বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে || কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী

0

আগের কথা
এই গ্রন্থের আগের দু’টি নিবন্ধ থেকে আমরা ‘বাংলাভাষার সম্পদ কোথায়’ এবং ‘বাংলাভাষার বিপদ কোথায়’ সেকথা জেনেছি। জেনেছি, কুবেরশাসিত বিশ্বায়নী ত্রাসে বিপর্য্যস্ত জাতিগুলির সঙ্গে বাংলাভাষীরাও নিজেদের অতীত ত্যাগ করে, ভাষা ত্যাগ করে, আত্মরক্ষার্থে পলায়ন ক’রে কুবের-পরিকল্পিত কৃত্রিম ত্রিলোকে বা তিন অন্ধকূপে এবং সেখানকার ইংরেজি ভাষার আবহে ঢুকে পড়ছে বলেই এই দুর্গতি। ফলত, জাতিসত্তাগুলি বিপন্ন, তাদের ভাষাও সেকারণেই বিপন্ন, এমনকি খোদ ইংরেজি ভাষাও ক্রমশ শীর্ণ হয়ে কাজ-চালানো হাটুরে ভাষায় পর্য্যবসিত হচ্ছে।…

স্বখাতসলিলে নিমজ্জমান আধুনিক সভ্যতার ভবিতব্য
আসলে, দুইখানি বিশ্বযুদ্ধ সেরে যন্ত্ররাজ বিভূতি বুঝে ফেলেছিল, জাতিগুলির দেশ দখল করে রাখা অনেক খরচসাপেক্ষ (‘কস্ট্লি’) হয়ে যাচ্ছে; অথচ, তার দরকার নেই। যেটা দরকার সে তো দেশ দখলে না রেখেও একশোভাগ সিদ্ধ করা যেতে পারে। যে দেহবাদী বোকাগুলো ‘স্বাধীনতা’‘স্বাধীনতা’ বলে চেঁচাচ্ছে, তাদের গলায় গলা মিলিয়ে বরং স্বাধীনতার জয়গান গাওয়াই ঠিক। কেননা, মানুষের যৌথ বা সামাজিক (ঝাঁক) অস্তিত্ব তো প্রকৃতপক্ষে দৃশ্য ভৌগোলিক বাহ্যিক দেশে থাকে না, থাকে তাদের মানসিক দেশে বা ত্রিলোকে— থাকে তাদের স্বাভাবিক কর্ম্মজগৎ, জ্ঞানজগৎ, ও প্রশাসনিক জগৎ (জাতির বা মানবঝাঁকের স্বাভাবিক আত্মনিয়ন্ত্রনের জগৎ) এই তিন লীলাভূমিতে। সেই ত্রিলোক ইতোমধ্যেই খানিকটা দখল তো হয়েই গেছে, বাকিটা দখল করে অধিকারে রাখতে পারলে দশগুণ লাভ। তার জন্য দেশগুলির ত্রিলোকে বৃহৎশিল্পানুসারী কর্ম্মজগৎ, তার তাঁবেদার শিক্ষাজগৎ, ও ফোঁপরা-গণতান্ত্রিক-রাষ্ট্রে মডেল আরও বেশি বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারলেই কেল্লা ফতেহ। খালি খালি কোনো জাতির বাহ্যিক দেশ দখল করে রাখার দরকার কী। তার চেয়ে বরং (বাহ্যিক, ভৌগোলিক, দৈহিক) স্বাধীনতার জয়গান গাওয়া যাক, (ফোঁপরা) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেওয়া যাক, (মনুষ্যত্ব নাশকারী তাঁবেদার) আধুনিক শিক্ষাবিস্তারের জয়গান গাওয়া যাক; তাহলেই গাছেরটাও খাওয়া যাবে, তলারটাও পাওয়া যাবে।

অতএব, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে দেশগুলি স্বাধীন হয়ে যেতে লাগল, তাদের অজ্ঞাতসারে অথচ তাদের চোখের সামনেই তাদের মানসিক দেশ বা ত্রিলোক দখল হয়ে যেতে লাগল, যন্ত্ররাজ বিভূতি যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতিতে (বিদেহী কুবের-এ) উত্তীর্ণ হয়ে যেতে লাগলেন। বিশ্বের লম্বা লম্বা ডিগ্রির লেজওয়ালা অ্যাকাডেমি-শিক্ষিত-বুদ্ধিজীবীরা একেবারে বুদ্ধু বনে গেলেন; বুদ্ধু বনে গেল তাঁদের অনুসারী জনসাধারণও। তাঁদের চোখের সামনেই তাঁদের কার্য্যকরী দেশটা পরাধীন হয়ে গেল; তাঁরা টেরই পেলেন না।…

সম্প্রতি সেই যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি কুবেরের দাপটে এমনকি যন্ত্ররাজ বিভূতিরাও (বৃহৎশিল্পপতিরাও) তটস্থ। বলতে কি, বৃহৎশিল্পও এখন রুগ্ন শিল্প হতে চলেছে, হয়ে গেছে। কিছুকাল আগেও যিনি বিশ্বের অগ্রণী বৃহৎশিল্পপতি ছিলেন, মোটরগাড়ি-নির্ম্মাতা সেই ফোর্ড এখন রুগ্ন শিল্পপতিদের দলে নাম লিখিয়েছেন। তাঁর ডেট্রয়েট শহরের বাসিন্দার সংখ্যা ১৮ লক্ষ থেকে কমে ৮ লক্ষে দাঁড়িয়েছে; ডেট্রয়েট শহরের অর্দ্ধেক রাস্তায় বাতি জ্বলে না আর, অর্দ্ধেক পার্ক বন্ধ হয়ে গেছে। বোকা দেশনেতারা এখন বৃহৎশিল্পকে নানারকমের ভর্ত্তুকি (ইনসেনটিভ) তাদের দেশে শিল্প গড়ার জন্য ডাকছে। ওদিকে কুবের চলেছে নতুন নতুন দেশ দখল করতে। তার ফোঁপরা-গণতন্ত্রের মডেল ঢুকিয়ে ‘আরব বসন্ত’-এর নামে আরব দেশগুলির ত্রিলোক দখল করছে সে, আর তার তাঁবেদার শিক্ষাজগৎ তার সেই কুকর্ম্মকে ‘গণতন্ত্রের মহোৎসব’বলে প্রবল ঢক্কানিনাদ করে চলেছে।…

কিন্তু প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে। মানবসমাজের স্বাভাবিক ত্রিলোকের ভিতরে যে তিনখানি কৃত্রিম ত্রিলোকের মডেল ঢুকিয়ে দিয়ে সেই স্বাভাবিক ত্রিলোক দখল করা হয়েছে, সেই কৃত্রিম মডেলগুলি তো অমর নয়; বরং নিতান্তই কাজ-চালানো গোছের। ফলত, সেগুলি শুরুতে মোহমুগ্ধকর নতুন মানসিক আবহ বলে মনে হলেও, কালে কালে সেগুলি অন্ধকূপ রূপে প্রতীয়মান হয়েছে, হচ্ছে। তাতে পড়ে যাওয়া সমস্ত মানুষকে সে কূপমণ্ডুকে পরিণত করেছে, করছে। লোকে বৃহৎশিল্পানুসারী কর্ম্মজগতের বাইরে, তার তাঁবেদার শিক্ষাজগতের বাইরে, তার ফোঁপরা-গণতান্ত্রিক-রাষ্ট্রব্যবস্থার বাইরে কোনো কিছু আর দেখতেই পাচ্ছে না। অথচ, এই তিন অন্ধকূপের বাইরেই আজও রয়েছে মানুষের বিশাল-বিপুল স্বাভাবিক (নেচারাল) কর্ম্মজগৎ, স্বাভাবিক জ্ঞানজগৎ, স্বাভাবিক প্রশাসনের (মানবঝাঁকের আত্ম-পরিচালনার) জগৎ; যা কুবের কর্ত্তৃক ইতোমধ্যে আক্রান্ত ও অনেকটাই ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু আজকের সভ্যমানুষ মানুষেরা ঐ স্বাভাবিক ত্রিলোক দেখতেই পাচ্ছে না; ঠিক যেরকম শহুরে কেরানী দিনরাত বিজলীবাতির আলোয় থাকতে থাকতে সূর্য্যালোককে দেখতেই পায় না, সেইরকম।… মোটকথা, যে পর্য্যন্ত কুবেরের ঐ কৃত্রিম ত্রিলোকের বিস্তার ঘটেছে, সে পর্য্যন্ত মানুষকে সেই কৃত্রিম ত্রিলোক আর স্বাভাবিক মানুষ থাকতে দেয়নি। কুবেরশাসিত এই আধুনিক বিশ্বায়িত সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সভ্য মানুষকে সে অতিখর্ব্ব কূপমণ্ডুক মানুষে পরিণত করে ফেলেছে। ফলত, তাদের সৃষ্টিশীলতা তলানিতে ঠেকেছে। তার সুস্পষ্ট ছাপ পড়ছে তাদের সংস্কৃতিজগতে। সেখানে অগত্যা চলছে চর্ব্বিতচর্ব্বণ। কুবেরশাসিত এই আধুনিক সভ্যতা সেকারণেই একটিও নতুন খেলার জন্ম দিতে পারছে না কিছুতেই। পারছে না নতুন কমেডি বা কমেডিয়ানের জন্ম দিতে; প্রাগাধুনিকেরা আজও যা পারে। এসবই আধুনিক এই সভ্যতার মৃত্যুর লক্ষণ। কার্য্যত ঐ তিন অন্ধকূপের ভিতরে কোনোমতে দেহটুকু নিয়ে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে ‘আধুনিক সভ্যতা’র খপ্পরে পড়ে যাওয়া মানুষ। অগত্যা মন মনুষ্যত্ব সবকিছু ফেলে দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন-আহরণের চেষ্টায় সাধারণ মানুষ ছুটছে; আর, অসাধারণ মানুষ ছুটছে ধন-আহরণ করে কোটি-কোটিপতি হওয়ার জন্য।…

দেখেশুনে গত শতাব্দীর মধ্যভাগেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘মন যখন রাজত্ব করে তখন সে আপনার সুখ আপনি সৃষ্টি করিতে পারে, কিন্তু ধন যখন সুখসঞ্চয়ের ভার নেয় তখন সুখের পরিবর্ত্তে কেবল সামগ্রী পাওয়া যায়।’আর সে সামগ্রীর বোঝা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আজ তা এতই বেড়েছে যে, হয় বোকা দেশনেতাদের দেশে ঐ উদ্বৃত্ত সামগ্রীগুলি বেচে দিয়ে, নয় সমুদ্রে ফেলে দিয়ে কুবেরকে প্রাণ বাঁচাতে হচ্ছে। তার মানে, কুবেরের রথ যদি না থামে রক্ষা নেই। এবার তাকে থামতে হবে, থামাতে হবে। ১ নইলে অন্ধকূপের বন্দীরা তো মরবেই, কুবেরও বাঁচবে না। আর তাছাড়া যন্ত্ররাজ বিভূতির (শিল্পপতির) শতকরা ৫ শতাংশ হলেও কর্ম্মজাগতিক সম্পর্ক ছিল, সমাজমনের মাটিতে পা ছিল, দায়বোধ ছিল; যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতির কোনো দায় নাই, কারণ কর্ম্মজগতে তার পা নেই, সে সম্পূর্ণতই উন্মার্গগামী। কিন্তু পাখি হোক আর বিমানই হোক, বসার জন্য তার ডাল চাই, বিমানবন্দর চাই। পায়ের তলায় মাটি না থাকায় কুবেরের বাহনদের হয়েছে মহাবিপদ। ব্যক্তিগতভাবে তাদের প্রত্যেকেই আপন আপন পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষের সমাজে থাকতে হয় (সমাজবৃক্ষের শাখায় বাস করতে হয়); বসবাসের অন্য কোনো উপায় তার নাই, মানুষ তো! অন্য মানুষের মতো তাকেও তো সমাজবৃক্ষের কোন না কোন শাখাতেই বাস করতে হয়। কিন্তু সমাজকে (মানুষের ঝাঁকত্বকে বা সমাজবৃক্ষকে) খণ্ডবিখণ্ড করতে না পারলে তার ফুলে উঠা বন্ধ হয়ে যায়; ফলে কুবের রূপে তার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। তার মানে, সমাজবৃক্ষের ডালে না বসলে প্রাণ বাঁচে না, সেই ডাল না কাটলেও প্রাণ বাঁচে না! কী বিপদ! তাই সমাজবৃক্ষের কোন ডালে সে পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করে, সেকথা সে গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। সেই ‘অন্তর্দ্ধান’ই তার শক্তি। অন্যথায় তার মৃত্যু। আর কুবেরের বাহনদের মৃত্যু মানেই কুবেরেরও মৃত্যু। এই চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে তার দিন কাটে।

তা সে যাই হোক, এদিকে ‘রাষ্ট্রপ্রধান দেশ’হওয়ায় কুবেরের রথ অনেকটা নির্ব্বিবাদে চলেছে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলি (রবীন্দ্রমতে) রাষ্ট্রপ্রধান নয়, ‘সমাজপ্রধান’(ঝাঁকস্বভাব-প্রধান)। তার মধ্যে আবার বাংলাভাষীরা হল সর্ব্বাধিক সমাজপ্রধান গুণসম্পন্ন। যে কারণে কুবেরের রথযাত্রার পক্ষে এ বড় কঠিন ঠাঁই। স্বাধীনতার পরবর্ত্তীকালে কুবেরের কৃত্রিম ত্রিলোকের মডেল ভারতের অদূরদর্শী নেতাদের মাধ্যমে এদেশে ঢুকিয়ে দিতে পারলেও, বাংলাভাষীদের সমাজ সেই মডেলের স্বরূপ যতই উপলব্ধি করেছে, ততই তার বিরোধী হয়ে উঠেছে, উঠছে। সে তো কুবেরের রথ আটকে নিজেদের প্রকৃতিপ্রদত্ত ত্রিলোক উদ্ধারে যাবেই। সে আশাতেই সে কুবেরের তাঁবেদার কংগ্রেস দলকে তাড়িয়ে বামপন্থীদের এনেছিল, জানত না যে, বামপন্থীরাও কুবেরের চেলাগিরি করতে লেগে যাবে। সেকারণে আজ সে আবার বামপন্থীদের তাড়িয়ে অনেক আশায় তৃণমূলকে এনেছে।…

যাই হোক না কেন, বাংলাভাষীরা যে তাদের প্রকৃতিপ্রদত্ত ত্রিলোক উদ্ধারে যাবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আর, তা করার জন্য যে সামর্থ্যের প্রয়োজন, দেখা যাচ্ছে, সে সামর্থ্য তাদের আছে। সর্ব্বোপরি, এক্ষেত্রে তার বাংলাভাষা কার্য্যকরী ভূমিকা নিতে পারে এবং তৃণমূল স্তরে তিন রকম প্রক্রিয়া গ্রহণ করে বাংলাকে বাঁচানো যেতে পারে। যেহেতু বিদেহী কুবেরের বিশ্বায়নী ত্রাসে ইঙ্গ-মার্কিন জাতি ও তাদের ভাষা বাদে বিশ্বের সমস্ত জাতি ও তাদের ভাষা একইভাবে ত্রস্ত ও বিপন্ন, বাংলা যদি নিজেকে বাঁচিয়ে ফেলতে পারে, এই ভয়ানক সময়ে সেটি হবে একটি নিদর্শন। তখন বিশ্বের বাকি সব জাতির মানুষেরাও বাংলার পথ অনুসরণ করতে পারেন।

বাংলার মানসমুক্তিতে বাংলাভাষার সম্ভাব্য ভূমিকা
সভ্যযুগের সূচনা লগ্ন থেকে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক ভাষার শব্দ বা কথাকে পশ্চাৎপটের স্মৃতি রূপে রেখে শিথিলভাবে প্রতীকায়ন করে বদ্ধকথায় পরিণত করে মানুষের সামাজিক গোষ্ঠীগুলি কাজ চালাতে শুরু করে। সমাজশীর্ষে যন্ত্ররাজের উত্থানের পর সেই প্রতীকী শব্দ বা বদ্ধকথাকে সংজ্ঞায়িত দৃঢ়তায় আবদ্ধ করে তাকে বদ্ধকথার ইটে পর্য্যবসিত করা হয়েছে এবং মানুষকে সেই বদ্ধকথার কারাগারে আবদ্ধ করে কথার দাসে পরিণত করে ফেলা হয়েছে। তার ফলেই কুবেরের রথ অবাধে চলতে সক্ষম হয়েছে।

আগে আমাদের ভাষার কোনো শব্দই বদ্ধকথা-মাত্র ছিল না। প্রতিটি গাছের নাম, মাছের নাম, জীবজন্তু ও কীটপতঙ্গদের নাম, বারগুলির নাম, … সবই সেই সেই বস্তু বা বিষয়ের স্বভাবের কথা বলে দিত। নটে থানকুনি ব্রাহ্মী সুষুনি প্রভৃতি শাকজাতীয় শব্দের, ঝিঙা পটল বেগুন ওল প্রভৃতি শাকফল-জাতীয় শব্দের, রুই কাৎলা মৃগেল সিঙ্গি মাগুর টেংরা প্রভৃতি মাছজাতীয় শব্দের, অশ্বত্থ বট বেল আম জাম প্রভৃতি গাছজাতীয় শব্দের, ভারত মিশর ইংলণ্ড জাপান প্রভৃতি দেশজাতীয় শব্দের, কিংবা, পাদোদক ষড়যন্ত্র রবিবার রাষ্ট্র সমাজ গণতন্ত্র শিক্ষাদীক্ষা প্রভৃতি ধারণাজাতীয় শব্দের পশ্চাৎপট দেখতে পেয়ে গেলেই তো নতুন দিগদর্শন ঘটে যায়। কী সমৃদ্ধ ও বিপুল পরিমাণ সেই উত্তরাধিকার! সেই উত্তরাধিকার ছাইগাদায় ফেলে দিয়ে ছাইচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। যে কারণে আমরা নটে বললে Amarantu বুঝি, নটুয়া নর্ত্তকদের স্বতঃউদ্ভবন বুঝি না। থানকুনি বললে Hydrocotyle asiatica বুঝি, সে যে পাচকশক্তির থানকে বা জঠরকে অতি গরম বা ঠাণ্ডা হতে না দিয়ে কুনকুনে গরম রাখে বলেই থানকুনি, সেকথা বুঝি না। … কুবেরের দাপটে বর্ত্তমানে এই সকল বদ্ধকথা আরও অনড় স্থির কঠোর কঠিন হয়ে বাংলাভাষীর মনের উপর চেপে বসেছে। ফলত বঙ্গভাষীর চিন্তাভাবনা হয়ে গেছে বদ্ধকথার সুনির্দ্দিষ্ট অজস্র নুড়িপাথর বা ইটের নানারকমের সম্মিলনী মাত্র। নব নব বাস্তব পরিস্থিতি ধারণ করবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে একালের বাংলাভাষা ও তার শব্দেরা।

পরমাপ্রকৃতি তাঁর অশেষ কৃপায় আমাদের দুজনকে দিয়ে বাংলা শব্দের সেই ছাইচাপা সত্যকে পুনরুদ্ধার করিয়ে নিয়েছেন এবং বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও সরল শব্দার্থকোষ লিখিয়ে নিয়েছেন। এর ফলে বাংলা শব্দের বা বদ্ধকথার বাঁধন খোলা ও কথার পশ্চাৎপট উন্মোচনের কাজের সূচনা হয়ে গেছে। এই পথে এগোতে থাকলে বাংলাভাষার প্রতিটি বদ্ধ-শব্দের বন্ধনমুক্তি ঘটে যায়। এভাবে শব্দের পশ্চাৎপটের রহস্য উন্মোচন করে করে এগোলে বঙ্গভাষীর বিশ্বদর্শন ঘটে যাবে; বদ্ধকথার কারাগারটা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। তখন তাঁর মন বদ্ধকথার দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে নবজীবনের মন্ত্র লাভ করবে। আর, তৎক্ষণাৎ যে বদ্ধকথার ইটের পিরামিডের উপর যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি বিরাজ করছেন, সেই পিরামিডটাই গলে সমতলে নেমে চলে আসবে।

‘পাদোদক’শব্দটির কথাই ধরুন। এর মানে বোঝা হয় ‘পা-ধোয়া জল’। অথচ সে ছিল ‘সাদৃশ্য’অর্থ মাত্র। প্রকৃত অর্থ ছিল, শ্লোকের ও পদাবলীর চরণে চরণে পদে পদে আমাদের মহান পূর্ব্বপুরুষেরা চরণামৃত-স্বরূপ যে অমৃতসমান জ্ঞানরস রেখে গিয়েছেন, তার কথা। পাদোদক পান করা মানে সেই জ্ঞানরস পান করা, পা-ধোয়া জল খাওয়া নয়। সেই পশ্চাৎপট উন্মোচন করে দিলেই পাদোদক কথাটি আর বদ্ধকথা মাত্র থাকে না, বন্ধনমুক্ত হয়ে যায় পাদোদক শব্দ ও তার শব্দার্থ। তখনই বাংলাভাষীর মনও পাদোদক কথাটির ‘পা-ধোয়া জল’-রূপ আবদ্ধ স্থির অনড় অচল অর্থের দাসত্ব থেকে বা পাদোদক-মূঢ়তা থেকে মুক্তি লাভ করে। একালের প্রতিটি বাংলা শব্দের দশা নটে থানকুনি বা পাদোদক শব্দের মতো। প্রতিটি শব্দের ক্ষেত্রেই এই মুক্তিসংগ্রাম চালাতে হবে। তবেই কথার অধীনতা বা দাসত্ব থেকে মিলবে মুক্তি।…

অতএব, পথ আমাদের সামনে খোলা হয়েই গিয়েছে। বাংলাভাষার প্রত্যেক শব্দের পশ্চাৎপটের রহস্য উন্মোচন করতে হাত লাগান। জ্ঞানের নব নব দিগন্ত উন্মোচিত হোক প্রত্যেক বাংলাভাষীর সামনে। আর, জ্ঞানচক্ষু খুলে গেলে বাকি কাজটি বঙ্গভাষীগণ নিজেরাই করে নিতে পারবেন।

প্রকৃতিপ্রদত্ত ত্রিলোকের উদ্ধার হবে কেমন করে
কথার দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতে শুরু করলে যে বিশ্বদর্শন ঘটতে থাকবে, সেই দর্শনই বাংলাভাষীকে বলবে— এবার তাহলে আমাদের হৃত ত্রিলোক উদ্ধার করে ফেলা হোক। কুবেরের কৃত্রিম ত্রিলোকের অন্ধকূপ থেকে মুক্তিলাভের ডাক দেওয়া হোক। অবশ্যই তার জন্য নিশ্চয় দ্বিমুখী প্রক্রিয়া চালাতে হবে। একদিকে কুবেরের রথ থামাতে হবে, অন্য দিকে নিজেদের প্রকৃতিপ্রদত্ত কর্ম্মজগৎ, জ্ঞানজগৎ, ও সমাজকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে হবে।

তবে কি আমরা সামাজিক অভ্যুত্থানের কথা বলছি? না, একদমই না। হিংসা, বিপ্লব বা ভোটে জিতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল, ওসব ব্যাপার থাকবে না এই প্রক্রিয়ায়। কেননা, সমস্যা তো একদিকে কুবেরের রথকে থামানো এবং অন্য দিকে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক লীলাভূমিতে কর্ম্মচর্চ্চা, জ্ঞানচর্চ্চা, ও যৌথতার চর্চ্চা করার সনাতন অভ্যাসের বোধন-উদ্বোধন করা এবং সে বিষয়ে সবাইকে অবহিত করা; জ্ঞানযোগীদের, কর্ম্মযোগীদের বা রাজনৈতিক নেতানেত্রীদেরও। কুবেরকে থামানোর প্রধান উপায় হল, তার বাহনস্বরূপ সংস্থাসমূহের পিছনে টাকা শোষণ করে ফুলতে থাকা ব্যক্তিগণের সামাজিক পরিচয় প্রকাশ করে দেওয়া। ব্যক্তি বলেই সমাজ ছাড়া সে বাঁচে না, অথচ সমাজকে (মানুষের ঝাঁকত্বকে) খণ্ড খণ্ড করে নষ্ট ধ্বংস করতে না পারলে তার ফুলে ওঠা আটকে যায়। তাই সে যে ডালে বসে, সেই ডালটাই কাটে। আর সেজন্যই তার নাম প্রকাশ হয়ে পড়লে তার দারা পুত্র পরিবার আত্মীয় স্বজন সমাজে টিকতে পারে না। এই ব্যাপারটি তার কাছে মৃত্যুর সমান হয়ে দেখা দেয়। আর, সনাতন অভ্যাসের বোধন-উদ্বোধন করার জন্য কী কী করা দরকার বলে আমাদের মনে হয়েছে, সেকথা এক এক করে বলছি। তবে প্রথমে কুবেরের রথকে ঠেকানোর বাস্তব প্রায়োগিক দিকগুলি বিষয়ে কথা হোক।

কুবেরের রথকে ঠেকাতে হলে তিন দিক দিয়েই তাকে আটকাতে হবে। কারণ সে বিরাজ করে শহরে, সেখান থেকে তিন দিক দিয়ে সে গ্রামে ঢুকছে— তার কর্ম্মব্যবস্থা, তার শিক্ষাব্যবস্থা, ও তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে সে গ্রামে ঢুকছে ও গ্রাম দখল করছে; গ্রামের মানুষের মানসভূমি ও বাহ্যভূমি দখল করছে। গ্রামের কর্ম্মজগতে সে ঢুকছে ‘ক্যাশ ক্রপ’বা ‘বিক্রয়ের জন্য শস্যাদি উৎপাদনের নীতি’নিয়ে, যা ‘পরিবারের ভোগের জন্য উৎপাদনের’গ্রাম্য নীতিকে সরিয়ে দিয়ে তার স্থান দখল করছে। গ্রামের কুটীর শিল্পকে সে বাধ্য করছে যন্ত্ররাজের অধীনস্থ হতে। শহরতলিতে গ্রামের জমি কিনে প্রাচীর তুলে তার ভিতরে শহুরে উৎপাদন ব্যবস্থা কায়েম করছে। সেই প্রাচীরের ভিতরে গ্রামসমাজের শাসন চলে না, চলে শহুরে শাসন বা কুবেরের তাঁবেদার শাসন। শহুরে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ও কুবেরের মিডিয়া তার হাত-পা প্রসারিত করছে গ্রামে। গোপন ভোটব্যবস্থা দ্বারা কলুষিত পঞ্চায়েতের নাম করে শহুরে শাসনব্যবস্থা ঢুকছে গ্রামে— ১০০ দিনের কাজ, বিপিএল কার্ড, ২ টাকা কেজি চাল, নানা দয়ামূলক যোজনা দিয়ে স্বনির্ভর গ্রামসমাজকে পরনির্ভর করে খর্ব্ব করা বা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, হচ্ছে। এরকম দানে যে গ্রামবাসীর মান সম্মান ইজ্জৎ হরণ করা হয়, আধুনিক শিক্ষিতেরা সেটা বুঝতেই পারে না। বুঝবে কী করে? শিক্ষিত হতে গিয়ে তারা তো নিজেদের মনুষ্যত্বটাই খর্ব্ব করে ফেলেছে। অথচ মানুষকে ও তার সমাজকে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করাই প্রকৃত কাজ ছিল রাষ্ট্রের। কোনো কোনো নেতানেত্রী সেরকম করার চেষ্টা করে থাকেন বটে, কিন্তু তাঁদের সে চেষ্টাকে ফলপ্রসূ হতে দেওয়া হয় না। কুবের পরিকল্পিত তাঁবেদার আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার, তার ফোঁপরা-গণতান্ত্রিক-রাষ্ট্র ও তার আমলাতন্ত্রের সমস্ত কাজকর্মের লক্ষ্য থাকে মানুষের যৌথতা নষ্ট করা, সমাজ ভেঙে দেওয়া, পরিবার থেকে গোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করে মানুষকে একা করে দেওয়া; শিক্ষিত মানুষকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা তুলে ধরে তার জয়গান গাইতে প্ররোচিত করা। কিন্তু সেটি যে বিপরীত পক্ষে কখনো কখনো সমাজবিরোধী কাজ রূপে ক্রিয়া করে ফেলে, আধুনিক অ্যাকাডেমি-শিক্ষায় শিক্ষিতেরা সেকথা বুঝতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা আমার নহে’। … তা সে যাই হোক, শিক্ষা কর্ম্ম প্রশাসন এই তিন দিক দিয়ে গ্রাম ও গ্রামের মা মাটি মানুষকে গ্রাস করে ধর্ষণ করছে কুবের ও তার চেলাচামুণ্ডারা। এই তিন দিক থেকে তার অগ্রগতিকে বলতে হবে— ঢের হয়েছে। এবার থামো।

অন্য দিকে গ্রামসমাজকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। গ্রামের প্রয়োজন গ্রামই মেটাবে। গ্রামের উৎপন্ন, গ্রামের শিক্ষা, গ্রামের লালনপালন (শাসন) গ্রামই সামলাবে। আর, গ্রামসমাজকে জাগ্রত করে ফেলতে পারলে, গ্রামই তা করে নিতে পারবে। গ্রামের শিক্ষা, গ্রামের স্বাস্থ্য, গ্রামের উন্নয়ন, এসব তো আগের কালে গ্রামই করত। ২ আধুনিক সভ্যতা গ্রাম দখল করে গ্রামসমাজের সেই সব মহান অর্জ্জনগুলি ফেলে দিয়েছে। ফেলে দিয়েছে গ্রামের, গ্রামসমাজের, গ্রামীণ জ্ঞানচর্চ্চাকারী জ্ঞানবুড়োর ও বৈদ্যদের এবং মায়েদের দর্শন রূপকথা গান খেলা ইত্যাদি সবকিছুই। ৩ আজকের বাংলাভাষীকে সেই হৃতসম্পদ পুনরুদ্ধার করে, তাদের ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে সেগুলির একালীকরণ করে নিতে হবে। এভাবে স্বনির্ভরতার দিকে পা বাড়িয়ে তার পরেই সে শহরকে বলতে পারে, ‘কে কার উপর নির্ভরশীল তার বিচার হোক। পারস্পরিক নির্ভরতার নীতি যদি মান্য হয়, তবে হিসাব করে দেখা হোক, আমার কাছে যে প্রাণ বাঁচানোর খাদ্যসম্ভার তুমি নিচ্ছ, তার বদলে আমাকে কী দিচ্ছ? নাকের বদলে নরুন!?’

তবে সব কাজই করতে হয় প্রচলিত পরিস্থিতির মধ্যে। এখন আমাদের দেশে চলছে একদিকে যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতির কর্ম্মজাগতিক রাজত্ব, তার তাঁবেদার শিক্ষাব্যবস্থা, ও ফুটো গণতন্ত্রনির্ভর রাষ্ট্রের শাসন; অপরদিকে গ্রামের মানুষের স্বাভাবিক-ত্রিলোকে চলছে দুর্ব্বল গ্রামসমাজের কষ্টকর অস্তিত্ব রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা। এই অবস্থা থেকে শহর সংযত হয়ে তার মতো থাকুক এবং গ্রাম পুনরুজ্জীবিত হয়ে স্বনির্ভর হয়ে চলুক, এবং শহর ও গ্রাম পরস্পরের পরিপূরক অবস্থানে সক্রিয় থাকুক— এই অবস্থায় পৌঁছতে গেলে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। হারিয়ে যাওয়া বহু কিছুই পুনরুদ্ধার করে একালীকরণ করতে হবে। অনেকগুলি গ্রাম মিলিয়ে এক একটি আবাসিক শান্তিনিকেতন এবং প্রতি গ্রামে তার বুনিয়াদী শাখা গড়ে তুলতে পারলে তবেই শহুরে শিক্ষাকে ঠেকানো সম্ভব। সেই আবাসিক শিক্ষাকেন্দ্রগুলির খরচ জোগাবেন গ্রামের মানুষেরাই। রাষ্ট্র তাদের স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টাকে সহায়তা করবে, দয়া করবে না।…

তবে এই সব ব্যাপারই বহু আলাপ-আলোচনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার। স্বভাব-নেতানেত্রীগণ দায়িত্ব নিয়ে এই কাজে হাত নিজেদের উৎসর্গ করলে, তবেই এর সবকিছু বুঝে ওঠা সম্ভব, বাস্তবায়িত করার কথা তার পরে। অতএব অবিলম্বে আলাপ-আলোচনা, চর্চ্চা শুরু হোক।

আলাপ-আলোচনা ও চর্চ্চায় দেশ মুখরিত হোক
প্রথমত, মানুষের শরীরের শ্রেষ্ঠ অংশ কোনটি— মাথা না পেট? জ্ঞান শ্রেষ্ঠ না ধন শ্রেষ্ঠ। কথা হোক, সমাজে জ্ঞানীর স্থান শীর্ষে থাকা উচিত নাকি ধনীর স্থান শীর্ষে থাকা উচিত। কর্ম্মযোগী বক্ষ বা হৃদয়ের স্থান কোথায়? মস্তিষ্ক ও হৃদয় ছাড়া যেমন মানবদেহের কথা ভাবা যায় না, তেমনি জ্ঞানযোগী-জ্ঞানব্রতী ও কর্ম্মযোগী-নেতানেত্রী ছাড়া কি সমাজদেহের কথা ভাবা সম্ভব? যার যা অবস্থান তাকে তার অবস্থান অনুসারে মর্য্যাদা দিতে হবে কি না? কাটলে রক্ত ঝরে মাথা থেকে, পা থেকেও। লাগলে ব্যথা করে মাথাতে, পায়েও। এ ক্ষেত্রে উভয়ের গুরুত্ব বা মর্য্যাদা সমান। কিন্তু মাথাকে রাখতে হয় উঁচুতে, রক্ষা করতে হয় বিশেষভাবে। মাথা গেল তো সবই গেল; এমনকি খারাপ হয়ে গেলেই সব থেকেও নাই হয়ে যায়। যদিও, হাত পা খোঁড়া হয়ে গেলে বা স্টিফেন হকিং-এর মতো মাথাটুকু সম্বল হয়ে বেঁচে থাকলেও প্রায় সবই থাকে। অথচ, খাদ্য ভাগের বেলায় সর্ব্বাঙ্গের কোষসমূহের প্রয়োজন পূরণকারী পেটের খোরাকের দাবি সবার আগে; মনের খোরাকের দাবির স্থান দ্বিতীয় স্থানে। বিশেষ পরিস্থিতিতে উলটোও হয়, হতে হয়। এইভাবে, মানবদেহে ও সমাজদেহে কার কোথায় স্থান, তা নিয়ে আলোচনা হোক। তারপর দেখা হোক, কর্ম্মজগতের দিশা ঠিক করবে কে? মস্তিষ্ক না হৃদয়? জ্ঞানযোগী না কর্ম্মযোগী? নাকি পেট? কে ঠিক করবে, কী কাজ মানুষের করা উচিত? কখন কীভাবে করা উচিত? খাদ্যাদি পাক করে প্রাণরস সারাদেহে বণ্টন করে দেওয়া পেটের কাজ। তাই, পেটের প্রয়োজনে খাদ্যাদি আনয়নের উপায় করতে হয় ঠিকই, কিন্তু সেটি কে আনবে, কীভাবে আনবে, তা দেখার দায়িত্ব পেটের নয়, মস্তিষ্কের ও হৃদয়ের এবং তাদের নির্দেশে কর্ম্মরত হাত-পায়ের। তা না করে পেটই যদি খাদ্যাদি আনয়নের উপায় ঠিক করতে লেগে যায়, মস্তিষ্কের ও হৃদয়ের স্থান দখল করে বসে, তা হলে মহাবিপদ। মন ও মনুষ্যত্ব ফেলে দিয়ে সেই বিপদে পড়ে গেছে বর্ত্তমান কুবেরশাসিত বিশ্বায়নী সভ্যতা। তার আসল ঘরে মশাল নাই, ঢেঁকিঘরে চাঁদোয়া! একালের সকল অহিতের কারণ সেটাই। এর বদলে কী ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, তাই নিয়ে আলোচনা হোক।

দ্বিতীয়ত, জ্ঞানজগতের দুটো ভাগ। স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানচর্চ্চার (সূর্য্যালোকের) এলাকা, ও পূর্ব্বাগত প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানচর্চ্চার (কৃত্রিম আলোকের) এলাকা। এই দ্বিতীয় এলাকাটিকেই শিক্ষাব্যবস্থা বলে। শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশজোড়া আলোচনা হোক। উত্তরপ্রজন্মের লালনপালন করা হবে কেমন করে? রবীন্দ্রনাথের মডেলকে একালীকরণ করে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা আলোচিত হোক। কুবেরের শিক্ষা মডেল, বর্ত্তমান রাষ্ট্রশীর্ষে অধিষ্ঠিত নেতা ও আমলারা যা প্রয়োগ করে চলেছে, তা ব্যর্থ করা হোক। শহুরে শিক্ষা মানেই তো মনুষ্যত্ব নাশের শিক্ষা, দক্ষ মজুর বা মিস্ত্রি হওয়ার শিক্ষা; সে শিক্ষায় যত উচ্চশিক্ষিত হওয়া যায় ততই মনুষ্যত্বহীন হতে হয়, ততই মিথ্যা কথা বলতে শেখে, সত্যগোপন করতে শেখে! শিক্ষিতেরাই তো ভোট দিয়ে নাম গোপন করা উচিত বিবেচনা করে! গ্রাম কেন সেই নষ্ট শিক্ষার জন্য শহরে ছুটবে? শহর কেন একটু একটু করে গ্রাম দখল করে বাউন্ডারি ওয়াল দেবে এবং গ্রামকে ধর্ষণ করবে? শহুরে আধুনিক শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা সেটাই তো করছে। অথচ একালের আধুনিক শিক্ষাবিদরা সেটা দেখতেই পাচ্ছেন না। কেন, এখনও শহরকে ও শহুরে শিক্ষাকে সীমায়িত এলাকায় আবদ্ধ করা হবে না কেন?

তৃতীয়ত, নেতার সঙ্গে জনতার নাড়ীর সম্বন্ধ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হোক। নেতাকে গালি দিয়ে যারা কাজ সারে, জানবেন তারা কুবেরের অনুচর। তারা নেতাকে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে কিনে নেওয়ার তালে থাকে। সমাজের নেতাই সমাজদেহের বক্ষ, হৃদয়। সমাজের আবেগ সে ধারণ করে। বলতে কী, কুবেরের পরিকল্পিত ফুটো-গণতন্ত্রের সব জুয়াচুরি পেরিয়ে আজও বাংলাভাষীদের সমাজে স্বাভাবিক নেতানেত্রীর জন্ম হয়। তাদের মুখ দিয়ে সমাজের হৃদয় কথা বলে। দলতন্ত্র ও গোপন-ভোটনির্ভর সরকারী নির্ব্বাচন প্রথার মাধ্যমে নির্ব্বাচিত-নেতা হতে গিয়ে সেই নেতার স্বভাব নষ্ট হয়। বলা ভাল, কুবের পরিকল্পিত ফোঁপরা-গণতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় মডেলের সত্যগোপনকারী নির্ব্বাচন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নেতার সঙ্গে জনতার নাড়ীর সম্বন্ধটাই কেটে দেয় এবং উভয়কে ছোটলোক হতে প্ররোচিত করে। লক্ষণীয় যে, অশিক্ষিতেরা, অবশিক্ষিতেরা, স্বশিক্ষিতেরা ভোট দিয়ে নাম গোপন করতে লজ্জা বোধ করে; সমগ্র গ্রামবাসী মিলে কাকে ভোট দিয়েছে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করে ভোজ করে। যখন কিনা, অ্যাকাডেমি-শিক্ষিতেরা নাম গোপন করে এবং সেই কুকর্ম্মের পক্ষে ওকালতি করে। কারণ অ্যাকাডেমি শিক্ষা তাদের মনুষ্যত্ব খর্ব্ব করে দিয়েছে। তাই তারা ওরকম করে। … এইসব নিয়ে আলোচনা শুরু হোক। নেতা বানাব কেমন করে? নেতার সঙ্গে জনতার নাড়ীর সম্বন্ধ রক্ষা করা হবে কেমন করে? হৃদয়কে বাদ দিয়ে যেমন মানবদেহ বাঁচে না, নেতানেত্রীদের বাদ দিয়ে তেমনি সমাজদেহ বাঁচতে পারে না।

বঙ্গভাষীর বাংলাকে বাঁচানোর সামর্থ্য
কথাটি আপাত বিচারে অবিশ্বাস্য লাগলেও একান্তভাবে সত্য— বাংলাভাষী জাতিটির স্বভাব ও ঐতিহ্য এতই উচ্চ মানের যে, সে বর্ত্তমান বিশ্বায়নী ত্রাস থেকে বাংলাকে রক্ষা করতে পারে। ৪ সংক্ষেপে, তার স্বাধীনচেতা মনোভাব, নিজ পদ্ধতির সংস্কৃতচর্চ্চা, তার পদাবলী সাহিত্যে অধিকার, তার কট্টরতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা উভয়ের বিরুদ্ধাচরণ, তার হিন্দু-মুসলিম-আদিবাসী নির্ব্বিশেষে একই অতীতের উত্তরাধিকার, জীবনে সঙ্গীতের ব্যাপক উপস্থিতি, সত্য-শিব-সুন্দরের প্রতি তার অচল ভক্তি, তার সর্বোত্তম দর্শনস্বরূপ অদ্বৈতবাদে (two-in-one মতবাদে) অধিকার, তার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর উত্তরাধিকার, তার অবিসংবাদিত আবেগ, বাহ্যসম্পদে অনীহা কিন্তু মানসসম্পদের প্রতি তীব্র বাসনা ছাড়াও তার রবীন্দ্র-নজরুলে ভক্তি— এরকম উত্তরাধিকার কোনো জাতির নাই বললেই চলে। … এছাড়াও তা যে অভিনব বৈশিষ্ট্যগুলি রয়েছে, এখন সে প্রসঙ্গে কিছু বলে নেওয়া যাক।

প্রথমত, বাংলাভাষী জাতিটি এখনও যে বিপুল বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহার করে কথা বলে থাকেন, তার পরিমাণ বিশ্বের যে কোনো জাতির বাগধারাদি ব্যবহারের পরিমাণের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এ যে আসলে ‘জ্ঞানবাণী’লেনদেন করা, সেকথা ‘বাংলাভাষার সম্পদ কোথায়’নিবন্ধ পাঠক ইতোমধ্যে নিশ্চয় জেনে গেছেন। বঙ্গভাষী তাই তার ভাষার কারণেই তুলনামূলক ভাবে অন্যান্য জাতির তুলনায় জ্ঞানী। গ্রামবাংলার মানুষের তো কথাই নেই, শহরের মন্ত্রী থেকে সান্ত্রী পর্যন্ত সকল বাংলাভাষীই বাংলার বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচন কমবেশি ব্যবহার করে থাকেন। সাধারণ বাংলাভাষীর জ্ঞানকে যারা ভয় পায়, যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতির সাগরেদ সেই অ্যাকাডেমি-শিক্ষাব্যবস্থার ধারক-বাহকেরা, আধুনিকতাবাদীরা, মার্কসবাদীরা বা মাওবাদীরা… তাদের বিপুল চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাভাষীকে তাঁর ঐ অভ্যাস ত্যাগ করানো যায়নি। বাঙালীকে যন্ত্রবৎ কর্ম্মী বানানোর শিক্ষা দিয়ে যারা আশা করেছিল, শিক্ষিত বাঙালীর বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব থাকবে না, জ্ঞান থাকবে না, আবেগ থাকবে না, প্রেম ভালবাসা স্নেহ মমতা মান অভিমান থাকবে না, তাদের সেই পরিকল্পনা অনেকটাই ভেস্তে গেছে। অ্যাকাডেমি শিক্ষাব্যবস্থার সমস্ত চাপ অগ্রাহ্য করে বাংলাভাষীর পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য তার সন্তানদের স্বভাবের ভিতরে আজও কমবেশি বিরাজ করছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাভাষীর মনে এখনও বাংলাভাষার বারোরকম শব্দপ্রকরণ কর্ম্মশালা কমবেশি সক্রিয় রয়েছে। গ্রামের বাংলাভাষীর তো রয়েইছে, এমনকি শহুরে শিক্ষিত বাংলাভাষীও সে ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেননি। বুদ্ধির ঢেঁকি, চামচা, পুঁচকে ঝলক, সটাসট-ফটাফট… এ ধরনের অজস্র নতুন নতুন বাংলা শব্দ একালের শহুরে বাংলাভাষীরই সৃষ্টি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, এই নবসৃষ্ট শব্দগুলি সবই একশোভাগ ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক (ধ্বনিভিত্তিক) নিয়মেই তাঁরা তৈরি করেন, অবশ্যই সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সচেতন না হয়েই; আর, সেটাই স্বাভাবিক। যে বিজ্ঞানসম্মত ভাষাতাত্ত্বিক সমর্থন তাঁদের ঐ কাজের পিছনে বিদ্যমান, পরমাপ্রকৃতি আমাদের দুজনকে নিমিত্ত করে ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ও ‘সরল শব্দার্থকোষ’প্রকাশ করে তাঁদের হাতে তুলে দিয়ে বাকি কাজটির সূচনাও করে দিয়েছেন। সুতরাং, এখন শুধুমাত্র তাঁদের ভাষাকে যদি সামাজিকভাবে ও সরকারিভাবে মর্য্যাদা দেওয়া হয়, তাহলেই বাংলাভাষী যে পুনরায় সগৌরবে জেগে উঠবেন, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই।

তৃতীয়ত, আয়ার্ল্যান্ডের অধিবাসী আইরিশদের মতো পশ্চিমবাংলার অধিবাসী বাংলাভাষীদের বাহ্যিক অবস্থা অনেকটা একরকম হলেও, মানসিক অবস্থা একরকম নয়। আয়ার্ল্যান্ডের ভাগ্যে কোন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না, ছিলেন না তাঁর মতো কোনো বড় মাপের আইরিশ কবি-সাহিত্যিক। ছিল না বাংলাভাষী জাতিটির মতো বিশাল জ্ঞানরসসেবী সমাজও। সর্ব্বোপরি, বাংলার হাতে প্রাচীন কাল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্য্যন্ত যে বিশাল ভাবসম্পদ, সাহিত্যভাণ্ডার, জ্ঞানভাণ্ডার আছে, আইরিশ জাতির তা ছিল না। সে কারণে আইরিশ জাতি বিশ্বজুড়ে চলা ভাষা-মড়কের হাত থেকে তার ভাষাকে বাঁচাতে পারেনি। কিন্তু বাংলাভাষীর ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা না ঘটারই কথা। বাংলাভাষী চাইলে এই ভাষা-মড়কের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কেননা, তার জন্য প্রয়োজনীয় সামর্থ্য তার কার্য্যকরীভাবে মজুত আছে।

চতুর্থত, বাহ্যসম্পদই মানুষের মোক্ষ, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা কুবেরের এই নীচ দর্শন অঘোষিতভাবে প্রচার করে চললেও, শিক্ষিতদের ৯৯৯টি বিষয়ে মূর্খ বানিয়ে অতি-খণ্ডজ্ঞানীতে পরিণত করে দিলেও, বাঙালী শিক্ষিতেরা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়নি। যাবে কী করে? তাদের পারিবারিক-সামাজিক শিক্ষাকে তাদের মনের গভীর থেকে তো উৎখাত করা যায়নি। যায়নি বলেই দেশে মানবীশরীর যখন ধর্ষিত হয়, তখন বাঙালী গ্রামবাসী অশিক্ষিতদের পাশাপাশি শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিতরাও প্রতিবাদ করতে লেগে যান। তখন একথা সেই ‘অবোধ’শিক্ষিতেরা ভুলে যান, কুবেরের প্রিয় দেহবাদী দর্শনের প্রচারে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করে গেছে উচ্চশিক্ষিতদের অ্যাকাডেমি শিক্ষাব্যবস্থাই। তাঁরা যদি জেদ ধরতেন, তাহলে কুবেরের মিডিয়া যত শক্তিমানই হোক, দেহবাদী দর্শনের প্রচার তারা কিছুতেই করতে পারত না। কেননা, হনুমানের লেজটাকে (পণ্ডিতের ডিগ্রির ওজনকে) সরিয়ে ফেলা কোনো ভীমের (ধনতান্ত্রিক প্রচারকারীর) পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হয়নি, হবে না।

পঞ্চমত, আগের নিবন্ধ থেকে সবাই জেনে গেছেন যে, একালের বিশ্বশাসক যন্ত্রসম্রাট মহাবিভূতি কুবের স্বভাবত মানুষের স্বাভাবিক যৌথতার বা ‘সমাজ’-এর ঘোর বিরোধী। তার পরিকল্পিত কর্ম্মজগতের মডেল, শিক্ষাব্যবস্থার মডেল, ও ফুটো-গণতন্ত্রের মডেল যে সমাজকে ধ্বংস করার সবরকম চেষ্টা চালায়, সেকথা আমরা ইতোপূর্ব্বে বলেছি। বাংলায় বিগত ষাট-সত্তর বছর ধরে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আধুনিকতা, মার্কস্বাদ এবং দলতন্ত্রনির্ভর গোপন ভোটব্যবস্থা নানাভাবে বাংলার সমাজকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়েছে সমানে। তা সত্ত্বেও সে সমাজ যে মরেনি, তার অজস্র প্রমাণ আমাদের হাতে রয়েছে। যেহেতু আধুনিকতা ও মার্কস্বাদী তত্ত্বটি খণ্ড তত্ত্ব মাত্র, তাতে মানুষের জন্ম-মৃত্যু-বিবাহাদির কোনো যথাযথ নিদান পাওয়া যায় না, তাই গ্রামসমাজকে রাষ্ট্র ও বামপন্থীরা ধ্বংস করতে পারেনি। সেকারণে আজকের গ্রামবাংলাতেও জন্ম মৃত্যু বিবাহ প্রভৃতি বিষয়ে গ্রামের সমাজ সক্রিয় হয়ে তার দায় কমবেশি পালন করে থাকে। গ্রামে কেউ মরে পড়ে থাকলে দেখামাত্র গোটা গ্রাম জড়ো হয়ে যায়, আজও। কেবল তাই নয়, সম্প্রতিকালে সেই দেয়ালে-পিঠ-ঠেকে-যাওয়া গ্রামসমাজের একপ্রকার পুনরুত্থান ও নবীকরণ হয়েছে, হচ্ছে। বলতে গেলে, সেই গ্রামসমাজই পশ্চিমবঙ্গের বিগত নির্ব্বাচনে বামপন্থীদের সরিয়ে তৃণমূলকে অনেক আশা নিয়ে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সে আশা তাদের পূর্ণ হবে কি না, হলেও কীভাবে হবে, সে কথা স্বতন্ত্র।…

মোটকথা, বিশ্বের কোনো জাতিগোষ্ঠীর এত অমূল্য ও বিপুল মানসসম্পদ নেই। ২৩ কোটি মানুষের এই ঝাঁকটি তাই বিশেষ যোগ্যতা ধরে।… বাংলার এই সকল সামর্থ্য নিয়ে বাংলাভাষীগণ যদি উদ্যোগী হন, তাহলে তাঁরা কেবল নিজেদেরই নয়, বাংলাভাষাকেও রক্ষা করে ফেলতে পারবেন।

উপসংহার
অতএব আর দেরী নয়, আমরা যারা কুবেরশাসিত এই আধুনিক শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থার অন্ধকূপে পড়ে গেছি, আমরা যারা কুবেরের বৃহৎশিল্পের নেতৃত্বে পরিচালিত সর্ব্বনাশা কর্ম্মজগতের অন্ধকূপে পড়ে গেছি, আমরা যারা কুবের-পরিকল্পিত ফোঁপরা-গণতন্ত্রের অন্ধকূপে পড়ে গেছি— এখান থেকে এবার আমাদের বেরোতেই হবে; স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক জ্ঞানজগতের সূর্য্যালোকে মুক্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাদের মন ও মনুষ্যত্বকে বাঁচাতেই হবে; বাঁচাতে হবে আমাদের লক্ষ্মীসাধক কর্ম্মজগৎকে, বাঁচাতে হবে আমাদের সমাজদেহের মাথা ও হৃদয়কে, আমাদের জ্ঞানব্রতী ও নেতানেত্রীকে। রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ ও একালীকরণ করে বাংলার গ্রামে গ্রামে নতুন নতুন শান্তিনিকেতন গড়ে তুলতে হবে। কর্ম্মজগতে কুবেরসাধনা ত্যাগ করে লক্ষ্মীসাধনার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্রকে জনগণের ছিদ্রহীন তন্ত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং নেতা-জনতা সম্বন্ধকে রক্ষা করার জন্য নতুন নির্ব্বাচন-ব্যবস্থার ডাক দিতে হবে; যে নির্ব্বাচনে ভোটপত্রের তিনটি পাতা থাকবে, এবং প্রত্যেক পাতায় ভোটারের ভোটচিহ্ন, ভোট-প্রাপকের স্বাক্ষর, ও নির্ব্বাচন কমিশনের স্বাক্ষর থাকবে এবং প্রত্যেকের কাছে এক একটি পাতা প্রমাণস্বরূপ থেকে যাবে। তাহলেই রাষ্ট্র-পরিচালনায় কুবেরের অনুপ্রবেশের পথটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। ৫…

যুগের ডাক এসেছে বাংলাভাষীর দুয়ারে। বাংলার মা মাটি মানুষকে বাঁচিয়ে, বাংলার কৃষি, কুটীর শিল্প, বাংলার জ্ঞানচর্চ্চা, নিজস্ব ঐতিহ্যপূর্ণ মানুষ গড়ার শিক্ষাব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, নিজস্ব গণ-লালনপালন ব্যবস্থা… এসবকে বাঁচাতে হবে, তবেই বাংলাভাষাও বাঁচবে। সেই পথে ভারতবর্ষও বাঁচবে, বাঁচবে মানবজাতির বিশ্বসভ্যতাও। তাই আজকের বাংলাভাষীর সামনে এক মহান দায়িত্ব পালনের ডাক এসেছে। সে তা সর্ব্বাংশে পালন করতে সক্ষম হবে, এই আমাদের প্রার্থনা। জয় হোক বাংলাভাষীর। জয় হোক বাংলাভাষার। জয় হোক মানবসভ্যতার।

টীকাটিপ্পনী
[১]
‘তুমি যত ভার দিয়াছ সে ভার
করিয়া দিয়াছ সোজা।
আমি যত ভার জমায়ে তুলেছি
সকলই হয়েছে বোঝা।
এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু,
নামাও—
ভারের বেগেতে চলেছি কোথায়,
এ যাত্রা তুমি থামাও।’— বীন্দ্রনাথ ঠাকুর

[২]
এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশী সমাজ’প্রভৃতি বেশ কিছু নিবন্ধ রয়েছে; এবার সকলে মিলে সেগুলি পাঠ রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনাকে একালীকরণ করার চেষ্টাকরা দরকার। আমাদের ‘অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে’ও ‘সুন্দর হে সুন্দর’ গ্রন্থে এ বিষয়ে আমরা করেছি।

[৩]
গ্রামবাংলা তার অর্জ্জিত যে জ্ঞানরস ও খেলাধূলা ইত্যাদিতে ডুবে থাকত, তার খবরই অনেকে আজ ভুলে গেছেন। সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করে একালীকরণ করা দরকার। নানা উপলক্ষে অগুন্তি মেলা, কীর্ত্তন, কবিগান, কথকতা, মঙ্গলগীতি, পল্লীগীতি, লোকগীতি, রাম-রসায়ন গান, যাত্রাপালা, নাটক, সত্যপীরের গান, ভাঁড়নাচ, লালনের গান, আউল(আওলিয়া)–বাউলের গান, সুফীসঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা-উপধারা, মুর্শীদা, গাজী-পীরের গান, কাওয়ালি, মহরম, লাঠিনাচ, ওলাবিবি, পৌষপার্ব্বণ, ভাদু, টুসু, ছৌ, মকর, কাঠিনাচ… শতরকমের খেলা, সিঁদুর টেপাটিপি, ছু কিত কিত, বউমারী, গিজা, হাডুডু, গোল্লাছুট, জলগদা, কানামাছি, বাঘ-বকরি, মোগল-পাঠান, গুটি (মার্বেল) খেলা, ঘুটিং খেলা, দাবা, অষ্টা, হেঁয়ালি লড়াই, ছড়া কাটাকাটি, ঝুল্লু, লুকোচুরি, কড়িখেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, নারকেল লড়াই, মুরগি লড়াই, পাঁঠা ও মেড়ার লড়াই, গরুনাচ… এবং হাজার রকমের রঙ্গতামাসা– এই সব উৎসব খেলাধূলা ও রঙ্গতামাসাকে কুবেরের তাঁবেদার আধুনিকতা নষ্ট করেছে। সর্ব্বোপরি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত, রামপ্রসাদকেও ধামাচাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তারা। মুক্তিগন্ধময় এত বিপুল সাংস্কৃতিক সম্ভার বোধ করি বিশ্বের কোনো জাতির ছিল না, নেই। মিথ্যা ও ত্রুটিপূর্ণ ‘আধুনিকতা’র মোহে এসবকে আধুনিকতাবাদীরা ঘৃণা করেছে, বরবাদ করেছে। মনে রাখা দরকার, মানবজাতি যত সভ্য হয়েছে, ততই সে তার সাংস্কৃতিক রসসৃষ্টি করার যোগ্যতা হারিয়েছে। নতুন খেলা, কমেডি বা রঙ্গতামাসা… ইত্যাদি সৃষ্টি করার যোগ্যতা তার ক্রমশ কমেছে। শিল্পবিপ্লবোত্তর আধুনিক সভ্যতা একটি খেলাও সৃষ্টি করতে পারেনি। যা পেরেছে তা হল, প্রাগাধুনিক যুগের কোনো কোনো খেলাকে (দাবা, ফুটবল, ক্রিকেট প্রভৃতিকে) বিক্রয়যোগ্য করে সেগুলির ভিতর থেকে ক্রীড়াত্বকে (নর্ম্মকে) সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া। এই বিচারে আধুনিক সভ্যতা একেবারেই শূন্যগর্ভা। বাংলায় ভানু জহর রবিঘোষ প্রমুখেরা গোপাল ভাঁড়ের শেষ প্রজন্ম। খেল, খেলা, ক্রীড়া, নর্ম্ম ও রঙ্গতামাসা প্রভৃতি শব্দের নিহিতার্থ আমাদের জানায় যে, মানবজাতি সেগুলিকে সৃষ্টি ও লালনপালন করার যোগ্যতা যতই হারাবে, ততই বিলুপ্ত হওয়ার দিকে পা বাড়াবে। মানুষ হাসতে-খেলতে ভুলে গিয়ে মনমরা হয়ে মৃত্যুর দিকে এগোয়, মানবজাতিরও ভবিতব্য তাই।

[৪]
এ প্রসঙ্গে অনেক বিস্তারে আলোচনা আছে আমাদের ‘বঙ্গযান’গ্রন্থে।

[৫]
এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা আমরা উপরোক্ত (২-এ কথিত) গ্রন্থ দুটিতে করেছি।

23669107_991937210946531_3818214380102258710_o (1)কলিম খান
জন্ম: ০১ জানুয়ারী ১৯৫০, মামুদাবাদ (মেদিনীপুর)। মৃত্যু: ১১ জুন ২০১৮, কলকাতা।

কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:

১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)

কলিম খান’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে (১৯৯৫)
২. দিশা থেকে বিদিশায় : নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশবার্তা (১৯৯৯)
৩. জ্যোতি থেকে মমতায় : ফ্রম এনলাইটেনমেন্ট টু…. (২০০০)
৪. পরমাভাষার সংকেত (২০০১)
৫. আত্নহত্যা থেকে গণহত্যা : আসমানদারী করতে দেব কাকে (২০০২)
৬. পরমা ভাষার বোধন উদ্বোধন : ভাষাবিজ্ঞানের ক্রিয়াভিত্তিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (২০০২)

59988119_1370063993133849_5472995070590320640_nরবি চক্রবর্ত্তী

জন্ম: ২৪শে অক্টোবর ১৯২৯, কোন্নগর, হুগলী।

কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:

১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)

রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. India Rediscovered (2002)
২. দিগন্তের টানে : The Lure of Horizon (২০১২)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার