রোদনের পদাবলী : বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বাংলা-বাঙালীর রাজনৈতিক হাহাকার || দ্বীপ দিদার

0

অলঙ্করণ : হিম ঋতব্রত

সেই কবে মারা গেছে, হাঁটুজল নদী, বাঁকে বাঁকে ঢেউয়ের দোলা,
কাশফুলের ওড়না ওড়া বনে বাতাসের দোলা, সবুজের নৃত্য,
দোলায়িত মন,
মাঠের রাখাল, গরুর পালের হাঁটুজল পাড়ি,
দড়ী ছেঁড়া গাভীটার পিছু ছোটা, রাখালিয়া বাঁশীটার মেঠোমনা সুরে
নেচে নেচে খেলা করা ঘাসফুলটার মন, উদাস কুটীরে ফেরা
সময়যাপন, ভরা কলসের আকাঙ্খা,
সময়ের পটভূমিকায়, মনে, খেলছে এখন জনপদ, নাগরিক কোলাহল,
দালানে দালানে ঢাকা, পুঁজির বাসরে নৃত্য করে, গণেশের জলসায়,
গলায় খেলছে সুর, ধনের গীতালী,
একচিলতে সবুজ উদ্যানে, হাঁটুজল লেকের কিনারে বসে,
ভাবছি এসব, জানে না সোহরাওয়ার্দী, সেই কবে ৭৫-এ মারা গেছে
ঘাসফুলটার মন, বাংলাদেশ,
বাঁকে বাঁকে ঢেউপ্রিয়তায় জেগে ওঠা রেসকোর্স ময়দান,
সুরেলা ভাষণ (…)
যারই গুঞ্জনে বয়ে যেত হাঁটুজল নদী, সমবেত সুরে,
পাখীর কাকলিমুখরিত গাছের ছায়ায়, মেঠোসুরে বেজে ওঠা বন্ধুয়ার গান,
বঙ্গের বাতাস,
পালতোলা নৌকা, বৈঠার ঘায়ে ঘায়ে জেগে ওঠা হাঁটুজল নদী,
বাংলাদেশ, সেই কবে মারা গেছে, ৭৫-এ
আজও বাঁশীর সুরে বেজে ওঠে বিজয়ার কান্না
জানে আলাওল, ভনে চণ্ডিদাস—
সখা, বৃথা যায় প্রেম রজকিনী বাঙলায়, ভুসুকু পায় না, শবরী বালিকার মন

                                                                              — রোদনের পদাবলী ।। আরণ্যক টিটো

 

কবিতার সূচনায় ছোট ছোট কথাচিত্রের গাঁথুনীতে এখানে জীবন্ত হয়ে ওঠেছে মৃত/বিস্মৃত একটা মাটী-বর্ত্তী গ্রামীণ জনপদের সবু-জিয়া চিত্রকল্পনা। শুধুই চিত্রকল্পনা? হাঁটুজল নদী, কাশবন, রাখাল, গরুর পাল, রাখালিয়া বাঁশী, দড়ী-ছেঁড়া গাভী এসব শব্দচিত্রের মাঝে যেমন লুক্কায়িত আছে আমাদের নিসর্গবর্ত্তী জীবনচিত্র, তেমনি লুক্কায়িত আছে আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির লেখচিত্র? আবার ঘাসফুলের মন, উদাস কুটীর, সময়যাপন, ভরা কলস এসব শব্দবন্ধে রূপায়িত হয়েছে আমাদের সমাজ-রাজনৈতিক আবহমান প্রত্যাশা?

সময়ের পটভূমিকায়, মনে, খেলছে এখন, জনপদ, নাগরিক কোলাহল,
দালানে দালানে ঢাকা, পুঁজির বাসরে নৃত্য করে, গনেশের জালসায়,
গলায় খেলছে সুর ধনের গীতালী, …

এইটা আলাদা কোন চিত্রকল্প নয় বরং আগের চিত্রকল্পেরই ধারাবাহিক রূপ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হল, যে চিত্রকল্পের সূচনায় আমরা হাঁটুজল নদী, কাশবন, গরুর পালের মত গ্রামীণ শব্দচিত্র ও কৃষি জীবন/জনপদের পরিচয় পেয়েছি তাতে চুপিসারে নাগরিক কোলাহল ঢুকে পড়ল কীভাবে? না, এখানে বিস্ময়ের কিছুই নাই হয়ত। স্বাভাবিক পরিবর্ত্তনের ধারায় সময়ের পটভূমিকায় হাঁটুজল নদী হয়ে গেছে হাঁটুজল লেক, গ্রাম হয়ে গেছে নগর? কিন্তু এরপরও কথা আছে পরিবর্ত্তন স্বাভাবিক, কিন্তু পরিবর্ত্তনের সুফল কিছু বিশেষ লোকের কাছে যাবে তা তো আর স্বাভাবিক হতে পারে না। এর মধ্যে থাকতে পারে অতিসুক্ষ্ম প্রতারণা, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ধোঁকা। গনেশের জলসা, পুঁজির বাসর, ধনের গীতালী এসব শব্দ কি এমন কোন প্রতারণার ইঙ্গিত দেয়? তা বুঝতে হলে একটু প্রদক্ষিণ করে আসতে হবে বিগত কিছু সন্ধিক্ষণ—

আমরা জানি আধুনিক নগর পত্তনের সাথে শিল্পবিপ্লবের গভীর সম্বন্ধ আছে। আর আধুনিক নগর এবং শিল্পবিপ্লবের সাথে জটিল ও গভীর সম্পর্ক আছে পুঁজির!?…

ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ-প্রান্তর হামাগুড়ি দিয়ে প্রাচীন যে কয়েকটা জনপদের সীমান্তের ওপর দণ্ডায়মান আজকের বাংলাদেশ। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এবং বড় শহর। অনেক আগে থেকেই বাঙলা একটা কৃষিপ্রধান জনপদ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠালগ্নেও এদেশের অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ কৃষিনির্ভর। আর রাষ্ট্রের ভাগ্যনিয়ন্তা ছিল মহামতি কৃষকগণই। অর্থনীতির পুরা ভাগই ছিল কৃষকের মুঠোই। কৃষিবান্ধব ছিল দেশ, দেশের ভূমী। একসময় বিচিত্র উদ্ভিদে ভরপুর ছিল এ জনপদ। গাছ-গাছালীতে ভরপুর ছিল আজকের প্রধান শহর ঢাকাও। বৃক্ষময় সবুজিয়া প্রকৃতির মাঝে ছিল কৃষিজমী, গোচারণ ভূমী, নদী, কাশবন। কিন্তু সময়ের পটভূমিকায় ধীরে ধীরে পাল্টে গেল পরিবেশ-প্রতিবেশের চিত্র। পাল্টে গেল সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি। দ্রুত বিস্তার ঘটল শিল্পের, যান্ত্রিক নগরের। ঘটল পুঁজির বিকাশ। বাড়ল শিল্পপতী। নাগরিক কোলাহলে মুখরিত হল চারদিক। গড়ে ওঠল কলকারখানা, আবাসিক এলাকা। দালানে দালানে ঢাকা পড়ল শহর ঢাকা। হ্রাস পেল কৃষি জমী; ক্ষিণকায় হল কৃষক। দ্রুত থেকে দ্রুততর হল পুঁজির বিকাশ। গনেশের জলসার জ্ঞান-বিজ্ঞান সবকিছু ছুটল পুঁজির পিছনে। আইন, প্রশাসন নিয়োজিত হল ধনীর ধন পাহারায়। এভাবে সর্ব্বত্র সর্ব্বদা গীত হতে থাকল পুঁজির মহিমা। এখন সহজে আঁচ করতে পারার কথা— এই যে হাঁটুজল নদী মারা গেল, গ্রাম নগরে পরিণত হল— এ শুধুই সামাজিক কিংবা প্রাকৃতিক পরিবর্ত্তন নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে অনেক সমাজ-রাজনৈতিক, সমাজ-অর্থনৈতিক শোষণ বঞ্চণা প্রতারণার নিদারুণ নির্ম্মম রহস্য? ভরা কলসের আকাঙক্ষায় ঘরে ফেরা লক্ষ কোটী মেহনতী মানুষের হাহাকার?

একচিলতে সবুজ উদ্যানে, হাঁটুজল লেকের কিনারে বসে,
ভাবছি এসব, জানে না সোহরাওয়ার্দী, সেই কবে ৭৫-এ মারা গেছে
ঘাসফুলটার মন, বাংলাদেশ,
বাঁকে বাঁকে জেগে ওঠা রেসকোর্স ময়দান, সুরেলা ভাষণ (…)
যারই গুঞ্জনে বয়ে যেত হাঁটুজল নদী, সমবেত সুরে,
পাখীর কাকলি মুখরিত গাছের ছায়ায়, মেঠো সুরে বেজে ওঠা বন্ধুয়ার গান,
বঙ্গের বাতাস,
পালতোলা নৌকা, বৈঠার ঘায়ে ঘায়ে জেগে ওঠা হাঁটুজল নদী,
বাংলাদেশ সেই কবে মারা গেছে, ৭৫-এ …

এতক্ষণ আমরা কৃষিভিত্তিক জনপদের সবুজিয়া ভৌগোলিক পরিবেশের চিত্রকল্পনা দেখছি। এবার সত্যি সত্যিই উঠে এল সেই সবুজিয়া জনপদের সহজিয়া রাজনীতির ঐতিহাসিক দৃশ্যপট।

এখন পূর্ব্বের চরণগুলোর প্রতীক, রূপক যেমন স্পষ্ট হচ্ছে, তেমনি আবার বহুরৈখিক হয়ে উঠছে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাঞ্জনায়।

এবার আমরা একটা সূত্র ধরে আগাতে পারি— কথক যেখানে বসে ভাবছেন সেইটাই কবিতার মূল কেন্দ্র— সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের লেকের কিনারে বসে কথক বাঙলার ভূ-প্রকৃতির ভেতর দিয়ে সমাজ-রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি পর্য্যবেক্ষণ করছে।

ভারতবর্ষের পরবর্ত্তী পাকিস্তানের অন্যতম ও অগ্রগামী গণতন্ত্রী নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি কি জানতেন স্বাধীন বাংলাদেশের রেসকোর্স ময়দানের নামাঙ্কিত হবে তাঁর নামে, অথবা তাঁরই উত্তরসূরী মুজিব বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা হয়ে একদিন একটা স্বাধীন সার্ব্বভৌম রাষ্ট্রের কান্ডারী হবেন? আবার পরিশেষে বাঙলার মুক্তির অতৃপ্ত প্রত্যাশা নিয়ে বাঙালীর হাতেই নির্ম্মমভাবে খুন হবেন?

সেই কবে ৭৫-এ মারা গেছে
ঘাসফুলটার মন,
বাংলাদেশ, …

১৯৭৫ সালে মারা গেছে ঘাসফুলটার মন। সাথে সাথে মারা গেছে বাংলাদেশও। কিন্তু কই বাংলাদেশ তো বেঁচে আছে, টিকে আছে। তবে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ আছে— আজকের বাংলাদেশ সেই কৃষক-শ্রমিকের ভরা কলসের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ কিনা? যে দেশের জন্য তারা লাঙ্গল-হাতুড়ী ফেলে অস্ত্র ধরেছিল।

এখন প্রশ্ন হতে পারে, ঘাসফুলটার মন আসলে কী? এই কি আবহমান বাঙলার মুক্তিকামী গণমানুষের রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা, নাকি স্বয়ং বঙ্গবন্ধুরই প্রতীক?

ঘাসফুলটার মন মুক্তির পথে বাঙলার কৃষক-শ্রমিকের চিরন্তন প্রত্যাশা হোক কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হোক— এই ঘাস ফুলের মন মারা যাওয়ার সাথে বাংলাদেশও মারা যায়? আর যে বাংলাদেশ বেঁচে আছে সেইটা কোন্ বাংলাদেশ, ১৯৭৫ সনে মারা যাওয়া সেইটাই বা কোন্ বাংলাদেশ?

ইতিহাসের গভীর পাঠ নিলে জানা যাবে, এ জনপদের মানুষ অনেক আগে থেকেই রাষ্ট্র-রাজনৈতিক/রাজ্য-রাজনৈতিক নয় বরং সামজ-রাজনৈতিক সিষ্টমেই বেশী সংঘবদ্ধ ছিল। তাই এ অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কোন রাজ-সংঘাতে অংশগ্রহণের খবর মিলে না। মৌর্য্য থেকে সেন, আফগান থেকে মোঙ্গল নানান শাসক গোষ্টীর সিংহাসন লাভে কিংবা সিংহাসন হারানোতে তাদের কোন আগ্রহ অথবা কৌতূহল ছিল না। পলাশীর প্রান্তরে সিরাজ উদ্ দৌলার পতনের সময় তাই তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাপুড়ের সাপ খেলার মত সেই নাটকীয় যুদ্ধ উপভোগ করেছে।

… একসময় সারা বিশ্বে রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেল। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, শ্রেণিসংগ্রাম, সমাজতন্ত্র নানান চেতনাও মতাদর্শ বিকাশের সাথে সাথে সাধারণ মানুষ রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এখানেও সাধারণ মানুষের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারিত হয় ধীরে ধীরে। জটিল সব ঐতিহাসিক রাজনৈতিক কারণে এখানে বিকশিত হয় ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনা। আর একসময় সে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার ভেতর দিয়ে বাঙালীর স্বাধিকার ও জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পাশাপাশি এতে ধীরে ধীরে শামিল হতে থাকে সাধারণ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষসহ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। তাদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক মঞ্চ হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। এবং তাদের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠে মুজিব। আর এতে এখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একপ্রকার হারজিত ঘটে গেল। শ্রেণিসংগ্রাম বা সমাজতান্ত্রিক চেতনাকে ছাপিয়ে এখানে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আধিপত্যের সূচনা হয়ে গেল। আওয়ামী লীগ ছিল একটা বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর শিষ্য মুজিব ছিলেন একজন গণতন্ত্রপন্থী নেতা। সাথে সাথে সমসাময়িক সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ও বিপ্লবের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। আর দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা তাঁকে শেষ পর্য্যন্ত সমাজতন্ত্রের প্রতিই দায়বদ্ধ করেছিল।

এদেশের যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দেখাদেখিতে আওয়ামী লীগের মত একটা বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের তাবুতে সমবেত হয়েছিল তাদের পক্ষে শ্রেণিসংগ্রামের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বাস্তবতা বোঝা যেমন সম্ভব ছিল না তেমনি সম্ভব ছিল না গণতন্ত্রের স্বরূপ বোঝা(?)। তারা কেবল স্বাধীনতার প্রশ্নে তাদের নেতা মুজিবকে বিশ্বাস করেছিল এবং তাঁর নিকট রাজনৈতিক আনুগত্য সমর্পণ করেছিল। তবে সেদিন দেশের বৃহত্তর খেটেখাওয়া জনগোষ্ঠী স্বাধীনতা বলতে কী বুঝেছিল?

পণ্ডিতগণ বলেন, পাকিস্তান পিরিয়ডে নাকি বাঙালীরা স্বাধীনতা বলতে কেবল পাকিস্তান শাসন থেকে মুক্ত হওয়াকে বুঝত(?)। স্বাধীন হওয়ার পর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে স্বাধীনতা ধারণার আরো বৃহদার্থ উন্মোচিত হয়। তাহলে কি সেদিন বাঙলার খেটেখাওয়া জনগোষ্ঠী স্বাধীনতা বলতে কেবল পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে মুক্তিকেই বুঝেছিল, নাকি এই স্বাধীনতা শব্দের ভেতর তারা অবচেতনে দেখতে পেয়েছিল তাদের যুগযুগান্তরের অব্যাক্ত রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা, অর্থনৈতিক মুক্তি?

১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হল। একেতো যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ— আন্তর্জাতিক যে মহল এদেশের জন্মরোধ করতে চেয়েছিল তারা আরো সূক্ষ¥ চাল চেলে যাচ্ছিল। আওয়ামী লীগ নামক যে বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, অস্থায়ী সরকার চালিয়েছিল, স্বাধীনতার পরেও যারা সরকার গঠন করেছিল ধীরে ধীরে তাদের অধিকাংশ নেতা-কর্ম্মীর বুর্জোয়া চরিত্র প্রকাশ পাচ্ছিল। তারা অনেকেই মেতে উঠেছিল লুটপাটে। আর তাদের সাথে যুক্ত হয়েছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের একটা ছদ্মবেশী অংশ। আরো জঘন্য লুটপাট চালাচ্ছিল দুরাচারী আমলারা। ফলে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী খেটেখাওয়া মেহনতী মানুষ প্রতারিত হচ্ছিল প্রতিনিয়ত। কোথায় তাদের হাজার বছরের কাক্সিক্ষত মুক্তি? স্বাধীনতা— এই কি কেবল মরীচিকা, ক্ষমতার হাত বদল নাকি …

একজন বঙ্গবন্ধু— দড়ী ছেঁড়া গাভীটার পিছু ছোটা সেই রাজনৈতিক রাখাল, সহজিয়া বাঙলার সহজিয়া মানুষের সহজিয়া নেতা— তিনি তাঁর লক্ষ্যে অবিচল। মেহনতী মানুষের বিশ্বাস রক্ষায়, তাদের প্রকৃত মুক্তির প্রত্যয়ে সংকল্পবদ্ধ। সাথে ছিলেন জাতীয় চার নেতার মত কিছু বিশ্বস্ত একনিষ্ঠ সহযোগী।

চারদিকে লুটপাটকারীদের উপর্য্যুপরি লুটপাট, আত্মসাৎ। অপর দিকে নিজ দলের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশটার দলত্যাগ, এবং সে তারুণ্যের নিষ্ঠুর এক সাম্যবাদী খেলার উন্মত্ততা বঙ্গবন্ধুর মধ্যে কিছুটা ভাবান্তর ঘটাল। তিনি বুঝলেন তাঁর লুটপাটকারী বুর্জোয়া নেতা-কর্ম্মীরা, দুরাচারী আমলারা, আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী মহলের দালাল/এজেণ্টরা এদেশের মেহনতী মানুষের দোরগোড়ায় কখনো মিছিলের সুফল পৌঁছাতে দিবে না(?)। তিনি এ-ও বুঝলেন, এই পুঁজিবাদী গোলকধাঁধার গণতন্ত্রও প্রকৃতপক্ষে কখনোই জনগণের হাতে ক্ষমতা যেতে দেবে না এবং এই বহুরূপী বহুদলীয় গণতন্ত্র দিয়ে তা কখনো সম্ভবও নয়(?)। তাই তিনি ডাক দিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের। দেশের মেহনতী মানুষকে প্রকৃত মুক্তির স্বাদ আস্বাদন করাতে বঙ্গবন্ধু শেষ পর্য্যন্ত হাঁটলেন শ্রেনিরাজনীতির পথে/শ্রেণিশাসনের পথে। চায়না সমাজতন্ত্র নয়, রুশ সমাজতন্ত্রও নয় তিনি প্রবর্ত্তন করলেন সমাজতন্ত্রের ভিন্ন এক রূপ— বাকশাল— বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ— বঙ্গীয় সমাজতন্ত্র(?)।

এবার বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা আরো বেশী তৎপর হয়ে ওঠল বঙ্গবন্ধুর এই গৌরবময় দুঃসাহসিক পদযাত্রাকে রোধ করার জন্য। যে কোন মূল্যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ী প্রমাণ করতে হবে। এবং মুজিবের যে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও জন সমর্থন তা খর্ব্ব করতে হবে। নিজ দলের অনেক লোভী স্বার্থন্বেষী নেতা-কর্ম্মী পরিণত হয় দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের দালাল/এজেণ্টে। রাজনীতির নামে লুটপাট করতে আসা ধনীর দুলালরা/বুর্জোয়ারা ধীরে ধীরে যে যা পারে তা নিয়ে কেটে পড়তে থাকে। এদিকে কৌশলে বন্ধ করা হয় বিদেশের নানা সহায়তা। টনকে টনকে খাদ্যদ্রব্যও অন্যান্য দ্রব্য জলে ফেলে, আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয়।

এভাবে তৈরী হয় ভয়াবহ এক কৃত্রিম সঙ্কট(?)।

বাঙলার অবিসংবাদিত নেতার ওপর লক্ষ-কোটী মেহনতী মানুষের আস্থা ও আনুগত্য টলমলে হয়ে ওঠে(?)।

১৯৭৫ সালে ১৫ই আগষ্ট কিছু বিপথগামী সেনার হাতে নির্ম্মম নিদারুণ ভাবে খুন হন বঙ্গবন্ধু। শুধু কি বঙ্গবন্ধু নিহত হন ওই দিন? নিহত হয় ঘাসফুলটার মন, বাঙলার কৃষক শ্রমিক মেহনতী মানুষের হাজার বছরের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ। তখন রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ করল একের পর এক বিশ্বাসঘাতক(?)। দেশ চলে গেল লোভী বেনিয়া, ধর্ম্মব্যাবসায়ী, বুর্জোয়া দালালদের হাতে। আর দেশ চলতে থাকে তাদেরই স্বার্থে।এভাবে চুরি গেল মিছিলের সুফল প্রতারিত হল দেশের মেহনতী মানুষ।

এখানে— বাঁকে বাঁকে ঢেউপ্রিয়তায় জেগে ওঠা রেসকোর্স ময়দান, সুরেলা ভাষণ বলতে রেসকোর্স ময়দান কেন্দ্রিক স্বাধীনতাপূর্ব্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা সমাবেশকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে। অথবা ৭ই মার্চ্চের ঐতিহাসিক উত্তাল সমাবেশ ও বঙ্গবন্ধুর সেই বিস্ময়কর জাদুকরী ভাষণকে বোঝানো হচ্ছে। ঢেউপ্রিয়তায় জেগে ওঠা বলতে কি এখানে বাঙলার মানুষের স্বভাবদ্রোহকে বোঝানো হচ্ছে? তবে কি বঙ্গবন্ধুর জাদুকরী সে সুরেলা ভাষণ ‘বুলঘকপুরী’ বাঙালীর স্বভাবদ্রোহকে জাগিয়ে দিয়েছিল নদীর বানের মত।

যারই গুঞ্জনে বয়ে যেত হাঁটু জল নদী, সমবেত সুরে,
পাখীর কাকলিমুখর মেঠো সুরে ওঠা বন্ধুয়ার গান,
বঙ্গের বাতাস
পাল তোলা নৌকা, বৈঠার ঘায়ে ঘায়ে জেগে ওঠা হাঁটুজল নদী

এখানে বাঙলার ভূ-প্রকৃতি, বাঙালীর রাজনৈতিক দ্রোহী স্বভাব, সংগীত প্রেম, বঙ্গবন্ধুর সুরেলা ভাষণ, নদীমাতৃক বাঙলার জনপ্রিয় বাহন, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক, সর্ব্বোপরি বাঙলার রাজনৈতিক জাগরণকে অবলম্বন করা হয়েছে সুক্ষ অলঙ্কারিক কৌশলে।

বৈঠার ঘায়ে ঘায়ে জেগে ওঠা হাঁটুজল নদী

… এখানে নৌকার চলাচলে নদীপ্রবাহ বজায় থাকার ব্যাপারটা যেমন চিত্রায়িত, তেমনি ইঙ্গিত করে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতায় বাঙলার জনসমুদ্রে রাজনৈতিক জাগরণের ব্যাপারটা।

বাংলাদেশ সেই কবে মারা গেছে, ৭৫-এ
আজও বাঁশীর সুরে কেঁদে ওঠে বিজয়ার কান্না
জানে আলাওল, ভনে চন্ডিদাস—
সখা, বৃথা যায় প্রেম রজকিনী বাঙলায়, ভুসুকু পায় না
শবরী বালিকার মন …

বাঙলার যে রাজনৈতিক রাখাল এজনপদের কৃষক শ্রমিক মেহনতী জনতার হাজার বছরের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আশা-আকাক্সক্ষার দুর্গ হয়ে উঠেছিল। যাঁর অঙ্গুরীয় বাণী বাঙলার সর্ব্বস্তরের মানুষকে সংঘটিত করেছিল এবং জুলুমবাজ কুচক্রী পাকিস্তানীদের পরাস্ত করার সাহস যুগিয়েছিল, তিনি নির্ম্মম নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন ৭৫-এ। আর তারই সাথে জন-আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ হয়ে যায় পুনর্পাকিস্তান(?)।

বঙ্গবন্ধু খুন হলেন— যাঁর আহবানে একদিন দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ মুক্তির সাধনায় মৃত্যুকে বরণ করতে নেমেছিল, তিনি নিহত, এত বড় একটা জঘন্য হত্যাকা-, তবুও কেউ রাজপথে নামল না, মিছিল হল না। জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব বলে বলে যারা একদিন পুরা একটা সামরিক সরকারকে দিশেহারা করে ফেলেছিল তারা কী করে আজ কিছু দিগভ্রান্ত সৈনিকের বন্দুকের কাছে নত হয়ে গেল? কোন মিছিল নাই, স্লোগান নাই; কেউ কাঁদলও না সশব্দে। বিজয়ার বিসর্জনের কানানার মত শুধু বাঁশীতে সুর বাজল— জোয়ার-ভাটির বাঙলায় এ যেন হাজার হাজার বছরের অব্যাক্ত বিচ্ছেদ বেদনা— প্রিয় প্রতিমার বিসর্জন, প্রিয় নেতার বিসর্জন!

অনেকেই নাকি এঅঞ্চলের অধিবাসীদের দুঃখবাদী ভাবুক বলে চিহ্নিত করেন। এখানকার সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্য্যাপদে যেমন সামাজিক অর্থনৈতিক দুঃখ দুর্দ্দশা অভাব অনটনের চিত্র আছে, তেমনি মধ্যযুগের সাহিত্যগ্রন্থে আছে মানবিক প্রেমের অসহায়ত্বের বর্ণনা(?)। এভাবে বাঙলা সাহিত্যও যেন হয়ে ওঠেছিল দুঃখবাদী।

সত্যিই কি এখানকার মানুষ দুঃখবাদী? এই ঘন ঘন ঋতু পরিবর্ত্তনের জনপদে কোন কিছুই যেন স্থায়ী হয় না; পূর্ণতা পায় না হাজার বছর ধরে কি প্রেম, কি রাজনীতি, কি অর্থনীতি সবক্ষেত্রে যেন বিরাজ করছে অনাকাক্সিক্ষত বিচ্ছেদ, সীমাহীন বঞ্চনা, নিদারুণ দৈন্যতা। তাই দস্যুকবলিত সমাজ-রাজনৈতিক পরিবেশে আলাওলের ব্যাক্তিজীবনের দুর্দ্দশা ভোগ, বিচ্ছেদ বেদনায় দীর্ণ অনন্ত প্রেমপিয়াসী কবি চন্ডিদাসের হাহাকার, শবরী বালিকার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ চর্য্যার কবির সিদ্ধি লাভের ব্যার্থতা সবকিছু যেন একাকার হয়ে গেছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সাথে …

 


দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপী গাইন, বাঘা বাইন…

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{রোদনের পদাবলী : বঙ্গবন্ধু হত্যা ও বাংলা-বাঙালীর রাজনৈতিক হাহাকার [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার