ভাষান্তর-উদ্ভূত মনান্তর বিভ্রাট || রাকি ইউসুফ

0

 

উমর খৈয়ামের একটা রুবাইয়ের তৃতীয়-চতুর্থ লাইন কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা করলেন—

“নগ্দা যা পাস তাই ধরে থাক, ধারের পণ্য করিসনে, / দূরের বাদ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চারি।”

নজরুল হয়তো মূল ফার্সি থেকে বাংলা করেছিলেন। আরো কেউ হয়তো করেছেন ফার্সি থেকে নিজ খেয়ালখুশিমতো বাংলা ‘ভাবান্তর’, কেউ করেছেন উর্দু অনুবাদ থেকে বাংলা, আবার কেউ করেছেন ফিটজেরাল্ডের করা ইংরেজি অনুবাদ থেকে আর এক ধাপ অনুবাদে বাংলা রূপান্তর।

তাতে ওই লাইন দু’টোই আর একজন বাংলা করলেন—

“নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক, / দূরের বাদ্য লাভ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।”

অন্য একজনের অনুবাদে শেষ লাইনটা হলো এমন—

“নেপথ্যের ওই ঢাকের বাদ্যে কর্ণে তোমার আঙুল দাও।”

এমনই সব রকমফের।

তবে আর কী? অনুবাদে পাঠক তখন অনুবাদককেই পায়, মূলের লেখক-কবি আর তার লেখা, সেই লেখার কোমলতা-কঠোরতা, বর্ণনার প্রকাশভঙ্গি, ভাষার ধ্বনিলালিত্য— সবই পড়ে থাকে ধোঁয়াশার আড়ালে। এ কথা তো সত্যি যে, ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতিতে এসবকে যথাযথ পুনর্বর্ণনা করায় এক অনিবার্য সীমাবদ্ধতা থাকেই। কিন্তু সীমাবদ্ধতার মাঝেও যথেষ্ট সৎ চেষ্টা কতোটাই বা দেখা যায়।

অনুবাদ বড়োই সোজা কাজ কিনা।

উমরের রুবাইয়াতের বেলায় ওই সোজার যিনি চ্যাম্পিয়ন, নামটা উল্লেখ নাহয় না-ই করলাম, তিনি অবশ্য অনুবাদের নামে অনেকটা ভেল্কিই দেখিয়ে দিয়েছেন। রুবাই হলো চার লাইনের আর বিশেষ গঠনের কবিতা, আর তিনি ‘আপন মনের মাধুরি বিলায়ে’ তার যা কিনা বাংলা করেছেন, নমুনা হিসেবে একটার উল্লেখ—

“এইখানে এই তরুতলে / তোমায় আমায় কূতূহলে / যে ক’টা দিন এই জীবনের কাটিয়ে যাবো প্রিয়ে। / সংগে রবে সুরার পাত্র, / অল্প কিছু আহার মাত্র, / আর একখানি ছন্দমধুর কাব্য হাতে নিয়ে। / থাকবে তুমি আমার পাশে, / গাইবে সখী প্রেমোচ্ছ্বাসে, / মরুর মাঝে স্বপ্নস্বরগ করবো বিরচন, / গহন কানন হবে লো সই নন্দনেরই বন।”

তো সেই ‘বাংলাকার’-এর সময়ের কোন্ এক গুণিজন যেন ওই নিয়ে এমন মন্তব্য করেছিলেন যে, তিনি তো ওগুলোকে নিজের মৌলিক লেখা বলেই চালাতে পারতেন।

এখন আবার ওই সোজা কাজ মনে করা অনেকেই ভাবে, লিখতে তেমন পারিনা তাতে কী, অনুবাদ করেই লেখক হয়ে যাবো। যেমন খুশি বাংলা করে দিলেই তো হলো, আর কী লাগে? চারধারে তাই ‘অনুবাদসাহিত্যে’র ছড়াছড়ি। এদের অনেকেই আবার মূল লেখার (বা মূলের ইংরেজি অনুবাদের) অনেক বাক্য পড়ে তার অর্থই বোঝে না, আন্দাজে যা খুশি লিখে দেয়। আর যা সব ‘অনুবাদ’ দাঁড়ায় তখন!

এইসব কথা বললে-টললে অপরাধ বড়ো কম হয় না। আর তাতে বড়োই ‘মানস আহার’ (প্রাকৃত ভাষায় ‘মাইণ্ড খাওয়া’) করে বসেন এই দেশের ‘অনুবাদশিল্পাধিপতি’ হনুবাদকদল আর তাদের প্রকাশকরা।

একবার যেমন কোনো একজন এই দেশের বিচিত্র অনুবাদকৃতি নিয়ে কোথাও সামান্য একটা আলোচনা, যাতে এই দেশের ভালো অনুবাদের প্রশংসা যেমন ছিলো তেমনি ছিলো অনুবাদ নামের ব্যাঙের ছাতার বাগানের পাঁচালিও, প্রকাশ করতেই যেন প্রবল এক ভূমিকম্প বেধে গেল। আর তার আফটার শকের এদিক-ওদিক ধাক্কায় শেষমেষ সেই ‘ভূমিকম্পারম্ভক’ নিজেই চাকরির উচ্চপদ থেকে স্থানচ্যুত হয়ে একেবারে ভূতলে পড়ে গড়াগড়ি খেয়ে শেষে বিতাড়িতই হয়ে গেলেন এক বড়সড় দৈনিক পত্রিকার রাজপ্রাসাদ থেকে।

কে জানে পদাঘাতকালে তাকে “দূর হ পামর”ও বলেও বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছিলো কিনা।

 

 

 

রাকি ইউসুফ

Bio অথবা তার বিকল্প—
নিজ মূল্যায়ণে দরিদ্র পাঠক, আনাড়ি লেখক এবং নবীশ কবি। মতামত তাই যে কারোই অসন্তোষের কারণ হতে পারে। উপেক্ষা কাম্য।
বয়সে প্রবীণ। আচরণে অপরিণত।
বিভিন্ন পেশায় ঘুরপাক খেয়ে আজীবন অপ্রতিষ্ঠিত।
উল্লেখ করার মতো আর তেমন কিছু নেই।
নিজেরই দেয়া তথ্য এসব।

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{ভাষান্তর-উদ্ভূত মনান্তর বিভ্রাট [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতির পরিবর্ত্তে লেখকের বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার