তিনটী ‘ট্যাঙ’ কবিতা ও ভূমিকা || হাসিব উল ইসলাম

0


ভূমিকা—
ট্যাঙ ডাইনেস্টির (৬১৮—৯০৭ খ্রিস্টাব্দ) সময়কে বলা হয়ে থাকে চৈনিক কবিতার স্বর্ণযুগ। চৈনিক ইতিহাসের মহত্তম কবিতাসমূহ ট্যাঙ রাজবংশের এই তিন শতাব্দী সময় জুড়ে রচিত হয়েছে। এবং প্রায়শই বলা হয়ে থাকে তিন থেকে চারজন কবিশ্রেষ্ঠ এই যুগে বসবাস করতেন। ওয়াঙ হান, কুই হু, এবং লি বাই-এর নাম উল্লেখ্য। শুধুমাত্র এঁরাই যে কবিতা লিখতেন এমনটা নয়, ট্যাঙ রাজত্বের সময়কালের ২,২০০ জন কবীর কথা জানা যায়। আরো আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে এঁদের লেখা প্রায় ৪৯,০০০ সংখ্যক কবিতা এখনো টিকে আছে। সবচেয়ে বিখ্যাত কবিতাগুলো নিয়ে সান ঝু’র ১৭৬৩ সালের কবিতাসংগ্রহ ‘ট্যাঙ শি সান বাই সু’ [তিনশ ট্যাঙ কবিতা] প্রকাশিত হয়। এই কবিতাসংগ্রহে উপরিউক্ত তিনজন কবীর কবিতাও গ্রন্থিত হয়েছে। চৈনিক সাহিত্যের সোনালী সময়ের এই তিন কবীর তিনটী কবিতার (১. যুদ্ধের গান, ২. দখিনা গ্রামের সুন্দরী এবং ৩. চাঁদের আলোয় একা বসে মদ খাই) ভাবানুবাদে আপনাকে স্বাগত জানাই।

‘যুদ্ধের গানের’ রচয়িতা ওয়াঙ হানের সম্পর্কে সাধারণত তেমন কিছু জানা যায় না। তবে কবী কুই হু ও তাঁর কবিতা ‘দখিনা গ্রামের সুন্দরী’ নিয়ে দারুণ একটা গল্প প্রচলিত আছে:

কুই হু সুদর্শন ছিলেন। তাঁর পান্ডিত্যও ছিল অসাধারণ। সরকারী চাকরীর পরীক্ষা (বাংলাদেশের বর্ত্তমান প্রেক্ষাপটে বললে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পরীক্ষা) দেয়ার জন্য পায়ে হেঁটে রাজধানীতে যাচ্ছিলেন। রাজধানীর দক্ষিণের একটা গ্রামের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কবীর প্রচন্ড তৃষ্ণা পায়। কুই হু এক কৃষকের দরজায় কড়া নাড়েন। আবেদন করেন এক ঘটী জলের জন্য। এক অতি রূপবতী কন্যা কুইকে সম্ভাষণ জানান। অতিথির দিকে বাড়িয়ে দেন এক ঘটী জল। পরের বছর পরীক্ষা শেষে ঐ পথে ফেরার সময় কবী আবারো কৃষকের দরজায় কড়া নাড়েন। কিন্ত বাড়ীতে কেউ ছিল না। কবীর হৃদয় ভেঙে যায়। তিনি তখুনি একটী কবিতা লিখে দরজায় ঝুলিয়ে যান। কয়েকদিন পর হু আবার সেই বাড়ীর দরজার সামনে গেলে সেই কৃষকের সাথে তাঁর দেখা হয়। কৃষক ভদ্রলোক অত্যন্ত রেগে ছিলেন। তিনি জানান, দরজায় আবিষ্কৃত কবিতাটী পাঠ করে তাঁর কন্যা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। এই বদ কবীর কথার আছরে এখনো সে অসুস্থ। যাই হোক, কুই হু কে পেয়ে চাষীর মেয়ে সুস্থ হয়ে ওঠে, এবং পরবর্ত্তীতে তাঁদের বিয়ে হয়।

লি বাই (তিনি লি পো নামেও পরিচিত) ‘চাঁদের আলোয় একা বসে মদ খাই’ কবিতার রচয়িতা ওপরিউক্ত চৈনিক ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম কবী। মাতৃভূমী চীনে তাকে দেবতার মর্য্যাদা দেওয়া হত। লি বাই তাঁর জীবনের কিয়দংশ ব্যয় করেছিলেন অসহায় নির্য্যাতিত মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পক্ষে। অনেকটা মধ্যযুগীয় নাইটের মতন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি বেশ কিছু মানুষকে তরবারি দিয়ে হত্যা করেন। আবার, তিনি ছিলেন একজন তাওবাদী সন্ন্যাসীও। বাড়ীর নিকটবর্ত্তী পাহাড়ে বেশ কয়েক বছর তিনি সাধনা করে কাটান। এই পেশা দুটীকে তাঁর স্বভাবচরিত্রের প্রতীক হিসেবে ধরা যায়। ফলে, লি বাইয়ের ভেতর একদিকে যেমন শান্ত, গভীর আধ্যাত্মিকতা আছে, অন্যদিকে আছে বেপরোয়া খেয়াল।

যুদ্ধের গান
(ওয়াঙ হান)

সুস্বাদু আঙুরের মদ উজ্জ্বল পাথরের কাপে,
এক ঘোড়সওয়ার তার বাদ্য বাজিয়ে
গানে গানে পায়ীদের খুব করে ডাকে :
নির্জন যুদ্ধের ময়দানে হাত পা ছড়িয়ে
শোয়া বসা আমরা মাতাল,—
আমাদের নিয়ে হেসো নাকো পাছে,
বল, কত জন সেই আদিকাল থেকে
যুদ্ধ শেষে বাড়ী ফিরে গেছে?

 

দখিনা গ্রামের সুন্দরী
(কুই হু)

গত বছর এই দিনে এই দরজার মাঝে এক যুবতীর মুখ আরক্তিম গোলাপের মত ফুটেছিল। আমি জানি না সেই যুবতীর মুখ কোথায় হারিয়ে গেছে। এখনো আগের মত গোলাপ ফোটে, এখনো তাঁর সৌরভ ভাসে বসন্ত বাতাসে।

 

চাঁদের আলোয় একা বসে মদ খাই
(লি বাই)

ফুল বাগানের মাঝে এক বোতল হুইস্কি। আমি একা মদ খাই, কোন সঙ্গী নাই। এক পেগ তুলে ধরে চাঁদকে ডাকি।

আমার ছায়ার সাথে আমি আর চাঁদ— এইভাবে গুনে গুনে তিনজন থাকি।

চাঁদ তেমন খায় না, আমার ছায়া ক্রমাগত খেয়ে চলে। আমি, চাঁদ, আর আমার ছায়া, এখন কেউ আর নেই বলে। যতক্ষণ বসন্ত থাকবে, আমরা আনন্দ করে যাব। আমি নৃত্য করি আর আমার ছায়া লুটোপুটি খায়। চাঁদও হেলেদুলে নাচে আর আমি গান গাই। যতক্ষণ না সময়ও মাতাল হবে, আমরা পুরোনো বন্ধুরা— একসাথে পান করে যাই।

মাতলামি শেষে চলে যাই যে যার গ্রন্থিত পথে— চিরতরে; আমরা অলস পথিক, আমাদের আবারো দেখা হবে ছায়াপথের ওপারে।

 

 

হাসিব উল ইসলাম
জন্ম: ১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৯১ সালে, কুষ্টিয়ায়।
ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক
(বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনানিবাস।)
কবিতা, অনুবাদ ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ক লেখালেখিতে বিশেষ আগ্রহী।
প্রকাশনা:
কবিতা, বাংলা থেকে ইংরেজি কবিতা, চিত্রকলা সম্পর্কিত লেখার অনুবাদ, বিদেশী গল্প-কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায়।

অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{তিনটী ‘ট্যাঙ’ কবিতা ও ভূমিকা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার