কর্ম কন্যা // আলী এহসান

0

আলী এহসানের গল্পঃ কর্ম কন্যা

আমার শ্বাশুড়ির দরকার নাই! কাজের বুয়া চাই; কাজের বুয়া। বুঝতে পেরেছো?
বুঝে কি করবো? বয়স একটু নাজুক হলেইতো তোমাকে আবার সতীনের ভয় তাড়া করে!
ওসব কবর চাপা দাও! এখন এই নবাবের বেটীকে বিদেয় করো প্লিজ!
কাজের মেয়ে নিয়ে জামী মহাবিপাকে। ক’দিন পরপরই এক ধান্দা। এখানে যাও। ওখানে খোঁজো। যত্তেসব! ইচ্ছে করে সব ছেড়ে ছুঁড়ে একতারা হাতে নিরুদ্দেশ হতে।
মতির মা থাকতে সমস্যা হয়নি। তারপর থেকেই ঝামেলার শুরু। তার রেখে যাওয়া মেয়েটিও ভালো ছিলো। বিয়ে থা হয়নি। দেখতে সুশ্রী। চটপটে। কিছু বলতে হতো না। নিজের উদ্যোগেই সামলেছে সব। কাজ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আপত্তি তার চলন-বলনে। ওর ঠোঁটের সহজাত হাসি, চোখের নাচন, শরীরের কাঁপন মিতার পছন্দ নয়। সে ভবিষ্যত ভেবে শঙ্কিত। কেলেঙ্কারির ভয়ে সন্ত্রস্ত। কখন কোন অঘটন ঘটে যায় কে জানে? সুতরাং মাস না পেরোতেই মেয়েটিকে বিদেয় নিতে হয়। এরপর আরো তিন তিন জন। চেষ্টার কাঠখড় পুড়িয়ে সে একেক জনকে যোগাড় করে, ক’দিন যেতে না যেতেই মিতা তাদের নট করে দেয় ।

উপায়ান্তর না দেখে দেশের বাড়ি থেকে গ্রাম সম্পর্কের এক কাকীকে নিয়ে এসেছে । যাক । এবার চিন্তা মুক্ত । চেনা মানুষ, আপনজন । পড়তি বয়স হলেও স্বাস্থ্য অটুট । সারা জীবন ঘর-গেরস্তির জোয়াল টেনেছেন । কোমরে আঁচল গুঁজে । পদ্মার ভাঙনে সব হারিয়ে এ বাড়ি – ও বাড়ি খুঁটে খেতেন । এখন একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়েছেন । খাওয়া-পড়ার ভাবনা ঘুঁচেছে । অপরদিকে কাজের লোকের সাথে জামীও পেয়েছে গুরুজন । সংসার আগলে রাখার বিশ্বস্ত স্বজন । সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ।

কিন্তু সময় হাঁটেনা আকাঙ্ক্ষার পথে । পরিকল্পনার নির্দিষ্ট ছকে ।
পনেরো দিনের মধ্যেই কাকী ওদের জীবন ঝুলিয়ে দেন বাঁশের ডগায় । তর্জনীর শাসনে ডান-বাম করান মর্জির খেয়ালে । কাজের চেয়ে হুকুম চালাতেই বেশি তৎপর । তার উপর এটা খান না । ওটা অপছন্দ । তরকারিতে তেল-ঝাল দ্বন্দ্ব । এমনি হাজারো অনুযোগে ঘরের আবহাওয়া তাঁতিয়ে রাখেন সর্বক্ষণ ।
ওরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনই চাকরি করে । মিতা দুপুরের খাবার সাথে নিয়ে যায় । জামীর অফিস কাছেই । লাঞ্চ করে বাসায় । প্রতিদিনের মতো আজও এসেছে । কলিং বেল চাপছে অনেকক্ষণ । কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই । চুপচাপ । একদম নিথর । এ সময় সে খেতে আসবে তা কাকী ভালো করেই জানেন । তাহলে? দরজা খুলছেনা কেনো? তবে কি ঘুমিয়ে পড়েছেন? এটাও যুক্তির সমর্থন পায় না । কোন দুর্ঘটনা? তার ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে । আকাশ-পাতাল ভাবতে থাকে অনিশ্চিত আশঙ্ক্ষায় ।

চোখে-মুখে চরম অসন্তুষ্টি নিয়ে অবশেষে দরজা খোলেন কাকী । জামী অসহিষ্ণু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে;
কি ব্যাপার? এতো দেরি হলো কেনো?
শরীলডায় তেমন জুইত পাইতাছিনা ।

জামী কোনো মন্তব্য না করে ডাইনিং রুমের দিকে এগোয় । পেছন থেকে কাকী বলেন;
অহনো রান্না চড়াই নাই । সকালের ভাত আছে । পেঁয়াজ কাইট্টা একটা ডিম ভাইজা লও ।

কথা শুনে জামীরের মেজাজে আগুন ধরে যায় । ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকায় পেছনে । কিন্তু কাকী তার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় নেই । তিনি রিমোট হাতে সোফায় বসে । মনোযোগ টিভির পর্দায় । কড়া একটা ধমক দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় । বয়স্কা মানুষ । কিছু বললে গ্রামে দুর্নাম রটবে । মিতার সমস্যা তার চেয়েও স্পর্শকাতর । শ্বাশুড়ি বলে কথা ! জামী বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে । জামা খুলে কিচেনে ঢোকে । অন্তরে অসহায় আক্ষেপ ।

ফলে যা হবার তাই । হাত পুড়িয়ে সে এখন ব্যাণ্ডেজ নিয়ে বসে আছে। মিতা ঘরে ফিরে স্বামীর অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠে । কারণ জেনে ধারণ করে রুদ্র মূর্তি । আজ একটা হেস্ত-ন্যস্ত করেই ছাড়বে । কিন্তু স্বামীর প্রবল বাধায় পিছু হঠতে বাধ্য হয় । ক্ষোভে-দুঃখে সশব্দে বন্ধ করে বেড রুমের দরজা । কাঁদতে থাকে বিছানায় লুটিয়ে ।

>০<

অফিস ছুটির পর রিকশায় টার্মিনাল । নৌকোয় পার হয় শীতলক্ষ্যা । যে করেই হোক আজ তাকে কাজের বুয়া নিয়ে ফিরতেই হবে । এরমধ্যে ছোট ভাইকে আনিয়ে কাকীকে পাঠিয়ে দিয়েছে দেশে । কিন্তু কাজের লোক ছাড়া ওদের চলবে কি করে । সকালে দু’জন ছুটে অফিসে । ছেলে স্কুলে । বাচ্চা মেয়েটাকে দেখা-শুনার জন্য কারো না কারো বাসায় থাকা জরুরি । মিতা অফিস ছুটি নিয়ে পাহারা দেবে আর কদ্দিন?

নৌকো থেকে নেমে জামী যাত্রী ছাউনির দিকে হাঁটে । ওখানে অপেক্ষা করছে কামাল । সে-ই নতুন মেয়ের খোঁজ এনেছে । এখন তাকে আনতে যাচ্ছে । বন্ধুকে দেখে কামাল হাত উঁচায় । উষ্ণ হাসে । দু’জন গিয়ে বসে চায়ের স্টলে । চা-সমুচা খায় । খুচরো গল্প করে । এক সময় উঠে দাঁড়ায় কামাল । বলে, চলো এবার যাওয়া যাক ।
জামী নিঃশব্দে বন্ধুর পিছু নেয় ।
ঘাটে প্রায় শ’খানেক রিকশা । সার বেঁধে যাত্রীর অপেক্ষায় । কিন্তু যেই জিজ্ঞেস করছে, নবীগঞ্জ যাবে?
না ।
বন্দর বাসস্ট্যান্ড?
না ।
চিতাশাল?
না ।
মদনগঞ্জ?
না ।
তাহলে কোথায় যাবে?
নিরুত্তর ।
যাত্রীসাধারণ রিকশাঅলাদের সম্মতি আদায়ে জোর চেষ্টা করছে । দূরে । মাঝারি দূরত্বের কোথাও । ড্রাইভাররা পছন্দ হলে যাত্রী নিচ্ছে । নয়তো প্রত্যাখ্যান করছে অবজ্ঞায় । সীটে বসে পা নাচাচ্ছে । দর-দামে টিটকেরি করেছে । অন্যদের মতো কামালও গন্তব্য জানিয়ে চালকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে; এ্যাই রিকশা কল্যান্দী যাবে?….কল্যান্দী?
যামু ।
কতো?
চল্লিশ টাকা ।
বলো কি? বিশ টাকার ভাড়া চল্লিশ টাকা! পঁচিশ টাকায় যাবে?
না ।
আটাশ? রিকশা চালক মুখ ফিরিয়ে নেয় । শেষ পর্যন্ত পয়ত্রিশ টাকায় রফা হয় । কামাল বাতাসে ক্ষোভ ঝাড়ে-
রিকশাঅলা, কাঠ মিস্ত্রী, রাজ ওস্তাগর নিজেরাই নিজেদের মজুরি বাড়িয়ে নিয়েছে। বাড়িঅলা বাড়ি ভাড়া । ব্যবসায়ীরা লাভ । আমরা শালার চাকরিজীবিরা পড়েছি গ্যাঁড়াকলে ।
ঠিকই বলেছো । এদিকে প্রতিদিন জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে ।
প্রসঙ্গ পেয়ে জমে ওঠে আলাপ । পিচঢালা পথে দ্রুত গড়াচ্ছে তিন চাকা ।

>০<

স্কুলের সামনে এসে ওরা রিকশা ছেড়ে দেয় । পায়ে হেঁটে গ্রামে ঢোকে । কয়েক বাড়ি পেরিয়ে এক দো’চালার সামনে দাঁড়ায় । কামালের হাঁক-ডাকে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে এক প্রৌঢ়া । কামাল তাকে উদ্দেশ্য করে বলে- এই যে নিপার মা! তোমার মেয়েকে নিতে এসেছি । জলদি রেডি করে দাও । তারপর জামীকে দেখিয়ে বলে-
এই সাহেবের বাসাতেই কাজ করবে । খাওয়া-পড়ার কোন অভাব হবে না । তার উপর বেতনের টাকাতো আছেই ।
অরতো বিয়া ঠিক অইয়্যা গ্যাছে ।
বলো কি? কামালের কণ্ঠে অবিশ্বাস । দীর্ঘশ্বাস ফেলে জামী । অন্তরে হতাশার বজ্রপাত । কামাল অর্থহীন বিড় বিড় করে-
গত পরশু না কথা ফাইনাল হলো?
আইয়ে কাইল পান-চিনি ।
যত্তোসব! এখনো বাল্য বিয়ে ।
কামাল বন্ধুকে নিয়ে পাশের গ্রামে যায় । এ বাড়ি-ওবাড়ি ঘোরে। কথা বলে পরিচিতদের সাথে । এ পল্লীর চিত্র ভিন্ন । এখানে পাঁচ বছরের বালিকা থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা পর্যন্ত সকলেই কর্মজীবি । তারা সকাল-সন্ধ্যা কাজ করে । ফুল তোলে । মালা গাঁথে । পুরো এলাকাজুড়ে কাঠ মালতীর চাষ । একেকজন গাছ থেকে ফুল তুলে একশ মালা গাঁথলে মজুরি পায় চল্লিশ টাকা । এসব মালা ট্রাকে করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট- দেশের বড়ো বড়ো শহরে যায় । ওরা সারাদিন পরিশ্রম করে রোজগার করতে পারে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা । ব্যবসায়ীদের মুনাফার তুলনায় এদের পারিশ্রমিক খুবই সামান্য । এরই মধ্যে মজুরি বৃদ্ধির জন্য ওরা সমিতি করে আন্দোলনে নেমেছিলো জোট বেঁধে । ফুল তোলা, মালা গাঁথা বন্ধ রেখেছিলো পাঁচ দিন । সংগ্রাম বৃথা যায়নি । ছিনিয়ে এনেছে বিজয় । একশ প্রতি মজুরি বাড়াতে পেরেছে পাঁচ টাকা করে । এখানে সবাই ফুল শ্রমিক । কাজের বুয়া পাবে কোত্থেকে?
ধ্যাৎ! বিকেলটাই মাটি হলো । কামাল নিজেকে অপরাধী ভাবছে । কাজের মেয়ে ঠিকঠাক করেই সে জামীকে মোবাইল করেছে । কিন্তু রাতারাতি ওর বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে কে জানতো? এরপর শুধু ঘুরোঘুরি । কাজের কাজ হলো না কিছুই । জামী ওকে কি ভাববে? বেচারা বড়ো আশা নিয়ে এসেছে ।
ফিরতি পথে ওরা চৌরাস্তার দিকে হাঁটে । পথে কামালের সহপাঠী রকিবের সাথে দেখা ।
কিরে! এদিকে কোত্থেকে?
আর বলিসনা! গোটা তল্লাট চক্কর দিয়ে একেবারে পেরেশান ।
কেনো? কী ব্যাপার?
কাজের মেয়ের খোঁজে বেরিয়েছি । কামাল বন্ধুকে সব খুলে বলে । জামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় । সব শুনে রকিব মন্তব্য করে-
কাজের মেয়ে পাওয়া এখন টাফ ব্যাপার । তারপর মাথা চুলকে বলে-
একটা মেয়ে অবশ্য ব্যবস্থা করা যায়..
তাহলে খুবই উপকার হবে দোস্ত ।
মেয়েটার বয়স বারো তেরো । বড়ো অসহায় ।
অসহায় নাহলে কি কেউ শখ করে ঝি-চাকরের কাজ করে?
কিন্তু..
আবার কিন্তু কীসের? কামালের অধৈর্য উচ্চারণ । জামীর মনে আশঙ্কা আড়মোড়া । রকিব বিমর্ষ কণ্ঠে বলেঃ মেয়েটা ধর্ষিতা ।
ধর্ষিতা । দু’বন্ধু আঁতকে ওঠে। মনে ধাক্কা খায় প্রচণ্ড । পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। রকিব বিষণ্ন সুরে বলেঃ ‘মাস দুয়েক আগের ঘটনা। এক দুপুরে মেয়েটির মা ওকে তালুকদার বাড়িতে পাঠিয়েছিলো চাল ধার করতে । তালুকদার গিন্নী তখন ঘরে ছিলো না । সে সুযোগে খালি ঘরে একা পেয়ে মধ্যবয়সী গৃহকর্তা মেয়েটিকে ধর্ষণ করে । এ নিয়ে প্রথমে কতো হই-চই । হাসপাতাল, থানা-পুলিশ, স্থানীয় পত্রিকায়ও কদিন খুব লেখালেখি হয়েছে ।’
তারপর?
প্রভাবশালীদের বিপরীতে গরীবদের যা হয় । ডাক্তারি রিপোর্ট উল্টো আসে । কেঁচে যায় মামলা । এরপর বিপদ আরো বেড়েছে । এখন মেয়েটি বাইরে বেরোতে পারেনা । বখাটেরা উত্যক্ত করে । সুযোগ খুঁজে । রাত-বিরেতে ঢিল পড়ে ঘরের চালে । ওর নিরাপত্তার জন্যেই একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রয় দরকার । যা পরিবারটির সামর্থের বাইরে ।
একাত্তরের বীরাঙ্গনাদেরকেই এদেশ মর্যাদা দিতে পারেনি । আত্মীয়রা আশ্রয় দেয়নি । সম্পর্ক অস্বীকার করেছে । আর এটাতো মামুলি ঘটনা ।
আপত্তি না থাকলে ওকে নিয়ে যেতে পারেন ।
এছাড়া উপায় কি? আর কাউকে তো পাচ্ছি না ।
কোনো সমস্যা নেই । ঘটনাটা গোপন রাখলেই হলো ।
তাহলে চলো যাওয়া যাক ।
চলো ।
বাসায় ফিরছে রিক্সায় । পাশে জড়োসরো আকলিমা । জামী খুবই উৎফুল্ল । ঠোঁটে বিজয়ের হাসি । তাকে ব্যর্থতার আঙ্গুল চুষতে হয়নি । শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেছে তার আরাধ্য কর্মকন্যা । সংসার সচল রাখার মূখ্য উপকরণ । আর মেয়েটি? সে পেতে যাচ্ছে একটি নিরাপদ আশ্রয় । নির্ভয়ে-নিশঙ্কে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো একটু জায়গা । রান্না ঘরের কোণ । দু’বেলা দু’মুঠো ভাত । পেট পুরে কবে খেয়েছে মনে পড়ে না । হয়তো এবার ভাগ্যের দুয়ার খুলবে । এ সুযোগ তার দুঃখ ঘোচাবে । যন্ত্রণা ভুলাবে । আকলিমার চোখে চকচক করে স্বপ্নের চড়ূইভাতি । সত্যি কি তাই? নাকি সামনে আরো ভয়ঙ্কর ভবিষ্যত!

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার