অন্তনি আর্তো-র লিখন || ভাষান্তর : সন্দীপন ভট্টাচার্য

0

অন্তনি আর্তো
ফরাসী লেখক
অন্তনি আর্তো নামে খ্যাত আঁতোয়ান মারি জোসেফ পল আর্তো ছিলেন একজন ফরাসি লেখক, কবি, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা এবং নাট্য পরিচালক, বিশ শতকের থিয়েটারের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব এবং ইয়োরোপীয় অভিভাবক হিসাবে স্বীকৃত, এবং তার অমার্জিত, পরাবাস্তব এবং নৈতিক ও সামাজিক চৌহদ্দি অতিক্রম করা বিষয়ের জন্য পরিচিত।

জন্ম: 4 সেপ্টেম্বর, 1896, মার্সেই, ফ্রান্স
মৃত্যু: 4 মার্চ, 1948, ইভরি-সুর-স্যেন, ফ্রান্স
বিখ্যাত প্রবন্ধ সংকলন : থিয়েটার অ্যান্ড দ্য ডাবল

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া

 

 

 

 

এক মনোশিল্পী

এক ভ্রূণগত শৈলীতে (জার্মান) পাউল ক্লে কিছু আশ্চর্য দৃশ্য সংগঠিত করেন। আমি তাঁর কিছু-কিছু দুঃস্বপ্ন, স্থাপত্যের মত ধৃত তাঁর মানসিক সংশ্লেষ (বা মানসিক স্থাপত্য) এবং কিছু মহাজাগতিক সংশ্লেষ বেশ পছন্দ করি, যেখানে বস্তুর গোপন বস্তুত্ব দৃশ্যমান হয়।

গেয়র্গ গ্রোস-এর সংশ্লেষের চেয়ে অনেক বেশী করে হয়। পাশাপাশি দেখলে তাঁদের প্রেরণামূলে গভীর প্রভেদ চোখে পড়ে।

গেয়র্গ গ্রোস তাঁর জগৎ নির্ব্বাচন করে তাকে তাঁর দৃষ্টিভুবনে নিয়ে আসেন, আর পাউল ক্লে-তে মনে হয় জগতের বস্তুভুবন নিজেরাই নিজেদের সংগঠিত করেছে। তিনি শুধু তাদের নির্দ্দেশ মেনে গেছেন। দৃষ্টির সংগঠন, গড়ন, ধারণার সংস্থিতি, ছবিগত যুক্তি ও বিযুক্তি, তার থেকে উদ্ভূত ফলাফল, ছবির সংগঠনও— বিশেষ কিছু দৃশ্যরূপের অন্তঃস্থ অর্থের সন্ধান ও তার মানসদৃশ্যের বিশদ বর্ণন। পাউল ক্লে-র ছবিকে আমার তা-ই মনে হয়েছে।

গ্রোস-এর রুক্ষতা আর সংক্ষিপ্ততা এই সংগঠিত দর্শনের সামনে বিস্ফোরিত হয়। দৃষ্টিগত একটা দিক পাউল ক্লে-তে বরাবর চোখে পড়লেও তাদের প্রকৃতি বস্তুত মানসিক।

 

 

 

র‍্যাঁবো

চিন্তায় নতুন ঘটনা, উদ্দীপক, সম্পর্কের প্রাণোচ্ছ্বাস— শুধু অনুভূতির মধ্যেকার সম্পর্ক নয়, এক অনুভূতির গভীরতা আর অন্য অনুভূতির গভীরতার মধ্যে যে সম্পর্ক তা-ও নয়— অনুভবের বহিরঙ্গ, তার স্থান, তার মর্য্যাদা, অনুভূতির গুরুত্ব, আর অন্য ধারণার সম্পর্কসূত্রে আর-এক ধারণার বহিরঙ্গ, তার উপমামূল্যের সম্পর্ক— এবং এ সবের সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া, নিজের ভেতরে তার স্বীকৃতি, তার ঘূর্ণন, তার বাঁক— এই হল র‍্যাঁবো-র অবদান।

র‍্যাঁবো এই জীবনের মধ্যেই বাঁচার আর ব্যবহারের এক নতুন রাস্তা দেখিয়েছেন। …

 

 

 

 

দুঃস্বপ্নদ্রষ্টা

আমার স্বপ্নগুলোর অধিকাংশই তরল। একজাতীয় বমনোদ্রেককারী জলে আমি ডুবে থাকি আর রক্তলাল ছায়াছবি সেখানে উথলোয়। জীবনে বা স্বপ্নে কোন ধারণার স্তরে আমি যেতে পারি না। আমার জীবনের ধারায় কিছুতেই থিতু হলাম না। আমার স্বপ্নে কোন মুক্তি নেই, আশ্রয় নেই, নেই নির্দ্দেশিকা। সত্যি, কাটা প্রত্যঙ্গের মত অবস্থা।

তা ছাড়া, আমার চিন্তার গভীরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, তার প্রতি আগ্রহী হওয়ার পক্ষে আমি বড্ডঅবসৃত। শুধু একটাই জিনিশ আমি চাইতে পারি— নিজের ভালর জন্যেই আমার চিন্তায় ধরা পড়বেন না।

আর স্বপ্নের বাস্তব চেহারার কথা তো বলেইছি— তরল।

 

 

 

 

খাদ্য প্রস্তুত

অস্তিত্বের কন্দর খালি করুন। আসুন, আত্মা শ্বাস নেয় আত্মার বাইরে। বাড়ি ছাড়ার সময় হল। বিশ্বচিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। আত্মার শিকড়ে আছে অতীব বিস্ময়।

আমরা এসেছি মনের ভিতর থেকে, মস্তিষ্কের ভেতর থেকে, ধারণা, যুক্তি, শৃঙ্খলা, (বড় হাতের) সত্য, কারণ— সব আমরা মৃত্যুর শূন্যতায় অর্পণ করেছি। যুক্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকুন, ভদ্রমহোদয়গণ, যুক্তি সম্পর্কে সতর্ক হোন। আপনি জানেন না, যুক্তির প্রতি আমাদের ঘৃণা আমাদের কত দূরে নিয়ে যেতে পারে।

জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে, কেবল আত্মাকে পরীক্ষা করেই জীবনের প্রকৃত শারীরতত্ত্ব নির্দ্ধারণ করা যায়, কিন্তু বাস্তবতার দেখা সেখানেও মেলে না। সে জন্যেই আমাদের মনকে বিচলিত করবেন না, আমরা, যারা এক পরাবাস্তব চিরন্তনের আকাঙ্ক্ষা রাখি, এবং আমরা, যারা দীর্ঘ দিন নিজেদের বর্ত্তমানচারী বলে মনে করি না, প্রতিচ্ছায়া বলে ভাবি।

 

 

 

 

দলাই লামা-র প্রতি

ও মহা লামা, আমরা আপনার সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরিচারক। এমন এক ভাষায় আপনার প্রজ্ঞা আমাদের প্রদান করুন, আমাদের ভূষিত করুন, দূষিত ইয়োরোপীয় মন যা বুঝবে। আর যদি প্রয়োজন হয়, তা হলে আমাদের মনের রূপান্তর ঘটান, মানুষের মন যেখানে যন্ত্রণা পায় না সেই নিখুঁত শীর্ষে আমাদের মনকে সম্পূর্ণ চালিত করুন।

অভ্যাসহীন মনে পরিণত করুন আমাদের, মনের গভীরে প্রকৃত সমাধিস্থ আত্ম-য়, অথবা শুদ্ধতম অভ্যাসে, আপনার অভ্যাসে স্থিত করুন আমাদের, যদি তাতে স্বাধীনতা মেলে।

মাস্তান পোপ, কলমচি, সমালোচক আর কুত্তারা আমাদের ঘিরে রেখেছে। আমাদের মন গিয়েছে কুত্তার প্রতি, এই পৃথিবীর সঙ্গে যার চিন্তার একটা সরাসরি সম্পর্ক আছে, অসংশোধনীয়, যে ভাবে শুধু বর্ত্তমানে।

শরীরের উন্নয়ন শেখান আমাদের, ও লামা, বলুন কী ভাবে এই পৃথিবীর তল থেকে আমরা মুক্তি পাব।

কারণ আপনিই জানেন আত্মার সেই স্বচ্ছ মুক্তির অর্থ, মনের গভীরে মনের হাত থেকে মুক্তির তত্ত্ব, যার কথা আমরা বলছি। ও গ্রহণীয় ধর্ম্মনেতা, ও মনের প্রকৃত পরিত্রাতা।

আমার অন্তরের শীর্ষে আমার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আপনাকে আমি দেখতে পাচ্ছি, ও লামা। আমি আপনারই মত— আমার ভেতরের আমি, গতি, ধারণা, ঠোঁট, উন্নয়ন, স্বপ্ন, কান্না, ধারণার বিসর্জ্জন, সমস্ত গড়নের ওপর আমার ভাসমান আমি, আশা করছি শুধু একটু প্রাণবায়ুর।

 

 

 

সমাজের ভেতরে সমাজ

রাস্তায় নাটকের প্রস্তাব,
পুলিশ কি অনুমতি দেবে, দেবে অনুমতি?
আধুনিক রাস্তার পরিবেশ মোটেই নাটকের উপযুক্ত নয়, ফলে
আমার পরিবেশ খুঁজতে হবে আমাকেই,
ঝোড়ো পরিবেশ, ঝোড়ো প্রতিবেশ,
চলমান নাটক,
সে যা-ই হোক, রাস্তায় মহড়া দিও না,
যা-ই হোক, সব কিছু অর্থনির্ভর,
টাকা বা টাকার অভাব সব আটকে দেয়,
ঘনিষ্ঠ সব উপকরণ জোটাতে হবে, যার তেমন কোন দাম নেই : কাঠকুটরো, ক্যানভাস, খাদ্য, আর অভিনেতা।
টাকা ছাড়াই তা পাওয়া যায়, কিংবা বিনিময় করা নেওয়া যায়, অথবা দ্রব্যের সমবায় একটা আবার প্রতিষ্ঠা করা যায়।
সংক্ষেপে, কী লাগবে?
জায়গা একটা লাগবেই, ফলে আবহাওয়া ভালো থাকলে জনপ্রাঙ্গণে অভিনয় করা যায়,
অথবা একটা হ্যাঙ্গারে, ফ্যাক্টরি বা গ্যারাজে,
মহড়া কিন্তু দিতেই হবে।
আমি দেখিয়ে দিতে পারি যে আমার টাকার দরকার নেই, ও ছাড়াই আমি পারি,
থাকার একটা জায়গা দিন আমায়,
কিছু খাদ্য,
বৈষয়িক লোকে মিহি কাপড় কেটে জামা বানাক,
সমাজের ভেতরে একটা সমাজ,
রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র।

 

 

 

 

সন্দীপন ভট্টাচার্য

প্রায় চল্লিশ বছর আগে পত্রিকা সম্পাদনার সূত্রে অনুবাদ করা শুরু। তারপর এই চার দশকে সম্পাদিত ও অনূদিত বইয়ের সংখ্যা কম নয়।
তার মধ্যে কয়েকটি :
বের্টোল্ট ব্রেখট : ‘ক-বাবুর যত কথা’, ‘নির্বাসিতের জার্নাল’; জাঁ-পল সার্ত্র : ‘লেখকের অস্তি নাস্তি অবস্থিতি’; সিমন দ্য বোভোয়া : ‘মেয়েদের হার মেয়েদের জিত’; ফেদেরিকো ফেলিনি : ‘একটি ছবির জন্ম ও অন্যান্য’, ক্রিস্তভ কিয়েসলোভস্কি : ‘প্রেম ও হত্যা’: দুটি ছবির চিত্রনাট্য; রবের ব্রেসঁ : ‘চলচ্চিত্র: চিন্তাবীজ’; ‘চেরির স্বাদ’ : আব্বাস কিয়ারোস্তামি-র কথা ছবি কবিতা, জ্যাক কেরুয়াক উইলিয়াম বারোজ অ্যালেন গিন্সবার্গ : ‘বিট প্রজন্ম অফবিট প্রসঙ্গ’; এদুয়ারদো গালেয়ানো : ‘আয়না: আমাদের প্রায় সব্বার গপ্প’।

প্রকাশক : মনফকিরা ও বইপত্তর। নিবাস : কলকাতা।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার