নাপিত ও সার্জনের দৃষ্টিতে বাংলা বানান-সংস্কার || শিশির ভট্টাচার্য্য

0

পৃথিবীর প্রথম পাস করা শল্যবিদ বা সার্জনদের মধ্যে অনেকেই প্রথম জীবনে পেশায় নাপিত ছিলেন। ইংল্যান্ডে এখনও ডাক্তারদের ‘ডক্টর’ এবং সার্জনদের ‘মিস্টার’ (নাপিত) বলার রেওয়াজ আছে (সার্জনদের ডক্টর বললে তাঁরা নাকি অপমানিত বোধ করেন!)। মধ্যযুগে ইওরোপের নাপিতেরা দলে দলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল শল্যবিদ্যায় ডিগ্রি নিতে। এই নাপিতেরা যখন পেশাদার সার্জন ছিলেন না, তখন রোগীর শরীরে তাঁরা হয়তো ইচ্ছেমতো ক্ষুর চালাতেন। কিন্তু ডিগ্রি নেবার পর, অর্থাৎ মানবদেহের অঙ্গসংস্থান সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে ফেলার পর, ক্ষুর ধরতেই তাঁদের নিশ্চয়ই হাত-পা কেঁপে উঠতো।

মানব শরীর ব্যবচ্ছেদ করে সার্জন, বৈয়াকরণ করে মানব ভাষার ব্যবচ্ছেদ। ব্যাকরণ হচ্ছে প্রাচীনতম শাস্ত্রগুলোর একটি যাতে অধিকার লাভ করতে হলে (অন্য আর দশটি শাস্ত্রের মতো) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অপরিহার্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যাঁরা বানান নিয়ে আলোচনা করেছেন বা বানান সংস্কারের সুপারিশ করেছেন তাঁদের সিংহভাগ পেশাদার বৈয়াকরণ নন, অর্থাৎ আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি তাঁদের নেই। ভাষাবিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলে বানানে হাত দেয়া যাবে না- এমন উদ্ভট দাবি অমি করি কোন মুখে, যখন জানি যে এম.বি.বি.এস. পাশ ডাক্তারকে টেক্কা দিতে পারেন, এমন হাতুড়ে ডাক্তারের অভাব কোনো কালেই ছিল না বাংলাদেশে। তবে হ্যাঁ, যে কোনো বিষয়ে পেশাদার ও অপেশাদার ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে একটা ফারাক না থেকে পারে না। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকলে, আমি নিশ্চিত, যেসব ভুল সুপারিশ বানান-সংস্কারকেরা করেছেন (এবং এখনও করে চলেছেন), সেগুলো হয়তো তাঁরা করতেন না। হয়তো বানান-সংস্কারের পথেই তাঁরা যেতেন না, বা গেলেও অনেক চিন্তাভাবনা করে তারপর ক্ষুর ধরতেন।

লিখিত ভাষার বিবর্তনের কোনো এক পর্যায়ে কমবেশি উচ্চারণ অনুসারে শব্দের প্রথম বানান স্থির হয়। প্রাকৃতিক কারণে প্রজন্মান্তরে উচ্চারণ বদলায়। নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখার পর শব্দের উচ্চারণ বদলায়। বিভিন্ন কারণে অন্য ভাষার শব্দ এসে প্রবেশ করে বাংলা শব্দকোষে। বাংলা ভাষার ধ্বনিতত্ত্বের নিয়মে সেই শব্দগুলোর মূল উচ্চারণ বদলে যায় এবং সেই অনুসারে বানান নির্ধারিত হয়। ভিন্নভাষার ধ্বনি সঠিকভাবে লেখার মতো বর্ণেরও অভাব থাকতে পারে বাংলা বর্ণমালায়। এরকম বহু বিচিত্র কারণে শব্দের উচ্চারণের সঙ্গে বানানের অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়। যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, যে কোনো সমাজে বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ এই অসঙ্গতি দূর করতে চায়। উচ্চারণ বদলে দেয়া মানুষের প্রায় সাধ্যাতীত। বানান অবশ্য ঘোষণা দিয়ে বদলানো যায়, পুরোনো বানান বাতিল করে নতুন বানান চাপিয়ে দেয়া যায়। বানান ও উচ্চারণের অসঙ্গতি দূর করতে বুদ্ধিজীবীদের একাংশের উদ্যোগে দেশে দেশে বানান-সংস্কারের সূত্রপাত হয়।

যে কোনো ভাষার বানান সংস্কারের ইতিহাসে কমপক্ষে তিনটি দল বা পক্ষ থাকে। প্রথম পক্ষ চায়, বানান হবে উচ্চারণের অনুসারী। সংস্কৃত ‘কর্ণ’ থেকে সৃষ্টি হওয়া ‘কাণ’ শব্দটি মূর্ধর্ণ (ণ) বর্ণ দিয়ে লেখা যাবে না, কারণ বাংলায় মূর্ধণ্য (ণ) ধ্বনি নেই। রবীন্দ্রনাথ, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু প্রমূখ আছেন প্রথম দলে। দ্বিতীয় পক্ষ চায়, শব্দের ব্যুৎপত্তি অর্থাৎ উচ্চারণের বিবর্তনের ইতিহাস ধরে রাখবে এর বানান। দেবপ্রসাদ ঘোষ, সুনীতিকুমারের পিতা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন এই দলে। শ্রী ঘোষ ‘কাণ’, ‘বাণান’ লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। তৃতীয় পক্ষ চায়, বানান যেমন আছে, তেমনই থাকুন, কালের প্রবাহে যা বদলাবার বদলাবে। এই দলে আছেন গোলাম মুরশিদ ও মনসুর মুসা। এই তিন দলের দাবিই কমবেশি মেনে নিয়ে গত শ খানেক বছর ধরে বাংলা বানান বিবর্তিত হচ্ছে।

সংস্কারবাদীরা নিদান দিয়েছেন: ‘খ্রীষ্ট’ ও ‘ষ্টেশন’ বিদেশি শব্দ বলে দন্ত্য-স ব্যবহার করে ‘খ্রিস্ট’ এবং ‘স্টেশন’ লেখা উচিত। কোন ভাষার উচ্চারণ অনুসৃত হচ্ছে এসব শব্দে, ইংরেজি, নাকি বাংলার? উচ্চারণানুগতাই যদি লক্ষ্য হবে, তবে ‘খ্রিশ্টো’ নয় কেন? সংস্কারবাদীরা বলেন, ‘কর্ণ’ থেকে ‘কান’ এবং ‘স্বর্ণ’ থেকে ‘সোনা’ হয়; কিন্তু ‘পদ্মা’ থেকে ‘পদ্দা’ বা ‘লক্ষ্মী’ থেকে ‘লোকখি’ হয় না, কারণ তৎসম শব্দে ‘পূর্বের বানান বহাল থাকিবে’। তাহলে ‘কার্ত্তিক’, ‘তর্ক্ক’ ইত্যাদি তৎসম শব্দে কেন ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব হবে না, বিশেষত যখন বাংলার একাধিক উপভাষায় ‘কাত্তিক’, ‘তক্ক’ উচ্চারণ শোনা যায়? ‘সূর্য্য’, ‘ভট্টাচার্য্য’ শব্দে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব আছে মনে করে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান-সংস্কারকেরা য-ফলা বাদ দেবার নিদান দিয়েছিলেন যা চোখ-কান বুজে মেনে চলছেন হালের সংস্কারবাদীরা। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সোৎসাহে এই সিদ্ধান্তের সমর্থনে কলম ধরেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে এসব শব্দে আছে দুটি আলাদা ধ্বনি: য এবং য়। হায়! ধ্বনি আর বর্ণকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন ত্রিশের দশকের বাঘা বাঘা বৈয়াকরণেরা এবং তাদের (এবং আমাদের সবার) গুরু রবীন্দ্রনাথ। সংস্কারকদের একজন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অবশ্য পরবর্তীকালে এই মহাভুল কবুল করেছিলেন।

একটা শব্দ কত পুরোনো হলে সেটিকে আর ‘বিদেশি’ বলা যাবে না? ‘খ্রিস্ট’ বা ‘স্টেশন’ আরও কত বছর পরে বাংলা শব্দকোষে আত্মীকৃত হবে? একজন সাধারণ ভাষাব্যবহারকারী কীভাবে জানবে কোন শব্দটা তৎসম, কোনটা তদ্ভব, কোনটা বিদেশি? বহু পুরোনো এই প্রশ্নটির পুনরাবৃত্তি করেছেন গোলাম মুরশিদ, প্রথম আলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক রচনায়। প্রকৃতপক্ষে ‘বিদেশি শব্দ’ কথাটাই বিভ্রান্তিকর, কারণ বাংলা ধ্বনিতত্ত্বের নিয়ম না মেনে কোনো শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বাংলা বা পৃথিবীর কোনো ভাষায় একটিও বিদেশি শব্দ থাকার কথা নয়।

পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই শব্দের উচ্চারণের সাথে বানানের শতভাগ মিল রাখা সম্ভব হয় না। উচ্চারণ অনুসারে যদি বানান লিখতে চাই তবে ‘সন্ত্রাস’-কে ‘শন্ত্রাশ’ ও ‘বাঘ’-কে ‘বাগ’ লেখা উচিত। এর কারণ প্রথমটি শব্দটিতে উচ্চারিত হয় তালব্য-শ এবং দ্বিতীয়টিতে অক্ষরের শেষে মহাপ্রাণতা বজায় রাখা অসম্ভব। ‘গোলাপ’ + ‘জল’ = যদি ‘গোলাবজল’ হয়, তবে ‘ডাক’ + ‘ঘর’ = ‘ডাগঘর’ হওয়া উচিত, কারণ বাংলায় কোনো স্পৃষ্ঠ অঘোষ ধ্বনি (প, ত, ক) কোনো স্পৃষ্ঠ ঘোষ ধ্বনির (ব, দ, গ) অগ্রবর্তী হলে ধ্বনিটি ঘোষ ধ্বনিতে পরিণত হয়। বলা বাহুল্য, ধ্বনিতত্ত্বের এমনতর সুক্ষ্ম নিয়মের কথা সার্জন অর্থাৎ পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানী ছাড়া অন্য কারও সদাসর্বদা স্মরণ থাকার কথা নয়।

সংস্কৃত সন্ধির নিয়মে কেন ‘উপর্যুক্ত’ লিখতে হবে অথবা সন্ধি পরিহার করে ‘উপরিউক্ত’ লিখতে হবে? নিম্ন + উক্ত = ‘নিম্নোক্ত’ যদি হতে পারে, তবে উপরে + উক্ত = ‘উপরোক্ত’ হতে পারবে না কেন? প্রকৃতপক্ষে এটা বাংলা রূপতত্ত্বের একটি নিয়ম যা সংস্কারকেরা কখনও খেয়াল করেননি। ‘লক্ষ্য করা’-র পরিবর্তে কেন ‘লক্ষ করা’ লিখতে হবে, যখন আমরা জানি যে ‘লক্ষ’ একটি সংখ্যাবাচক শব্দ? বাংলাভাষায় তারিখশব্দ গঠনের রূপতাত্ত্বিক নিয়ম রয়েছে। এই নিয়মে গঠিত ‘পহেলা’, ‘সাতই’, ‘একুশে’ ইত্যাদি শব্দ বাদ দিয়ে কেন ‘এক বৈশাখ’, ‘সাত মার্চ’, ‘একুশ ফেব্রুয়ারি’ বলতে বা লিখতে হবে? অকারণে ভাষাব্যবহারকারীদের মনে দ্বিধার সৃষ্টি করা কেন? বলা বাহুল্য, তারিখশব্দ ব্যবহার না করার এই হুযোগ শুরু করেছিলেন খোদ রবীন্দ্রনাথ যা প্রথমে আনন্দবাজার ও পরে প্রথম আলো বাংলাভাষীদের উপর চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। লেখার ভাষা থেকে এই ব্যাকরণ-বিকৃতি এখন মুখের ভাষায় পর্যন্ত এসে গিয়েছে।

তাই বলে বানান সংস্কারের কি কোনো প্রয়োজন নেই? ২০১২ সালে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে পবিত্র সরকার লিখেছিলেন: “আমরা চাই আর না-ই চাই- বাংলা বানানের সংস্কার এবং সমতা-বিধান গত শতাব্দী থেকেই শুরু হয়েছে- তার ফলাফলকে বিসর্জন দিয়ে আমরা হ্যালেডের আগে পুঁথির যুগে ফিরে যেতে পারি না।” সহমত, কিন্তু এটাওতো ঠিক যে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উদ্যোগে কোনো সংস্কার না হলেও বাংলা বানানে পরিবর্তন আসতো। সে পরিবর্তন হতো ধীর গতির স্বাভাবিক পরিবর্তন, ‘একটী/একটি’, ‘সহর/শহর’ এর মতো। প্রথম আলোতে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রবন্ধে মোহাম্মদ আজম দাবি করেছেন, সংস্কারের ফলে বাংলা বানানের বিশৃঙ্খল বাগান সুশৃঙ্খল হয়েছে। সহমত, কিন্তু সংস্কারের কারণে বাংলা বানানে কিছু তুঘলকী অস্থিরতারও সৃষ্টি হয়েছে, যার জন্যে অবশ্য সংস্কারপন্থীদের অপেশাদার দৃষ্টিভঙ্গীই অনেকাংশে দায়ী।

এ পর্যন্ত যত বানানরীতির প্রস্তাব করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে কমবেশি অসঙ্গতি দেখে মনে হয়, বাংলা বানান সংস্কারে বহু নাপিত যেমন পেশাদার সার্জনের ভূমিকা নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন, তেমনি অনেক পাশকরা সার্জনও অপেশাদার নাপিতের আচরণ করেছেন। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রোমান হরফে বাংলা লেখার পক্ষপাতী ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রস্তাব করেছিলেন ‘একদা এক শৃগাল’ না লিখে ‘অে’ কদা অে’ ক সৃগাল’ লেখা হোক। যোগেশচন্দ্র রায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ‘জ্ঞান’ নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই, তবে এই নমস্য ব্যক্তিদের ভয়ংকর সব বানান-সংস্কার প্রস্তাব তাঁদের ‘কা-জ্ঞান’ সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে।

বানান সংস্কার জাতীয় রাজনীতির অংশ এই অর্থে যে পৃথিবীর যেসব দেশে বানান সংস্কার হয়েছে সেসব দেশের সরকার বাহাদুর সংস্কারের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। ফ্রান্সের মতো গণতান্ত্রিক দেশেই যেখানে বানান সংস্কার বা অভিধান রচনায় পেশাদার ভাষাতাত্ত্বিকদের মত (সাধারণত) কেউ (সে খবরজীবীই হোক বা ক্ষমতাজীবীই হোক) নেয় না, সেখানে চীন বা বাংলাদেশের কথা বলা বাহুল্য। সুতরাং বানান-সংস্কার খুব কম ক্ষেত্রেই ভাষাবিজ্ঞানসম্মত হয়। সুখের বিষয় এই যে Government proposes, People disposes, ফরাসি একাডেমির বানান সংস্কার ফরাসি জনগণ কখনই মেনে নেয়নি। তারা মিছিল করে বলেছে: ‘আমার বানানে হাত দিও না।’ ফরাসি একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত অভিধান সবচেয়ে কম ‘বিক্রিত’ হয় ফ্রান্সে, সম্ভবত এর ‘বিকৃত’ বানানের কারণে। চীনে হাজার হাজার চিত্রলিপির মধ্যে মাত্র কয়েকটি পরিবর্তন করাতে লোকজন প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল চীনের তথাকথিত কমিউনিস্ট সরকারের রক্তচক্ষুর তোয়াক্কা না করে। বাংলাদেশে অন্য অনেক বিষয়ের মতো, চাপিয়ে দেয়া বানানের ক্ষেত্রেও, অসন্তোষের বাণী ‘নীরবে নিভৃতে কাঁদে’।

এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে প্রত্যেক শিক্ষিত ভাষাব্যবহারকারীর শব্দকোষে প্রতিটি শব্দের একটিমাত্র বানান লিপিবদ্ধ থাকে। সেই বানান পরিবর্তিত হলে, আগের বানানের স্মৃতি ভাষাব্যবহারকারীকে দ্বিধাগ্রস্থ করতে পারে: শ্রেণী, শ্রেণি নাকি শ্রেনি? বানানের সঙ্গে ব্যক্তি ও জাতির অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। ‘সঠিক’ বানান লেখা বা না লেখার উপর বি.সি.এস.-এর মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় পাস/ফেল নির্ভর করতে পারে। সুতরাং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বানান হতে পারে জীবন-মরণ সমস্যা। বানান সংস্কারে/পরিবর্তনে রাষ্ট্র ও সমাজের প্রচূর অর্থ ব্যয় হয়। জনগণের অর্থের অপচয় রোধ করার স্বার্থে বানানের ব্যাপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত অবশ্যই যুক্তিসম্মত এবং যথাসম্ভব গণতান্ত্রিকভাবে নেয়া উচিত।

বানান সংস্কারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে তিনটি বিষয় আমলে নিতে হবে: ১. ব্যুৎপত্তি, ২. উচ্চারণ ও ৩. অভ্যাস/ঐতিহ্য। বানান-প্রপঞ্চে অকারণে অস্থিরতা সৃষ্টি করা বাঞ্ছনীয় নয়। বাংলা বানানের ভাষাবিজ্ঞানসম্মত ও কা-জ্ঞানসম্মত সংস্কারে কোনো আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি আছে বিকল্প বানান রহিত করাতে। মনসুর মুসা হিসাব করে দেখিয়েছেন, বিকল্প বানান আছে এমন বাংলা শব্দের সংখ্যা ১৭৫ এর বেশি হবে না। কিছু বিকল্প আগে থেকেই ছিল, নতুন কিছু বিকল্প সংস্কারের কারণে সৃষ্টি হয়েছে। বিকল্প বানান থাকলেও কালের প্রবাহে একটি বানানই টিকে থাকবে, যেমনটি হয়েছে ‘বাংলা’, ‘বাঙলা’ ও ‘বাঙ্গালা’-র ক্ষেত্রে। আমাদের সুপারিশ হচ্ছে: ১. পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীদের দিয়ে বানান সংস্কার করানো হোক এবং ২. বিকল্প বানানও একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বহাল রাখা হোক।

সবাই এক বানান ব্যবহার করা শুরু করলেও সেই বানান চিরদিন বজায় থাকবে না। সবচেয়ে সুস্থির বানানরীতিতেও বৈচিত্র্য ঢুকে পড়বেই। আজকের বানান আগামিকালের মানুষ বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে না। তাদের যুগের উচ্চারণরীতি অনুসারে, ব্যুৎপত্তির দাবি মেনে তারাও নতুনভাবে বানান সংস্কারের উদ্যোগ নিতে চাইবে। আবার সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা নতুন, হাল আমলের বানান ছেড়ে পুরোনো, সাবেক বানানে ফিরে যেতে পারেন। পৃথিবীর একাধিক দেশে এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে, ভবিষ্যতেও যে ঘটবে না এমন কথা হলফ করে বলা যায় না।

 

 

 


শিশির ভট্টাচার্য্য
অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

জন্ম চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড থানার কুমিরা গ্রামে। ভাষা বিজ্ঞানে পিএইচডি (২০০৭) কানাডার মন্ট্রিয়ল বিশ্ববিদ্যালয়ে, প্যারিসের সর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানে এমফিল (১৯৯৫) ও এমএ (১৯৯৮) এবং ইন্ডোলজিতে এমএ (১৯৯৮)। পোস্ট-ডক্টরেট গবেষণা টোকিওর রাষ্ট্রভাষা ইনস্টিটিউটে (২০০৮-১০)। ভাষা ও ব্যাকরণ বিষয়ে দেশি ও বিদেশি জার্নালে প্রায় ৪০টি প্রবন্ধ বেরিয়েছে।

 

[“নাপিত ও সার্জনের দৃষ্টিতে বাংলা বানান-সংস্কার” (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসৃত) চারবাক-এর বানান রীতির পরিবর্ত্তে লেখকের বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
নিবন্ধটি পূর্ব্বে bdnews24.com-এ প্রকাশিত হয়, সূত্রধর— নাপিত ও সার্জনের দৃষ্টিতে বাংলা বানান-সংস্কার

চারবাকে
প্রকাশের উৎসমূল— নাপিত ও সার্জনের দৃষ্টিতে বাংলা বানান-সংস্কার

— সম্পাদকীয় ]

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার