলার জন্ম দিয়ে বাংলাকে বিভক্ত করতে চাইছে৷
জয় বাংলা৷…