সকালের ডায়েরী || রাসেল রহমান

0

ছবি ইণ্টারনেট থেকে

এক—
কোন প্রার্থনা কবুল হয় না, পূরণের কোন সুযোগ নেই। প্রার্থনা এত বিচিত্র হয়, মাঝে মাঝে এত ধ্বংসাত্মক, অপরের অকল্যাণকর হয় যে প্রার্থনা পুরণ হতে থাকলে এই দেশে রোদ ওঠত না, বৃষ্টি হত না, বৃষ্টি হলেও বন্যা হত না। পরস্পরবিরোধী প্রার্থনায় এই রাষ্ট্র কাঠামোই ভেসে পড়ত।

প্রার্থনা পুরণ হলে র‍্যাম্বো হইতাম, ব্রুস লী হইতাম, মাস্তান হইতাম আরো বড় হয়ে নায়িকা পপির প্রেমিক হইতাম, শাবানা আজমীকে বিয়ে করতাম।

দোয়া কবুল হইলে কত আগেই স্বৈরশাসক মরে যেত, খচ্চর পুলিশটা যে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল গাজা বিক্রেতার সাথে কথা বলার অপরাধে, তার … খসে পড়ত।

আমার প্রেমে দীর্ঘকাল মাতাল মেয়েটা যে আমাকে প্রার্থনা করত, তার প্রার্থনা কবুল করতে যাওয়ার দিন যে জানায় আমি তার বিবেচনায় নেই। তারপরের দিন লাশ পড়ে থাকতে পারতো কোন ধানক্ষেতে, কেননা আমি তার মৃত্যু কামনা করেছিলাম।

এখনো আমি কবি হইতে চাই, একটা উপন্যাসের জনক হইতে চাই, বুদ্ধিজীবী হইতেও মনটা চায়। আবার ব্যাবসায়ী হিসেবে টাকাপয়সার মালিক হইতে ও মন চায়।

মানুষের উপকার করতে মন চায়, আবার অনেকগুলিরে কিলাইতে, কেলাইতে মন চায়।

এ পর্য্যন্ত যা যা হইতে চাইছি যদি হইতাম, সবগুলো প্রার্থনা কবুল হইলে আমি কি হইতাম, কেমন হইতাম সেটা আমি কল্পনা করতেও ভয় পাই।

প্রার্থনা আমার ক্যাথারসিস, প্রার্থনার পথ ধরে মুক্তি পায় আমার মনোবাসনা, বিকার ও কদর্য্যতা। অবদমনের বোঝা কিছু হালকা হয়, কিছু চিন্তা পায়রাগুলির মত উড়ে যায়, কিছু চিন্তা পোষ মেনে বারান্দায় ডানা ঝাপটায়, কিছু চিন্তা সিন্দাবাদের ভুত হয়ে ঝুলে থাকে।

প্রার্থনা পুরনের নয় বরং ছড়িয়ে দেওয়ার যাতে আত্মহত্যা না করে আয়ুর সমান বেঁচে থাকা যায়, যাতে সহনীয় হয় এই বিরাটে গরাদযাপন।

ভাগ্যিস প্রার্থনা পুরণ হয় না, হলে এই কথাগুলি লিখতে পারতাম না, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যেত। অথবা আমি তথাগত হয়ে বিগত হয়ে যেতাম, মিশে যেতাম এই শীত কুঁয়াশায়, লাউয়ের পাতার শিশিরে অথবা হয়ে যেতাম হিমের ও রাতের শীতবাতাসে।

দুই—
সারারাত এককাতে শুয়ে একপাশের স্বপ্ন দেখেছি, জেগে উঠে পুনরায় ঘুমিয়ে গেছি। মেরুদন্ডের মাঝখান থেকে ঘাড়ের শুরু পর্য্যন্ত ছড়িয়ে গেছে ব্যথা, মাঝে মাঝে তীব্র শ্বাসকষ্ট সেই কারণে এককাতে শুয়েছি একরৈখিক ব্যথা, বেদনা সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্ন যা দেখেছি তাতে মনে হল না ভিন্ন জাগতিক কিছু, এই জগতের ই বর্দ্ধিত ভিন্নমাত্রিক সুক্ষ্মজগৎ।

যেমন শরীরের ভিতর কোথাও আত্মা বলতে সুক্ষ্ম কিছু আছে এরকম হাইপোথিসিসের চাইতে গোটা শরীরটাকেই আমার আত্মা মনে হয়।

সেই স্বপ্নে এই রিয়ালিটীর ব্যাথা, বেদনা, অন্তর্দহনকে নার্সিং করা হয়, শ্রশুষা করার একটা অটোমেটিক প্রসেস আছে। সেই প্রসেসের কাছে সচেতন সমর্পণ করে কিছু উপকার পাই।

আমার অসুস্থতা থেকে সুস্থতা, চাওয়া পর্য্যায় থেকে পাওয়ায় উত্তরনের দায়িত্ব নেয় আমার অবচেতন। আমার ভয়, উদ্বেগ ছেড়ে দেই আমার মনের কাছে অতপর আমি উদ্বেগ আমলে নেই, ভয় পেতে থাকি এবং বেরিয়ে যেতে থাকি।

নিজ অস্তিত্বের কাছে সমর্পিত হতে চাই
নিজের কাছে নতজানু হতে চাই
নিজকে ছেড়ে দিয়ে আমিই অস্তিত্বে পরিণত হতে চাই; যাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যথা-বেদনারা হারিয়ে যায় সমগ্রে।

তিন—
আশ্চর্য্যের ব্যাপার আজও আমি ঠিকঠাক বেঁচে ওঠেছি। প্রতিদিন অবাক হই, একটা বয়সের পর ঘুম থেকে সকাল দেখতে পারা আশ্চর্য্যজনক হয়ে যায়। প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়ার আগে মনে হয়, হতে পারে এটাই সেই আশ্চর্য্য ঘুম যেখানে থেকে এখানে আর ফিরে আসা যায় না।

ছোট একটা খাটে একা ঘুমাই সেখানে গতরাতে ভাগ বসিয়েছে ছেলে, তার জোর দাবী আমার সাথে ঘুমাবে। আমি তাকে বুঝাতে পারি না ঘুম মানে দেহ বিছানায় রেখে ঘুরতে যাওয়া, দেহের বোঝা রেখে এক অলৌকিক ভ্রমণ এই ঘুম। ঘুমানোর সময় কাউকে সাথে নেওয়া তাই বিপজ্জনক, হয়ত তুমি ডাকবে আমি তখন অন্যকোন দেশে বিহারে, তাড়া খেয়ে দৌড়াচ্ছি বা ভীষণ লজ্জাকর কোন রমনে ব্যস্ত। সেখান থেকে খুব দ্রুত আমি আসতে পারি না, তোমার প্রয়োজনে সাড়া দিতে পারি না সহজে, ফিরে আসতে, দেহের সাথে মানিয়ে নিতে কষ্ট হয়।

কোন সময় এমন হতে পারে আমি আর ফিরতে নাও পারি তোমাদের মিথ্যা জগতে, তোমাদের ঘোরগ্রস্ত পাগলা গারদে। যেখানে ভুতের মত খেটে খাদ্য যোগাড় করার পর প্রতিপালকের প্রার্থনা আর নামগান গাইতে হয়। যেখানে কায়ক্লেশে কোনরকম বেঁচে থেকেও নরকে অনন্ত বসন্ত আতঙ্কে দিন যাপন করতে হয়।

এখানে রমনীদের অন্তরাত্মা উজাড় করে ভালবাসার পরে ও সবকিছুই বাকী রয়ে যায়।

এখানে সকাল মানেই যুদ্ধদিনের পিটি প্যারেড, অবমাননা, পায়ে পিষ্ট হওয়ার জন্য জামা জুতা পরিধান করা।

চার—
সকালে উঠে স্বপ্নলোকের সবকিছু ভুলে গেছি। মনে করতে চাইলেও পারি না অধিকাংশ দিন। ভাল হয় ভুলে গেলে, মনে থাকা বিষয়গুলো জ্বালায়, পোড়ায়, কামড়াতে থাকে।

রুশোকে নিয়ে স্কুলে গেছি মা সহ।

সে ম্যসাকার করে দিয়েছে। ক্লাসে ঢুকেনি, খেলতে শুরু করেছে, কোন বুঝ নিতে সে চায়নি, চোখ রাঙানো, মাইর ধরের হুমকিতে টলেনি, একটা দিয়েছিলাম সে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। সন্তানের সাথে পেরে উঠা যায় না। আমার মা বোন আমার সাথে পেরে ওঠেনি, আমি পেরে ওঠব না রুশোর সাথে, অধঃপাতে গেলেও তাকিয়ে দেখে যেতে হবে।

মাঝে মাঝে মনে হয় প্রত্যেক মানুষ একেকটা ইনপুট দেওয়া সফটওয়্যার, প্রোগ্রামড, কোন পরিবর্ত্তন, রুপান্তর অসম্ভব। প্রত্যেকে যেন তার স্বভাব ধর্ম্মের অনুগত দাস, প্রত্যেক মানুষ তার ইচ্ছাশক্তির সীমানা দ্বারা সীমায়িত।

প্রত্যেক হিউম্যান ডিভাইস যে অটোমেটিক কার্য্যকলাপের মধ্যে দিয়ে যায় সেখানে কোন চিন্তা থাকে না, ভিন্নতা থাকে না, সচেতনতা থাকে না। যে যার পরিস্থিতিতে ফ্যাসিষ্ট, প্রভাবক হিসেবে জাহির থাকতে চায়।

এইসময়েও মানুষ কত মুর্খের মত অন্যকে পরিচালিত করতে চায়, নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দিয়ে বুঝে নিতে চায় প্রতিদান।

এখনো নিজের বোঝাপড়ার জঞ্জালে মানুষ অন্যকে জড়াতে চায়। মানুষের ব্যবহারিক আনুগত্য হয়ত আদায় করা যায় তার আপাত পরিস্থিতির কারণে কিন্তু তার মন ততোধিক বিদ্রোহী থাকে ভেতরে ভেতরে।

আমার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।

পাঁচ—
সকালে উইঠা মনে হইতেছে আমি ফাত্রা, ফাউল আর ব্যাক্তিত্বহীন। অতি সহজে আমি ম্যানেজেবল, এভেইলেবল। প্রত্যাখাত হওয়ার সাথে সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ক্ষেত্রেও আমার কোন অনমনীয় অবস্থান নেই তাই আমি ব্যাক্তিত্বহীন।

ফাত্রা আর ফাউল আমি আছিলাম আর আছিও।

কিন্তু ব্যাক্তিত্ব জিনিসটা কি!

আগে মনে করতাম যারা গম্ভীর, ওয়েট বেশী, গোফ রাখে দাড়ী ছাড়া শারীরিক এপিরিয়েন্সের মানুষ যাদের বাতচিতে জ্ঞান থাকে, বিবেচনা থাকে, যারা হালকার ওপর ভেসে যায় না স্রোতে, প্রথায়।

আমি মনে করি আমি ব্যাক্তিত্বহীন, ব্যাক্তি হয়ে উঠার জন্য কোন আদর্শ, দর্শন বা অনমনীয়তা, জেদ বা এইরকম কিছু ব্যাপার আমার স্বভাবের সাথে গেথে রাখিনি, প্রচার করিনি।

আমি এইরকম, সেইরকম আমি কিন্তু অভাবে হাত পাতি না, আমি কোন অন্যায় করি না, অন্যায়ের সাথে আপোস করি না সুলভ কোন অলঙ্কার আমি ধারণ করিনি, ধারণ করতে চাইলেও আমি পারি না। মানুষের কাছে এলে, মানুষ জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা আসমান দেখাই না, দেখাই আমার চোখের ভিতরের লাল, কম্পমান হাতের কাঁপুনি আর দেখাইতে চাই তোমার প্রতি আমার উথলে ওঠা দরদ।

মানুষের সামনে এলে মেলে ধরি শীতবাতাসে শীর্ষেন্দুর নভেলের মত, পাতায় পাতায় বিষন্নতা, বেদনা আর ভালবাসা। আমি ফাত্রা হলেও নিজেকে দোষ দেই না, তারে আমি আড়ালে চুমু খাই আশ্লেষে।

আমি ভালবাসি আমার ফাউলামি ও বলদামি। আমি বলদ বইলাই এখনো আমি মানুষ হওয়ার কাছাকাছি আছি।

আমি ফাউল এইটা আমি জানি, আমি ব্যাক্তিত্বের মত কোন মেশিন নই, আমি বলদা এইটা আমি জানি, অনেকে জানে না বইলা আমি তাদের চেয়ে জ্ঞানী (সক্রেটিসের চ্যালা)।

ছয়—
স্বপ্নে দেখলাম আমাকে কনে দেখানো হচ্ছে। কনে সুবিধার না, শরীর নারীর, মুখ পুরুষালী আমি খারিজ করে দেই একের পর এক। আমার সাথে আছে আমার কর্ম্মস্থলের এক ইঞ্জিনিয়ার সে তার দূর সম্পর্কের শ্যালিকা দেখাইল, মুখটা দেখে চমকে ওঠলাম সেই নারীর মুখে আমার বাল্যকালের বন্ধুর আদল। স্বপ্নে বিয়ে হইল না, কেননা সব নারীর মুখে পুরুষের আদল। সম্ভবত বিয়ে সংক্রান্ত বিষয়ে মাথা ঘামাইতে ঘামাইতে অবচেতনে বিয়ের খায়েশ হইছিল! স্বপ্নেও আমি কি ভীষণভাবে পুরুষ!

নারী-বাদ, নারী নিয়ে নানা কথা মনে আসতেছে আজ…

সমাজ সব অর্থেই পিতৃতান্ত্রিক। ইহা ইতিহাসের কোন কালপর্ব্বে মাতৃতান্ত্রিক ছিল কিনা তাতে গভীর সন্দেহ হয়। এইকালের হালহকিকত দেইখা অতীত অনুমান করার কিছু সুযোগ রয়ে যায়। অতীতেও নারী গর্ভধারণ করত, বর্ত্তমানেও করে তাই অতীতে নারীর খুব রমরমা ছিল এখন নাই, সেইটা গল্পের মত লাগে। পুরুষ নারীর গর্ভে জন্মায় বলেই নারীর অবস্থান পুরুষের চাইতে কম মুখ্য, পুরুষ গর্ভধারণ করলে সেও নানা প্রাকৃতিক কারণে পিছিয়ে থাকত নারীর চেয়ে।

বিয়ে প্রথা চালু হওয়ায় নারীর নিরাপত্তা, জীবিকা ও সন্তানের পরিচয় নির্দ্ধারণে সুবিধা হয়েছে। পুরুষও সুবিধা ভোগ করে তবে সুপরিয়র হিসেবে, কেননা এখানেও গর্ভধারণ, উৎপাদনে পিছিয়ে থাকা এবং অলরেডী সমাজ পুরুষতান্ত্রিক হওয়ার সুবিধা।

তাই নারীবাদী আন্দোলন পুরুষের কাছ থেকে আরও বেশী সুবিধা আদায়ের আন্দোলন। পুরুষকে নারী-বাদ কাঠামো গিলিয়ে পুরুষের সমর্থন নিয়ে এই আন্দোলন চলমান। অনেকখানি কাজ হইছে, তবে সুবিধা পেয়েছে মেধাবী আর সাহসী নারীরা।

মেধাবীরা বরাবর স্বাধীনতা বেশী পায়, সুবিধার জায়গা তৈরী করে নেয়, অধিক পাওয়ারের অধিকারী হয়ে যায় অটোমেটিক সেটার জন্য নারী-বাদ গুরুত্বপূর্ণ না।

বিবাহ মুখাপেক্ষী না হইলে নারীর জন্য নারী-বাদ ভাল। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হইলে সবার জন্য ভাল। অত্যন্ত বিকশিত আর অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সমাজের জন্য নারী-বাদ অধিকতর উপযোগী।

সাত—
গতকাল দুপুর থেকে গভীর রাত পর্য্যন্ত ব্যাস্ত ছিলাম বিয়ের অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিষয়ে পরিবার নিয়া। সাধারণত আমার যে কাজ থাকে বাচ্চা সামলানো আমি সেইটাই করছি, লগে আরেকজন যোগ দিছে হেরেও দেখতে হইছে।

আমার বৌ পাহাড় সমান সাজগোজের পাহাড় নিয়া এই জটলায়, সেই জটলায় ঘুরতেছে আর কম্পেয়ার করতেছে। উনি ভাবতেছেন তারে বেশী সাদা দেখাইতেছে না, চোখের পাপড়ীটা লেংটা রয়ে গেলে, ঠোঁটের লিপস্টিকের পরে রেখাটা আঁকিয়ে নিলে ভাল হইত।

প্রত্যেকটা মেয়ে এবং মহিলাকে দেখলাম এরা তাদের প্রকৃত রঙ, সজীবতা আর স্নিগ্ধতা বিসর্জ্জন দিয়ে একেকজন উর্ব্বশী, মেনকাদের মত বানোয়াট কেউ হয়ে উঠার চেষ্টায় জান বাজী রাখছে। এই যে স্বাভাবিকতা থেকে অধিক দর্শনীয়, রমনীয় হয়ে উঠার প্রচেষ্টা নিজের জন্য হতেই পারে না, পুরোটাই অন্যের কাছে গ্রহনীয়, মনোরম লাগার লক্ষ্যে। সেইটা তাদের অশ্লীল করে তোলে, অধিক বেশী শারীরিক করে তোলে।

এই গভীরতর অসুখ মেয়েদের জেঁকে বসেছে অনেক কাল ধরে। মা থেকে মেয়ে, মেয়ে থেকে নাতনী পর্য্যন্ত বাহিত হয়ে আসছে এই সাজগোজ রোগ। এই রোগের গভীরে নিহিত আছে নীচু চেতনা যাহা ভাষায় প্রকাশ উপযোগী নয়।

তাহারা আধুনিকতা বলতেও জামা, জুতা সাজগোজ আর অধিক পুরুষের সাথে বাত্চিত বোঝে।

আমি নিজেকে দেখানোর বা কম্পেয়ার করার খুব বেশী সুযোগ পাই নাই পুত্রের কারণে। খুব দর্শনীয় বারুদমাখা চোখের কোন মেয়ে চোখে পরেনি। আমার পোষাক নিয়ে হীনমন্যতার কাল আমি পেরিয়ে এসেছি প্রায়।

আমার কাছে নিজেকে জাহির করার উপায় হচ্ছে পরিস্কার জামা-জুতা পরা, গোসল করে শরীরের গন্ধ দূর করা, অভিব্যাক্তিতে বিনয়ের ভান ধরে রাখা আর মানসিকভাবে মনের উদ্বেগ, দুশ্চিন্তার প্রভাবমুক্ত মনের উপস্থাপন।

আট—
পরীমনির মা হওয়া দেখিয়ে দেয় পুরুষতন্ত্রের দাপট। আমি ধারণা করি সে হয়ত ইতিমধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেছে, তার ভেতরের দ্রোহ স্তিমিত হয়ে আসছে কেননা তার এই বিবাহ এবং সন্তানের মা হওয়া পরোক্ষভাবে এক ধরণের পরাজয়, পুরুষতন্ত্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার। কোন কর্ত্তৃপক্ষের সাথে ডিল হয়ে থাকতে পারে। এতে করে মামলা থেকে অব্যাহতি, রাষ্ট্রীয় নিপিড়ন থেকে, হয়রানি থেকে মুক্তি মেলার শর্ত্ত থাকতে পারে।

কেননা কিছু না লিখে, সরাসরি প্রতিবাদ না করে শুধু নারীর জন্য সীমানা অতিক্রম করেই সে ভেঙে ফেলতে চাইতে চাইছে মধ্যবিত্তের নর্মস। ক্রমাগত অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছেন সমাজকে, রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট মুল্যবোধ নাড়িয়ে দিচ্ছেন, ভয়ডরহীন জীবন যাপনের প্রতীক হয়ে উঠছিলেন। ক্রমাগত বিরক্ত করছেন প্রথা ও প্রচলিত ধারার জীবনকে।

জন্মদিনে লুঙ্গি পড়ে উৎযাপনের পরে উনি লিখেছিলেন, আমি মাঝরাতে বাসায় ফিরে পোষাক ছেড়ে ঘুমিয়ে আবার সকালে ওঠেছি, শুটিংয়ে গিয়ে কাজ শেষ করে বাসায় এসেছি আর আপনারা এখনো আমার লুংগিতে পরে আছেন! এটা দারুণ চপটাঘাত ছিল।

বাচ্চায় বাচ্চায় সয়লাব হয়ে যাওয়া এই দেশে আরো একটা বাচ্চার আগমন এমন কোন সুখবর না।

বাচ্চা যা আছে সেইগুলাই ঠিক মত পুষ্টি পায় না, এনার্জী খরচ করার জন্য মাঠ পায় না, বাসায় এসে শোয়ার জন্য নিজস্ব ঘর পায় না, পড়ালেখার জন্য স্কুল পায় না। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে মেধাবী না হলে বিচার পায় না।

অন্যের বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা ভাবার সেই মানসিক উচ্চতা আমরা অর্জ্জন করতে পারিনি। আমরা এখনো মনে করি আমাদের বাচ্চা ভাল, অন্যদের বাচ্চা শয়তান, বখে যাওয়া। আমাদের বাচ্চাকে ওই লোকের বাচ্চা নেশা করা শিখাইছে। আমাদের বাচ্চার সেক্স ছিল না, অন্য বাচ্চারা মাথায় সেক্স ঢুকাইছে তাই সে বয়সের দোষে একটু ধর্ষণ করছে।

এখনো বাচ্চাদের আমরা জারজ বইলা গালি দেই, নিজের বাচ্চাকেও দেই। এখন পরীমনির বাচ্চারে দেওয়া শুরু হইছে যে এখনো আকার লাভ করেনি, পেট থেকে বের হওয়ার পর কি বলবে সেটা অনুমান করা যায়।

আমি এক পরিবারকে জানতাম যাদের কোন বাচ্চা ছিল না, একটা শিশুকে দত্তক নিয়েছিল, বাচ্চাটা বড় হওয়ার আমি অবাক হয়ে দেখতাম সে তার পালক পিতা মাতার মত ই দেখতে প্রায়, এমনকি কথা বলার ধরণ পর্য্যন্ত।

গ্রামদেশের মানুষ এখনো মনে করে একমাত্র মা জানে বাচ্চার বাবার নাম! যদি একজন নারী বহুগামী হয় তার পক্ষে বলা শক্ত বাচ্চার বাবার নাম। পরীমনির বাচ্চার বাবা কে সেটা নিয়ে অনেকে মাথা ঘামাইতে দেখা যাচ্ছে।

বাবা যেই হোক প্রকৃত বাবা মা হওয়া কঠিন ব্যাপার। যে বা যারা হতে পারে তারা নমস্য।

পরীমনি রাজের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয় তারা বাবা মা হতে প্রস্তুত।

বিবাহ ব্যাপারটা প্রাতিষ্ঠানিক, কাগজনির্ভর হয়েছে বেশী দিন হয়নি। তাহলে আরও আগের অবস্থার কথা চিন্তা করেন তারা তো তাইলে লিভ টুগেদার করত, সেই ফসলগুলো মনে হয় জারজ ছিল না।

দিন যায়, পৃথিবী পরিণত হয় আর আমরা চিন্তার দিক থেকে পিছিয়ে যাই; আরও খাদ্য শৃঙ্খলে নিজেদের বেঁধে রাখি অন্যদের বেঁধে রাখতে চাই।

পরীকে অভিনন্দন। একটা বিদ্রোহের সুন্দর অবসানের জন্য এখান থেকে কেউ না কেউ এগিয়ে নেবে।

নয়—
কোন এক প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গিয়ে প্রায় সোয়া দুই ঘন্টা দাড়িয়ে থাকার পর উনি উৎকট, উদ্ভট ড্রেস পড়ে নামলেন রিকশা থেকে, কাছে আসতেই উগ্র পারফিউমের ঘ্রাণে আমার দম বন্ধ অবস্থা হলেও আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি কেননা উনি তখন দাতা, আমি গ্রহীতা।

আমি বড্ড প্রেমের কাঙাল। আমাকে উপেক্ষা করতে হয় তার চোখের পাতার ওপর গোলাপী রঙয়ের সন্ত্রাস। মুখ জোড়া এত বিচিত্র রঙয়ের পেইণ্টিং যে তার দিকে তাকিয়ে আমি তারে খুঁজি কিন্তু পাই না।

আমি তাহার সাথে রিক্সায় ঘেষাঘেসি করে বসার সুযোগ পেয়েছিলাম বহু সাধ্য সাধনায়। আমার ভিখারীর মত চোখের আর্ত্তি আর অপেক্ষা তার ভেতর করুণার উদ্রেক করেছিল। আমি যেভাবে তারে মনে করাঘাত করে গেছি মন দিয়ে, সেই আঘাতে বিপর্য্যস্ত হয়ে সে আমাকে নিয়েছিল বাধ্য হয়ে। আমি তার প্রেম ছিলাম না, প্রেমের সেই যাদু ‘আমি তাকে দেখলাম আর হয়ে গেল’ টাইপ ছিল না। তাঁর মনোজগতে রুই-কাৎলা গেঁথে উঠানোর টার্গেট ছিল। আমাকে সে নিয়েছিল যাতে সে এই পথে আমাকে ব্যবহার করতে পারে।

সে আমাকে বলে, কী দেখ হাবলার মত?
আমি তারে বলি, এমন সাজে আসছ যে তোমাকে চেনা যাচ্ছে না ঠিকঠাক।

হঠাৎ সে আমার দিকে তাকিয়ে আৎকে ওঠে, আল্লা এইটা কি পরে আসছ তুমি, এইটা কিছু হইল! ভাল কিছু ছিল না, জুতার সামনে দিকে সেলাই খুলে গেছে, বেল্টের চামড়া উঠে গেছে, শার্টের কি অবস্থা। আমি কেমনে তোমাকে নিয়ে বের হই!

আমি সেইদিন অপ্রতিভ হয়েছিলাম আকস্মিক, ভেতর থেকে অহমের ভুত জেগেছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, আমাকে নিয়ে যেতে হবে না। আমি ব্যবসায়ীদের সাথে প্রেম ব্যবসা করি না।

সে রেগেমেগে কালী হয়ে উঠে বলেছিল, ছোটলোক চালচুলা নেই, আবার প্রেম করতে আসে, তোরে দয়া করেছিলাম এবার নর্দ্দমায় যা।

আমি বলেছিলাম, যাত্রার নাচনওয়ালীর সাজার সেন্স তোর চাইতে ভাল। দীর্ঘদিন গোসল না করা শরীরে যখন সেণ্ট মারিস দুই দুর্গন্ধ মিলে যা হয় সেটা সয়ে আসছি অনেকদিন, দূরে যায়া মর।

সে থাপ্পড় মারতে আসছিল, আমি আমার গাল জেসাসের মত সহজলভ্য রাখিনি।

আমি তাকে বলেছিলাম, প্রেম নামে যে ব্যবসা তুমি চালায়া আসতেছ সেটা আমি বুঝতেছি। আজ ওমুক সুদর্শন বইলা, এরে … কাল ওমুকের টাকা আছে, তারে … কিন্তু কিন্তু কিপটা বিধায় তারে ছাড়লা ..

কেউ গিফট করল, তারে তুমি জামার ভিতর হাত ঢুকাইতে দিলা আর আমারে সইরা বসতে বললা। একদিন পরিবার থেকে ভাল পাত্রের সন্ধান আসলে বিয়া কইরা জিতে যাওয়া টাইপ বেশ্যা তুমি। তোমার চাইতে দোকান খুলে বসা মেয়েরা অনেক ভাল।

সে অনেক কেদেঁছিল, আমি তাকে কাঁদাতে চেয়েছিলাম। আমি পেরেছিলাম তাকে ধুয়ে দিতে। আমি তাকে ছুড়ে মেরেছিলাম, উলঙ্গ করে দিয়েছিলাম।

আমিও পুড়ছিলাম, কেননা যে ধরণের পোষাকে সে আমাকে দেখতে চেয়েছিল সেইসব পোষাকের আকাঙ্খা আমার ছিল, যেই ঘ্রাণে সে আমার ভেতর বুঁদ হয়ে থাকতে চেয়েছিল সেই ঘ্রাণ আমি বের করতে পারিনি অস্তিত্বের গভীরতম প্রদেশ থেকে, কেননা আমায় তখন শাসন করত হতাশা, দুশ্চিন্তা আর নৈরাজ্যের মত বোধ।

প্রেমের চাইতে প্রেমের গান অনেক প্রেমময়, প্রেমের চাইতে প্রেমের কবিতা শ্রেয়তর, প্রেম চরিতার্থ হওয়ার চাইতে প্রেমহীন নারীর বুকে মাথা রেখে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকার জন্য হাহাকার ভাল, প্রেম ব্যবসার চাইতে, কথা ব্যবসার চেয়ে ছুঁয়ে থাকা ভাল …

দশ—
মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরী বিষয় হচ্ছে তার জীবিকা। সবার জন্য আয় করা জরুরী। মেয়েদের একটা বড় অংশ বিবাহের মাধ্যমে জীবিকা নির্ব্বাহ করে। তাই মেয়েদের জীবিকা অনেকাংশেই এখনো পুরুষের জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। জীবনকে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য টাকা উপার্জ্জনের কোন বিকল্প নেই।

অনাদিকাল থেকে মেয়েরা ধন-সম্পত্তিওয়ালা উপার্জ্জনক্ষম ব্যাক্তিদের প্রেমিকা, স্ত্রী হতে চেয়েছে। তাদের পারিবারিক স্কুলিং এক্ষেত্রে উদুদ্ধ করে থাকে। প্রতিপত্তিওয়ালা কারো সাথে বিয়ে হবার পর ও তাদের ভাগ্যে সামান্য মাসোহারা আর জরুরী জিনিস মেলে কিন্তু টাকা পয়সার দখল পুরুষের হাতেই থাকে।

সেই পরিস্থিতিতে সঞ্চয় ও জমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে মেয়েদের উৎসাহী হওয়া স্বাভাবিক। ভবিষ্যৎ ভাবনা, নিরাপত্তাহীনতা ফলে তাদের মন সম্পতের (সম্পদের) পড়ে থাকে। সম্পতের (সম্পদের) অসম বণ্টনের কারণে মেয়েরা সম্পত্তির মালিকানা সেভাবে পায় না। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণতঃ মেয়েরা উপার্জ্জনের বাইরে থাকে তাই ভবিষ্যৎ মোকাবিলা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।

সেই উদ্বেগ তারা ছড়িয়ে দেয় পুরুষের মাঝে, শত প্রতিকুলতা স্বত্তেও আরও টাকা উপার্জ্জনের জন্য চাপ তৈরী করে। পুরুষ তখন ঘরের শান্তি, সুখের জন্য যেনতেন প্রকারে টাকা উপার্জ্জনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। টাকা উপার্জ্জনের সাথে সাথে সে মেশিন হয়ে উঠতে থাকে এবং একটা ম্যাসেজ আত্মস্থ করে টাকা হলেই নারীর মন, সার্ভিস মেলে; অন্যথায় সে বিরক্তিকর অস্তিত্ব। এতে করে তার মনে মগজে সম্পর্ক একটা ব্যাবসা এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। সে ভেতরে ভেতরে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করে, একা হতে থাকে। পুরুষ তার নারীর প্রতি মনোযোগ, ভালবাসা হারাতে থাকে।

মেয়েরা ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে থাকে, অন্যে কারো উন্নতি, স্বচ্ছলতা সৌন্দর্য্য নিয়ে। পাশের বাড়ীর নারীর সাথে তার প্রতিযোগিতা চলে আসে। সেই রেস জিতার জন্য পুরুষকে চাপ দেয়। পুরুষ এই অতি চাপ নিতে ব্যর্থ হলে মেয়েদের চেহারা বদলে যায়, কোকিলকন্ঠী হয়ে যায় কর্কশ কাক। কান ঝালাপালা করে, শব্দ বাক্যের বিষ ঢেলে পুরুষের মন বিষাক্ত করে। এমন আক্রমণ করে যে তার আত্মবিশ্বাস গুড়িয়ে যেতে থাকে।

মেয়েরা যখন বলে ‘তোমার সাথে বিয়ে হয়ে আমার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে’ এই কথার মানে হচ্ছে সে অপাত্রে শরীর দিয়েছে, মন দিয়েছে। বেচাকেনার ক্ষেত্রে সে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারে নাই। এই মেকী মেকী শরীর দেয়া নেওয়ার খেলা, একসাথে খাওয়া থাকার চুক্তিকে সংসার বলে। সেই সংসারে নারী হিসেব করে সে কি পেল বা অর্থমুল্যে কত পাওয়া গেল। সেখানের অপ্রাপ্তি তাকে কুড়ে কুড়ে খায়।

যা কিছু বলা হয় যেমন বিবাহ স্বর্গীয় ব্যপার, পবিত্র বন্ধন এসব বাণীর অসাড়তা বোঝা যায় স্বামী প্রাণঘাতি রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে, দেউলিয়া হয়ে গেলে বিবাহিত জীবনের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। বিবাহের পুরো প্রক্রিয়া অনেক বেশী কেনা-বেচার, অনেক বেশী অর্থনৈতিক।

বিবাহ শুরু হওয়ার পর পর ভেতরে ভেতরে সম্পর্কের ভাঙনও শুরু হয়। অভ্যাসের দাসত্ব করে সম্পর্ক হয়ত টিকে থাকে সন্তানের দিকে তাকিয়ে, পরস্পরের উপায়হীনতার কারণে। নারীরা দ্রুত সেপারেট হতে পারেনা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অভাবে, সেইজন্য সে পুরুষের কোলে শুয়ে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে নামে।

যদি সুযোগ থাকে তবে তারা শ্রেয়তর উপার্জ্জনক্ষম কাউকে বেছে নেয়। পুরুষ এককাঠি সরেস, সে ঘরকা মোরগী ডাল বরাবরকে পাশ কাটিয়ে বাহারওয়ালীর মধু খায়, আর পুরাতন চলে গেলে, মরে গেলে, বছর পার হওয়ার সবুরও করে না নতুন জুটী বাধঁতে। এই টাকা পয়সার কাঙালপনা তাদের নৈতিকতা, সব ধরণের মুল্যবোধ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

নারীদের নীচুতা প্রকাশিত হয় পরিপার্শ্বের অবস্থাপন্নদের সাথে তুলনায় গিয়ে, অন্যদের ইর্ষা করে এবং বাস্তবিক অভাব অভিযোগ থেকে। কিন্তু নারীরা যেটা বুঝতে পারে না সেটা হচ্ছে স্বচ্ছল হওয়ার শর্টকাট কোন রাস্তা নেই। যার যার স্বচ্ছলতার পথ তার নিজের করে নিতে হয়। পুরুষের আশায় বসে থেকে সেই স্বচ্ছলতার আশা করা বোকামি ছাড়া কিছুই না। পুরুষ নারীর ঘর সামলানোর, বাচ্চা মানুষ করার ও সবার সাথে এডজাষ্ট করার দক্ষতার ওপর নারীর মূল্যায়ন করে আসছে, সেই অনুযায়ী সে শাড়ী, গয়না, লাইফস্টাইল পেতে পারে কিন্তু টাকা-পয়সার মালিকানা দূর অস্ত, খরচ করলেও হিসেবের মধ্যে থাকতে হয়।

নারীর এই চলতি লড়াই শেষ পর্য্যন্ত একটা সংকীর্ণতায় পর্য্যবসিত হয়। পাশাপাশি সে এবং তার সাথে সম্পর্কিত মানুষদের আরাম ও অভ্যেস হারাম করে দেয়।

এগার—
পুরুষ যত পুরুষতন্ত্রের ফাঁদ পাতে নারীর জন্য সেই ফাঁদে সে নিজেও পড়ে যায়। নারীকে সোজা রাখার জন্য, অধিকারে রাখার জন্য, নমনীয় রাখার জন্য সে ধর্ম্মীয় বিধিবিধানের দোহাই দেয়, পাপের ভয় দেখায় এতে সাময়িক সুবিধা সে পায়, কিন্তু মুখরা, দুর্বিনীত নারীর জন্য কোন দোয়া, দাওয়া কিছুই কাজে আসে না। সে যত ঘরে থাকে তত নীচুতা তাকে ঘিরে থাকে, তত সে ক্রিটিকাল হয়। একপুরুষের মর্দ্দানি সইতে সইতে, তার স্তবগান গাইতে গাইতে, অভিনয় করতে করতে সে অভিনেত্রী হয়ে ওঠে। তাঁর কোন স্পেস নাই, পুরুষ বন্ধু নাই, শেয়ার করার কেউ নাই, তাকে মূল্যায়ন করার তৃতীয় চোখ নাই। নারীর সেই বহুগামী মন দিনের কিছু সময় পাগল হয়ে যায়, সেই পাগলাটে আচরণের আওয়াজ, সেই ক্ষ্যাপাটে বিক্ষোভের আঁচ পোহাতে হয় পুরুষকে।

গ্রামের এক লোক খুব বৌয়ের সাথে মর্দ্দানি দেখাইত, মৃদু গালমন্দের পাশাপাশি সে পিটাইত। একদিন বৌটা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে জামাইয়ের অণ্ডকোষ ধরে চাপ দেয় এতে করে পুরুষের শরীরের পুরো কন্ট্রোল পেয়ে যায়, একটু করে প্রেশার বাড়ায় আর পুরুষ তত মা গো, বাবা গো বলে চিৎকার দেয় আর বলে আমার চৌদ্দগোষ্টীর কসম এবারের মত ছাড় আর তোরে আর মারুম না।

পুরুষ যত তড়পায় অতদুর সে যেতে পারে না, তার সমস্ত ক্ষমতা হচ্ছে সম্পত্তির মালিকানায় আর আয়-রোজগারে। এইজন্য পুরুষ চায় না বৌ কাজ করুক, উপার্জ্জন করুক, সে বরং ঘর সামলাক, রান্না করুক আর বাচ্চা পয়দা করুক।

পুরুষের প্রতি পুরুষের সবচেয়ে প্রথম জ্ঞানী পরামর্শ হচ্ছে বিয়ের রাতেই বিড়াল মারতে হবে। সেই বিড়াল খুঁজতে খুঁজতে রাত অর্ধেক হলেও বিড়াল পাওয়া যায় না, আর মারব কী! সেই আপার হ্যাণ্ড নেওয়ার মোমেণ্ট অনেকে খুঁজে পায় না, পেলেও সেই ভাব নেওয়ার প্রসেসে অনেকে ঢুকতে চায় না। এটা অত্যন্ত গর্হিত রাজনীতি। যারা বিড়াল মেরে সংসার শুরু করে তাদের জীবন যায় বিড়ালের নখের আচঁড় খেতে খেতে।

দ্বিতীয় পরামর্শ; তেজী বৌ তোমার, তুমি তারে কয়েকটা বাচ্চা দাও দেখবা তেজ কই যায়।

বাচ্চা আনা মানে যে শুধু নারীর ব্যস্ততা বাড়ে তা কিন্তু না, পুরুষের ভরণপোষণ খরচ বেড়ে যায়, পেরেশানি বেড়ে যায়, দায়িত্বের জোয়ালে সে নিজেও যে শৃঙ্খলিত হয় সেটা মোটা মাথায় বুঝতে পারে না, ধীরে ধীরে সে বুঝে।

সে বুঝতে পারে সন্তান আসে মূলতঃ মায়ের হাড় মাংস শুষে নিয়ে, যৌবন, রুপ সবকিছু ধসিয়ে দিয়ে। পুরুষ তখন দেখে তার রমণী আর রমণীয় নাই, সে হয়ে গেছে ডাইনী।

সন্তান যেহেতু মায়ের ছায়ায়, মায়ায়, পিটানোর ওপর মানুষ হয়, সে মায়ের ন্যাওটা হয়, সৈনিক হয় সাধারণভাবেই। ওপরন্তু সমাজে প্রচলিত মাতৃভক্তির জয়গান, ধর্ম্মের বাণী আছে মায়ের ছায়া, দোয়ায় সন্তানের বেহেশত। যদিও মায়ের বেহেশতের যাবার কোন নিশ্চয়তা মা নিজেই দিতে পারে না।

আস্তে আস্তে সেই থেরাপী পুরুষের বিপক্ষে চলে যায় কেননা সন্তানেরা মায়ের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, মায়ের যে কোন অবমাননায়।

পারিবারিক গ্রুপিং য়ে মায়ের পক্ষে সাপোর্টার বেশী হয়, সেই রাজনীতিতে রাজার আসন টলে যায় একপর্য্যায়ে রাণী তখন শুষ্ক হলেও তিন কামড়ার ঘটী-বাটীর সংসারের রাজত্ব পায়।

নারীর এই সন্তান দিয়ে প্রতিশোধ নেয়া আর আধিপত্য শেষ হয় ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার পর সে হয় পরে অসহায়, দুঃস্থ।

পুরুষ অধিকতর মরণশীল, নিয়মে পুরুষ আগে মরে গেলে তার সব চলে যায়। চলে যায় সংসারের আধিপত্য, নিজ সম্পত্তি, টাকা ব্যবহার করার অধিকার। ছেলে বলে, তোমার কি লাগবে আমারে বল, আমি এনে দিব। ছেলের বৌ বলে, এত ঘুরতে যায়েন না, টিভি দেইখেন না, আল্লা বিল্লা করেন।

মেয়েলী লোভ শেষপর্য্যন্ত তাকে ঠেলে দেয় করুণ পরিস্থিতির দিকে। সে যা কিছুর মালিকানার জন্য নিজ স্বামীর মাথা খাইছে, চুড়ান্ত চাপ প্রয়োগ করে কিছু সম্পৎ (সম্পদ) হাতিয়েছে যে ভবিষ্যতের জন্য, সুরক্ষার জন্য সেই সম্পৎ (সম্পদ) তার থেকেও নেই। কেননা সে ব্যবহার করতে পারছে না টাকা, নামে থাকা সম্পৎ (সম্পদ)। বরং নানা প্রয়োজনে সন্তানকে দিতে হচ্ছে আর নিজেই ঢুকে যাচ্ছে বিধিনিষেধের গোল গন্ডীর ভেতরে।

নারী-পুরষের সম্পর্ক ব্যবসার চলমান রাজনীতির পুরুষতান্ত্রিক দিকগুলো বেশী ক্ষতিকর হয়েছে পুরুষের জন্য আর নারীকে দিয়েছে টিকে থাকার প্রানান্তকর, হীনতম লড়াই আর অপচেষ্টা।

বার—
একদিন চলে যাবো বৃদ্ধদের আবাসে …

একদিন এই সংসার থেকে অবসর নেব। যে জোয়াল কাধে নিয়েছিলাম মনোরম এক ধর্ম্ম হিসেবে, ইবাদত হিসেবে সেই জোয়াল ধীরে ধীরে চাপ বাড়াচ্ছে, ভারী হয়ে যাচ্ছে, কেড়ে নিচ্ছে আমার সৃষ্টিশীলতা, একাকিত্ব।

মধ্যরাতে শীতরাতের ডাক, আধখানা পংক্তির ইশারা এখন উপেক্ষা করতে হয়। কোন কোন মাঝরাতে যখন ঘুম আসে না, সেইসব রাত জেগে ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে কোথাও আর চলে যাওয়া যায় না, মফস্বলী কোন শহরে সন্ধ্যারাতে চা খাওয়া হয় না সদ্য পরিচিত কোন কবীর সাথে।

কার্তিকের জোৎস্নায় আর বসা হয় না বাউলের উলের সন্ধানে। দোল পূর্ণিমায় আর যাওয়া হয় না সামহিক ধ্যানের শক্তির উৎসবে। বাড়ী ভাড়া, মাসিক বাজার না করে আমি কোথাও যেতে পারি না, কেননা সেটা ধর্ম্মে সইবে না।

কোন পাহাড়ে পাহাড়ীদের সাথে পান করা যায় না চোলাই আর স্নিগ্ধতা, কেন না আমার পায়ে বেড়ী, মুখে মাস্ক। কোন টমেটো ক্ষেতের ধার দিয়ে যেতে যেতে আমি কামড়াতে পারি না সদ্য সবুজ টমেটো। আমার মুখ তোমার শপথ নিয়েছে। আমি বন্ধুদের পানের ডাক, ধোঁয়া ওঠা কফীর মগের প্রলোভন আমাকে এড়িয়ে যেতে হয়, কেননা আমি বেহেশতে যাব বিবির সাথে, পান করব হুরদের বাহুলগ্ন হয়ে।

আমি কোথাও যেতে পারি না একা, কেন না একাকিত্ব ঘোচানোর দাম দিয়ে কিনেছি লোহার সংসার।

পঞ্চাশে আমি বাণপ্রস্থে বা বনের দিকে যেতে পারি না, কেননা বন ইতিমধ্যে উজাড় হয়েছে, সংসার এখনো প্রস্তুত হয়নি। অনেকদিন নিজের কাছে বসা হয় না, নিজেকেই আমি হারিয়ে ফেলেছি মানুষের দঙ্গলে। নিজের কাছে ফেরার সব পথ ক্রমশঃ হারিয়ে ফেলছি। এখন যে সব চিন্তা আমাকে চালায়, জ্বালিয়ে রাখে সেইসব মন ভিন্ন ভিন্ন মানুষ হিসেবে নানা জায়গায় খেলে বেড়ায়, কেউ কবিতা লেখে, কেউ জীবিকার জন্য হাত কচলাতে কচলাতে হাতের রেখা মুছে ফেলে, কেউ বুড়া হতে থাকে এদের ভীড় ঠেলে আমি সামনে আসতে পারি না। সেইসব কন্ঠ অনেক জোড়ালো, উঁচু লয়ে বাধা।

আমি শেষবয়সে কোন মায়ার বিষঘেরা নীড়ের বদলে একটা বৃদ্ধদের আবাসে বসবাস করতে চাই। আমি কোন বাসার গ্যাস বিল, পানির বিল দিয়ে নাতীকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য নই। চলমান উৎসব থেকে ছিটকে কোনে পরে থাকার জন্য নই।

আমাকে কেউ ধুমপান ত্যাগের তাগিদ দিক সেটা আমি চাই না। আমি মির্জ্জা গালিব শুনতে শুনতে পান করে কাটাতে চাই শেষ বয়স।

শেষ বয়সে কেউ আমাকে ধর্ম্মালয় চেনাক সেটা আমি চাই না।

জীবনের শেষ কিছুদিন আমি তালাশ করতে চাই জীবনের রহস্য। উপলব্ধি করতে চাই, আমি এইখানে বেচেঁছিলাম, আমি কারো লিখিত চরিত্র নই যে লেখকের কলমের আচঁড়ে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে আর ব্যর্থ হয়েছে।

তের—
সকালে ঘুম ভেঙেছে ফোনের শব্দে, এত সকালে সাধারণত কেউ কল করে না। ধড়ফড় করে উঠে ফোন ধরতে ধরতে কল মিসড হয়ে গেল, কল ব্যাক করে একটা মৃত্যু সংবাদ শোনলাম। আমার এক বন্ধুর পিতা মারা গেছেন, যিনি বেশ সময় ধরে ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন, খাদ্যনালীর ক্যান্সার। ভয়াবহ এক ব্যাধি, যে ব্যাধির চিকিৎসা এখনো আবিষ্কার হয় নাই। অনেক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার হলেও ক্যান্সার রোগের চিকিৎসা নামে যেটা চলে সেটা হয়ত কিছু ব্যাথা কমায় কিন্তু রোগী দীর্ঘ শারীরিক মানসিক ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে যায়।

একটা ব্যায়বহুল চিকিৎসার পরিনাম যখন আগাম অনুমান করা যায় তখন সেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের মানুষদের একটা নৈতিক ক্রাইসিসে ফেলে দেয়। অনেকে ভেতরে ভেতরে ভাবে এই চিকিৎসা করিয়ে লাভ কী, বাঁচানোর আশা নেই কিন্তু যারা বেঁচে থাকবে তাদের অর্দ্ধেক মেরে যাবে অর্থনৈতিকভাবে।

যে মানুষটি মরে গিয়েছেন উনি ছোটখাট শরীরের স্নিগ্ধ মানুষ ছিলেন, পরিবার অন্তঃপ্রাণ ছিলেন। পান খেতেন জর্দা দিয়ে এটাই তার একমাত্র শখ ছিল। যখন শরীর খারাপ হতে শুরু করে উনি সেটাও ছেড়ে দিয়েছিলেন। রোগাক্রান্ত হওয়ার পর দেখতাম পুরো পরিবার উনাকে ঘিরে থাকত, প্রতিটী প্রয়োজনে, অসুবিধায় এগিয়ে আসত। নিঃসন্দেহে মানুষ হিসেবে এটা তাঁর সেরা অর্জ্জন পরিবারকে একসুতায় গেঁথে রাখতে পারা। উনার শান্তি কামনা করি।

আমার বাবা যখন মারা যায় তখন শোকের অভিব্যাক্তি ফুটিয়ে তোলার জন্য যথেষ্ট বয়স আমার হয়নি। বাবা মারা যাওয়া ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার পর দুয়ারে খাটিয়ার ওপর পড়ে থাকা নিথর মুখটা দেখে। সেদিন জোৎস্না ছিল খুব ফকফকা, আমার মায়ের উন্মাদের মত বিলাপ আর এক ফুপুর আহাজারিতে ভারী হওয়া পরিবেশ আমাকে এই বোধ দেয় যে বাবা আর ফিরবে না দেহে, উঠে দাঁড়াবে না, আমার হাত ধরে আর হাঁটবে না বাজারের দিকে। পাকা চুল তুলে দেওয়ার বিনিময়ে চুল প্রতি দশ পয়সা আমাকে আর কেউ দেবে না।

কেন জানি আমি কাদঁতে পারিনি ঠিকঠাক। আমার দিকে সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল, কেউ কেউ বিষ নযরে দেখছিল। আমি ছিলাম অসহায় সেই প্রেশারে, আমি কি করে দেখাই এই শোক, কান্না দিয়ে ফুরানোর নয়, এই শোক এক ক্ষতি, যেই ক্ষতি আমি এখনো বয়ে বেড়াই।

এখনো সেই জড়তা আমি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। কেউ মারা গেলে আমি ঠিকঠাক শোক জানাতে পারি না, শান্তনা দিতে পারি না। কোন ভাষা আমি পাই না সহমর্ম্মিতার।

এক অর্থে আমরা সবাই মরেই আছি জন্মানোর সাথে সাথেই, মৃত্যু হয়েই আছে, যে কোন সময় শুধু ঘটে যাবে একটা রুপান্তর।

এটাই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যেটা সম্পর্কে সার্ত্রে বলেছেন, মহাশক্তির আস্বাদন। একমাত্র মৃত্যুই হয়ত পারে জীবনের রহস্য উন্মোচন করতে, সত্য উপলব্ধি করাতে, চুড়ান্ত মোক্ষ দিতে।

দেহভার বিমুক্ত হলে হয়ত জীবনের যন্ত্রণার ইতি ঘটবে; এইসব জরা, ব্যাধি তীব্র মনস্তাপ থেকে মুক্তি মিলবে। (“জন্মলাভকারী সবকিছুই যন্ত্রণাময়। কেন এটা এমন এসব জিজ্ঞাসা করে কোন লাভ নেই। এটা এমনই।” — ইউজি কৃষ্ণমূর্তি)

চোদ্দ—
আমার নরকে আমাকে যেতে দিন …

দয়া করে আমার নরক আমাকে বানাতে দিন, সেই নরকে যাওয়ার পথ তৈরী করতে দিন, সেখানে যাওয়ার জন্য পোষাক পরতে দিন। নরকে যাওয়ার পথে আমার যাত্রা নির্বিঘ্ন রাখুন। আপনার সারমন, সুসমাচার, তারিখ আপনার হেফাজতে রাখুন।

তার আগে বর্ত্তমান নরকের মায়া কাটিয়ে উঠতে দিন। এখানে আমার পরিবারের মানুষেরা থাকে, তারা আমার ভাই হয়, কেউ বইন লাগে, কেউ আমার বৌ লাগে, এদের ঘন হয়ে থাকা আত্মার শ্বাসে, বিষবাতাসে টিকে থাকতে দিন।

এই পরিমণ্ডলের বাইরে আমার স্বল্প আপন কিছু মানুষ আছে এদের আমরা বন্ধু বলি, আত্মার সাথী বলি যাদের সাথে মতের অমিল আছে, মতের বিরোধ আছে। কেউ বাম আছে, কেউ ডান আছে। বিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর আছে কেউ, কেউ লালনপন্থায় আছে কেউবা নিজপন্থী। এদের সাথে কম মাখামাখি, বেশী মাখামাখির সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্কে উত্তাপ আছে, ক্ষোভ আছে, প্রতিশোধ আছে, সেইগুলি মিটমাট করে যেতে দিন।

এই নরকে কোন কোন যায়গায় আমার যাওয়া হয়নি, যেমন কিছু পাহাড়, জংলা বা নীলনদ। এই নরকের দুবাই বা রজনীশপুরমে আমার যাওয়া হয়নি। সেখানে একটু ঘুরে আসতে হবে।

অনেক অমল কিশোরী, তিলোত্তমা ফুলেদের আঁচল খুলে দেখা হয়নি, পোহাইনি তাদের সোনারঙ। কোন নারীর উত্তাপে শীত পোহাতে পোহাতে পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলাম হাত, সেই হাত আজও অক্ষত আছে, হাত এখনো অপেক্ষায় আছে পুরবে বলে।

এই গ্রহের অনেক স্তরের নরকে আমার পুড়ে অভ্যাস আছে, আমাকে আর নরকের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। বোধ হওয়ার পর থেকেই দেখে আসছি দেশের মসনদে আছে কবী, সন্ত্রাসী আর অথর্ব্ব একনায়কেরা। তাদের ঝাঝালো শাসনে আর শোষণে পুড়ছে দেশ।

পরিবারের শাসনভার নিয়েছে একনায়ক বাবা অথবা মা, তাদের নির্ব্বোধ কমাণ্ডমেণ্টে পীড়িত হচ্ছে, দলিত হচ্ছে সন্তানেরা।

ধর্ম্মগ্রন্থ অগ্রাহ্য করে প্রেমিকা নিয়েছে প্রেমিককে শাসনের ভার। প্রতিটী প্রেমিক গ্রহীতার মত নতজানু থাকে প্রেমিকার কাছে, যেন কালীর পায়ের নীচে শিব।

নতজানু হয়েছি চাকরিদাতার সামনে, অবমাননার চাবুকের ঘায়ে ঘায়ে পিঠ কাল হয়েছে তবু সয়ে থেকেছি ক্ষুধার আগুন নিয়মিত নেভাতে হয় বলে। ক্ষুধার চাইতে বড় আগুন আমি চিনিনি, পেটের চাইতে বড় হাবিয়া দোযখকে আমার মামুলী মনে হয়।

পেটের ওপরে আছে এক অনুভুতির কেন্দ্র যাকে অনেকে হৃৎমাঝার বলে। সেখানে এক প্রবল গর্ত হয়ে আছে, সেখানে শুধু স্নেহ, স্নিগ্ধতা আর ভালবাসার জন্য হাহাকার। সেখানে আমৃত্যু মনন্তর, জীবনের পর্ব্বে পর্ব্বে তার মনোযোগ লাগে, যত্ন লাগে, ভালবাসার হাতের স্পর্শ লাগে, না পেলে সেখান থেকে কান্না আসে, অর্থহীনতার বোধ তৈরী হয়।

আমাকে নরক থেকে বাচাঁনোর জন্য কোন ত্বরিকার প্রয়োজন নেই। নরক আমার সয়ে গেছে, যেমন সয়ে গেছে বাংলাদেশ, যেমন সহনীয় হয়েছ তুমি ও ব্যর্থতা।

আমাকে আমার নরক বানাতে দিন, আমার নরকে আমাকে যেতে দিন, দেখি সেই নরকে দুঃখ কতটা পুড়ে।

পনের—
পকেটের পরিস্থিতি খারাপ থাকলেই আমি খারাপ বোধ করি সবচেয়ে বেশী। কোন ঘটনা, দুর্ঘটনা, মান-অপমান আমাকে নুইয়ে ফেলতে পারে না বরং টাকা-পয়সার যোগান এসবকিছুকে মোকাবিলা করার শক্তি দেয়।

টাকার গুরুত্ব বুঝে উঠতে আমার সময় লেগেছে, বুঝে উঠলেও সবসময় সেই সংকট থেকে বের হওয়া যায় সেরকমও না। একসময় বন্ধুরা পরিত্যাগ করলে, প্রেমে বিচ্ছেদ ঘটলে মরে যেতে ইচ্ছে করত, নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে চাইতাম। সেই পর্ব্ব আমি পেরিয়ে এসেছি, সেই না বোঝার কালকে আমি এখন ব্যখ্যা করতে পারি।

অস্তিত্ব যখন নিজ বোঝাপড়ার ওপর না দাঁড়ায় তখন সে অপরের মুখাপেক্ষী থাকে, নিজের সুখের জন্য সে অপরের ওপর, অপরের মনোযোগের ওপর, অপরের শক্তির ওপর নির্ভর করে। সেই নির্ভরতা, করুণার জন্য সে নিজের ওপর নির্ভর করতে পারে না, বড় বা পরিণত হতে শিখে না। মায়া, মমতা আর ভালবাসা হয়ে যায় ক্রাচ।

যখন মানুষের এইসব ক্রাচ সরে যেতে শুরু করে তখন সে আত্মশক্তির সন্ধান পাওয়া শুরু করে, মনের শক্তির উন্মোচন শুরু হয় সেই সময়। এইজন্য কোন দার্শনিক বলেছিলেন, বিপদে বাঁচ, প্রতিভা বিকশিত হবে, বেঁচে উঠার প্রাণশক্তির উদ্বোধন হবে। আদতে তাই হয়।

মানুষের টিকে থাকতে টাকা লাগে, টাকাই তাঁর অবস্থা, অবস্থানকে সুসংহত করে। টাকাওয়ালা মানুষ খরচ বা সাহায্য করার ব্যাপারে সঙ্কুচিত হলেও মানুষ তাকে গোনায় ধরে, আমলে নেয়। মনে করা হায় সে ঐশী রহমত প্রাপ্ত, ভাগ্য তাকে নিয়ে এসেছে যেমন এখনো মনে করা হয় রাষ্ট্র ক্ষমতায় কে বা করা থাকবে সেটা খোদায়ী নির্ব্বাচনের বিষয়।

তবু মানুষ বিধির বিধান মানতে পারে না, নিজ অবস্থা ফেরানোর জন্য ভুতের মত খাটে, ব্যর্থ হলে অন্যকে দোষারোপ করে। বস্তুত টাকার অভাবই মানুষকে দুমড়ে দেয়। কোন প্রেমে ব্যর্থতা, প্রিয়জন বিচ্ছেদ, পারিবারিক অবহেলা প্রভাব ফেলে, মানুষকে নুইয়ে দিতে পারে কিন্তু ভেঙে ফেলতে পারে না। সবকিছুই পুনঃপ্রতিষ্ঠা পেতে পারে আর্থিক অবস্থা শক্ত থাকলে। নিজেকে না খুঁজলে, না খোচালে নিজ এসে কখনো কাউকে ডাকে না। নিজ সীমাবদ্ধতা না বুঝতে পারলে সেটা থেকে উৎরানো যায় না।

টাকা-পয়সা ইনকামের জন্য সবসময় মেধাই সব নয়, থাকতে হয় নিজের ওপর বিশ্বাস, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস ও ইতিবাচক মানসিকতা। নীতি নৈতিকতা, ধর্ম্মীয় বিধিবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে থাকলে মনের মধ্যে দ্বন্দ তৈরী হয়, টাকা কামানো তখন দুরবর্ত্তী হয়ে যায়। আপনি যে বিশ্বব্যবস্থার ভিতর আছেন সেখানে সততার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আপনাকে পিছিয়ে দেবে।

যেনতেন প্রকারে টাকা কামানোকে যদি নিজের সাথে মানিয়ে নিতে না পারেন সেক্ষেত্রে আপনাকে পরমের ইচ্ছাই সব, সে যেভাবে রেখেছে সেভাবেই সুখী হতে পারেন।

আমার লেখালেখিতে যত নৈরাজ্য, নিরাশা আর নৈতিকতা প্রকাশিত হয় সবকিছু তত বেশী ব্যাক্তিগত নয়। গভীর দুঃখ, বেদনা বেশী দিন ভেতরে থাকলে সেগুলো একসময় কমজোরী কবিতা হয়ে উড়ে যায়। আমি সেগুলো পালন করি না, জোর করে বিদায় করতে চাই না। অত গভীর বেদনার মধ্যে দিয়ে গেলে কবে একটা মহাকাব্যিক সুইসাইড করে ফেলতাম!

জীবনকে প্রতি পলে উপভোগ করি এবং প্রতিদিন ঘুম থেকে জেগে ওঠাকে বিস্ময়কর, আনন্দদায়ক মনে করি। শুধু পকেটের স্বাস্থ্য, শারীরিক স্বাস্থ্য খারাপ থাকলে পৃথিবীটাকে মনে হয় কারাগার, শরীরকে মনে হয় বহন অযোগ্য, বেদনাদায়ক বোঝা।

ট্যাহা, তোমায় প্রণতি করি…

ষোল—
মেয়েরা সাধারণত রিলাক্সড থাকে না …

মেয়েরা ঘরে বাইরে কোথাও রিলাক্স থাকে না। মেয়েরা যখন বাসে ওঠে দুরবর্ত্তী যাত্রায় বা স্বল্প দুরের যাত্রায় কখনো তারা ঘুমায় না, তাদের জেগে থাকতে হয়, নিজ ও শরীর পাহারা দেওয়ার জন্য, তাহাদের ঘুম বেমানান বলে। পুরুষ ঘুমিয়ে পড়তে পারে, লালা ফেলতে পারে, পাশের যাত্রীর ওপর ঢলে পড়তে পারে কারণ তাদের শরীরের কোন কিছু খোয়া যায় না।

নারীদের গায়ে স্পর্শ লাগলেই তাদের অনেক কিছু খোয়া যায়, তারা অবলীলায় লুট হয়ে যায়, তাদের কিছু সম্পৎ (সম্পদ) খরচ হয়ে যায় পুরুষ স্পর্শে। এইজন্য তারা বাস থেকে নামার সময় সতর্ক থাকে কেননা স্পর্শ বাঁচিয়ে তাদের নামতে হয়। তারা যখন মার্কেটে যায় ভীড়ের মধ্যে পুরুষের হাত শনাক্ত করার জন্য সজাগ থাকতে হয়।

নারীর গাঁ বাঁচিয়ে চলার শরীরী ভাষা পুরুষের চোখে তাকে লোভনীয় করে।

মেয়েরা ঘন ঘন চুল ঠিক করে, ঠিক করার জন্য বাহু তোলে তখন তাদের বুক স্ফীত হয়, মনোহর হয়ে থাকে এই কাজটা তারা পুরুষের সামনে বেশী করে।

মেয়েরা ঘন ঘন ওড়না টানে, ঠিক করে। যথাস্থানে ওড়না রাখতে গিয়ে ‘সুস্মিতার সবুজ ওড়না উড়ে যায়’। একদিক ঢাকতে গিয়ে অন্যবুক উন্মোচিত হয়ে যায় সেটা ঠিক করতে যেয়ে আরও সে নজরে পড়ে বা পড়তে চায়।

মেয়েরা ওড়না কেন পরে, বুক থাকা কি দোষনীয় কিছু! আমি ছোটবেলায় ওরকম ভাবতাম।

স্তন থাকা দোষনীয় নয় কিন্তু সেটাকে গুরুতর ভাবে উপস্থাপনে আশপাশের ইমান নষ্ট হওয়ার আশংকা তৈরী হয়। বক্ষ বন্ধনীর উৎপাদন, বক্ষবন্দনা, বিজ্ঞাপনের প্রচারে স্তন হয়ে ওঠেছে জীবনের প্রতিতী। রবীন্দ্রনাথ থেকে শামসুর রাহমান স্তন ছাড়া, স্তন বন্দনা ছাড়া কাব্য করতে পারেন না। এতে করে নারী বাধ্য হয়েছে শরীরের এক অপরিহার্য্য অংশকে লুকিয়ে রাখতে, অতিযত্ন করতে এবং সেটাকে কাজে লাগাতে। তাইতো তাদের স্তন ঝুলে যাওয়াকে মনে করে সবশেষ হয়ে যাওয়া, তার পুরুষকে অভিযুক্ত করে তার সব শেষ করে দেওয়ার জন্য।

পুরুষ নারীর কোল থেকে বাচ্চা নেওয়ার সময় অতিসতর্ক হয় বুককে স্পর্শ থেকে বাঁচানোর জন্য। এই তৎপড়তা নারীকে, তার বুককে লোভনীয় করে তোলে হয়ত।

আমি যতগুলো নারীর সাথে ঘুরতে বেরিয়েছি সারাদিনের জন্য, তাদের কাউকে কোনদিন ওয়াশরুম খুঁজতে দেখিনি। তাদের কি প্রস্রাবের বেগ হয় না, হয় কিন্তু চেপে যায়। সারাটা সময় তারা স্বতঃস্ফূর্ত্ত থাকে না, আরাম করে উপভোগ করে না খাবার, হাতে হাত রাখা, চুমু বা সিনেমা হলের আলো আঁধারীতে অজান্তে ঘন হয়ে যাওয়া। এতে করে তাদের আক্রান্ত হতে দেখা যায় প্রস্রাবের ইনফেকশন সহ নানা যন্ত্রনাদায়ক ব্যাধিতে।

গরমের দিনে তারা সেদ্ধ হয় অতিরিক্ত পোষাকের চাপে। পুরুষ সেখানে আদুল গায়ে, উদ্ভট ভুড়ী ভাসিয়ে দিনভর ঘর বাহির করে।

মেয়েদের প্রচণ্ড গরমে বাপ ভাইয়ের উপস্থিতি মাথায় রেখে পোষাকে পুরে থাকতে হয়, পুড়তে হয় গরমে। একটু হালকা, খোলামেলা পোষাক পরতে পারে না, কেননা সমস্যা হচ্ছে তার শরীর আর ঝুলে থাকা ঠাণ্ডা গোশত।

মেয়েরা যত তার শরীরের, রুপের ব্যাপারে সজাগ হয়, সচেতন হয় তত সে স্বাভাবিকতা থেকে সরে যায়। তার সাথে পুরুষের খুব আকাশ পাতাল ফারাক তেমন নয় কিন্তু।

তবু তারা শাড়ী পরে, শাড়ীর সাথে পায়ের নখ পর্য্যন্ত ম্যাচিং করে আর জনমানুষের স্বাভাবিক স্রোত থেকে দূরে সরে যায়। মানুষ হওয়া থেকে দূরে সরে যায়, যৌন-আবেদনের প্যাকেজ, আইটেম হয়ে উঠতে থাকে।

শুধুই পুরুষতান্ত্রিক সমস্যার কারণে মেয়েরা চেপে থাকে, চাপে থাকে সেরকম না। মেয়েরা ভজে গেছে পুরুষের স্তুতিতে, পূজায় আর সহজ জীবিকায়। শুধুমাত্র শরীর, শরীরের ভাষা আর গার্হস্থ্য বিদ্যা রপ্ত করে মিলছে মনোযোগ, কেয়ার আর রুটী রোজগার।

এই সহজিয়া প্রতারক সরলতার ফাঁদে ধরা দেওয়ায় মেয়েরা মেয়ে হয়ে ওঠে, নারী হয়ে ওঠে। শেষপর্য্যন্ত তারা রিলাক্স হতে পারে না।

 

 

রাসেল রহমান
জন্ম: ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪।
(জন্ম ও বেড়ে ওঠার কিছু অংশ টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। বাকী অংশ ডেমরা আহমেদ বাওয়ানী টেক্সটাইল মিল কোয়ার্টারে।)
প্রকাশিত গ্রন্থ (অনুবাদ):
১. মন্ত্র of Life, রোদেলা (২০১০)
২. ভগবানের সাথে কথোপকথন, রোদেলা (২০১১)
৩. নিজস্ব নির্জনপথ, রোদেলা (২০১৭)
৪. নিজ সত্তার সাথে একীভূত হও, রোদেলা (২০১৭)
শখ: পড়া, মানুষ দেখা, নিজেরে পর্য্যবেক্ষণে রাখা। গান গাওয়া, গান শোনা।

প্রচ্ছদ: মেহেরাজ হাসান শিশির

{সকালের ডায়েরী [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভব) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার