‘মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এতোদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিষ্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়া শ্রেণি তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী- সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরী-ভোগী শ্রমজীবী রূপে।’
-কার্ল মার্কস
মুঘল প্রতিষ্ঠান স্বাধীন শিল্পিকে বেতনভুক্ত কর্মচারীতে পরিণত করেছে। আর ঐ বেতনভুক্ত কর্মচারী [ সে আর ‘শিল্পি’ নাই কিন্তু, খেয়াল করুন ] সেই ইতিহাস থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কর্মচারীবেশে পরিশ্রমই করে গেল। পরিস্থিতির ক্রমাগত বিবর্তন তাকে বরংচ গোলামে পরিণত করেছে।
প্রাতিষ্ঠানিক কনসাইনমেন্টনোটে লেখকের দস্তখত প্রদান অর্থই হল ‘প্রতিষ্ঠান’ আরোপিত সকল শর্তাবলি মেনে নিয়ে প্রতিষ্ঠার সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়া, যেখানে লেখকের স্বাধীনতা ব্যাপারটা অবাস্তব- নিছককল্পনা মাত্র।
প্রতিষ্ঠান দেখলেই ইনাদের
ল্যাজ লড়বড় করে। অত্যন্ত প্রভুভক্ত
বলিয়া কর্পোমার্কেটে ইহাদের বেশ খ্যাতি রহিয়াছে
যেহেতু প্রতিষ্ঠানের প্রথম লক্ষ্য মুনাফা, দ্বিতীয় লক্ষ্য মুনাফা, এমনকি তৃতীয় লক্ষ্যও মুনাফা। তাই এরা শিল্প-সাহিত্যের বিচার করে একমাত্র মুনাফার অঙ্কে। মূলত এরা শিল্প ব্যাপারটাই বোঝে না। শিল্প নির্বাচন এদের কাছে কমোডের কালার চয়েজের মতো ব্যাপার! তাই অনিবার্যভাবেই শিল্পি এদের কাছে হাস্যকর বস্তুতে পরিণত হয়, শেষপর্যন্ত। খেয়াল করে দেখবেন ডগ স্কোয়াডের মতোই ওদের রয়েছে ওয়েল ট্রেইনেড রাইটার্স স্কোয়াড। এই স্কোয়াড দিয়ে তারা তাদের ইচ্ছেমতো মাল ডেলিভারী করায়, ফাই-ফরমাশ খাটায়। বুর্জোয়া শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার চতুর কর্মে ব্যবহার করে। যা খুশি তাই লিখিয়ে নেয়, চুক্তিহেতু।
সে ওখানে গল্প-কবিতা দিক আর পাছামারা দিক, সেটা বিষয় না; বিষয়টা হল তার দ্বারা বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠান উপকৃত হয়েছে নাকি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিংবা তার কৃতকর্মের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যত লাভ বা ক্ষতির সম্ভাবনা কী আছে, তা-ও আলোচ্য বিষয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখক বুঝতেই পারেন না যে তিনি ক্রমাগত কী উৎপাদন করে চলেছেন; কার দারস্থ হচ্ছেন তা প্রকাশে; কোন পদ্ধতিতে- কেন দারস্থ হচ্ছেন মধ্যসত্ত্বভোগী মুনাফাখোর বুর্জোয়াদের কাছে। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি নিজে কীসে পরিণত হচ্ছেন; এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে তার অবস্থানটা কোথায় গিয়ে ঠেকছে। দুঃখের বিষয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে লেখকগণ তা বুঝতেই পারেন না! প্রতিষ্ঠানের রং-বেরঙের হরেক রকম ভেলকিতে এমনভাবে অন্ধ হয়ে যান! আবার কিছু লেখক এতোটাই ধুরন্ধর হবার চেষ্টা করেন যে, গণউন্নয়নকামীÑভালোভালো কথাবার্তা বলে (কখনোবা একটুখানি অবাঞ্ছিত উস্কানিমূলক আওয়াজ দিয়ে বিতর্কিত হবার চেষ্টা করেন!) সকলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন! এবং পরবর্তীতে শিল্পীশোষক ভন্ড উদ্বৃত্তমূল্যখোর বুর্জোয়াদের নানারকম প্রতিষ্ঠান থেকে ঢাউশরঙিন বই/থিসিস প্রকাশ করে মুনাফার্জন করেন। এরা মূলত ঐ শিল্পীশোষক ভন্ড উদ্বৃত্তমূল্যখোর প্রতিষ্ঠানেরই নিজের লোক; এদের উভয়ের লক্ষ্যই মুনাফা; অনিবার্যভাবেই এই দুই বাইঞ্চোতের মধ্যে বন্টিত হয়; আর পাঠকেরা এই ভেলকির মধ্যেই পড়ে থাকেন।
প্রতিষ্ঠানের প্রভাবে অধিকাংশ মানুষ শুধু গড়পড়তা সাহিত্য পাঠ করার ফলে সেইসব ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানের লেখাই এখানে বহুল পঠিত হয়েছে- হয়- যাদের লেখায় টকমিষ্টিঝাল ফ্লেভার পাওয়া যায়। আর এইসব লেখক করেছে সাহিত্যের অপুরণীয় ক্ষতি।
ক্রিয়েটিভ সাহিত্য ক্রিয়েটিভ পাঠক গড়ে তোলে। পাঠকও লেখকের পাশাপাশি ভাবতে শুরু করেন, চিন্তার রাজ্য বিস্তৃত হয় ক্রমাগত; এভাবে একজন পাঠকও ধীরে ধীরে লেখক হয়ে উঠতে পারেন। অপরদিকে চটকদার সাহিত্য পাঠকের মস্তিষ্ককে ভোঁতা করে দেয়। এভাবে চলতে চলতে একসময় ঐ ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পাঠকটি কখন নিজের অজান্তেই অর্টিস্টিক হয়ে পড়েন বুঝতেই পারেন না।
পুরনো ব্যবস্থার রক্ষকদের কাছে সংস্কার ও উন্নয়নের প্রবক্তারা সর্বদাই বোকা বনবে যদি না তারা একথা বোঝে যে, যতো অসভ্য ও জরাজীর্ণ মনে হোক না কেন প্রত্যেকটি পুরনো প্রতিষ্ঠানই টিকে আছে কোন না কোন শাসক শ্রেণির শক্তির জোড়ে। এবং এইসব শ্রেণীর প্রতিরোধ চূর্ণ করার শুধু একটি উপায়ই আছে: যে শক্তি পুরনোর উচ্ছেদ ও নতুনকে সৃষ্টি করতে পারে- এবং নিজের সামাজিক অবস্থানহেতু যা তাকে করতে হবে- তেমন শক্তিকে আমাদের চারপাশের সমাজের মধ্যে থেকেই আবিষ্কার করে তাকে শিক্ষিত ও সংগ্রামের জন্যে সংগঠিত করে তোলা।
-ভি. আই. লেনিন
এখনকার সময়ে লেখককে শুধু ক্রিয়েটিভ লেখা লিখলেই চলে না। পাশাপাশি তাকে সেই লেখা প্রচারে একটিভিস্টের ভূমিকায়ও নামতে হয়। আবার পরিবার-সোসাইটি-রাষ্ট্রসহ বহুবিধ প্রতিষ্ঠান, যা নিয়ত উন্মুখ হয়ে আছে আপনাকে গ্রাস করবে বলে, তাদের রাহুগ্রাস থেকে গা-বাঁচিয়ে নয়, বরং ঐসব আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ প্রচেষ্টাই করে যেতে হয় প্রতি মূহুর্তে। কেননা এক গালে থাপ্পর খেয়ে অপর গালটি এগিয়ে দেয়া কোন কাজের কথা নয়।
আক্রমণটা দু’রকমই হতে পারে; শারীরিক অথবা মানসিক। যদিও শারীরিক আক্রমণের থেকে মানসিক আক্রমণই বর্তমান সময়ে খুব কার্যকর ও আধুনিক পদ্ধতি, তারপরও দুটোই চালু আছে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে নেশা হল এস্টাবলিশমেন্টের নেশা। এই নেশাগ্রস্ত কোন লেখকের পক্ষেই আর ক্রিয়েটিভ রাইটিং সম্ভব নয়। যদি এমনও হয় যে ঐ লেখক পূর্বে ক্রিয়েটিভ রাইটার ছিলেন কিন্তু পূর্ণবিকাশ না হওয়ায় এই নেশার খপ্পরে পড়েছেন তারপরও তাকে ধ্বংশের ভাগাড়ে নিক্ষিপ্ত করার আগ পর্যন্ত এটা থামবে না। প্রতিষ্ঠান এই নেশাটা লেখকের মনে ঢুকিয়ে দেয় ওদের স্বার্থে। এই আক্রমণটা মানসিক, এটা দেখা যায় না।
আরেক আক্রমণ, যা দেখা যায়, সেটাকে বলেছি শারীরিক। মোটাদাগে কাজটা হল লেখককে- লেখকের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়া- নোংরা শ্রেণিস্বার্থে, যা লেখকের জন্য অনেক বড় প্রতিবন্ধক। আর মোটাদাগে এই কাজটা করতে চায় পরিবার-সোসাইটি-রাষ্ট্রসহ বিবিধ প্রতিষ্ঠান। যে কোন বিষয় যখন রাষ্ট্রের দালালিমূলক না হয়ে ঠিক তার বিপরীত হয়, তখন রাষ্ট্র সেই বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে নীতিমালা বানায়। কন্ঠরোধ করতে চায় যেকোন উপায়ে।
এরা বুঝতেই পারে না, ব্ল্যাক যীশুর আর্টিস্টকে- তাঁর চিত্রকর্ম নষ্ট না করে, এডিট না করে সম্মানের সাথে আফ্রিকান এক বিচারক কেন খালাস দিয়ে দেন। আর ঐ বিচারক কেন বলেছিলেন যে, আর্টওয়ার্ক কেমন হবে বা হওয়া উচিত তা আদালত নির্দেশ দিতে পারে না।
শুধু আদালত নামক প্রতিষ্ঠানই নয়
আর্টওয়ার্ক কেমন হবে
তার সিদ্ধান্ত শুধু শিল্পীই নেবেন,
আর কেউ নয়- কোন প্রতিষ্ঠান নয় ।
আমরা চাই পরিবর্তন;
এই ব্যবস্থা পাল্টে
এমন ব্যবস্থা জারি করতে
যা বলির পাঠা হতে বাধ্য করবে না কাউকে
রচনাকাল: শেষ জুলাই থেকে মধ্য আগস্ট ২০১৪
সাম্য রাইয়ান
জন্মঃ তিরিশ ডিসেম্বর, নয়ের দশক
সম্পাদক, বিন্দু
প্রকাশিত বইঃ
সুবিমল মিশ্র প্রসঙ্গে কতিপয় নোট (গদ্য/বাঙ্ময় প্রকাশনা/২০১৫)
ফোনঃ ০১৭৮৩১১৬২৬০ । ই-মেইলঃ sammoraian@gmail.com
ওয়েবঃ sammoraian.blogspot.com