আমপাতা ও নীল শাড়ী || মঈন চৌধুরী

0

মঈন চৌধুরীর চিত্রকর্ম্ম— মুক্তি

বিদেশে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরছিলাম। বাংলাদেশের ওপর বিমান পৌছানোর পর সারাক্ষন জানালা দিয়ে বাংলাদেশের নদী আর সবুজ দেখতে দেখতে ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছিলাম। বিমানের চাকা যখন ঢাকার রানওয়েতে নামল, তখন আর ইমোশন ধরে রাখতে পারলাম না। চোখ দিয়ে তখন টপ টপ করে পানী পড়ছিল। আমার পাশে বসা এক বিদেশী ভদ্রলোক আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো— Anything bad waiting for you? বললাম—Not at all, I’m happy to land in my country. Thank you। ভদ্রলোক আর কথা বাড়ালেন না।

এখন আমি ভাবি, যে ইমোশন নিয়ে আমি আমার দেশে ফিরে এসেছিলাম, সে ইমোশন কি আমার এখন আছে? আমার দেশ কি আমাকে আমার স্বপ্ন দিতে পেরেছে? উত্তর আমি পাই না, মনে হয় আমি, আমরা, আমাদের দেশ সবাই মিলে সুন্দর স্বপ্নগুলো সব নষ্ট করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে তাই রাগ করে আমার আদরের বাংলাদেশকেই আমি এখন বকাঝকা করি।

মাঝে মধ্যে আবার দেশের বাইরে গেলে কেন জানি দেশটার কথাই বেশী মনে হয়, মন পোড়ায়। দেশের বাইর গেলেই মাঝে মধ্যে সেই পুরাতন ইমোশন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মনে পড়ে যায় সেই আমপাতা আর নীল শাড়ীর কথা। আমপাতা আর নীল শাড়ীর গল্প তবে খোলাসা করেই বলি।

বিদেশে পড়াশোনা করার জন্য স্কলারশিপ পেয়ে আমি গিয়েছিলাম অস্ট্রিয়ার সালজবুর্গ শহরে। আমার কোর্সের কিছু অংশ মিউনিখ ইউনিভার্সিটীতে করতে হয়েছিল। আমি যখন সালজবুর্গে গিয়েছিলাম, তখন একজনও বাঙালী ছিল না সেখানে। মাঝে মধ্যে তাই নিজেই নিজের সাথে বাংলায় কথা বলতাম। দেশের কথা এতই মনে হত যে মাঝে মাঝে ভীষণ হোমসিক হয়ে পড়তাম। এভাবে ছয় মাস কেটে যাবার পর স্টাডী ট্যুরে একবার ভিয়েনা যাচ্ছিলাম। পথে দানিউব নদীর তীরে মেল্খ মনেস্ট্রী দেখার জন্য আমাদের বাস থামল। মনেস্ট্রী দেখার পর ফিরে এসে দুপুরের খাবার আগে হঠাৎ খেয়াল করলাম দানিউব নদীর তীর ঘেঁসে একটা আমগাছ দাড়িয়ে আছে। আমি প্রায় পাগল হয়ে গেলাম আম গাছটী ধরে দেখার জন্য। আমার মনে হচ্ছিল ঐ আমগাছটায় বাংলাদেশ আছে। কাওকে কিছু না বলে, কিছু না খেয়ে, উঁচুনীচু পাথর আর জলাভুমী অতি কষ্টে পার হয়ে আম গাছটীর কাছে গেলাম। দুহাত বাড়িয়ে খুব আদর করে তুলে আনলাম আমগাছের দুটা পাতা। কিন্তু হায়, আমি দেখতে পেলাম গাছটী আমগাছ নয়, আমগাছের মত দেখতে অন্য কোন গাছ। এত হতাশ হলাম যে আমার চোখ ভিজে গেল। ফিরে এসে দেখি আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। আমাদের টিচার ডঃ ওয়েইছ অল্প সল্প বকা দিলেন আমাকে। কিছু না খেয়েই রওয়ানা করলাম ভিয়েনার দিকে।

ভিয়েনা গিয়ে ভাবলাম, ছয় মাস বাংলা বলি না, এবার নিশ্চয় বলা যাবে। কিন্তু কোথায় যে বাঙালী পাব, তা তো জানা নেই। আর মাত্র দুদিনের জন্য বেড়াতে এসে বাঙালী খুঁজে বের করাও প্রায় অসম্ভব। তাই আমার একমাত্র ভরসা ছিল রাস্তাঘাটে বাঙালী ধরা। একদিন মারিয়া হিল্ফাস্ট্রাসেতে ঘুরে বেড়ানোর সময় হঠাৎ দেখতে পেলাম অনেক দূরে নীল শাড়ী পড়া এক মহিলা হেটে যাচ্ছেন। আমার মনে হল বাঙালী ঐ মহিলার সাথে একটু কথা বলতে পারলে কিছুটা হলেও বাংলাদেশকে পাব, তার সাথে কথা বলতেই হবে। মারিয়া হিল্ফাস্ট্রাসেতে তখন প্রচণ্ড ভিড়। আমি লোকজন কাটিয়ে মহিলার দিকে কখনো দৌড়ে কখনোবা জোরে হেঁটে এগুতে লাগলাম। মাঝে মধ্যে হারিয়ে ফেলছিলাম মহিলাকে, তারপরেও আন্দাজ করে এগুতে এগুতে প্রায়ে বিশ মিনিট পর হাপাতে হাপাতে তার সামনে উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম—Excuse me! Are you from Bangladesh? মহিলা উত্তর করল— No, I’m an Indian, I’m from Delhi। আবারও হতাশ হলাম। মহিলা আমার সাথে কিছুক্ষন কথা বললেন। আমিও খুলে বললাম আমার মনের অবস্থা। তিনি আমাকে বললেন— হিন্দীতে কথা বললে কি মন শান্ত হবে? আমি বললাম— আমি তো হিন্দী জানি না। তখন তিনি আমাকে ভিয়েনা আই ইনস্টিটিউট কিংবা ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি কমিশনে যেতে বললেন। ওখানে নাকি কিছু বাঙালী লোকজন আছে। আমার যাওয়া হয়নি, বাঙালী আর বাংলাদেশকে পেলামও না।

এখন আমি কি আর আগের মত আছি? মনে হয় না, আমি বদলে গেছি। আমার এক ছেলে আর এক মেয়ে। তারা পড়াশোনায় তুখোড়৷ দুজনই মেলবোর্নের মোনাস ইউনিভার্সিটী থেকে পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার পর যখনই দেশের কথা বলেছে, আমি তাদের বলেছি— “অবশ্যই আসবে, তবে একটু অপেক্ষা কর, দেশের অবস্থা কি হয় দেখি।” ইতিমধ্যে তারা অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকও হয়ে গেছে। পিতা হিসেবে আমার এক মন চায় যে তারা দেশে ফিরুক, আবার অন্য এক মন চায় না তারা দেশে ফিরে এসে এক অসহায় অবস্থায় পড়ুক৷ সত্যি কথা হল, আমি মনে হয় চাচ্ছি না তারা দেশে ফিরে দেশের সম্পৎ হয়ে থাক। আবার অন্য দিকে আমি আর আমার স্ত্রী সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশ ছাড়তে চাই না৷ আমি মনে প্রাণে চাই এই দেশে আমার বাবা আর মায়ের কবরের পাশে আমাদের কবর হোক৷

আমার বিবর্ত্তন দেখে আমি অবাক হয়েছি। আমি আমার দেশের জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আমি জানতে চাচ্ছি, আমার এই বিবর্ত্তনের জন্য দায়ী কে? দায়ী কি আমার দেশ, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, নাকি আমি নিজে? প্রথম সত্য হিসেবে আমি আমাকেই কাঠগড়ায় দাড় করিয়ে দোষী সাব্যস্ত করেছি, কিন্তু ভাবছি এই বিবর্ত্তনের প্রেক্ষাপটে আরও কী যেন আছে!

 

 

 

 

মঈন চৌধুরী
ভু-প্রকৌশল উপদেষ্টা, শিক্ষকতা, কবী, প্রাবন্ধিক ও শিল্পী৷
জন্মস্থান : কোলকাতা।
জন্মতারিখ : ২৫শে বৈশাখ, ১৩৫৪ সাল।
নিবাস : বাংলাদেশ।

প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ
১. এ কেমন ভালবাসা (১৯৮৮), ২. ইন্দ্রজালে আপেক্ষিক (১৯৮৯), ৩. জীবন শব্দ রেখা (১৯৯০), ৪. কবিতা ও ড্রইং (১৯৯২), ৫. প্লাবন ও অন্তঃবৃক্ষের গান (১৯৯৪), ৬. কমলার ফুল জলপাই চাই (১৯৯৬), ৭. শব্দের পদ্মফুল (২০০৪), ৮. অন্তর সুন্দর স্বপ্ন (২০০৫), ৯. অর্পণ দর্পণে দেখা (২০০৭), ১০. রাইনা পরী রাধা (২০০৭), ১১. A Journey with Mita (২০০৮) ১২. কবিতা সংগ্রহ (২০১৪)

প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ
১. সৃষ্টির সিড়ি (১৯৯৭), ২. বাঙ্গাল জাতীয়তাবাদ (১৯৯৮), ৩. ফুকোর মানব (১৯৯৯), ৪. হ্বিটগেন্সটাইনের দর্শন (২০০০), ৫. ইহা শব্দ (২০০৪), ৬. অল্প স্বল্প হলুদ গল্প (২০০৬), ৭. শব্দের সম্ভাবনা (২০০৭), ৮. বাংলা বানান সংস্কার (২০০৮), ৯. ভাষা, মনস্তত্ত্ব ও বাঙ্গাল/বাঙালি সংস্কৃতি (২০০৯). ১০. প্রবন্ধ সংগ্রহ (২০১২)।

সম্পাদনা
সম্পাদক : প্রান্ত — সাহিত্য ও দর্শন বিষয়ক ছোট কাগজ (১৯৮৮–১৯৯৮)।

শিল্প প্রদর্শনী
সালজবুর্গ, অস্ট্রিয়া (১৯৭৪); প্যারিস, ফ্রান্স (১৯৭৫); এথেন্স, গ্রীস (২০১৩)।

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{আমপাতা ও নীল শাড়ী [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার