সভ্যতার শুরুতে || ঈশান বড়ুয়া

0


লোকটা ঠিক সন্ধ্যা ছয়টা তিন মিনিটে চিৎকার দিয়ে ওঠল, আমার টাকা কেন দিবি না! চারপাশে এমনিতেই গাড়ী ছিল না, তবুও যেন ঠিক সন্ধ্যাটা একটা নিঃস্তব্ধতায় আটকে গেল। টক স্বাদের সন্ধ্যা। মাগীর পুত টাকা দে মাগীর পুত, লোকটার চিৎকারে আবার নিঃস্তব্ধতা ভাঙল! সবাই ফিরে তাকায় তার দিকে। এককাঁধে ভারী ব্যাগ, অন্যহাতে শপিঙের থলে নেওয়া লোকটা হাঁটতে হাঁটতে চারপাশের পরিস্থিতিতে আবার হৃদয় মোচড়ানো পুড়তে থাকা ক্যামিকেলের কড়া বাতাস ঢুকিয়ে দেয়। কি ভয় নগরের! এই ক্রোধের মুখে দাঁড়াবে সাধ্য কার! পাহাড় টলে যাবে এমন শক্তি ওই চিৎকারে। প্রকৃতি তার কাকদের চুপ করিয়ে দিয়েছে। এই নিষ্ঠুর পিঠ ঠেকে যাওয়া পৌঢ় ব্যক্তিটা দখল করে নিল নগরের শত বছরের প্রাচীন বুক! কত ওজন হতে পারে? চিৎকার করতে করতে লোকটা হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ নগরের মানুষগুলো চিৎকার করে ওঠে, তাদের ব্যর্থতা ঢাকতে, “ওই পাগল … ভুয়ো …, ওই পাগল … ভুয়ো …।” নগরের প্রতিটি কোণ একমুহূর্ত্তের মধ্যে নিজের স্বাভাবিক চেহারায় ফেরত চলে এল। লোকটাও যেন নিজেকে পাগল না প্রমাণ করতে জোরে জোরে হাঁটা দেয়। দ্রুত পদক্ষেপে মিশে যায় শহরের ক্যামোফ্লেজে!

সভ্যতা তখন পার করলো পাঁচলাইশ মোড়। হঠাৎ কেউ পাথর তুলে দিয়েছে বুকে, এমনটা লাগছে! কি নিঃস্ব ওই চিৎকার! তার বুক নাড়িয়ে ভেঙে দিল সন্ধ্যাটা। সভ্যতার পকেটে খুব অল্প টাকা। এই দুঃসময়ে এই সন্ধ্যাটা, কাল কালি লেপটে দিল সুন্দর নীল ক্যানভাসে! আকাশ কি কেউ চুরি করেছিল কখনও? এত একটুকরো মিঠাই। বিক্রি হবে প্রতিটি কোণায়! অক্ষমতা পরিণত হচ্ছে চিন্তায়। সভ্যতার সামনে এসে দাঁড়ায় অরূপ আর স্বরূপ। দুইজনের নাম মিল থাকলে, তারা বন্ধু হলেও, তারা দুইজন দুইমেরুর লোক।

“এক ফুলের মর্ম্ম জানতে হয়”

অরূপ গান গাইতে গাইতে হাঁটে। স্বরূপ সভ্যতাকে বলে, দাদা! একটা কথা কিন্তু সত্যি। এই যে দুনিয়াতে এত্ত সুন্দর, আমরা কতটা দেখি! মাথাব্যথা করে দাদা! সভ্যতা বলে, ওই যে সাঁইজির কালাম গাইছে। মর্ম্ম জানতে হয়! স্বরূপ বলে, তবে এই মিথ্যাচার কেন?

সভ্যতা মিথ্যাচার করে তার নিজের ঘরকে স্বর্গ বানিয়ে বসে আছে। লোকে ভাবে স্বর্গ। কিন্তু সভ্যতা জানে, এই ঘরটা পৃথিবীর বাইরের ঘর! একটা একলা দ্বীপ, যেইখানে সী-গালরা বিশ্রাম নিতে আসে। আবার উড়ে চলে যায়। এইখানে একমাত্র বাসিন্দা সভ্যতা। জালে আটকা পরা মাছদের নিয়ে খেলা করে সে, এটাই তার সময় কাটানোর পথ। অনুচ্চারিত হাজার শব্দ দিয়ে সে জাল বোনে মাছেদের জন্য। বোকা মাছেরা! এরাও একেকটী দ্বীপ ফেরত সেতু। বাইরের পৃথিবীর সাথে একমাত্র যোগাযোগ সভ্যতার।

অরূপ গান থামিয়ে বলে, দাদা ওই লোকটা কে জান? ওকে আমি চিনি। রুহিতের বাবা। মাত্র করোনার আগে ছোট ব্যবসাটা শুরু করেছিল। অল্প কিছু পুঁজি নিয়ে। রুহিতের ইউনিভার্সিটীর ভর্ত্তির টাকা দিয়ে শুরু করেছিল। করোনাতে খুব মার খেয়েছিল ব্যবসায়। বেচারা! রুহিতের এখন চাকরী করে বাসায় সাপোর্ট দিতে হয়, জান! তাই রুহিতকে দেখা যায় না।

সভ্যতা গান ধরে, “আমারে বন্ধুয়ার মনে নাই!”

গানটা আটকে যাচ্ছে। রুহিতের বাবা কি চন্দ্রবিন্দুর গানের ওই লাইনটা? কষ্ট সামলে কেষ্ট!

সভ্যতা, অরূপ আর স্বরূপ কালী বাড়ীতে ঢুকে পরে। ওই তো রুহিতের বাবা! মা কালীর কাছে কী চাইছেন তিনি? উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন কেন অমন করে! মরে যাননি তো! উনি দুলছেন! পুরা শরীর দুলছে। হঠাৎ মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেন তিনি। না, কাঁদছেন না তো! চোখে তো পানি নেই! মন্দিরের কোণায় রাখা হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে বসেন এইবার। একটা একটা রীড চেপে দেখছেন। বসে গেছে একটু সাউন্ডটা! অসুবিধে নেই তাতে। কীর্ত্তন করতে এর থেকে বেশী কী দরকার! রুহিতের বাবা জানেন এমন এক আনন্দের খবর, যা এই মন্দিরের কোনো মানুষ জানেন না!

স্বরূপ হঠাৎ কানে কানে বলে, দাদা রুহিত আসছে। এবার দেখ মজা। বাপ বেটায় ঝড় তুলবে গানের। সভ্যতা হাসে। রুহিত জানে না কিছুক্ষণ আগে তার বাবা কিভাবে চিৎকার করে সন্ধ্যাটাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এই নগরের প্রত্যেকটা নিষ্ঠুর মানুষদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়ে, থামিয়ে দিতে পেরেছিল নগরের হৃৎস্পন্দন! রুহিতকে দেখে অরূপ আর স্বরূপ একটু সরে বসে। তাদের আর গাইতে ইচ্ছে করছে না। তারা কি ক্লান্ত? সভ্যতা যেমন ক্লান্ত, তার বুকের ব্যথা নিয়ে! কিসের ব্যথা এত! সভ্যতা একটা ফিনিক্স পাখী। বারবার জ্বালালেই সে আবার উঠে আসে ছাই থেকে। নতুনভাবে শুরু করে সময়কে!

রুহিত আর রুহিতের বাবা শুরু করেছেন গাওয়া!

“পরজনমে আমারই মত রাধা হইয়ো তুমি প্রিয়া”

রুহিত জানে কি ভয়ংকর আবেগে এই গান গায় তার বাবা। রুহিত যখন মাত্র ছয় বছর, তখন তার মা চলে যায়। বাবা জানেন শুধু, মায়ের যন্ত্রণার সময়গুলোকে। রুহিত জিজ্ঞাসা করলেও তার বাবা শুধু বলেন, খুব কষ্ট পাইসিল রে। আর কিছু বলেন না। রুহিত আর চাপাচাপি করে না। মা-হারা এই সংসারে তারা দুইজন আলাদা আলাদা হয়ে গেছে। মা থাকলে কখনই এমন হত না। বাবাকে আজ অন্যরকম লাগছে! মুখে কিসের আলো ওই কাল মানুষটার!

“বলে না ছিলেম গো পেয়ারী, পিরীতি করিস না!”

আজ গানগুলো সব বদলে গেছে। এই গান কি রুহিতের জন্য গাইছে তার বাবা! তার বাবা কিভাবে জানেন, রুহিতের মনে কি চলছে! এই তো তিনদিন আগে সে ফুটবল খেলতে গিয়ে পরে গিয়ে হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে ফেলে! বাবা তো জানেই না! শরীরের খবর না জেনে, খোঁজ নেয় মনের! আনন্দ নেমে আসে কালী বাড়ীতে। ঝড় ওঠেছে রুহিতের খোল আর তার বাবার কণ্ঠে। একের পর এক গেয়ে যাচ্ছে কীর্ত্তন। তার বাবা কি অন্য জন্মে বৈষ্ণব ছিল! নয় তো প্রেম আসে কোথা থেকে! রুহিত আর সভ্যতা একই কথা ভাবছে! এই লোকটার জীবন তো সুখের নয়। শুধু হারিয়েছেন আর দুঃশ্চিন্তা বহন করেছেন! তবুও প্রেম আসে কোথা থেকে! সভ্যতা প্রেম পায় না খুঁজে। এতদিন সে জানত সে নিজেই প্রেম। কিন্তু সে তো ঘৃণা!

সভ্যতা একজন ঘৃণা! তবুও সে সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে! কখনও ভেঙে পড়ে না! পড়তে জানে না! সে শুধু জানে ঝড়ের মত এগিয়ে যাওয়া। যাওয়ার পথেই লন্ডভন্ড করতে থাকে যা কিছু পায়! পৃথিবীটা ধ্বংস করায় যেন তার একমাত্র উদ্দেশ্য। বিপরীতে, রুহিতের বাবা তো কিছু না পাওয়ার দলে। তবুও এত আনন্দ পায় কই? সভ্যতার খুব ইচ্ছে করে একবার যেয়ে জিজ্ঞাসা করে, কে টাকা দেয় নাই? নাম ঠিকানা দেন! গলায় ঠ্যাং ঢুকায় দিয়ে টাকা বাইর করুম। সভ্যতার গলা আটকে গেছে! রুহিতের বাবার চিৎকারটা তার গলা চেপে ধরেছে! হায় রে সভ্যতা, কত ওজন হলে তুই আটকে যাস অচেনা মানুষের কাছে? সভ্যতা উঠে হাঁটতে শুরু করে।

রুহিতের বাবা গান থামান রাত এগারোটায়। বাপ বেটায় হাঁটছে রাস্তা দিয়ে। রুহিতের বাবা হঠাৎ রুহিতকে জিজ্ঞাসা করে, মাকে মনে পড়ে?

রুহিত, খুব ঝাপসা হয়ে গেসে বাবা। খালি মনে পড়ে পুঁথীর লক্ষ্মীর মত কেউ একজন হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে! মা ওইরকম ছিল না?

রুহিতের বাবা, হ্যাঁ, মনে আছে দেখছি তোর। তোর মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রুহিত। ছবিটাতে দাগ পড়েছে। কি কতগুলা ঘুমের ঔষুধ দিল ডাক্তার। স্বপ্নেও দেখি না তাকে!

রুহিত অবাক হয়! তার বাবা তো এমন না! রুহিত বলে, নিউমার্কেটে একটা দোকান আছে। পুরান ছবিতে দাগ পরলেও ওরা ঠিক করে দিতে পারে। নতুন করে প্রিন্ট করে দেয় আবার। মায়ের ছবিটা কালকে ঠিক করে এনে দেব।

রুহিতের বাবা খুশি হয়ে যায়। বলে, আরে এটা তো খুব মজা! আচ্ছা, বাজার তো নাই। দুইটা ডিম নে। আজকে ডিমের ঝোল দিয়ে ভাত খাব। রুহিত মাথা নাড়ে।

এক হাঁড়ী ভাত, দুটা সিদ্ধ ডিম দিয়ে আলুর টলটইল্যা ঝোল, এতটুকুই! কি আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে বাবা! আজকে কি টাকা পেল বাবা? টাকা খুঁজবে সে? কিছু টাকা দরকার রুহিতের। সিগারেটের দোকানে কয়েকশ টাকা বাকী পড়েছে। ওইদিকে আবার একজন থেকে তিনশ টাকা ধার নিয়েছিল। শোধ করতে পারছে না। এক হাজার টাকা হলেই হয়ে যাবে রুহিতের। কিন্তু কেমন যেন লাগছে বাবাকে। চাইতে গিয়ে মুখে আটকে যাচ্ছে। বাবাও ধারকর্জ্জের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। রুহিত যা ইনকাম করে, তা মোটেই বেশী না। না, কাল পরশু চাওয়া যাবে।

রাত বাড়ছে নগরে। করোনার মহামারীতে আরো চুপ হয়ে গেছে নগর। এত শব্দহীনতায় নগরের মানুষ অভ্যস্ত না! তাদের বুক চেপে ধরেছে এই ‘শব্দ-নাই’ পরিস্থিতি। এরমধ্যেই রুহিতের বাবা বুক চেপে ধরে! রুহিত উঠে বসে। বাবা! বাবা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে রুহিতের দিকে। রুহিত বুঝছেনা কী করবে, কোথায় যাবে! হঠাৎ মোবাইল বের করে কল দেয় জ্যাঠাকে। জ্যাঠা ধরতে ধরতেই তড়পড়ানি থেমে যায় রুহিতের বাবার! রুহিত চিৎকার করে ওঠে, কেঁদে ওঠে। শুধু জ্যাঠা এখনও মোবাইলে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে। “কি হয়্যি, ওডো … ন মাতর কা, ওডো, কী হয়্যি …”

ঠিক ওই সময়টাতে সভ্যতা লুকোচুরি খেলছে খোদার সাথে! গলায় দড়ী নাকি ছাদ থেকে লাফ! কল আসতেই লাফ দিয়ে উঠে বসে। স্বরূপ কল দিয়েছে! এত রাতে!

স্বরূপ, “দাদা, রুহিতের বাবা আর নাই। অরূপ তোমাকে নিতে যাচ্ছে। আমি মেডিকেল আছি। কিছু টাকা আনিও পারলে। লাশ পোড়াতে টাকা লাগবে।”

 

 

 


ঈশান বড়ুয়া
জন্ম— সেপ্টেম্বর, ১৬, ১৯৯২। নিবাস— রাউজান, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ।
সম্পাদক : নাগরিক পদাবলী (ছোট কাগজ)।

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির
অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{সভ্যতার শুরুতে || ঈশান বড়ুয়া [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে যথাসম্ভবভাবে সম্পাদিত।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার