করোনাকাল ও শিক্ষার স্বরলিপি || মেহেরাজ হাসান শিশির

0

বাংলাদেশী শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে অসন্তোষের অন্ত নেই। এর যারা প্রধান গ্রাহক ও ভুক্তভোগী, খোদ সেসব শিক্ষার্থীরাই, এর নানান হালচাল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং অনতিবিলম্বে এর সংস্কার প্রয়োজন— এই মর্ম্মে মত প্রকাশ করে। শিক্ষার্থীসহ মোটাদাগে সর্ব্বস্তরেই এমন মতটি বেশ জনপ্রিয় যে, এই বিদ্যমান ব্যবস্থা দিয়ে আর চালানো সম্ভব নয় এবং নতুন যুগের নতুন ধরনের ব্যবস্থা তৈরি করা অতি জরুরী।

অন্য অনেকের মতো আমিও মনে করি, এই শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার-অযোগ্য এবং পূর্ণ বিলোপ বাদে এর কোন নিস্তার নেই। ভেঙেচুরে নতুন করে গড়াটাই এই পুরা ব্যবস্থাটির পুনর্জাগরণের একমাত্র পথ। কলোনিয়াল আবর্জ্জনা হঠাতে হলে প্রয়োজন অ্যান্টি কলোনিয়াল নতুন ধরনের ধ্যানধারণা। প্রাচ্যে, এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চ্চায় অতি দরিদ্র এই বঙ্গ অঞ্চলেও উত্তর আধুনিকতা কিংবা সমমনা অন্য চিন্তাচর্চ্চাগুলোর হাত ধরে, উপনিবেশ বিরোধী জ্ঞানকাণ্ডটিকে মোটামুটি চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরে আমরা একটা অবস্থানে নিয়ে এসছি।

কিন্তু অতি অবশ্যই শিকার করতে হবে, ওই চর্চ্চাগুলো সাধারণের নাগালের বাইরে এবং বলতেই হয়, আমাদের বর্ত্তমান আলাপে অপ্রাসঙ্গিক।

আমি কথা বলছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিৎ এই তত্ত্বটির স্বপক্ষে। এতোবড়ো আলাপের ফাঁদ এই মুহূর্ত্তে হয়তবা আমি ফাঁদতাম না, যদি না চারবাকে সম্প্রতি এবিষয়ক একটি প্রবন্ধ (করোনা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান || রিজবাহ রিজবী) ছাপা হত। সেখানে আলোচনার বিষয় হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিরুদ্ধে এবং লেখক বলেছেন এই ঘুণে ধরা শিক্ষাব্যবস্থাটিকে ভেঙে আবার নতুন করে গড়ার স্বার্থে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাই ভাল। শুরু থেকেই আমি এই মতের বিরুদ্ধাচারণ করে আসছি।

 

 

এই উপনেবিশবাদী গোলাম তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা অতি অবশ্যই ভেঙে পড়া উচিৎ। স্বাধীনতার পঞ্চাশবছরেও এই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের কিছু দিতে পারে নাই। এই শিক্ষাব্যবস্থা কখনোই মুক্তচিন্তা বা চর্চ্চাকে বরদাস্ত করে না বরং প্রথাবদ্ধ এবং রাষ্ট্রশক্তির সহায়ক একধরনের পূর্ব্বনির্দ্ধারিত জ্ঞানপদ্ধতিকে জারি রাখে। যেটা উত্তরাধিকার সূত্রে উপনিবেশের কাছ থেকে পাওয়া। কেরাণী তৈরী করার কিম্ভুত শিক্ষাচার পুরোপুরি ধ্বংস হোক, এই চাওয়াটির সঙ্গে আমি আগে থেকেই একমত।

কিন্তু, ভেঙে পড়ার জন্য যেসব বৈপ্লবিক পূর্ব্বাবস্থার দরকার হয়, সেটা কি এই করোনাকালীন বাস্তবতার মধ্যে আছে?

বিপ্লবের পূর্ব্বশর্ত্ত বাদে নিছক ‘বদল’ আনার প্রয়োজনে মাঠে নামলে কেমন হয় সেটা এই বাংলা অঞ্চলেই, নকশালবাড়ীর উত্তাল দিনগুলোতে আমরা দেখেছি৷ পরিবর্ত্তনের পূর্ব্বশর্ত্তগুলো ঠিকঠাক না থাকলে, পরিবর্ত্তন আসে না এবং সেটা একধরনের হঠকারিতায় পরিণত হয়।

ওই নিবন্ধটিতে লেখা হয়েছে, যাঁরা খোলার জন্যে সরব হচ্ছেন তাঁদের প্রধান যুক্তিটি হচ্ছে এই যে এই ভয়ানক বদ্ধাবস্থায় পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং শিক্ষার স্রোতধারায় বিদ্যার্থীকে ফিরিয়ে আনাই তাদের লক্ষ্য।

কিন্তু আমরা দেখেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে এই পর্য্যন্ত যারা সরব হচ্ছেন বা মাঠে নেমেছেন তাঁদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং চাকরীপ্রত্যাশীরা।

ধরা যাক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী পাশ্ববর্তী গ্রামে থাকার জায়গাজনিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে হল্ খোলার দাবী জানায় এবং এসূত্রেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার জন্য সরব হয়।

অন্য যারা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবীতে সরব হয়েছেন বা হচ্ছেন আমরা দেখেছি তাঁদেরও দাবীটি যতটা না পড়াশোনাকে সচল করা তারচে বেশী বাসস্থান বা অর্থনৈতিক সমস্যাকে দূর করা বা অন্য আরো পার্শ্ববর্ত্তী কারণগুলোকে গ্লোরিফাই করা।

অর্থাৎ এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিক শিক্ষালাভ করার জন্য খুলবে না বরং শিক্ষার্থীদের অন্য প্রয়োজনগুলো মেটাবার জন্য খুলবে, অন্তত তাঁদের দাবিনামা ছিল এটাই।

 

আর যেইধরনের বিপ্লব বা জাগরণ আমূল পরিবর্ত্তনের প্রেক্ষাপট তৈরি করে, ভেঙে আবার নতুন করে গড়ার বাস্তবতা তৈরি করে, আমরা নিকট অতীতে দেখেছি সেগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করেই দানা বেঁধেছে এবং এই কেন্দ্রিকতাকে আবর্ত্তনকরেই বিকাশলাভ করেছে। (আগ্রহীরা কোটা সংস্কার বা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দিকে তাকান)

অর্থাৎ যে ধরনের পরিবর্ত্তনের কথা আমরা বলছি বা যে কিসিমের ভাঙন আমরা চাচ্ছি সেটার সংগঠন বা প্রস্তুত হবার প্রেক্ষাপট তৈরি করার জন্য হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা জরুরী। যে কোন ধরনের ব্যবস্থার বিকল্প বিদ্যমান ব্যবস্থার ভেতর থেকেই তৈরী হয়। সাড়াজাগানো সকল জাগরণের দিকে তাকালেই এটা টের পাওয়া যায়। সেই পনের শতকের রেনেসাঁস বা উনিশশ সতেরর রুশ বিপ্লব, কিংবা উত্তাল ষাটের দশকে বিশ্বজোড়া ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে আমরা নতুন নতুন যত সব ধ্যানধারনাকে পেলাম, সবই কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থার পেট থেকে বেরোনো।

সুতরাং যে ধরনের বিপ্লব আমরা চাইছি, সে ধরনের বিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় অবস্থা তৈরি করার জন্য হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সচল থাকা জরুরী।

প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে হলে আগে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম্মকে পূর্ণরুপে কার্য্যকর থাকতে হয়।

অনতিবিলম্বে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার দাবীতে সর্ব্বস্তর থেকে সরব হোন। এর প্রয়োজনীয়তা আছে।

 

 

 

মেহেরাজ হাসান শিশির
উচ্চমাধ্যমিক পর্য্যায়ে অধ্যয়নরত ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি মহাবিদ্যালয়ে’। জন্ম ও বেড়ে ওঠা চাঁদপুরে। পড়াশোনা সূত্রে বর্ত্তমান অবস্থান ঢাকায়।
আগ্রহের বিষয় সমাজতন্ত্র। লেখালেখির শুরু কবিতা দিয়ে। এছাড়া গান আবৃত্তি ও উপস্থাপনা করেন। কিশোর আলো ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত।

ইমেল : meherajshishir14@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার