র‌্যাগ ডে এবং সংস্কৃতির সংকট || মুরাদ হাসান

0


এদেশের সিংহভাগ আলেমশ্রেণী ইসলামী সংস্কৃতিকে বিদ’আত বলে যতই দূরে ঠেলে দিচ্ছে পশ্চিমা অপসংস্কৃতির আগ্ৰাসন ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংস্কৃতিহীন কোন জাতি বাঁচতে পারে না। আর বছরে দুই ঈদ দিয়ে সংস্কৃতির অভাব পূরণ করতে বলা নিছক বোকামি বৈ’ তো কিছুই নয়।

দেখুন, এ দেশের ছাত্রছাত্রীরা আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে স্থানীয় হুজুরদের দাওয়াত দিয়ে মিলাত মাহফিলের আয়োজন করত। বিদায় ভাষণে ছাত্র শিক্ষকদের চোখের পানী নাকের পানী এক হয়ে ঝরত! কি দারুণ মূহুর্ত্ত। আজীবন মস্তিষ্কে দাগ কাটার মত। কিন্তু এখন কী হচ্ছে? পশ্চিমা স্টাইলে সাদা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে অবাধে ডান্স, মেয়েদের বুকে হাতাহাতি, নানান অশালীন অঙ্গিভঙ্গী, টি-শার্টে অরুচিকর মন্তব্য! সব মিলিয়ে রীতিমত মদের বার!

আমি অবশ্যই এসবের বিরোধী। আমরা যদি অপসংস্কৃতির আগ্ৰাসন রুখতে না পারি তাহলে সাম্রাজ্যবাদের আগ্ৰাসন রুখব কীভাবে? একটা রাষ্ট্র যদি অন্য কোন রাষ্ট্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে চায় তাহলে সর্ব্ব প্রথম সে দেশে সংস্কৃতি চালান করে। একটা দেশের জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য অথবা শোষণ করার জন্য সাংস্কৃতিক বিনিময়ের থেকে উত্তম কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশে ভারতের এত প্রভাবের পিছনে যেটা সবচেয়ে বড় হাতিয়ার সেটা হচ্ছে দুই দেশের প্রায় অভিন্ন সংস্কৃতি।

সংস্কৃতি নদীর মত বহমান। সংস্কৃতিকে আমরা চেষ্টা করলেও খাঁটী রাখতে পারব না। একদেশের সংস্কৃতির সাথে অন্যদেশের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটবেই। আমরা যদি পশ্চিমাদের সংস্কৃতি বা ধ্যান ধারণার সার উপাদানগুলো আয়ত্ত করতে পারি তাহলে আমাদের সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে। কিন্তু আমরা কী করছি? পশ্চিমাদের আধিপত্য, উন্নতি, ধর্ম্মহীনতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাদের মত ভান ধরতে পারাটাকে বিশাল কিছু বলে ধরে নিচ্ছি। যা হীনমন্যতা ছাড়া কিছুই নয়।

সংস্কৃতির সাথে ধর্ম্মের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। সংস্কৃতি থেকে ধর্ম্মকে আলাদা করলে না থাকে ধর্ম্ম না থাকে সংস্কৃতি! ইসলাম ধর্ম্মের ভৌগলিক উৎপত্তি আরবে। আর যেহেতু ধর্ম্মের সাথে সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সেহেতু ইসলাম ধর্ম্মের সাথে আরব্য সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ ঘটেছে। অবশ্য যেসব সংস্কৃতি ইসলাম ধর্ম্মের মৌলিকতার সাথে সাংঘর্ষিক সেগুলো পরিহার করা হয়েছে। ইসলাম ধর্ম্ম যেহেতু শুধু আরবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি সেহেতু সে যেখানেই গিয়েছে আরব্য সংস্কৃতিকে সাথে করে নিয়ে গেছে।

আর এখানেই একটা বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। কোন দেশের ধর্ম্ম প্রচারকগণ একগুঁয়েমি করে আরব্য সংস্কৃতির সাথে নিজ দেশের সংস্কৃতির আপোষকে গোমরাহীর কাজ বলে গণ্য করেছেন। এই একগুঁয়ে ব্যক্তিগণ বোধহয় আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই বেশী ছিল। আবার তৎকালীন তুর্কী অঞ্চলের ধর্ম্ম প্রচারকগণ আরব্য সংস্কৃতির সাথে স্বীয় সংস্কৃতির আপোষ করতে পেরেছিল। আর এর ফলেই হয়ত তুর্কীরা ইসলামের সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশতে পেরেছিল। যার চুড়ান্ত ফলাফল হিসেবে তারা আটশ বছর খিলাফতের নেতৃত্ব পায়।

সংস্কৃতি একটা জাতির আইডেন্টিফাই নির্দ্ধারণ করে। আমরা বাঙালী কিংবা বাঙালী মুসলমান, হাজার হাজার বছর ধরে বাংলায় বসবাস করছি। আমাদের দেশের ধর্ম্ম প্রচারকগণ এদেশের ভৌগলিক সংস্কৃতির সাথে আপোষ করতে কখনোই আগ্ৰহ দেখায়নি। শুধু তাই নয় আরব্য সংস্কৃতিকে পূজাতুল্য মনে করে আজীবন তা ছড়িয়ে দেওয়ার বাসনা নিয়ে কাজ করেছে। আর ভৌগোলিক সংস্কৃতিকে হয়ত হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি নয়ত বিদ’আত বলে পাশ কাটিয়ে গেছে।

তারা বুঝতে পারেনি স্বীয় দেশের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে অন্য দেশের সংস্কৃতিকে আয়ত্ত্ব করা কতটা দুর্ব্বোধ্য কাজ। যার ফলে বাঙালী মুসলমান সমাজে সংস্কৃতির একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ভাতের সংকট আর সংস্কৃতির সংকট নিয়ে জীবন চলা সম্ভব নয়। এ কারণে অজান্তেই আরব্য সংস্কৃতির সাথে এদেশের সংস্কৃতির একটা সংমিশ্রণ হয়ে গেছে। আর এ বিষয়টা আলেম ওলামাদেরও নজর এড়ায়নি। তারা এসবকে সর্ব্বদা হারাম বলে ফতোয়া দিয়ে বেড়িয়েছে। বর্ত্তমান আলেম ওলামারাও তার ব্যতিক্রম নয়।

পশ্চিমা অপসংস্কৃতির এই আগ্ৰাসনের সময় যদি ধর্ম্মের সাথে এদেশীয় সংস্কৃতির সংমিশ্রণকে সাপোর্ট না করে আগের মতই বিরোধিতা করে সংস্কৃতিহীন করে রাখার অপপ্রয়াস জারি রাখা হয় তাহলে শুধু এমন বিদায় অনুষ্ঠান নয় ভবিষ্যতে আরো অনেককিছুই দেখার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। এসব যদি দেখতে না হয় তাহলে আসুন এসব গাঁজাখুরি ফতোয়ার তোয়াক্কা না করে অপসংস্কৃতি রুখে দিয়ে স্বীয় সংস্কৃতির চর্চ্চা করি।

 

 

 


মুরাদ হাসান
২১ ব্যাচ এইচএসসি পরীক্ষার্থী,
গুরুদয়াল সরকারি কলেজ, কিশোরগঞ্জ।
ফোন: ০১৩২২১৩৫৩৫১

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{র‌্যাগ ডে এবং সংস্কৃতির সংকট [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার