রেহানা মরিয়ম নূর : একজন দর্শকের চোখে লেখা || মাইনুর নাহার

0

রেহানা মরিয়ম নূর দেখলাম, এই প্রথম বাংলাদেশের কোন সিনেমা দেখে সিনেমা সিনেমা লেগেছে— সিনেমা দেখছি মনে হয়েছে। সেক্স আর ভায়োলেন্স, উদ্ভট সাজপোষাক, অপ্রয়োজনীয় চিৎকার, অকথ্য ভাষায় গালাগালি এইসব বাদ দিয়েও শুধুমাত্র একটা টপিকে ফোকাস করে একটা চরিত্রকে প্রধান করে তার চারপাশের বাস্তবতা, সমাজ, রাজনীতি কতটা দূরদর্শিতা নিয়ে উপস্থাপন করা যায় সেটা এই সিনেমা দেখিয়ে দিয়েছে। সিনেমা নামে আমরা অনেক সময় বড় পর্দ্দায় নাটক দেখি। সিনেমার নামে অনেক সময় আধো-অন্ধকার ফ্রেমে বন্দী সেক্স, ভায়োলেন্সের চিত্রায়ণ দেখি জীবন ঘনিষ্ঠতার তকমায়। এইসব আধা সিনেমা, কমার্শিয়াল সিনেমা দেখতে দেখতে আমরা এতই অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছি যে আমরা ভুলেই গিয়েছি সেক্স বা ভায়োলেন্স না দেখিয়েও, নায়িকার বৃষ্টিভেজা শরীরের বাঁক, নকরামি, ধর্ষণের দৃশ্য, ভিলেনের বিকৃত হাসি চিত্রায়িত না করেও একটা সিনেমা তৈরি করা যায়। এই সিনেমা দেখিয়ে দিয়েছে জীবন ঘনিষ্ঠতা মানে বেডরুমের রোমান্টিকতা বা সেক্স না। সিনেমা দেখার আগেই অনেক রিভিউ, ব্যক্তিগত সমালোচনা পড়া হয়ে গিয়েছিল তাই সিনেমাটা দেখতে যাওয়ার সময় মনেমনে সেইসব রিভিউ, সমালোচনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম। যাতে ফাঁকা মন নিয়ে দেখতে পারি। তবুও মাঝেমধ্যে কোন দৃশ্যে বা ঘটনায় মনে উঁকি দিয়েছিল কোন কোন মন্তব্য। যেহেতু আমি সিনেমা রিভিউয়ার না তাই সাধারণ দর্শক হিসেবে নিজের ভালো লাগা প্রকাশ করছি। সিনেমায় চরিত্রের পেছনে পেছনে ক্যামেরার ফলো করা, চরিত্রের সাথে সাথে ক্যামেরাও হাঁটা এই কনসেপ্ট আমার কাছে আধুনিক মনে হয়েছে। শুধুমাত্র দুয়েকটা জায়গায় মনে হয়েছে ক্যামেরার স্থিরতা থাকলে ভালো হত। প্রতিটা চরিত্রের অভিনয় ছিল পরিমাপ মত। সিনেমার শেষ দৃশ্য দেখে প্রথমে মনে হতে পারে যুক্তিহীন এই কঠিন, রূঢ় আচরণ। প্রিয় সন্তানের সাথে এমন আচরণ কিভাবে সম্ভব! সম্ভব— কারণ এমন সামাজিক, পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে মানসিকভাবে বিপর্য্যস্ত একজন মানুষ শেষপর্যন্ত একজন মানুষই; অতিমানব কেউ নন। এইযে অতিমানব বা অতিমানবিক কিছু দেখায়নি এটাও একটা নতুন সংযোজন সিনেমায়। কাহিনীর মনঃস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, ক্লাইমেক্স দেখানোর জন্য ব্যাকগ্রাউণ্ড মিউজিক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

রেহানা মরিয়ম নূরে অভিনিত চরিত্রের অঙ্গভঙ্গী, শ্বাসপ্রশ্বাস, হাঁটা-চলার ভঙ্গী, চোখের চাহনী, দরজা বন্ধ করার আওয়াজ, ঘড়ীর কাঁটার টিকটিক শব্দ থেকে পানীর কল ছাড়া, কল থেকে পানী পড়ার আওয়াজ আবার কল বন্ধ করার শব্দ এইসব বাস্তব শব্দের মাধ্যমে প্রতিটী ক্লাইমেক্সকে একদম স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কোন সংগীত সংযোজন ছাড়াই কোন্ সিচুয়েশনে কী ঘটছে তার প্রতিক্রিয়ায় চরিত্রের মনঃস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন কোন কিছু বুঝতে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি দর্শক হিসেবে। আলোর ব্যাবহারও ছিল গুরুত্বপূর্ণ, পুরা ছবিতে নীল রঙের প্রাধান্য। যেন নীল দংশনে রেহানা নয় দর্শকও পুড়তে থাকবে। পুরা ছবিতে রেহানাকে দেখানো হয়েছে সিঙ্গেল মাদার হিসেবে। জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত, ছোট মেয়েকে নিয়ে বাবা-মা, ভাইয়ের সাথে থাকেন। স্বভাবে কঠিন, চাহনী রুক্ষ যেন সারাক্ষণ রেগে আছে। এই সিনেমায় কয়েকটা জায়গায় দর্শক হিসেবে আমাকে অন্য রকম অনুভূতি দিয়েছে, কর্ম্মক্ষেত্রের ব্যস্ততার মাঝেও নিজের আত্মজার জন্য গভীর চিন্তা ছুটির পরে স্কুলে সে একা থাকছে কিনা, কার সাথে আসবে এইসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা। বারবার ফোন করে খবর নেওয়া, কখনো কখনো বাধ্য হয়ে সন্তানকে অফিসে নিয়ে আসা এ তো প্রতিটা কর্ম্মজীবী মায়ের গল্প। আবার ছাত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, ছাত্রীকে সাহস যোগানো, প্রতিবাদ করতে উৎসাহী করা এবং বাস্তবতার কথা চিন্তা করে যখন ছাত্রী কোন প্রতিবাদ করতে আগ্রহী হয় না তখন রেহানা নিজেই ভিকটিম সেজে প্রতিবাদ করে, যা নির্যাতিত নারীদের প্রতিবাদ করতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। শেষের দিকে এসে রেহানার নার্ভাস ব্রেকডাউন ভবিতব্যই ছিল। অনেক জায়গায় এই সিনেমা আমাদের তথাকথিত সমাজকে নগ্ন ভাবে উপস্থাপন করেছে, মুখোমুখি করেছে কিছু প্রশ্নেরও। আবার আশা জাগিয়েছে সিনেমা জগতে নতুন সম্ভাবনার। মেক-আপ-হীন মুখ সাথে মানানসই পোষাক আর হসপিটালের চারদেয়ালে কাহিনীর প্রধান চরিত্র রেহানার পারিবারিক, সামাজিক, মনঃস্তাত্ত্বিক লড়াই অসাধারণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অভিনেত্রী বাঁধন। চলচ্চিত্রের এ এক নতুন যাত্রা।

ধন্যবাদ পরিচালক সাদ এবং তার টিমকে।

 

 


মাইনুর নাহার
কবী ও গদ্যকার। পেশা : শিক্ষকতা। জন্মস্থান : চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
আলোকচিত্র : ইণ্টারনেট থেকে

{রেহানা মরিয়ম নূর : একজন দর্শকের চোখে লেখা || মাইনুর নাহার [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার