সোনারঘাট || রুখসানা কাজল

0

চিত্রকর্ম্ম : মঈন চৌধুরী

খুলনা থেকে একজন সাঁতারের প্রশিক্ষক এসেছিলেন আমাদের ছোট শহরে। সুমিত্রা পাল ম্যাম। সপ্তাহের তিনদিন উনি আমাদের খোলা ভ্যানে তুলে সহর (শহর) ছাড়িয়ে যেখানে নদী বেশ চওড়া সেখানে সাঁতার শেখাতে নিয়ে যেতেন। আমরা সাঁতার ম্যামের ঘাড়ে পিঠে চড়ে হইহই করে সাঁতার শিখতে চলে যেতাম। কখনো নদীর চরে কাদামাটী মেখে গড়াগড়ি খেয়ে, কখনো কচুরিফুলের মালা গেঁথে কখনো আবার কৃষকের জমী থেকে কাঁচা বাদাম আর ছোলাগাছ চুরি করে সাঁতার শেখা, সাঁতার শেখা খেলা খেলতাম।

সাঁতার ম্যাম কিছু বলতেন না। অনেক সময় আমাদের হয়ে রাগী কৃষকদের সাথে হাসিমুখে ঝগড়া করে আরো দুমুঠো কাঁচা বাদাম আর ছোলার গাছ আদায় করে আনতেন।

মাঝে মাঝে সাঁতরে অনেক দূর চলে যেতেন ম্যাম। তা প্রায় মাঝ নদী বরাবর। একটী বা দুটী ভেসে থাকা নৌকার কাছে গিয়ে থামতেন। আমরা ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ইদানীং এ নদীতে বড় নদী থেকে কুমীর চলে আসছে। সে কুমীর হঠাৎ হঠাৎ কাউকে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর খেয়ে ফেলছে। কিন্তু দেখতাম ম্যাম অই নৌকার মাঝীদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে ফের ফিরে আসত আমাদের কাছে। অই মাঝীরা খুব ভাল ছিল। সাঁতার ম্যামের কাছে আমাদের জন্যে চকোলেট, বিস্কিট, জিলাপী, দানাদার আরো কতকিছু যে দিয়ে দিত। আমরা খেতাম আর ম্যামের ভাগেরটা ম্যাম কোমরে গুঁজে নিয়ে যেত রাত্তিরে খাবে বলে।

সেই সাঁতার ম্যাম একটী ব্যায়াম শিখিয়ে দিয়েছিল আমাদের। যখন সাঁৎরাতে সাঁৎরাতে দুই ডানা আর দুই পা ব্যথায় ভেঙে আসবে, হাত পায়ের পেশীতে খিঁচ ধরে টান লাগবে, তখন শরীরটাকে শিথিল করে পানীর ওপর চিৎ হয়ে ভেসে থাকতে হবে। পানী ভাসিয়ে নিয়ে যাবে দোলাতে দোলাতে। চেনা নদী। ভয়ের তো কিছু নেই। ঘাট কোন না কোন একটা পাওয়া যাবেই। নইলে ভাসমান নৌকার মাঝী মাল্লারা টেনে তুলে নেবে। জলের দেশের নিয়ম ত তাই। কাউকে, সে মানুষ কিম্বা পশু হোক না কেন, জ্যান্ত ভেসে যেতে দেখলেই জলের আইনে তাকে বাঁচাতে হবে।

আমি প্রাণপণে তাই করছিলাম। ছোট ছোট পানীর দোলা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিটী দোলার আঘাতে ক্লান্ত আমি উঁহু আহ্ করে ভেসে যাচ্ছিলাম স্রোতে। দূরে ঘাট দেখা যাচ্ছে। মুখরিত সোনার ঘাট। সে ঘাটের পৈঠায় বসে আমার বাপী, বরুণচাচা, ময়েন স্যার, কমলা দিদিমনি, অশোককাকু, তাতারিফুপী ননষ্টপ বকে যাচ্ছে। মিস জোন্স আর মা হাসিমুখে গল্প করছে হঠাৎ পালিয়ে আসা আমার নকশাল দাদার সাথে। বাপীর হাতে লাল পতাকা। রেনুদি চক্কর দিচ্ছে পাহারাদারের মত। পুলিশ এলেই ইশারা করবে আর হাওয়ায় পালিয়ে যাবে দাদা। ওদিকে বরুণচাচা আর আমার সেজোমণি সেই আগের মতই মস্কো পিকিং মস্কো পিকিং করে লাগাতার তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে।

অবাক হয়ে দেখি, আশ্চর্য্যেরও মহাআশ্চর্য্য! আমার লষ্ট হাসবেন্ড সাদা স্পীডবোটে চড়ে সেই সদা বিরক্ত, হতাশ আর অপুরুষিত মীন মুখে আমার ভেসে আসা দেখছে। অনেকটা যেন পুলিশের মত তার চোখ। দৃষ্টিতে তীব্র মনোযোগের আড়ালে তীক্ষ্ণ গুপ্তচরের ক্ষিপ্রতা। ঘাটে পৌঁছানোর আগেই খপ্ করে ধরে ফেলে আমাকে। পুলিশের মত অনুনাসিক সুরে সে জেরা করে চলে, তোমাদের সাঁতার ম্যামের ভাগে চকোলেট, জিলিপী, দানাদার, বিস্কিট ছাড়া আর কি কি ছিল বল তো খুকী! অই যে চ্যাপ্টা মত, কালো। নল আছে। তোমার ভাইয়ার খেলনা পিস্তলের মত। মনে পড়েছে? বাহ্ গুড। আচ্ছা বলত, তোমাদের ম্যাম কি সেটা কোমরে গুঁজে রেখেছিল নাকি বালুচরে বাদামের ক্ষেতের ভেতর পুঁতে রেখেছিল? দেখাতে পারবে আমাদের? পারবে না? সে কি! কিছুই মনে পড়ছে না এখনও? এই দেখ খুকী, এই সবগুলো মিমি চকোলেট আর ভিউকার্ডগুলো তোমার জন্যে এনেছি। বল খুকী। সত্যি করে বল তো দেখি।

আমি ঝুঁটী বাঁধা মাথা দুলিয়ে, মুখের ভেতর লোভের লালা টেনে নিয়ে বলে যাই, কিচ্ছু না। কই কিচ্ছু দেখিনি তো আমি। কিচ্ছু ছিল না ম্যামের কাছে! সত্যি বলছি কিচ্ছু ছিল না কাকু।

লোকটার মীন মুখে আগুন জ্বলে ওঠে। আমি ভয়ে দ্রুত নেমে পড়ি পানীতে। এবার ভেসে যাচ্ছি। ভেসে যাচ্ছি সেই সোনার ঘাটের দিকে। হাত পা খিঁচিয়ে যাচ্ছে। ব্যাথায় ভরে যাচ্ছে শরীর। আমি শরীরটাকে শিথিল করে চীৎ হয়ে ভাসতে থাকি। মনে মনে ভয় পাই, লোকটা ঘাট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে ডুবিয়ে মারবে না তো!

আমার জিভের নীচ থেকে থার্মোমিটার বের করে ডাক্তারআপু বলে ওঠেন, এই তো জ্বর কমতে শুরু করেছে। হান্ড্রেড টু পয়েন্ট ফাইভ। তবে এত সহজে জ্বর ছাড়বে না। ভোগাবে আরো কিছুদিন।

আমি কাঁইকুঁই করে উঠি, এত জ্বর আমার কক্ষনো হয় না। কী হল আমার! মরে যাচ্ছি যে! আমি মরে যাচ্ছি!

খুব আদরে কদিনের জটাজুটো বাঁধা আমার চুলে চুমু খেয়ে অশেষ হেসে ডাক্তারকে জানায়, আন্টী প্রতি তিনচার বছর পর পর আম্মুর এই জ্বর হয়। ডাক্তার এন্টিবায়োটিক আর টেস্ট দেয়। আম্মু ওষুধ খেয়ে জ্বর সেরে গেলেই টেস্টের কথা ইচ্ছে করে ভুলে যায়। কোন টেস্ট আর করায় না। ইনফ্যাক্ট টেস্টের কথা মনেই আনে না। তবে এবার দেখছি খুব বেশী কষ্ট পাচ্ছে।

আমি জ্বরতপ্ত শরীরটা অশেষের হাতের ওপর ছেড়ে দিতে দিতে শব্দহীন উচ্চারণে বলে চলি, ভেসে যাচ্ছি। আমি কিন্তু ভেসে চলে যাচ্ছি। অই যে মাঝ নদীতে নৌকা এসে থেমেছে। অই যে সাঁতার ম্যাম চকোলেট, বিস্কিট, দানাদার, জিলিপীর সাথে খেলনা পিস্তলের মত কি যেন লুকিয়ে ফেলল কোমরে। মাঝীটা কেন যেন মাঝী নয়! নকশাল দাদার মত লাগল। দাদা! নকশাল বলে যে বাড়ী থেকে উধাও হয়ে গেছিল সেই আমার কোন ছোট্ট বেলায়!

গেল সন্ধ্যায় জ্বর কমে এলে অশেষ আমাকে মোয়ানা ফিল্মটী দেখতে বসিয়ে দিয়েছিল। মনের ভেতর আমার যে নিজস্ব একটী নদী আছে ওঁ জানে। আর জীবনভর ফাইট দিতে আমি যে খুব ভালোবাসি ছেলেটা তা-ও জানে। আমি আধো ঘুমে আধো জাগরণে মোয়ানাকে দেখছিলাম আর উদ্দীপ্ত হয়ে নিজেই বলছিলাম, হেই লুক, আই এম রুখসানা কাজল কামাল, ডটার অফ দ্যা রিভার মধুমতী! সিষ্টার অফ এ পলাতক নকশাল। এইসব জ্বরটরে আমার কিচ্ছু হয় না, কিচ্ছু হয় না—

কে যেন ভারী গলায় অশেষকে বলে, এবার সবগুলো টেস্ট করিয়ে ফেল বুঝলে। আমি এখন ঢাকায় আছি কিছুদিন। জোর করে না করলে তোমার মা কবেই বা কি করেছে স্বেচ্ছায়!

কে? কে? কে ভাই আপনি? ছেলের কাছে আমার গুপ্তী খুলে মেলে দিচ্ছেন! চোখ খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেও আমি পারি না। আমার চোখের আশেপাশে অসংখ্য নদীনালা। তাতে ধাপ বেঁধেছে কচুরিপানার দাম। কিছুতেই সে ভার সরিয়ে আমি তাকাতে পারছি না। কিন্তু কে এই মানুষটা? অশেষকে সাহস দিয়ে আমার সেবা করে চলছে! আমার পায়ের, মাথার জলপটী বার বার বদলে দিচ্ছে অসীম মমতায়!

বাঁহাতের ওপর মাথা রেখে কঁকিয়ে উঠি ব্যাথায়, ও মাগো। বাবাগো। মরে যাচ্ছি গো। আমি মরে যাচ্ছি।

ঘরসুদ্ধ সবাই হেসে ওঠে। সেই ভারী গলা অশেষকে বলে, একেই বলে ঠেলায় পড়ে বাঘের ধান খাওয়া বুঝলে অশেষ। তোমার মা সেই ছোটবেলা থেকে এরকম। মারকুটে। দাঙ্গাবাজ। তা এখন কেমন লাগছে মাতঙ্গিনী রুখসানা?

আমি চোখ মেলে তাকাতে চাই। এই কন্ঠস্বর আমার শৈশব মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। সেই যে রাতদুপুরে, ভর বিকালে, ভোরের আজানের আগে যখন তখন পুলিশ আসত আমাদের বাসায়। দাদাকে খুঁজে পেতে সারা বাড়ী, বাগান, বইয়ের বাকসো, আলমারী তছনছ করে ফেলত। ষ্টোর রুমে রাখা চালের বস্তা, আলুর ঝাঁপী খুলে ফেলে পেঁয়াজ রসুনের মাচান ভেঙ্গেচুরে একাকার করে চলে যেত। সব মনে পড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু আমি চোখ মেলে তাকাতে পারছি না। কচুরিপানার শিকড় আর নালে জড়াজড়ি হয়ে গেছে আমার চুল। দূরে বড় নদীর ঘ্রাণ ভেসে আসছে। নদী ডাকছে গুমগুম করে। কঠিন ভৈরবী বাজছে সে সুরে। আমি ভেসে যাচ্ছি সেই ভৈঁরো সুরের মায়া ঝরা জলপথে। আরো একটী বাঁক। সেটা পেরুতে পারলেই হাতের কাছে সোনারঘাট। সেখানে লাল পতাকা হাতে বাপী বসে আছে। বাপীর পাশে দাদা। দাদার দুপাশে মা আর সাঁতার ম্যামসহ আরো কত জন!

হঠাৎ রক্ষীবাহিনীর কমান্ডরের মুখের মত হয়ে যায় আমার লষ্ট হাসব্যান্ডের মুখ। সাফল্যের শেষ মুহুর্ত্তে বরাবরের মতই রুক্ষ কঠিন স্বরে সে হেঁকে ওঠে, ফায়ার!

চিত্রকর্ম্ম : মঈন চৌধুরী

মুহুর্ত্ত মাত্র! প্রতিটা কচুরিপানার ধাপ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে নদীতে। এক সময় একটী ধাপ থেকে মরণ চিৎকার ভেসে আসে। সুমিত্রাদি। ম্যাম। আমাদের সাঁতার ম্যাম একবার ভেসে উঠে আবার হারিয়ে যায় কচুরিপানার বনে। পানীতে ঘূর্ণি ওঠে। লাল হয়ে যায় জলের স্রোত। তারপরেও দুজন সৈনিক না থেমে ঠা ঠা করে গুলি চালিয়ে যায়। আমরা, ম্যাম আমাদের সাঁতার ম্যাম বলে জলপুলিশের নৌকায় ঠক্ ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে কাঁদতে থাকি। কেউ কেউ সৈনিকদের পায়ের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠি, ম্যাম ম্যাম, এই যে আমরা। হাত ধরুন ম্যাম! সাঁতার ম্যাম—

সৈনিকরা আলুর বস্তার মত আমাদের সবাইকে নৌকার মাঝখানে জড় করে রেখেছে। ভেজা গা। খালি পা। এ ওর গায়ের সাথে লেপ্টে চেপ্টে কাঁপছি আর কাঁদছি। বিধ্বস্ত নদী। বিধ্বস্ত কচুরিপানার দল। এলোমেলো হয়ে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে বড় নদীর বুকের গভীরে। আমরা কাঁদতে কাঁদতে ঢিকসি তুলে বলি, ম্যাম মরে যাচ্ছে। আমাদের সাঁতার ম্যাম বড় নদীতে ভেসে যাচ্ছে। ও রাইফেল কাকুরা আপনারা ম্যামকে বাঁচান। আমাদের ম্যামকে বাঁচান প্লিজ!

ধ্যাড়াঙ্গে এক সৈনিক রাইফেল নামিয়ে কমান্ডারকে জিগ্যেস করে, লাশ কি তুলে আনব স্যার?

নোওপ। কমান্ডার লাল গামছা মাথায় বেঁধে রাখাল রাজা সেজে উত্তর দেয়, রিপোর্টবুকে লিখে রেখ, সফল খতম বাট নো ট্রেস। আমরা পিকনিক করতে এসেছিলাম। আচমকা নকশালরা—

বাট এই বাচ্চারা স্যার—

কমান্ডার রঙ ছোপানো সুন্দর বিকালকে কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। কমান্ডারের মুখটা কেমন ফ্যাঁকাসে। অপুরুষ ফর্সা রঙের। আমি জানি এরকম মরা মুখে হাজার বার চুমু খেলেও এ রঙের কোন খোলতাই হয় না। ফ্যাতফেতে পানসে। জলশীতল মীন স্পর্শ। অথচ বেদম স্মার্ট। আর্টিফিসিয়াল সুন্দর দেখতে কমান্ডার লোকটা এক পায়ে একটী খালি ড্রাম টেনে তার ওপর বসে মুড়িমাখানো হাসি হেসে বলে, ওরা ভুলে যাবে। ভয়ে একটু পরেই জ্বর আসবে ওদের সবার। ফেবুলেসলি হাই ফিভার। আবোল তাবোল বকবে। জ্বর থাকবে সাত থেকে পনের দিন। তদ্দিনে ওদের ঘিলু ধুয়ে ফকফকা হয়ে যাবে। মেমরি পুড়ে মিষ্টি আলুর মত তুলতুল হয়ে যাবে। বাচ্চারা তখন নিজেরাই গল্প বানাবে, রাইফেল কাকুরা খুব ভাল। আমরা যখন ভেসে যাচ্ছিলাম ওরা এসে বাঁচিয়েছে। আর সাঁতার ম্যাম আমাদের পানীতে ফেলে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। কি বাজে পচা এই সাঁতার ম্যাম। ম্যামকে কুমীরে খেয়ে নিলে খুব ভাল হয়।

সৈনিকরা তাই শুনে ঠা ঠা করে হাসে। ওদের দাঁতগুলো ওদের কোমরে ঝুলানো পেতলরঙ্গা বুলেট মালার মত পরিপাটি, সাজানো ঝকঝকে। ওরা সুর করে গেয়ে ওঠে, জোরসে বল, তালে বল, আরে প্রাণে বল, সবাই বল, তোমার বাড়ী আমার বাড়ী নকশালবাড়ী নকশালবাড়ী।

কমান্ডার দু হাতে চুটকি বাজিয়ে তালি দিয়ে পা নাচায়। তারপর দুঃখ দুঃখ ভাব করে আমাদের পাশে এসে বসে। আমার ভেজা চুলগুলো জোরে টেনে দিয়ে অন্যদের চুলও টেনে দেয়, বাচ্চুরা তোমরা তো জানো, বড় নদী থেকে একটী কুমীর ঢুকে পড়েছে এই নদীতে। মানুষখেকো কুমীর। ইসস্ তোমাদের সেফ্ করতে পারলাম। কিন্তু তোমাদের সাঁতার মিসকে কিছুতেই বাঁচাতে পারলাম না। সো স্যাড বাচ্চুরা। প্রে ফর হার।

ততক্ষণে আমাদের চোখ বুজে আসতে শুরু করেছে। গা তেতে উঠছে জ্বরে। সবকিছু কেমন লাল লাল দেখতে লাগছে। আবার তার সাথে হঠাৎ প্রচন্ড ঠান্ডাও লাগতে শুরু করেছে। জ্বর তপ্ত কানে শুনতে পেলাম কে যেন বলে ওঠল, স্যার চারু মজুমদার ধরা পড়েছে ত অনেক দিন আগে। এনকাউন্টারে তার মৃত্যুও হয়ে গেছে। খবরটী যদি সত্যি হয় তো এরা এখনো কিসের আশায়—

কড়া তামাকের গন্ধে অদ্ভুত ভাল লাগায় ভরে যায় জলপুলিশের লঞ্চ। আরামে মাথা খুলে খুলে ভেসে যাচ্ছে আকাশে বাতাসে। আমি গাইছি। হাসছি। ছড়া বলছি। অন্যরাও খুশি খুশি। তারা চেঁচাচ্ছে। গাইছে, হাসছে। এরম করতে করতে আমরা নেতিয়ে যেতে থাকি। ফেবুলেসলি হাই ফিভারে আমরা শুয়ে পড়ি জলপুলিশের লঞ্চের পাটাতনে।

কারা যেন ত্রস্তে আমাদের কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে। কে যেন নিজের শার্ট খুলে আমাকে পেঁচিয়ে ভাল করে ঢেকে ঢুকে দিয়ে চেঁচিয়ে ডেকে ওঠল, বড়কাকা বুন্ডির যে অনেক জ্বর। বাসায় নেব, নাকি ফার্মেসীতে নিয়ে যাব?

আমি যেতে যেতে দুহাতে ফ্রকের কোণা মুচড়ে, চৌকী দিয়ে বানানো মঞ্চে পায়ে তাল ঠুকে, গলা উঁচু করে মাইক্রোফোনের ফুটো ফুটো রূপালী ঠোঁট ছুঁয়ে বলি, আমার নাম রুখসানা কাজল কামাল। ক্লাশ থ্রী। আমি এখন একটা ছড়া বলব। বলি?

উঠোন জুড়ে মা, চাচী, ফুফু, মাসী, কাকীরা ফুরফুর করে হেসে হাত দোলায়, আচ্ছা আচ্ছা বল্ বল্। তাড়াতাড়ি বলে ফেল বাপু। তোদের ন্যাংটাপোংটাদের আসর শেষ হলেই হেমন্তের গান শোনাবে বরুণ। ও বরুণ অনেকগুলো গান গাবি কিন্তু ভাই! থামবি না মোটেও। ফাঁকি দিলি কিন্তুক মার আছে তোর কপালে এইবেলা বলে রাখলাম!

ষ্টেজের পাশ থেকে মাথায় গাট্টা মারার ভয় দেখিয়ে আপুলি বলে, এক্কেরে এক মিনিট তোদের জন্যে। মনে থাকে যেন। তোর পরে নাজমা ছড়া বলবে। নাজমা কই রে! এই নাজমা এদিকে আয় এখুনি। লাইনে দাঁড়িয়ে থাক। যা, জলদি যা—

আমি হাত দুলিয়ে নদী বানাই, লাফিয়ে লাফিয়ে নদী পেরুই আর থমকে থমকে ছড়া বলতে থাকি, এ নদীতে কুমীর নাই, হাপুসহুপুস নেয়ে যাই। হাপুসহুপুস নেয়ে যাই, এ নদীতে কুমীর নাই। জোরসে বল, তালে বল, আরে রে রে সুরে বল, প্রাণে বল, জানে বল, সবাই বল, সবাই বল, জলদি বল, জলদি বল তোমার বাড়ী আমার বাড়ী নকশালবাড়ী নকশালবাড়ী …

 

 

 


রুখসানা কাজল
শৈশব কৈশোর মধুমতী নদী বাহিত গোপালগঞ্জ শহরে।
পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। পেশায় শিক্ষক।
প্রকাশিত বইঃ
কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ (ইত্যাদি প্রকাশনী), রুখসানা কাজলের অণুগল্প (অণুপ্রাণন প্রকাশনী), আহা জীবন (চিত্রা প্রকাশনী), জলের অক্ষর (নালন্দা প্রকাশনী), নুনফল গল্পগুলো (রসেবশে প্রকাশনী, পরিবেশক— খোয়াবনামা, প্রান্তজনের কথা, কলিকেতা)

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{সোনারঘাট || রুখসানা কাজলের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার