ক-বাবুর নানা কথা ॥ বের্টোল্ট ব্রেখট ।।অনুবাদ: সন্দীপন ভট্টাচার্য

0

ক-বাবুর নানা কথা

ক্ষমতার প্রতিষেধ
চিন্তাশীল ক-বাবু একটা হলঘরে বিপুল দর্শকের সামনে যখন ক্ষমতার বিরুদ্ধে বলছিলেন, তখন হঠাৎ লক্ষ করলেন সামনের সারির লোকজন কেমন যেন কুঁকড়ে গিয়ে হল ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি চারদিকে তাকালেন, তারপর দেখলেন তাঁর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে— স্বয়ং ক্ষমতা।
“কী বলছিলে তুমি?” ক্ষমতা জিগ্যেস করল তাঁকে।
“আমি তো ক্ষমতার পক্ষেই বলছিলাম,” জানালেন ক-বাবু।
হল ছেড়ে যাওয়ার পর ক-বাবুর ছাত্ররা তাঁর শিরদাঁড়া নিয়ে প্রশ্ন তুলল। তাতে ক-বাবু বললেন, “ভাঙার জন্য কোন শিরদাঁড়া নেই আমার। ক্ষমতার চেয়ে বেশিদিন বাঁচতে হবে আমায়।”
তারপর ক-বাবু এই গল্পটা বললেন :
বেআইনই যখন আইন, সে সময়ে একদিন এক এজেন্ট অ-বাবুর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকল। অ-বাবু কিন্তু জানতেন কী ভাবে না বলতে হয়। শহরটা যারা তখন শাসন করছিল, তাদের নামে ছাপা একটা দলিল ঐ এজেন্ট অ-বাবুকে দেখাল, যেখানে লেখা আছে যে তারা যেখানে পা রাখবে সে জায়গাটাই তাদের, একই ভাবে যে-খাদ্য তারা খেতে চাইবে তা-ই তাদের দিতে হবে, এমনকী যার দিকে তাদের চোখ পড়বে সে-ই তাদের গোলাম হতে বাধ্য থাকবে।
এজেন্ট একটা চেয়ারে বসে খাবার চাইল, তারপর হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় শুল। ঘুমিয়ে পড়ার আগে দেওয়ালের দিকে মুখ করে সে জানতে চাইল, ‘তুমি কি আমার গোলাম হবে?’
অ-বাবু তাকে কম্বল দিয়ে ঢাকা দিলেন, মশামাছি তাড়িয়ে তার দিকে নজর রেখে বসে থাকলেন। সেদিনকার মতো কাজ শেষ হলেও পরবর্তী সাত বছর তিনি তার গোলামি করে গেলেন। কিন্তু সে যা-ই করুন না, একটা ব্যাপারে অ-বাবু খুব সতর্ক ছিলেন— মুখে তিনি একটা কথাও বলেননি। সাত বছর কাটার পর, খেয়ে-ঘুমিয়ে আর আদেশ করে-করে ঐ এজেন্ট গায়ে-মাথায় এন্তার চর্বি জমিয়ে একদিন পটল তুলল। তখন অ-বাবু তাকে ঐ পুরনো কম্বলে মুড়ে, টেনে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বিছানাপত্তর সব কাচলেন, দেওয়ালে রঙ করালেন, তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে উত্তরটা দিলেন— ‘না।’


জ্ঞানের বাহক সম্পর্কে
“জ্ঞান যে বহন করবে সে কখনও লড়াই করবে না, সত্যি কথাও বলতে যাবে না কখনও, কোন কাজ করবে না, তা বলে খাবে না তা নয়, কোন সম্মান নিতে অস্বীকার করবে না, আবার কারও দৃষ্টি আকর্ষণও করবে না। জ্ঞান যে বহন করবে তার কেবল একটাই ধর্ম, যে, সে জ্ঞান বহন করবে,” বললেন ক-বাবু।


খারাপটাও শস্তা নয় তা বলে
মানবজাতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে ক-বাবু দারিদ্র্যের বণ্টন বিষয়ে তাঁর ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন। একদিন অ্যাপার্টমেন্টের চারদিকে চোখ বুলিয়ে তাঁর মনে হল আসবাবগুলো পালটানো দরকার। হওয়া দরকার আরও শস্তা, আরও মলিন, ঠিকঠাক বানানো হয়নি এমন। তৎক্ষণাৎ এক ছুতোরের কাছে গিয়ে তিনি আসবাব থেকে সব বার্নিশ তুলে ফেলতে বললেন। কিন্তু বার্নিশ তোলার পর আসবাবগুলো মলিন হল না তত, কিন্তু সেগুলোর হাল একেবারে খারাপ হয়ে গেল। সে যা-ই হোক, ছুতোরের পয়সা তো মেটাতে হবে, তার পর আসবাবগুলো ফেলে দিয়ে নতুন করে সব কিনলেন তিনি। শস্তা, মলিন, ঠিকঠাক বানানো হয়নি এমন। কারণ আসবাবগুলো তো তাঁর দরকার। কিছু লোক এ কথা শুনে ক-বাবুকে নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করল, কারণ দেখা গেল তাঁর মলিন আসবাবগুলো আগের বার্নিশ-করা আসবাবের চেয়ে দামি। কিন্তু ক-বাবু বললেন, “দারিদ্র্য মানে সঞ্চয় নয়, ব্যয়। আমি জানি তোমাদের ধারণার সঙ্গে তোমাদের দারিদ্র্য মেলে না। আমার ধারণার সঙ্গে আবার সম্পদ জিনিসটা ঠিক মেলে না।”


দুর্বলতার অধিকার
কঠিন সময়ে ক-বাবু কাউকে সাহায্য করেছিলেন। ঘটনার পর ক-বাবুকে সে একটা ধন্যবাদও দিল না।
লোকটার অকৃতজ্ঞতা নিয়ে ক-বাবুকে সরবে নালিশ করতে দেখে বন্ধুরা তো অবাক। তাঁদের মনে হল ক-বাবুর ব্যবহার অভদ্র, এমনকী তাঁরা তাঁকে বললেন, “কৃতজ্ঞতার জন্য অত বলতে নেই, জানো না কৃতজ্ঞ হওয়ার পক্ষে মানুষ কত দুর্বল?” “আর আমি,” ক-বাবু জানতে চাইলেন, “আমি বুঝি মানুষ না? কৃতজ্ঞতার জন্য বলার মতো দুর্বল আমি হব না কেন? লোকে ভাবে তার প্রতি খারাপ কিছু করা হয়েছে, এটা স্বীকার করলে বুঝি নিজের নির্বুদ্ধিতার কথাটাই স্বীকার করে নেওয়া হয়। কেন এ রকম?”


নির্বোধের নির্বাচন বিষয়ে
চিন্তাশীল ক-বাবু যখন শুনলেন যে
মদের চোরাকারবারি এবং গণহত্যাকারী,
নিউ ইয়র্ক শহরের সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধীকে
কুকুরের মতো গুলি করে মারা হয়েছে এবং
কবর দেওয়া হয়েছে কোন অনুষ্ঠান ছাড়াই,
তিনি গভীর হতাশা ব্যক্ত করলেন।

“কী ভাবে এ অবস্থা হল যে,” তিনি বললেন,
“এমনকী একজন অপরাধীও তার জীবনের ব্যাপারে নিশ্চিত নয়,
এবং যে-কোন কাজ করতে যে পিছপা নয়,
এমনকী তারও সাফল্যের কোন মাপ নেই?
সকলেই জানে যে মানবিক সম্মান রক্ষার বিষয়ে যাঁরা সচেতন ছিলেন
তাঁরা হেরে গেছেন।
কিন্তু যারা তা বরবাদ করেছিল?
এটা কি তা হলে বলা যায় যে যারা গহ্বর এড়ায়
তারা মরে গিয়ে শেষে উচ্চতায়?
ন্যায়নিষ্ঠরা রাতে ঘুমের শুরু থেকেই ভিজে যান ঘামে
অতি মৃদু পায়ের শব্দেও তাঁরা সতর্ক হয়ে ওঠেন
তাঁদের শুদ্ধ বিবেক ঘুমের মধ্যেও তাঁদের অনুসরণ করে
আর এখন কিনা আমি শুনছি, অপরাধীরা, তারাও আর
শান্তিতে ঘুমোতে পারে না?
কী গোলমেলে ব্যাপার?
এ কী অদ্ভুত সময় রে, বাবা!
অল্পস্বল্প জোচ্চুরি, শুনি নাকি আর
যথেষ্ট নয়।
তুচ্ছ একটা খুন
তোমাকে নিয়ে যাবে না কোথাও।
দুপুরে খাওয়ার আগে দু-তিনটে বেইমানির কাজ
যে-কেউ স্বেচ্ছায় তা করবে।
কিন্তু ইচ্ছে দিয়ে আর কী হবে
যখন আসল কথা হল ক্ষমতা!
এমনকী নীতির অভাবও আর যথেষ্ট নয় :
ফলাফলই মূল।

ফলে এমনকী মহাবজ্জাতেও
অনায়াসে নেমে যায় কবরের গর্তে।
আর সেখানে তার মতো এত লোকের সমাবেশ যে
কেউ তা লক্ষও করে না।
আরও শস্তাতেই কবরের জায়গা জুটে যেত
এই লোকটার, যে-কোন মূল্যে যে টাকা চেয়েছিল!
এতগুলো খুন
আর এত ছোট জীবন!

এতগুলো অপরাধ
আর এত কম বন্ধু!
পকেট ফাঁকা হলে তো
কমে যেত আরও।

এই সব ঘটনা দেখে
কেন আমাদের মন খারাপ হয়ে যাবে না?
আর কী পরিকল্পনা এখনও করা যেতে পারে
অপরাধ যার জন্ম দিতে পারে?
আমাদের কাছে খুব বেশি কিছু চাওয়াটা কিন্তু ঠিক নয়।
এ সব দেখে,” ক-বাবু বললেন,
“ভারি আশাহত হয়ে পড়েছি আমরা।”


গাড়ি চালাচ্ছেন ক-বাবু
ক-বাবু গাড়ি চালাতে শিখলেন, কিন্তু প্রথম দিকে খুব একটা ভালো চালাতে পারতেন না। “এত দিন আমি একটা মাত্র গাড়ি চালাতে শিখেছি,” ক-বাবু যুক্তি দিলেন, “কিন্তু গাড়ি তো আসলে চালাতে হয় দুটো, অর্থাৎ চালাতে হয় আগের গাড়িটাও। আগের গাড়িটা চালানোর সুবিধে-অসুবিধের কথা খেয়াল না করে এবং তার সামনে বাধাবিপত্তিই বা কী আছে, তার বিচার না করে সে গাড়ির সাপেক্ষে নিজের গাড়িটা চালাব কী করে।”


ক-বাবু ও কবিতা
কবিতার একটা বই পড়ার পর ক-বাবু বললেন, “প্রাচীন রোমে সরকারি দপ্তরের লোকেরা যখন ফোরামে উপস্থিত হতেন, তখন পকেটওয়ালা কোন পোশাক পরায় নিষেধাজ্ঞা ছিল, যাতে তাঁরা কোনরকম ঘুষ নিতে না পারেন। একই ভাবে, কবিদেরও কোট কিংবা জ্যাকেট পরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা উচিত, যাতে কোট বা জ্যাকেটের পকেটে লুকিয়ে তাঁরা কবিতা নিয়ে না ঘুরতে পারেন।”


কোষ্ঠী
যাদের কোষ্ঠী আছে, অতীতের এমন কোন দিনের কথা ক-বাবু তাদের জ্যোতিষীকে বলতে বললেন, যে-দিন তাদের জীবনে বিশেষ ভাবে ভালো বা খারাপ কিছু ঘটেছিল। কোষ্ঠী দেখে জ্যোতিষী নিশ্চয়ই তা বলে দিতে পারবেন। ক-বাবুর এই উপদেশ কেউ শুনল না। কারণ নক্ষত্রের অবস্থান সেদিন কতটা পক্ষে ছিল বা বিপক্ষে সে তথ্য জানা গেলেও, যদি প্রশ্নকর্তার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা না-মেলে, জ্যোতিষী বিরক্ত হয়ে বলেন, আরে, নক্ষত্র শুধু সম্ভাবনার কথাই বলে, ঐ দিন অমনও হতে পারত, সে সম্ভাবনা ছিল। ক-বাবু এ কথা শুনে ভারি আশ্চর্য হলেন এবং নতুন একটা প্রশ্ন তুললেন।
“এটাও আমার কাছে পরিষ্কার নয় যে,” ক-বাবু বললেন, “সব প্রাণীকে ছেড়ে শুধু মানুষের ওপরেই কেন ঐ আন্তর্জাগতিক নক্ষত্রসমাবেশের এত প্রভাব। পশুপাখিদের মোটেই এত অবহেলা করা ঠিক নয়। ধরা যাক একটা লোকের রাশি কুম্ভ, আর একটা মাছির রাশি বৃষ, দু-জনেই জলে ডুবে মরল। তখন কী হল? মাছিটা বোধ হয় লোকটার সঙ্গেই ডোবে, যদিও নক্ষত্রের অবস্থান তার খুবই অনুকূলে ছিল। না, এ আমার পছন্দ নয়।”


ভুল বোঝা
ক-বাবু একটা সভায় যোগ দেন এবং পরে গল্পটা বলেন : খ শহরে হারাম বলে একটা ক্লাব আছে। সেখানকার রীতি হল, বার্ষিক অনুষ্ঠানে এক প্রস্থ চমৎকার খাওয়াদাওয়ার পর বার-কয়েক ‘হারাম’ বলতে হবে। এই ক্লাবের সদস্যরা কিছুতেই তাঁদের মতামত লুকিয়ে রাখতে পারেন না, কিন্তু পাশাপাশি এ কথাও জানতে বাধ্য হন যে তাঁদের সব বিবৃতিই ভুল বোঝা হয়েছে। “আমি তো শুনেছি,” মাথা নেড়ে জানালেন ক-বাবু, “এমনকী এই ‘হারাম’ শব্দটাকেও কেউ-কেউ ভুল বোঝে, কারণ তারা মনে করে শব্দটার কোন মানেই নেই।”

১০
দুই চালক
দু-জন থিয়েটার পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গির কথা জিগ্যেস করলে ক-বাবু তাঁদের এই ভাবে তুলনা করলেন : “আমি একজন চালককে জানি ট্রাফিকের নিয়মকানুন তার নখাগ্রে, সব সে মানে এবং নিজের সুবিধায় তা ব্যবহার করতে জানে। সে সাঁ করে এগিয়ে যেতে জানে, তারপর কিন্তু স্বাভাবিক গতিতেই চলে, ফলে এঞ্জিনে চাপ পড়ে না এবং খুব সতর্ক ও বলিষ্ঠ ভাবে অন্যান্য গাড়ির মধ্যে দিয়ে সে এগিয়ে যায়। আর-একজন চালক এগোয় অন্য ভাবে। নিজের পথের চেয়ে তার গোটা ট্রাফিক ব্যবস্থার প্রতি আগ্রহ, এবং নিজেকে সে তার একটা ক্ষুদ্র অংশ বলে মনে করে। সে তার অধিকারের সুযোগ নেয় না এবং নিজেকে খুব বেশি প্রকটও করে না। মেজাজের দিক থেকে সে তার সামনের ও পেছনের গাড়ির সঙ্গে একযোগে গাড়ি চালায়, প্রতিটি গাড়ির এবং এমনকী পথচারীদের অগ্রগতিতেও আনন্দ পায় সে।”

১১
বিবেচনাবোধ
ক-বাবুকে যিনি নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তার একটা কুকুর ছিল। একদিন কুকুরটার হাঁটা দেখেই মনে হচ্ছিল সে কোন অপরাধবোধে ভুগছে। “ওর কিছু একটা হয়েছে, এক্ষুনি ওর সঙ্গে বিষণ্ণ কিন্তু কঠিন স্বরে কথা বলুন,” উপদেশ দিলেন ক-বাবু। “কিন্তু আমি জানি না ওর কী হয়েছে,” গৃহকর্তা প্রতিবাদ করলেন। “কুকুরটা তো তা জানে না,” উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন ক-বাবু, “দ্রুত জানান যে আপনি বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত কিন্তু মোটেই তা অনুমোদন করছেন না। তা না-হলে কুকুরটার বিবেচনাবোধ আহত হবে।”

১২
বন্ধুভাব নিয়ে
ক-বাবু বন্ধুত্বকে বিরাট মূল্য দেন। তিনি বলেন, “কাউকে দমিয়ে রাখা, বন্ধুভাবেই, বা কাউকে সম্ভাবনার দিক থেকে বিচার না করা, কিংবা কেউ বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করলে তবেই তার প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা, অথবা কেউ যখন গরম হয়ে আছে তার সঙ্গে শীতল ব্যবহার করা, আবার শীতল হয়ে থাকলে গরম ব্যবহার করা মোটেই বন্ধুত্বের কাজ নয়।”

১৩
ক-বাবু এবং তাঁর ভাইঝির আঁকা ছবি
ক-বাবু তাঁর ভাইঝির আঁকা ছবির দিকে দেখলেন। সেখানে একটা মুরগিকে খামার থেকে উড়ে পালাতে দেখা যাচ্ছে। “আচ্ছা বল, তোর মুরগিটার তিনটে পা কেন?” জিগ্যেস করলেন ক-বাবু। “মুরগি তো উড়তে পারে না,” উত্তর দিল ক্ষুদে শিল্পী, “তাই তাকে ওপরে তোলার জন্য একটা তৃতীয় পায়ের দরকার হয়েছে আমার।”
“কথাটা যে জানতে চেয়েছিলাম তার জন্য নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি আমি,” বললেন ক-বাবু।

১৪
দুর্নীতিযোগ্যতা বিষয়ে
একবার সমসাময়িক এক সামাজিক সমাবেশে ক-বাবু বিশুদ্ধ জ্ঞান নিয়ে কথা বলছিলেন এবং দুর্নীতিযোগ্যতাকে অতিক্রম করেই যে তা অর্জন করা সম্ভব সে কথা জানালেন। কেউ একজন পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জিগ্যেস করল, তা এই দুর্নীতিযোগ্যতার সঙ্গে যোগ কীসের। তৎক্ষণাৎ ক-বাবু বললেন, “টাকা।” এতে সেখানে বিস্ময়সূচক ওঃ আঃ ইত্যাদি নানা আওয়াজ শোনা গেল, কেউ-কেউ এমনকী মাথা নেড়ে ক্ষোভও প্রকাশ করলেন। তার মানে উত্তরে তাঁরা সূক্ষ্ম ও সংস্কৃত কিছু শোনার আশা করেছিলেন। অর্থাৎ দুর্নীতিগ্রস্ত লোকও মনে-মনে এই আকাঙ্ক্ষা লালন করে যে তাকেও সূক্ষ্ম এবং বৌদ্ধিক কিছু দিয়ে ঘুষ দেওয়া হবে, যাতে ঘুষ-নেওয়া লোকটাকে অন্তত কেউ নির্বোধ না বলতে পারে।
অনেকে, শোনা যায়, সম্মান দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্ত। তার মানে টাকার দ্বারা নয়। এবং অন্যায় ভাবে টাকা নিয়েছে বলে যারা ধরা পড়েছে, তাদের কাছ থেকে টাকা কেড়ে নেওয়া গেলেও অন্যায় ভাবে যারা সম্মান পেয়েছে, তারা কিন্তু আশা করে যে তাঁদের সম্মান অক্ষত থাকবে।
ফলে যারা শোষণের দায়ে অভিযুক্ত তাদের অনেকে আমাদের এ কথা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করতে পারে যে তারা শাসন করার জন্য টাকা খায়, টাকা খাওয়ার জন্য শাসন করে না। কিন্তু যখন টাকা থাকা মানেই শাসন করা, তখন টাকা চুরির অছিলা ছাড়া শাসন আর কিছুই নয়।”

১৫
ভুল এবং প্রগতি
কেউ যদি শুধু নিজের কথাই ভাবে, তা হলে তার পক্ষে এটা বিশ্বাস করা শক্ত যে সে কোন ভুল করতে পারে, ফলে সে কোথাও এগোতে পারে না। সে জন্যই অন্যদের কথাও ভাবা দরকার, যারা কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আর শুধু এ ভাবেই কোন কিছুকে সম্পূর্ণতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে সে।

১৬
মনুষ্য-স্বভাবের জ্ঞান
মানুষের স্বভাব সম্পর্কে ক-বাবুর জ্ঞান অল্প। তিনি বলেন, “মনুষ্য-স্বভাবের জ্ঞান একমাত্র সেখানেই দরকার যেখানে শোষণ যুক্ত। ভাবা মানে পালটানো। আমি যদি কোন লোককে নিয়ে ভাবি তো তাকে পালটাব। মাঝে-মাঝে তো মনে হয় লোকটা আদপেই এরকম নয়, আমি তাকে নিয়ে ভাবা শুরু করতেই তার এই হাল।”

১৭
ক-বাবু ও হড়পা বান
ক-বাবু একটা উপত্যকা অঞ্চল দিয়ে হাঁটছিলেন, হঠাৎই দেখলেন তিনি হাঁটছেন জলে পা দিয়ে। তখন তিনি উপলব্ধি করলেন যে উপত্যকাটা সমুদ্রেরই একটা হাতা, আর এখন সেখানে জোয়ার এসেছে। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি একটা নৌকার আশায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন, এবং দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ না নৌকার দেখা পাওয়ার আশা তাঁর গেল। শেষ পর্যন্ত যখন কোন নৌকার দেখা পাওয়া গেল না, তিনি সে আশা ছাড়লেন, কিন্তু আশা করলেন জল হয়তো আর বাড়বে না। জল যখন তাঁর চিবুক ছুঁল, তখন তিনি সে আশাও ছাড়লেন এবং সাঁতার কাটতে শুরু করলেন। উপলব্ধি করলেন যে আসলে তিনি নিজেই একটা নৌকা।

১৮
ক-বাবু ও অভিনেত্রী
ক-বাবুর এক অভিনেত্রী বন্ধু ছিল, এক ধনীর কাছ থেকে সে কিছু উপহার পেয়েছিল। কাজেই ধনীদের সম্পর্কে তার ধারণা ছিল ক-বাবুর থেকে আলাদা। ক-বাবু মনে করেন ধনীরা বজ্জাত, কিন্তু তাঁর বান্ধবী মনে করে তারা সকলে খারাপ নয়। এ কথা সে কেন মনে করে? সে তাদের কাছ থেকে উপহার পায় বলে এ কথা ভাবে না, এই কারণে ভাবে যে সে তাদের কাছ থেকে উপহার পায়, আর সে এমন মানুষ নয় যে কোন বজ্জাত লোকের কাছ থেকে উপহার নিতে পারে। ক-বাবু এ নিয়ে গভীর ভাবে ভাবলেন, কিন্তু নিজের সম্পর্কে সে যা ভাবে তা বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না। “নাও ওদের টাকা,” বলে উঠলেন ক-বাবু (যা অনিবার্য তা মাথায় রেখে)। “ঐ উপহারের টাকা ওদের নয়, ওসব চুরির টাকা। ওদের লুঠের টাকায় ভাগ বসাও, যাতে তুমি ভালো অভিনেত্রী হয়ে উঠতে পারো!” “টাকা ছাড়া কি আমি ভালো অভিনেত্রী হতে পারব না?” বান্ধবী জানতে চাইল। “না,” তীব্র স্বরে বলে উঠলেন ক-বাবু, “না, না, না।”

১৯
ক-বাবু ও খবরের কাগজ
ম-বাবুর সঙ্গে ক-বাবুর হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। ম-বাবু খবরের কাগজের বিরুদ্ধে বিরাট সংগ্রামী। “আমি খবরের কাগজের ভয়ানক বিরোধী,” জানালেন ম-বাবু, “আমি চাই না কোন খবরের কাগজ আর বেরোক।” “আমি তার চেয়েও বড় বিরোধী। আমি খবরের কাগজ চাই, কিন্তু তা অন্যরকম,” বললেন ক-বাবু।
“একটা টুকরো-কাগজে লিখুন আপনার দাবি কী,” ম-বাবুকে বললেন ক-বাবু, “যাতে খবরের কাগজ বেরোতে পারে। কারণ কাগজ তো বেরোবেই। কিন্তু দাবি যেন হয় ন্যূনতম। আমার যেমন মনে হয়, আপনি যদি দুর্নীতিমুক্ত লোকের চেয়ে এ ক্ষেত্রে দুর্নীতিযোগ্য লোককে তা বের করার অনুমতি দেন, তা হলে আমার সুবিধে হবে যে তাকে স্রেফ ঘুষ দিয়ে কাগজের মান একটু উন্নত করতে পারব। কিন্তু আপনি যদি দুর্নীতিমুক্ত লোকই দাবি করেন, তা হলে চলুন আমরা তাকে খুঁজে বার করি। যদি খুঁজে না পাই, তবে দুর্নীতিমুক্ত মানুষ অন্তত তৈরি করার কথা ভাবি। একটা কাগজের টুকরোয় লিখুন যে খবরের কাগজ কেমন হওয়া দরকার, এবং তার পর যদি এমন কোন পিঁপড়েকে খুঁজে পাই যে তা অনুমোদন করছে, তা হলে আমরা তৎক্ষণাৎ কাজ শুরু করে দেব। খবরের কাগজের উন্নতি করতে হলে, খবরের কাগজের উন্নতি করা আদৌ সম্ভব নয়, এই গণ-কোলাহলের চেয়ে ঐ পিঁপড়ে আমাদের ঢের বেশি কাজে লাগবে। কারণ পাহাড় সরানো সম্ভব নয়, এই গুজবের চেয়ে একটা পিঁপড়ের পক্ষে পাহাড় সরানো অনেক বেশি সম্ভব।”
খবরের কাগজ যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উপায় হয়ে থাকে, তবে তা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনারও উপায়। ম-বাবুর মতো লোকেরাই তাঁদের অসন্তুষ্টির জেরে খবরের কাগজের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। ম-বাবু মনে করেন তিনি আজকের দিনে খবরের কাগজের অর্থহীনতা নিয়ে বেশি চিন্তিত, আসলে তিনি চিন্তিত ভবিষ্যতে খবরের কাগজের অর্থ নিয়ে।
মানুষ সম্পর্কে ম-বাবুর উচ্চ ধারণা, কিন্তু তিনি মনে করেন না খবরের কাগজের কোন উন্নতি সম্ভব। এ দিকে মানুষ সম্পর্কে ক-বাবুর ধারণা খুব ভালো নয়, কিন্তু তিনি মনে করেন খবরের কাগজের উন্নতি করা সম্ভব। “সব কিছুই উন্নত হতে পারে,” ক-বাবু বলেন, “শুধু মানুষ ছাড়া।”

২০
বেইমানি প্রসঙ্গে
প্রতিশ্রুতি কি রক্ষা করা উচিত?
প্রতিশ্রুতি কি দেওয়া উচিত? যেখানে কোন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, সেখানে তার মানে কোন শৃঙ্খলা নেই। যেখানে শৃঙ্খলা নেই, সেখানে আগে সেটাই প্রতিষ্ঠা করা দরকার। মানুষ কোন প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না। বাহু মাথাকে কী প্রতিশ্রুতি দেয়? যে সে চিরকাল বাহু হয়েই থাকবে, পা-এ পরিণত হবে না। কারণ প্রত্যকে সাত বছরে বাহু পালটে যায়। যদি কোন লোক কোন লোকের সঙ্গে বেইমানি করে, তো যাকে সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আর যার সঙ্গে সে বেইমানি করল, এ দু-জন কি এক? প্রতিশ্রুতি যাকে দেওয়া হয়েছে প্রতিনিয়তই নিজেকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবিষ্কার করে সে, এবং সে অনুযায়ী নিজেকে পালটাতে বাধ্য হয়, এবং অন্য মানুষে পরিণত হয়, তো তার কাছে কী ভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা যাবে যা দেওয়া হয়েছিল অন্য কারও কাছে? চিন্তাশীল লোক কোন কিছুর প্রতিশ্রুতি দেয় না, শুধু চিন্তা করার প্রতিশ্রুতি ছাড়া।

২১
ধারাভাষ্য
কোন একজন সম্পর্কে ক-বাবু বললেন, “মস্ত কূটনীতিক তিনি। তিনি যা হতে পারেন, তা যে কেউ তার কাছ থেকে ঠকিয়ে নেবে, সেটি তিনি হতে দেবেন না।
“কারণ লোকে এখন হাড় পর্যন্ত শোষিত, ফলে তা চায় না, তা বলে এটা মনে করে নিজেকে ঠকানো চলবে না যে তারা মোটেই শোষিত হতে চায় না। হাড় পর্যন্ত যারা শুষে নিচ্ছে তাদের অপরাধ এতে আরও বাড়ে এই কারণে যে, এ ক্ষেত্রে তারা একটা খুবই নৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে নষ্ট করে দিচ্ছে।”

২২
স্বার্থের সন্তুষ্টি
স্বার্থের যে সন্তুষ্টি প্রয়োজন, তার মূল কারণ হল, স্বার্থের পরিপন্থী বলে চিন্তাশীল লোকের অধিকাংশ ভাবনা শেষ পর্যন্ত ভাবাই হয় না। স্বার্থের সন্তুষ্টি যদি অসম্ভব হয়, তবে সে দিকে এবং বিবিধ স্বার্থের অসমতার দিকে তাঁদের নজর ফেরানো দরকার। কারণ একমাত্র এ ভাবেই চিন্তাশীল লোক সেই ভাবনা ভাবতে পারে, যা অন্যের স্বার্থে কাজে লাগে। আর অন্যের স্বার্থের কথা ভাবা একেবারেই কোন স্বার্থ না থাকার চেয়ে অন্তত সোজা।

২৩
দুই খেসারত
চরম দুর্বিপাকের দিন যখন শুরু হল, যার কথা তিনি আগেই বুঝেছিলেন, বুঝেছিলেন এ তাকে খেয়ে নেবে, মুছে ফেলবে, দীর্ঘকালের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তখন চিন্তাশীল লোকটিকে তারা এক বিশৃঙ্খল বাড়ি থেকে উদ্ধার করল।
চূড়ান্ত ক্ষয়ের মধ্যে তিনি দেখাচ্ছিলেন কোন্‌ জিনিসগুলো তিনি সঙ্গে নিতে চান, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে ভয় পাচ্ছিলেন যে হয়তো এ-ও বেশি হয়ে যাবে, তখন সব কিছু একত্র করে তারা তাঁর সামনে রাখল। একটা মানুষ যতটা বহন করতে পারে তার চেয়ে তা বেশি ছিল না, যতটা দিয়ে দিতে পারে তার চেয়েও না। দেখেশুনে বিরাট এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তিনি বললেন সব একটা ঝোলায় পুরতে, অধিকাংশই বই বা কাগজ— একজন মানুষ যতটা ভুলে যেতে পারে তার চেয়ে বেশি জ্ঞান ছিল না তাতে। তিনি ঝোলাটা সঙ্গে নিলেন, সেই সঙ্গে একটা কম্বল, যা তিনি নিলেন পরিষ্কার রাখা সহজ বলে। বাদবাকি যা-কিছু তাঁর চারপাশে জড়ো করেছিলেন, অনুশোচনার একটি বাক্য আর সম্মতিসূচক পাঁচটি বাক্য বলে ছেড়ে গেলেন তিনি।
এই খেসারত ছিল সহজ।
শোনা যায় আরও একটা খেসারত তাঁকে দিতে হয়েছিল, যা ছিল অনেক কঠিন। এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলেন যখন, তখন একসময়ে কিছুদিনের জন্য একটা বড় বাড়িতে ছিলেন। সেখানে এই চরম দুর্বিপাক তাঁকে খেয়ে নেবার আগে, যা তিনি আগেই বুঝেছিলেন, তিনি মূল্যবান একটা বা একাধিক কম্বলের বিনিময়ে তাঁর কম্বলটা দিয়ে দিলেন, ঝোলাটাও দিয়ে দিলেন অনুশোচনার একটি বাক্য এবং সম্মতিসূচক পাঁচটি বাক্য বলে, সেই সঙ্গে বিস্মৃত হলেন তাঁর প্রাজ্ঞতা, ফলে মুছে যাওয়া সম্পূর্ণ হল।
এ খেসারত ছিল অনেক কঠিন।

২৪
ভালো থাকার লক্ষণ
ক-বাবু কোথাও একটা দারুণ কাজ করা পুরনো চেয়ার দেখে সেটা কিনে ফেললেন। বললেন, “এরকম একটা চেয়ারের পাশে জীবনকে কী ভাবে সাজালে চেয়ারটা নিয়ে লোকে কিছু বলবে না, বা বুঝবে যে এর থেকে আনন্দ পেলে সেটা খুব খারাপ বা ভালো কিছু নয়, সে বিষয়ে খানিক অন্তর্দৃষ্টি লাভের আশা করছি আমি।
“কোন-কোন দার্শনিক এ প্রশ্ন তুলেছেন যে, কঠিন পরিস্থিতিতে জনপ্রিয় সাম্প্রতিক গান দ্বারা পরিচালিত হতে হলে জীবনটা ঠিক কেমন হওয়া দরকার। তা, আমাদের হাতে যদি সুন্দর একটা জীবন থাকেই, তবে তার বিরাট কোন উদ্দেশ্য বা বিশাল কোন উপদেশের দরকার নেই, এবং তা হলে নির্বাচনের এই কঠিন ব্যবস্থাটাও ভেস্তে যায়,” প্রশ্নটার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই জানালেন ক-বাবু।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার