বেদ, বেদব্যাস, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, বেদে বা জিপসী || হারুনুর রশিদ রাজা

0


বেদ : যাহা দ্বারা দিশাগ্রস্থভাবে বিদিত বা জ্ঞাত হওয়া যায়। আদি মানব যখন প্রকৃতি থেকে লব্ধ জ্ঞানগুলোকে সীমায়িত করে মন্ত্রে রূপ দেয় তখনই সে সর্ব্বপ্রথম প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কৃত্রিমতা বা দিশাগ্রস্থতায় পতিত হয়, যা আজও সমানতালে বিরাজমান। আর এটাই ছিল তৎকালীন আদি সনাতন শৈবিক যৌথতাভিত্তিক ব্যাবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার বা আদি মানবের বিভক্ত হওয়ার সর্ব্বপ্রথম ধাপ যা পরে বৈদিক ব্যাবস্থার সৃষ্টি করে।

সে যাই হোক। এই প্রকৃতি থেকে লব্ধ কৃত্রিম জ্ঞান মানুষ সর্ব্বপ্রথম চারটা ভাগে বিভক্ত করে চারটা বেদ বা জ্ঞানগ্রন্থে বিন্যস্ত করে। মানবসভ্যতার প্রথম এই চারটা বেদ বা জ্ঞানগ্রন্থ হল : ঋগ্বেদ, যজুর্ব্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ! এই বেদ বা সনাতন মানবের ভাষায় “কৃত্রিম জ্ঞানমন্ত্র” তৈরী একদিনে বা এক প্রজন্মে হয়নি, সেটা হয়েছে কয়েক হাজার বছরের পরম্পরায়।

বলা হয়ে থাকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বেদকে এই এই চারভাগে বিভক্ত করেন!

এখন দেখা যাক কে এই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস! ইনি বশিষ্ঠের প্রপৌত্র, শক্তির প্রৌত্র, পরাশরের পুত্র এবং এঁর মাতা মৎসগন্ধা!

ওপরে যে নামগুলো বলা হল এগুলো একটাও কোন ব্যাক্তিবিশেষের নাম নয়, এগুলো হল বিভিন্ন সামাজিক সত্তার রূপকী বা প্রতীকী নাম।

আরো বলা হচ্ছে যে বেদব্যাস হল চিরঞ্জীব সত্তা, তার মানে এই সত্তা সমাজে সবসময় বিরাজমান!

আরো গভীরে না গিয়ে বলা যায় যে বেদব্যাস হল সেকালের এ্যাকাডেমিক ও বুদ্ধিজীবী সংগঠনের নাম। কোন বৃত্তের বা চক্রের ব্যাস হল তাকে নিয়ন্ত্রণকারী একটা রেখা। তাই বেদব্যাস হল জ্ঞান(বেদ)জীবীদের সংগঠন (ব্যাস)! এমনতর সংগঠনের সদস্যদের টাইটেল পরবর্ত্তীতে “ব্যাস” হয়েছিল যা এখনও অনেক মানুষের নামের শেষে আছে।

আশা করি আপনাদের এখন বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস একক কোন ব্যাক্তির নাম নয়।

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস হল আদি সনাতন শৈবিক যৌথতাভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থার বিরোধী বৈদিক তথা ব্যাক্তিসম্পত্তির সপক্ষের ব্রাহ্মণদের সংগঠন। তাই, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস সংগঠনের মা বা উৎস হল মৎসগন্ধা বা আমিত্বের বা ব্যাক্তিসম্পতের (ব্যাক্তিসম্পদের) গন্ধযুক্ত জনগণের অংশটী।

এটা হল এখনকার সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধনতান্ত্রিক ব্যাবস্থার যে বিরোধ তার আদি রূপ। অর্থাৎ তখনকার শৈবিক যৌথতাভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থার সপক্ষের ব্রাহ্মণগোষ্টির সাথে তখনকার বৈদিক ব্যাক্তিসম্পতের (ব্যাক্তিসম্পদের) সপক্ষের ব্রাহ্মণদের মতভেদের যে লড়াই চলছিল তার ফলে সনাতন শৈবিক ব্যাবস্থা ভেঙ্গে অবশেষে বৈদিক ব্যাবস্থার সৃষ্টি হওয়ার ইতিহাসের অংশ বিশেষ।

তবে এই লড়াই অনেক কাল অবধি চলেছিল এবং প্রাথমিকদিকে বেদবাদী বা সনাতন-বিরোধী ব্রাহ্মণরা অনেকবারই হেরেছিল এবং সনাতন সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল। তেমনই এক বিতাড়িত অংশের নাম “বেদে” যারা যৌথসমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে স্বদেশে বেদে হিসাবে এবং ভারতবর্ষের বাইরে জিপসী হিসাবে পরিচিত।

তবে যখন বৈদিক ব্রাহ্মণরা শেষমেশ লড়াইয়ে জিতে যায় তখন তারা যৌথতাবাদী শিবপন্থীদেরও সমাজচ্যুত করেছিল এবং কঠোর বৈদিক ব্যাবস্থার সৃষ্টি করেছিল। তাই তো শিববাদীদের কোন পুজা হত না এবং শিববাদী ব্রাহ্মণরা শ্মশানে ছাইমেখে ন্যাংটাবাবা হয় ঘুরে বেড়াত এবং এখনও ঘুরে বেড়ায় (কুম্ভমেলা)!

মনে করা হয় যে মহেঞ্জোদারো সভ্যতার (মহানদের প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা) সৃষ্টি হয়েছিল এই আদি সমাজতান্ত্রিক যৌথতাবাদী তথা শিববাদী ব্রাহ্মণদের দ্বারা। পরবর্ত্তীতে বেদবাদী ব্রাহ্মণরা এই সভ্যতা ধ্বংস করে এবং বৈদিক সভ্যতার সৃষ্টি করে।

পাদটীকা ১ :
কৃষ্ণবর্ণহেতু ইঁনি কৃষ্ণ এবং যমুনামধ্যস্থ দ্বীপ ইঁহার ন্যাসস্থান হেতু ইঁনি দ্বৈপায়ন। অর্থাৎ কৃষ্ণ বা কালো বা অন্ধকারে লুক্কায়িত [তৎকালীন সনাতন সমাজে ব্যাক্তিগত সম্পৎ (সম্পদ) নিষিদ্ধ ছিল] সম্পৎ (সম্পদ) ধারা দিয়ে গঠিত দ্বীপ বা সম্পৎরাশির (সম্পদরাশির) বাহক সত্তার প্রবক্তা বা প্রতিনিধি হল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন!

পাদটীকা ২ :
বৈদিক ব্যাবস্থায়ও কিন্তু কিছুটা যৌথতা ছিল এবং পণ্য বা বিক্রয়ের জন্য উৎপাদন নিষিদ্ধ ছিল বা পাপ বলে গণ্য হত। কিন্তু পরবর্ত্তীতে গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরা পণ্যবাদীতা অর্থাৎ আরো বেশী ধনতান্ত্রিক ব্যাবস্থার সৃষ্টি করে। শঙ্করাচার্য্য সেই বুদ্ধের পণ্যবাদী ব্যাবস্থা ভেঙ্গে আবার বৈদিক সেমি-সমাজতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যেটা আর সম্ভব হয়নি।

পাদটীকা ৩ :
পরাশর ও মৎসগন্ধা শব্দের অর্থ জানতে পারলে অনেকটা বুঝতে পারবেন তাদের “সন্তান” কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে। এখানে মৎস অর্থ সংক্ষেপে বলি : মৎ মানে আমি/আমার, মৎস মানে আমার অংশ। সনাতন শৈবিক যৌথতাভিত্তিক সমাজ ব্যাবস্থায় আমার বলে কোন কিছু ছিল না। সব কিছু ছিল যৌথসমাজের সম্পৎ (সম্পদ), অনেকটা একালের সমাজতান্ত্রিক যৌথ উৎপাদন ব্যাবস্থার মত। আমার আমার করত যারা তারা সমাজের চোখে নিকৃষ্ট গন্ধযুক্ত ছিল। সেই ধরণের জনগণের অংশটাকে মৎসগন্ধা বলা হত। মাংস শব্দের অর্থও মৎস শব্দের মত। আমার আমার বলা বা ব্যাক্তিগত সম্পৎ (সম্পদ) করা পাপ বলে গণ্য হত। তাই, অতীতহারা, অতীত না বুঝতে পারা অনেক মানুষ এখন বাহ্যিক মৎস ও মাংস খাওয়াকে পাপ মনে করে। নিজের অতীত ইতিহাস চূড়ান্তভাবে ভুলে গেলে যা হয়। তেমনি কিছু মানুষ পদ-অর্থ না বুঝে পা ধোয়া জল খায়!!!

তথ্যসূত্র : কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী প্রণীত বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

 

 

 


হারুনুর রশিদ রাজা
জন্মস্থান—
রংপুর, বাংলাদেশ।
বসবাস—
মন্ট্রিয়ল শহরে।
নিউরোসাইণ্টিষ্ট, ফার্মাসিষ্ট। মূখ্য বিজ্ঞানী, বায়োটেক কোম্পানী, কানাডা।

অলঙ্করণ : হিম ঋতব্রত
প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{বেদ, বেদব্যাস, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, বেদে বা জিপসী || হারুনুর রশিদ রাজা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার