প্রকাশিতব্য, ‘তমসাপ্রবঞ্চনা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্ব্বাচিত কবিতা (দ্বিতীয়পর্ব্ব) || তানভীর আকন্দ

0

চিত্রকর্ম্ম : অলকানন্দা সেনগুপ্ত

জ্যোৎস্না দর্শন

এলাচের সুঘ্রাণ নিয়ে মাঠে-ইঁদুরের
দেহের মতন আর্দ্র মাটীতে
হেলে পড়ে চাঁদ,
শীর্ণ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে যায়
পরিযায়ী মেঘ,
বাতাসের সেকি আর্ত্ত-করুণ সুরে সুরে
আমাদের অস্থী ও ত্বকে
আঙুল বুলিয়ে যায় স্মৃতি,
কাকে আর ডাকব বল?
বহুদিন আগে মরে গেছে,
শুকনা ঘাসের ওপর ফেলে রেখে গেছে তার
গুনগুন গান- সেইসব একান্ত সেরেনাদ!

তবু বারবার ফিরে আসে চাঁদ- জ্যোৎস্নায়
সঞ্চিত প্রেমের আলিঙ্গনে!
আহা প্রেম,
তুমিও অকারণ শুধু ফিরে ফিরে আস,
কোথাও হারিয়ে গেলে রিক্সার বেল
আমাদের ঠোঁটে রেখে যাও
একটুকু স্পর্শের আকুলতা …

সমর্পণ

স্বপ্ন নয়, স্মৃতি যেন-এ কোন দিব্যজ্ঞানে ইশারা আরেক
তোমার-আহা কী মর্মন্তুদ- দিলে তুমি সে নতুন আজ্ঞা এক।

(কেমনে উপেক্ষা করি আমার শপথ
কেমনে অগ্রাহ্য করি প্রণয় বাঁধন
দু’হাত ওপরে তুলে করি মোনাজাত
এই শোক যেন তুমি কর প্রশমন)

তবু, পরোয়া করি না প্রভু- দাও বল- দৃঢ়তা মনের
যেন আমরাও পারি এই চকচকে কনক্রিট মরুভূমে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিতে পুত্রের লহু আর তার প্রাণ
দেব তোমাকে ইনাম।

এই যান্ত্রিক উটের পিঠে চলেছি আমরা যেন,
আমাদের অশেষ সফর, বয়ে নিয়ে কত শত
বছরের খেদ আর ক্ষুধা,
আমাদের তপ্ত অশ্রুর মত, প্রভু-
কর বর্ষণ তোমার রহমত,
যেন তাতে এই শুষ্ক মাটীর ওপর
সহসা লতিয়ে ওঠে তৃণ, সুপেয় জলের হ্রদ
লোমশ পশুর বিচরণে মুখরিত হয়,
কোলাহলে জেগে ওঠে আমাদের পাপিষ্ট হৃদয়।
পরোয়া করি না প্রভু- দাও বল- দৃঢ়তা মনের
যেন আমরাও পারি এঁকে দিতে
কোমল ত্বকের ওপরে শাণিত ছুরীর চুম্বন।

আমাদের চোখে অগ্নিকুণ্ডের তৃষিত জিবের মতন
লাফ দিয়ে ওঠে চিরায়ত জিঘাংসাসকল,
আর এক অলীক ইশারা যেন
আমাদের দেয় পথের নির্দ্দেশ,
কোথায় সে পবিত্র পাথর? যুগল পাহাড়?
ক্ষুধা ও তৃষ্ণার স্মৃতি!

পরোয়া করি না প্রভু- দাও বল- দৃঢ়তা মনের
পুত্রের শোণিত ধারায় সেইসব কাতর আর্ত্তনাদ
আর আর সব আক্ষেপ যাক মুছে।

(দিকে-দিগন্তে কেবলই সূর্য্যের উত্তাপে
যেমনে ছড়িয়ে পড়ে জলের উদ্ভাব,
তোমার ইশারা তবে পবিত্র আজ্ঞা হয়ে
ঘুচিয়ে আনবে আমাদের আজন্ম অভাব)

প্রভু, এই তো আরজ।

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস

ঘরের দেয়ালে ভেসে আছে ছায়ামূর্ত্তির মত
শত শত লাশ, মৃত্যুর হাতছানি!
হয়ত ঘরের বাইরে- দরজার সামনেই
সাজাচ্ছে কেউ একজোড়া বেয়নেট,
কয়েকটা বুলেট আর ধারালো ছুরীর শুভেচ্ছা!

হে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তোমাদের স্বাগতম,
আসছে জোছনারাতে তোমাদের হাতে
তুলে দেব বলে আমাদের তুচ্ছ জীবন- আরও কিছুদূর
বেঁচে থাকবার আয়োজন করি, আর স্বপ্নে দেখি
হাতুড়ীর আঘাতে আঘাতে করোটীর
বাইশটা হাড়ের মাঝে বেজে ওঠে
নিদারুণ সিম্ফনি, ঘুম ঘুম রিক্যুয়াম।

সরি সারি বুটের শব্দে বিমোহিত হয়ে
কোথা হতে উড়ে আসে ঝাঁকবেঁধে
শাদা শাদা পায়রার দল…

পাগল

পথের পাশে বসে আছে এক পাগল
ছিন্নবস্ত্র গায়ে, উদভ্রান্ত দুই চোখ,
অকথ্য বাক্যবাণে আকাশের দিকে
ছুড়ে দিচ্ছে তার তাবৎ বিষাদ,
আর তার সমস্ত অভিযোগ
পার হয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ীর শব্দ
টায়ারের ঘর্ষণ- সভ্যতার যাবতীয় হুংকার।

বিস্মরণ

মৃত্যুর ভেতর বাহিরে আসা যাওয়া করে আমাদের
অবিভক্ত কররেখা,
কোথায় রেখেছ তবে আগ্রাসী আঙুলের শোভা?
যত না বেজেছে বেহালা সুরে
তারচেয়ে বেশী কম্পন তুলে ফিরে গেছে
বদ্ধ দরজার ওইপাশে;

পালকের কোমলতা ঘেটে খুঁজে আনি
পরাজিত উষ্ণতা কিছু- এই প্রেম, দেহের আঙিনাভরে
নেচে গেছে কতকাল, পড়ে আছে বিপন্ন ঘুঙুর
কার পায়?

যেন স্মৃতির দূরত্ব থেকে ফিরে এসে,
আনমনে, বাতাস ঝাপটে দিচ্ছে জানালায়-
পর্দ্দার ওইপাশে ক্ষণে ক্ষণে দৃশ্যমান,
আমরাও সাজিয়ে নিচ্ছি আমাদের বিগত প্রেমের ইতিহাস!

দৃষ্টির অগোচরে দৃশ্যও নিছক অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে …

স্বপ্নপ্রয়াণ

পাতার আশ্বাস থেকে টুপ করে নেমে পড়ি
বিন্দু জলের মগ্নতায়,
গভীরে বাজছে তানসেন তার চেয়ে গভীরে প্রলয়!
আকাশে থমকে গেছে সহসা জলের বিস্ফার
কামনার আস্বাদ নৈঋতে ফেলে গেছে ছায়া!

এইসব বৈরাগ্য আর বাসনার দ্বৈত আলিঙ্গণে
দেহের চতুর্দ্দিকে এঁকে নিই অলীক বৃত্ত এক,
তোমাকে ছাড়িয়ে যাই, চলে যাই ছাড়িয়ে আমাকেও…

মৃগয়া

ধনুকের বক্রতায় বাজে এই রাত, লুটিয়ে পড়েছে যেন
শিকারের রুদ্ধশ্বাস ছুটন্ত তারার পিছে পিছে,
সহস্র ব্যাধের গল্পে এই ব্যাসার্দ্ধ বিবৃতি শুনি, মৃতচাঁদ
কোথায় পেয়েছে ঠাই, কোন মরুভূমে?

কুয়াশার স্মৃতি ভুলে বাজিয়ে গিয়েছে কারা ভঙ্গুর এস্রাজ?
ফুল থেকে ফুলে জন্মসারাৎসার মেখে চলে গেছে
অবারিত পালকের নীচে,
সহসা সলাজ মুখে দেখি তাই ঘুঙুরের নীতি লেখা আছে,
অসহ দর্পনে আছে সুর, আছে রচিত সুঘ্রাণ-

এইসব কথকতা ভুলে যাও,
ভেঙে দাও রাতের আসরে দেখা নাচ, মোহিনী অট্টম।

মায়াবস্তবতা

কতটা প্রশান্তি আছে ঘুমের আলিঙ্গনে?
পেয়ালা ভর্ত্তি আছে কৃষ্ণচূড়ার লাল!
বারান্দায় গুটিসুটি পড়ে আছে চাঁদ,
অথবা চাঁদের ছায়ায় প্রতিটা ঘামের গ্রন্থী
উড়ে যায় মিনারের ছাদে!
ভেঙে পড়ে দৃশ্যকতক, একেকটী তোমার চোখ-
নীল নীল ময়ূরের ডানা!

চুম্বন

চুম্বন মাত্রই ধ্বসে পড়ে তাসের পাহাড়
চোখের ওপর পড়ে ডোরাকাটা রোদ
যেতে যার ইচ্ছা যাও যেখানে যাবার
কোথায় লুকিয়ে আছে অলীক দ্রাঘিমা?
বসন্ত বিলোপ হলে দ্রাক্ষাকুঞ্জে ফুল
কোথায় সমুদ্র আজ কোথায় নীলিমা?

 

 

 

 

 

তানভীর আকন্দ
কবিতা লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্ত্তমানে লৌকিক প্রকাশনা সংস্থার সাথে জড়িত আছেন।

ই-মেইল:
tanvirakanda09@gmail.com

 

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{তানভীর আকন্দের প্রকাশিতব্য, ‘তমসাপ্রবঞ্চনা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নির্ব্বাচিত কবিতা (দ্বিতীয়পর্ব্ব) [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার