তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব : পাঠ প্রতিক্রিয়া || শিবলী শাহেদ

0

 

ক’ বছর আগে প্রতিচিন্তার ২০১৭ সালের একটী সংখ্যায় বদরুল আলম খানের একটী গদ্য পড়ার মওকা মিলেছিল। লেখাটী আমার এত ভাল লেগে যায় যে, এখনও সময় পেলেই উল্টে পালটে দেখি। প্রবন্ধটীর নাম ‘তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব’। সুবিদিত যে, নামের মূল্য নামমাত্র। কিন্তু আমার মনে এ ধরণের চিন্তা স্থান পায় না। শিরোনাম— তদীয় লেখায় লেখকের চিন্তার অভিযাত্রার একটা ইঙ্গিত আমাদেরকে দিতে পারে— এমনটাই আমি ভাবি। যেমন, উক্ত প্রবন্ধের নামকরণের শানেনুযুল কী হতে পারে তা নিয়ে এন্তার চিন্তাভাবনার সুযোগ আছে। তলস্তয় যে ভূখণ্ডে এক্সিস্ট করতেন তাকে আমরা বিপ্লব-পূর্ব্ব রাশিয়া বা জারের রাশিয়া ইত্যাদি নামে চিনে থাকি। কিন্তু ‘তলস্তয়ের’ দেশে-ই বলশেভিক বিপ্লব কেন? কেন সেটা পুশকিন, দস্তয়েভস্কি কিংবা আন্তন চেখভের দেশে নয়!! এই উত্তর বের করাটা একেবারেই না-মুমকিন নয়। তলস্তয়ের লেখায় সামগ্রিকভাবে যেভাবে রাশিয়া ধরা পড়ে অতটা অন্য কারো লেখায় ধরা পড়ে না। ওয়ার এন্ড পিস-এ তিনি যেন একজন ইয়ান ভ্যান আইক। অতি নিপুণতার সাথে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিটেইলিং শিল্পীর আঁচড়ে তুলে ধরার কী আশ্চর্য্য ক্ষমতা! যেন কৌশেয়-বস্ত্র নির্ম্মাণে এক জহুরী-চক্ষু তাঁত। সেই-সাথে আন্না কারেনিনা, ডেথ অফ আইভান ইলিয়াচ, রেসারেকশন ইত্যাদি গ্রন্থগুলো তৎকালীন রাশিয়াকে বুঝবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ‘তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব’— ঠিকই আছে।

লেখক এরপর তার সোভিয়েত ভ্রমণের কাহিনী বর্ণনা করেন। তার স্মৃতিরোমন্থনের এক পর্য্যায়ে আমরা জানতে পারি যে, কৈশোরে তিনি সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহী হন মার্ক্স-এঙ্গেলস কিংবা লেনিন পাঠ করে নয়, তার আগ্রহের শুরুটা মূলতঃ আইনস্টাইনের লেখা ‘সমাজতন্ত্র কেন?’(Why Socialism?) নামক রচনাটী পাঠ করে!!! এই লেখায় আইনস্টাইন তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখালেন যে, মানবজাতির জন্য সমাজতন্ত্রই একমাত্র আদর্শ ব্যবস্থা। সেই সাথে তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন যেন কোনভাবেই আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, এবং সেই সাথে নিশ্চিত করতে হবে ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতা। আইনস্টাইন একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবেই সুপরিচিত কিন্তু তিনি যে একজন জবরদস্ত সমাজবিজ্ঞানীও বটে তা এই লেখাটী না পড়লে হয়ত অজানাই থেকে যেত। তবে আইন্সটাইনের সতর্কবার্ত্তা কেউ তেমন আমলে নেয়নি। উপেক্ষা করেছে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে তার সবচেয়ে মূল্যবান কথাগুলো। রবীন্দ্রনাথেও আমরা এরকম কিছু সতর্কবাণী দেখেছিলাম। তিনি সোভিয়েতের দুর্ব্বল দিকের প্রতি ঈঙ্গিত করে বলেছিলেন, “…মানুষের ব্যষ্টিগত ও সমষ্টিগত সীমা এরা যে ঠিকমত ধরতে পেরেছে তা আমার বোধ হয় না। সে হিসেবে এরা ফ্যাসিস্টদের মতই। এই কারণে সমষ্টির খাতিরে ব্যষ্টির প্রতি পীড়নে এরা কোন বাধাই মানতে চায় না। ভুলে যায় ব্যষ্টিকে দুর্ব্বল করে সমষ্টিকে সবল করা যায় না, ব্যষ্টি যদি শৃঙ্খলিত হয় তবে সমষ্টি স্বাধীন হতে পারে না।”

প্রবন্ধটীতে এরপর আছে রুশ বিপ্লবের কথা— সুইজারল্যান্ডের জুরিখ থেকে পেত্রোগ্রাদে লেনিনের ফিরে আসার লোমহর্ষক বর্ণনা। যদিও বিপ্লব সফল হবার পর সোভিয়েতে ওয়ার কমিউনিজম থেকে NEP-এ প্রবর্ত্তন নিয়ে কিছু আলোচনা আশা করেছিলাম কিন্তু এই লেখায় লেখক এসব এড়িয়ে গেছেন কারণ লেখাটী শেষপর্য্যন্ত এটী একটী ভ্রমণ কাহিনীই।

সোভিয়েত পতনের কিছুকাল পর ১৯৯২ সালে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা সাহেব একটী বই লিখেন। বইয়ের নাম The End of history and last man. এই বইয়ে তিনি খোলাখুলি ঘোষণা করেন যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও বুর্জোয়া গণতন্ত্রই মানব সভ্যতার চূড়ান্ত রূপ এবং এর থেকে উন্নততর সামাজিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা নিরর্থক। তার এই ঘোষণার পরপরই ১৯৯৫, ৯৭, ২০০২ এবং ২০০৮ এ বিশ্বাবাসী প্রত্যক্ষ করেছে পুঁজিবাদী সংকট৷ সুতরাং ফুকুইয়ামা সাহেবের কথা এখন আর গ্রহণযোগ্য নয়।

ঠিক কী কারণে অর্থনীতি ও সমাজনীতির সোভিয়েত মডেল ব্যর্থ হল তা পুনরায় খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পর্য্যালোচনা করা প্রয়োজন অক্টোবর বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তর সোভিয়েতের সমাজব্যবস্থা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যারের একটী উক্তির মাধ্যমে ইতি টানছি—

“… পুঁজিবাদ আধুনিকই বটে। কিন্তু এর অভ্যন্তরে রয়েছে যে লুণ্ঠনপ্রবৃত্তি সেটী প্রাচীন, আসলে প্রাগৈতিহাসিক।” [লেনিন কেন জরুরি]

 

 

 

 

 


শিবলী শাহেদ
সমকালীন কবিতার উল্লেখযোগ্য নাম। সেইসব বিরলপ্রজ কবিদের একজন, যাঁরা মেঘের চাইতে মানুষে বিশ্বাস বেশী রাখেন। তাঁর এই মানুষপ্রবণতার পাঠ কিছুটা মার্ক্স, বাকীটা ওশো, আর প্রায় পুরোটাই প্রকৃতি আর জীবনের কাছ থেকে নেয়া। পৃথিবী ভ্রমণের প্রায় তিন দশক পেরোনোর পরেও, এই কবী, মানুষেই রাখেন আশা, আর ভালোবাসার বিরল বিশ্বাস।

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{তলস্তয়ের দেশে বলশেভিক বিপ্লব : পাঠ প্রতিক্রিয়া [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার