বাঙ্গলাভাষার সম্পদ কোথায় || রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান

0

কথারম্ভ

সাধারণভাবে ভাষা মানুষের (ক) জ্ঞানচর্চ্চা, (খ) প্রশাসন চালানো, ও (গ) কর্ম্মজগৎ চালানো, অর্থাৎ উৎপাদন, বণ্টন প্রভৃতি অর্থকরী কাজকর্ম্ম বা রুজি-রোজগার চালিয়ে সমাজ-সংসার চালানো— একত্রে এই তিনরকম কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যে ভাষার সাহায্যে এই তিনরকম কাজই খুব ভালভাবে করা যায়, সে ভাষাই ভাল ভাষা, কার্য্যকরী ভাষা; ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে প্রকৃত কাজের ভাষা। যে শক্তির জোরে সেই কার্য্যকরী ভাষা তার ঐ তিনরকম কাজই চালাতে পারে, আমরা সেই শক্তির বিষয়ে কথাবার্ত্তা বলতে চলেছি। সেই শক্তি যে যে ভাষার যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে, তাদেরকেই আমরা শক্তিমান ভাষা, প্রকৃত সম্পদশালী-ভাষা বলে মনে করি। এখন জানা দরকার, ভাষার সেই প্রকৃত-সম্পদ বা শক্তি কাকে বলে?

          বনজঙ্গল সাপটে একজন মানুষ প্রচুর পরিমাণে ফলমূল সংগ্রহ করে আনে এবং সেকারণে তার ঘরে প্রচুর ফলমূল থাকতে পারে। ঘরের সেই ফলমূল হল মানুষটির অর্জ্জিত-সম্পদ। এইরূপ অর্জ্জিত-সম্পদকে মানুষটির প্রকৃত-সম্পদ বলে মনে করা হয় না। প্রকৃত-সম্পদ বলে মনে করা হয় মানুষটির ফলমূল সংগ্রহ করে আনার শক্তিকে, ফলমূল সংগ্রহ করার উপায়স্বরূপ নানা প্রকার হাতের-হাতিয়ারকে— তার আকর্ষি, কাতি, ডাণ্ডায় বাঁধা দাউলি, লগির মাথায় বাঁধা জালি, গাছে চড়ার মই, মাটি খোঁড়ার শাবল, কাটারি প্রভৃতি অস্ত্রশস্ত্রকে; সেগুলি ব্যবহার করার দক্ষতাকে; এবং সর্ব্বোপরি তা করার ইচ্ছাকে। ঐগুলি বানিয়ে নিতে পেরেছে এবং ব্যবহার করতে পারে বলেই মানুষটি যখন ইচ্ছা করে তখনই যেমন খুশি তেমন ফলমূল সংগ্রহ করে আনতে পারে। তাই ওগুলিই তার প্রকৃত শক্তি, প্রকৃত-সম্পদ।

          ভাষার সম্পদের ক্ষেত্রেও একথা একশোভাগ খাটে। কোনো ভাষায় ব্যাস বাল্মীকি কাশীরাম কৃত্তিবাস কিংবা হোমার শেকসপীয়র জন্মগ্রহণ করে কী বিপুল ভাষিক সৃষ্টিসম্ভার রেখে গেছেন, তা দিয়ে সেই ভাষার অর্জ্জিত-সম্পদের হিসাব করা যেতে পারে ঠিকই; কিন্তু তা দিয়ে সেই ভাষার প্রকৃত-সম্পদের হিসাব করা যায় না। তার জন্য সেই ভাষার চেতনার-হাতিয়ার, তা ব্যবহার করার দক্ষতা ও ইচ্ছাকে জানতে হয়। কেননা, সেগুলিই তার প্রকৃত-সম্পদ। এখন তাহলে সেই বিষয়েই খোঁজখবর করা যাক।

হাতের হাতিয়ার ও চেতনার হাতিয়ার

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, বানর মানুষ হয়েছে হাতিয়ার ব্যবহার করে। যে বানর গাছের ডাল ভেঙে সেটিকে লাঠির মত হাতিয়ার রূপে ব্যবহার করতে পারেনি, সে চিরকালের জন্য বানরই থেকে গেছে। আর যে পেরেছে সে ক্রমশ লাঠি থেকে কপিকল (ক্রেন) প্রভৃতিতে পৌঁছে গেছে এবং বানরদেহ খুইয়ে মানবদেহ লাভ করেছে। ইতিহাসবিদগণ সেকারণে কোন যুগের কোন বিশেষ জাতির বাহ্যসম্পদের হিসাব করতে যখন বসেন, সবার আগে দেখেন, সেই জাতির হাতিয়ার-সম্ভারে কী কী হাতিয়ার ছিল।

        একই কথা মানুষের মানসসম্পদের ক্ষেত্রেও খাটে। খাটত না, আদি হাতিয়ার-ব্যবহারকারী বানরটি লাঠি দিয়ে ফল পাড়তে গিয়ে যদি একটাই ফল পেত। পরমাপ্রকৃতির ইচ্ছায় তা হয়নি। কেননা, কেউ যদি একটি নতুন সৃষ্টির বা আবিষ্কারমূলক কাজের ফল পাওয়ার যোগ্যতা অর্জ্জন করে, পরমাপ্রকৃতি তাকে আরেকটি ফল প্রসাদ বা (grace) রূপে দিয়ে দেন; এটিই তাঁর চিরাচরিত রীতি। সেই রীতির ফলে আদি বানর যখন লাঠি হাতে প্রথম একটি ফল পেড়ে ফেলল, সে একসঙ্গে দুটো ফল পেয়ে গেল— গাছের ফল, আর অভিজ্ঞতা-ফল। গাছের ফলটা পেয়েছিল দেহের অংশ হাতে, আর অভিজ্ঞতা-ফলটা পেয়েছিল মনের অংশ চেতনায়। এর পর যত হাতিয়ার দিয়ে যত নতুন ফল পাড়া হতে লাগল, তত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা-ফলের প্রাপ্তি ঘটতে লাগল। সেগুলিকে ধারণা নাম দিয়ে রাখা হতে লাগল চেতনার মহাভাণ্ডারে— স্মৃতিতে। কিন্তু স্মৃতিতে ধারণাসমূহ রেখে রেখে নষ্ট করার নিয়ম নেই; কেননা ধারণাগুলি পরবর্ত্তী কাজে লাগে, লেগে যায়, লাগাতে হয়। আর, লাগানোর জন্য স্মৃতিতে রাখা ধারণাগুলিকে নাড়াচাড়া বাঁধাছাঁদা করে শ্রুতিতে চালান করার কাজ চলতেই থাকে; তা সে সচেতন বা অচেতন যেভাবেই হোক। সেটি করতে গিয়ে স্বভাবতই ধারণাধারী ও ধারণা-নাড়াচাড়া-বাঁধাছাঁদা-কারী চেতনা-হাতিয়ারের ডাক পড়ে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে একে একে হাজির হয় সঙ্কেত, ইশারা, মুদ্রা, চীৎকার, ধ্বনি, সুর, শব্দ, বাক্য … ইত্যাদি নানা রকম চেতনা-হাতিয়ারেরা। অর্থাৎ কিনা, পরমাপ্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এক এক করে চেতনা-হাতিয়ারগুলির উদ্ভব হতে থাকে, এবং সেগুলির ব্যবহারও শুরু হয়ে যায়। হাতের হাতিয়ার ব্যবহার করতে করতে বানরদেহ যেমন মানবদেহে উন্নীত হয়, পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চেতনার হাতিয়ারগুলি ব্যবহার করতে করতে বানরমন তেমনি মানবমনে উন্নীত হতে থাকে। এইভাবে হাতের হাতিয়ার নিয়ে মানবদেহ এবং চেতনার হাতিয়ার নিয়ে মানবমন ক্রমে সারা বিশ্বের উপর সগৌরবে রাজত্ব করতে শুরু করে দেয়। …

         ইশারা মুদ্রা ধ্বনি প্রভৃতি চেতনার হাতিয়ারগুলির মধ্যে যে-হাতিয়ার সর্ব্বাধিক সম্প্রসারিত হতে পেরেছে, সে হল মানুষের ধারণার ধারক ও বাহক শব্দ ও সেই শব্দ সম্বলিত ভাষা। মানবমনের গভীরে চেতনার বিশাল চিন্তন-যজ্ঞের কেন্দ্রীয় কর্ম্মশালা হ’ল এই ভাষা। একালের কোনো পরিবহন সংস্থা যেমন তাদের কর্ম্মশালার সাঁড়াশি শাবল থেকে শুরু করে বিশাল কপিকল পর্য্যন্ত শত রকমের হাতিয়ার দিয়ে তাদের গুদামঘরের বিভিন্ন জিনিসকে শক্ত করে ধরে, নাড়াচাড়া করে, পাঁচ-দশটি জিনিসের বান্ডিল বা গুচ্ছ বানিয়ে ছোট বড় নানা মাপের গাঁটরিতে সেগুলিকে ঠেসে বাঁধে, তারপর সেই গাঁটরিগুলিকে লরিতে তুলে প্রাপকের উদ্দেশ্যে নিয়ে যায়; ভাষাও তেমনি চেতনার ভাণ্ডারে বা স্মৃতিতে রাখা ধারণাসমূহকে অজস্র শব্দ, শব্দবন্ধ, শব্দজোড়, বাগধারা, বাক্য ইত্যাদির সাহায্যে ধরে, নাড়াচাড়া করে, পাঁচ-দশটি শব্দ বা শব্দবন্ধের একাধিক বাক্যের বান্ডিল বা গুচ্ছ তৈরি করে, তারপর বিভিন্ন মাপের বয়ানে, ভাষণে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধের গাঁটরিতে সেগুলিকে বাঁধে এবং সুদীর্ঘ বিবরণে চাপিয়ে শ্রুতিতে পাঠিয়ে দেয়; কিংবা গ্রন্থের ছোট বড় গাড়িতে তুলে পাঠক বা শ্রোতার কাছে নিয়ে যায়। এই হল ভাষার প্রকৃত কাজ-কারবার। সেকারণে কার্য্যত ভাষা হল মানুষের চেতনায় ধরা দেওয়া ও ধরে রাখা ধারণাসমূহকে বাঁদাছাঁদা করে শ্রোতা বা পাঠকের কাছে পাঠানোর একরকম সার্ব্বিক মানসিক পরিবহন ব্যবস্থা মাত্র। আর, সেই পরিবহন ব্যবস্থার প্রধান শক্তি হল তার ধারণা নাড়াচাড়া ও বাঁধাছাঁদা করার হাতিয়ারের সম্ভার; এককথায় শব্দের সম্ভার। এই শব্দসম্ভারই ভাষার মূল শক্তি, ভাষার প্রকৃত সম্পদ।

          শব্দসমূহের প্রধানত দুটি শ্রেণী রয়েছে। যে-শব্দগুলির সাহায্যে প্রধানত দৃশ্যসত্তা বিষয়ক ধারণাদের ধরে নাড়াচাড়া-বাঁধাছাঁদা করা হয়, সেগুলি দ্বিতীয় শ্রেণীর। যেমন গাছ, মাছ, গরু, মরু… ইত্যাদি। আর যে শব্দগুলির সাহায্যে অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয় সত্তা বিষয়ক ধারণাদের ধরে নাড়াচাড়া-বাঁধাছাঁদার কাজ করা হয়, সেগুলি প্রথম শ্রেণীর। যেমন রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্র, জ্ঞান, বুদ্ধি, চেতনা, সত্য, মিথ্যা, সুন্দর, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, ধনতন্ত্র, গণতন্ত্র, যোগ, বিয়োগ, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি… ইত্যাদি। যে ভাষায় এই প্রথম শ্রেণীর শব্দ যত বেশি আছে, সেই ভাষা তত বেশি জ্ঞানচর্চ্চার কাজে লাগে। তবে কিনা এমন অনেক জ্ঞানচর্চ্চার ভাষা আছে, যে ভাষায় প্রথম শ্রেণীর শব্দ থাকলেও জনসাধারণ্যে তার ব্যবহার আর নেই; সমাজে রাজত্বকারী দর্শন বদলে যাওয়ায় জনসাধারণ্যে সেগুলি ব্যবহার করার ইচ্ছাও আর নেই। এই মাপকাঠিতে যে ভাষায় সবরকমের শব্দসম্ভার রয়েছে এবং সেগুলির ব্যবহারও জনসাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে, সেই ভাষাই সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে সম্পদশালী, সর্ব্বাধিক প্রকৃত-সম্পদের অধিকারী। সে ভাষাই মানুষের সর্ব্বপ্রকার মনোভাব পরিবহনের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পরিবহন ব্যবস্থা; কার্য্যকারিতা বা গুণাগুণের বিচারে সে ভাষাই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ভাষা।

         এখন তাহলে বিভিন্ন ভাষার প্রকৃত-সম্পদের বা শব্দসম্ভারের সংবাদ সংগ্রহ করার চেষ্টা করা যাক। তারপর তাদের তুলনা করে দেখতে হবে, কোন ভাষা কী পরিমাণে প্রকৃত-সম্পদের অধিকারী। তাহলেই আমরা বুঝতে পারব, অন্যান্য ভাষার তুলনায় বাংলাভাষার শক্তি বা প্রকৃত-সম্পদ কতখানি রয়েছে, কোথায় রয়েছে, কীভাবে রয়েছে।

          কিন্তু সমস্যা হল, পাঠকপাঠিকাগণ প্রত্যেকে সব ভাষা জানেন না, আমরাও বহু ভাষা জানি না। শুধুমাত্র বাংলাভাষা ও ইংরেজিভাষা, এই দুটি ভাষা আমরা কিছুটা জানি বলে আমাদের মনে হয়। যেটি জানি, সেটুকু নিয়েই কাজ করতে হবে আমাদের। কেননা, এ বিষয়ে যাঁদের কাজ করার কথা, তুলনামূলক ভাষাচর্চ্চার সেই মহাপণ্ডিতেরা আজ পর্য্যন্ত প্রায় কিছুই করে উঠতে পারেননি। কেন পারেননি, সে অনেক কথা।…

         কবি বলেছেন, ‘মাটির প্রদীপ ছিল সে কহিল স্বামী, আমার যেটুকু সাধ্য সে করিব আমি’— আমাদেরও সেই কথা। তাহলে, প্রথমে বাংলাভাষার প্রকৃত-সম্পদকে একত্র করে দেখা হোক এবং তারপর সেই সম্পদ ইংরেজী ভাষার আছে কি না, তার তুলনামূলক বিচার করার চেষ্টা করা যাবে। অন্যান্য ভাষাগুলিতে আমাদের যতটুকু গম্যি আছে, ততটুকু তুলনা টানার চেষ্টা করব তাদের সঙ্গেও। পাঠকদের মধ্যে যাঁরা বাংলা ইংরেজী ছাড়া প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অন্য কোনো ভাষা জানেন, তাঁরা তাঁদের জানা ভাষার সঙ্গে বাংলাভাষার হাতিয়ারগুলির তুলনা করে দেখে নিতে পারবেন; এই চিন্তায় যোগ-বিয়োগও করতে পারবেন, আশা করা যাক।

ভাষার প্রকৃত-সম্পদ : শব্দসম্ভারের সন্ধানে

ভাষায় ব্যবহৃত বাক্যাদির মূলে রয়েছে শব্দ। এ হল মানুষের মুখনিঃসৃত স্বতন্ত্র অর্থবাহী ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি; অর্থহীন আওয়াজ নয়। দৃশ্য চিমটা সাঁড়াশি যেমন দৃশ্য বস্তুকে ধরে, অদৃশ্য চিমটা সাঁড়াশির মত এই শব্দ তেমনি অদৃশ্য-বস্তু বা ‘ধারণা’কে ধরে; ধ’রে বহন করে নিয়ে যায়। এদের সংখ্যা অগণ্য। এই যে কথাগুলি লেখা হচ্ছে, ‘এর’ ‘প্রত্যেকটি’ ‘শব্দ’ ‘এক’ ‘বা’ ‘একাধিক’ ‘ধারণাকে’ ‘ধরে’ ‘আপনার’ ‘সামনে’ ‘উপস্থিত’ ‘করছে’। আপনিও ধারণাগুলিকে বুঝে নিতে পারছেন। এগুলি তাই আমাদের সঙ্গে আপনার মনোভাব লেনদেনের বা চেতনায় থাকা ‘ধারণা’ লেনদেনের হাতিয়ার।

           এখান থেকে একটি সহজ সিদ্ধান্তে আমরা প্রথমেই চলে যেতে পারি— যে ভাষায় যত বেশি স্বতন্ত্র অর্থধারী শব্দ আছে, সে ভাষায় চেতনার হাতিয়ারের সংখ্যাও তত বেশি; তাই সে ভাষার প্রকৃত-সম্পদও তত বেশি। তাহলে, কোন ভাষার শব্দসংখ্যা কত, সেই অঙ্কটি জানতে পারলেই আমরা তাদের তুলনা করে বুঝে যাব, কোন ভাষা সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী।

            ঠিক কথা। কিন্তু সমস্যা হ’ল, কোন ভাষায় কত স্বতন্ত্র অর্থধারী শব্দ আছে, সেটি আমরা জানব কী করে? কোনো একটি ভাষার অভিধানে কত শব্দ আছে, তা জানলে কি সেই ভাষায় কত স্বতন্ত্র অর্থধারী শব্দ ব্যবহৃত হয়, তার হদিশ পাওয়া সম্ভব? দেখা যাক। — আন্তর্জালের অন্তরীক্ষে ভাসন্ত একটি ইংরেজী অভিধান জানাচ্ছে, তাদের সংকলিত (সংগৃহীত) শব্দের মোট সংখ্যা দশ লক্ষ। সাধারণ ইংরেজী অভিধানে এই সংখ্যাটি সর্ব্বাধিক লাখ দুয়েক। আর, আমাদের বাংলায়? ভাষাতাত্ত্বিক সুনীতিবাবুর বয়ান অনুসারে বাংলার ‘সর্ব্বশ্রেষ্ঠ অভিধান বলিয়া পরিগণিত’ শ্রী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানের শব্দসংখ্যা নাকি ৭৫,০০০। কোথায় দু-লক্ষ, আর, কোথায় ৭৫,০০০! ভাবুন একবার। তার ওপর, খুব যত্ন করে করা ঢাকার বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর শব্দসংখ্যা তাঁদেরই হিসেবে মাত্র ৩২,৭৩৭। অবশ্য ভুক্তি-উপভুক্তি মিলিয়ে সেই সংখ্যাটিকে আর একটু বাড়িয়েও ফেলা যায় এবং সেরকম হিসেবও তাঁরা করেছেন এবং দেখেছেন, তাতে সংখ্যাটি গিয়ে দাঁড়ায় মোট ৭৩,২৭৯ টিতে। সুনীতিবাবুর মতে, শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুই খণ্ডে সংকলিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে নাকি আরও কিছু বেশি শব্দ সংকলিত হয়েছে; অর্থাৎ বড়জোর লাখখানেক। সুনীতিবাবু তাই বলে গেছেন— হায়, বাংলাভাষার শব্দসংখ্যা কত কম! প্রশ্ন হল, বাংলাভাষার শব্দসংখ্যা কি সত্যিই অত কম?

              একজন ৪০-৫০টি আঙুর থাকে এমন আঙুরের থোকা বিক্রি করেন, আর অন্যজন গুণে গুণে শুকনো আঙুর বা কিসমিস বিক্রি করেন। সন্ধেবেলায় ‘আজ কত বিক্রি করলে গো’ শুধোলে প্রথম জন বলতে পারেন ১০ টা; দ্বিতীয় জন বলতে পারেন ১০০টা। কেউ ভুল বলছেন না, মিথ্যাও বলছেন না। কিন্তু যিনি শুনলেন তাঁর বোধবুদ্ধি ঠিক না থাকলে, তিনি ভাবতে পারেন— হায়, প্রথম জন ভারি দুঃখী, তাঁর বড়ই কম আঙুর বিক্রি হয়েছে। শব্দগণনার ক্ষেত্রে আমাদের তথাকথিত ‘ভাষাতাত্ত্বিক’দের জ্ঞানগম্যি এই পর্য্যায়ের। একটা কিসমিসের সঙ্গে একথোকা আঙুরকে সমান ভেবে হিসেব করে নিতে তাঁদের আটকায়নি। কেন এরকম করতে গেলেন তাঁরা, সে ভিন্ন প্রসঙ্গ এবং আমাদের ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান’ গ্রন্থে সে বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি করা যাবে না। এই মুহূর্ত্তের দাবি হল, আঙুর গুনতে হলে সকলের আঙুর এক নিয়মেই গণনা করা চাই; কোথাও একটি বিশাল পরিবারকে ‘একজন মানুষ’এবং অন্যত্র পরিবার-বিচ্ছিন্ন মাত্র একজনকে ‘একজন মানুষ’— এভাবে জনগণনা করা যায় না। শব্দকে স্বতন্ত্র করে যদি গুনতেই হয়, ইংরেজী বাংলা উভয় ভাষার ক্ষেত্রেই সে নীতি মান্য করা উচিত।

            আর, তা করা হলে ব্যাপারটি কেমন দাঁড়াতে পারে একটুখানি নাড়াচাড়া করে দেখলেই বুঝতে পারবেন। ইংরেজীর go শব্দটির ৪টি মাত্র স্বতন্ত্র অর্থধারী রূপ পাওয়া যায়— go, went, gone, going। কিন্তু তাদের অভিধানের ভুক্তিতে পাওয়া যায় ৩টি— go, gone, going। বাংলায় তদর্থক ‘যাওয়া’ শব্দটির রূপের সংখ্যা কমপক্ষে ৩৪টি— যা, যাই, যাইত, যাইতাম, যাইতিস, যাইতে, যাইতেন, যাইতেছ, যাইতেছি, যাইতেছিস, যাইতেছিল, যাইতেছিলাম, যাইতেছিলে, যাইতেছিলি, যাইতেছিলেন, যাইতেছে, যাইতেছেন, যাইব, যাইবি, যাইবে, যাইবেন, যাইয়ো, যাইল, যাইলাম, যাইলি, যাইলে, যাইলেন, যাইস, যাউন, যাও, যাওন, যাওয়া, যায়েন। (সমার্থক চলিত রূপগুলিকে— যথা, যাইত > যেত, … ইত্যাদিকে এবং গেল, গেলাম, ইত্যাদিকে হিসেবে না ধরেই ৩৪টি।) এরকম হওয়ার কারণ হল, প্রাচীন যৌথসমাজের স্বভাব আজও বাংলার অভ্যাসে থেকে গেছে। সেকারণে বাংলা শব্দ এখনও এক একটি যৌথ-পরিবারের মত থাকে, যাদের সদস্যসংখ্যা ১০-২০ থেকে ২০০-২৫০ পর্য্যন্ত যে কোনো সংখ্যক হতে পারে। সেই নিয়মে ‘যাওয়া’ শব্দ-পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৩৪টি। অথচ বঙ্গীয় শব্দকোষের ভুক্তিতে ৩৪টির বদলে পাওয়া যায় ২টি— যা, যাওন। তার মানে, ইংরেজীর ব্যবহারিক জগতে যেখানে ৪টি শব্দের প্রচলন রয়েছে, সেখানে তাদের অভিধানে পাবেন ৩টিকে; আর, বাংলার ব্যবহারিক জগতে যেখানে ৩৪টিরও বেশি শব্দের প্রচলন রয়েছে, সেখানে তাদের অভিধানে পাবেন ২টি শব্দকে। অভিধান যদি সমস্ত স্বতন্ত্র শব্দকে তাদের ভুক্তিতে রাখত, তাহলে সেক্ষেত্রে ইংরেজী অভিধানে আমরা ৪টি শব্দ পেতাম, বাংলা অভিধানে পেতাম কমপক্ষে ৩৪টি। এই অঙ্কটিকেই যদি সার্ব্বিকভাবে প্রয়োগ করা হত, ইংরেজী অভিধানের শব্দসংখ্যা হয়ে যেত আড়াই লক্ষের বেশি এবং বাংলা অভিধানের শব্দসংখ্যা বেড়ে হয়ে যেত পৌনে তের লক্ষ। বোঝাই যাচ্ছে যে, প্রচলিত অভিধানগুলিতে যেভাবে শব্দের ভুক্তি ঘটানো হয়েছে, তা দিয়ে কোন ভাষার ভাষাভাষী জনসাধারণ কত শব্দ ব্যবহার করেন, তার হদিশ পাওয়া বেশ কঠিন।

              তাহলে কী করব আমরা? কীভাবে আমরা বুঝব, কোনা ভাষা-ব্যবহারকারী জনসাধারণ কত শব্দ ব্যবহার করে থাকেন? কীভাবেই বা ইংরেজী ও বাংলা ভাষার মোট শব্দের বা ‘প্রকৃত-সম্পদ’-এর তুলনা করব আমরা?

              এই অবস্থায় একটি মাত্র পথ খোলা থাকে আমাদের সামনে। অর্জ্জিত ধারণার প্রক্রিয়াকরণ করে শব্দাদি বানিয়ে তাকে ভাষণে পরিণত করার কাজ সব ভাষাকেই করতে হয়; বাংলা এবং ইংরেজী ভাষাকেও করতে হয়। তার মানে, ভাষার সাহায্যে অর্জ্জিত ধারণা লেনদেন করতে হলে সব ভাষাকেই শব্দ-প্রকরণ করতে হয়; শব্দসংখ্যার গণনা করা যাক আর নাই যাক। আর, শব্দ-প্রকরণের যতরকম পদ্ধতি থাকা সম্ভব, কোনো ভাষায় সেই সমস্ত শব্দ-প্রকরণ পদ্ধতি প্রচলিত থাকলে, সে ভাষা যে সম্পদশালী হবেই তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। তাহলে বাংলাভাষায় শব্দ-প্রকরণের কী কী পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে তা দেখে নিয়ে, তার সঙ্গে ইংরেজী ভাষায় প্রচলিত শব্দ-প্রকরণ পদ্ধতির তুলনা করলেই উভয়ের চেতনার হাতিয়ার স্বরূপ সম্পদের তুলনা করে ফেলা যাবে। হ্যাঁ, এইখানে দাঁড়িয়ে আমরা যে কোনো ভাষার সম্পদের তুলনা করার একটা কার্য্যকরী পন্থা সুস্পষ্ট দেখতে পাই।

                 তাছাড়া, কাজটি ইংরেজী ও বাংলা উভয় ভাষার ভাষাবিদগণ আমাদের জন্য অনেকটাই করে রেখে গিয়েছেন। বাকিটা আমাদের করে নিতে হবে। … তাহলে আর দেরি না করে, তাঁদের দেখানো শব্দ-প্রকরণ পদ্ধতির তুলনামূলক বিচারের কাজে মনোনিবেশ করে ফেলা যাক।

শব্দ-প্রকরণ : বাংলা বনাম ইংরেজী

শব্দ-প্রকরণ চলে কোথায়? চলে প্রত্যেক মানুষের মনে এবং তাঁদের অগোচরেই। গাছেরা যেমন উদ্ভিদবিজ্ঞান না পড়েই সালোক-সংশ্লেষ করে, কথাবলা-মানুষও তেমনি ভাষাবিজ্ঞান না পড়েই কথাবার্ত্তা বলে থাকেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের গৌরব এই যে, তাঁরা গাছেদের সালোক-সংশ্লেষের বিজ্ঞানটি বুঝে নিয়ে ব্যক্তভাবে (explicitly) তা প্রকাশ করে দেন; ভাষাবিজ্ঞানী শব্দার্থতত্ত্ববিদ (যাস্ক) ও বৈয়াকরণগণের (পাণিনির) গৌরব এই যে, সাধারণ মানুষের মনের গভীরে চলা ঐ শব্দ-প্রকরণ বিজ্ঞানটিকে বুঝে নিয়ে সেকথা তাঁরা ব্যক্তভাবে (explicitly) প্রকাশ করে গেছেন। অর্থাৎ, মানবমনে ধারণার প্রক্রিয়াকরণ হয়ে শব্দ-প্রকরণ কীভাবে হয়, তার লিখিত উত্তরাধিকার আমাদের হাতে কমবেশি রয়েছে। সর্ব্বোপরি রয়েছে আমাদের ও আমাদের পাঠক-পাঠিকাদের ব্যক্তিগত উপলব্ধি। তাই দিয়েই এখন আমরা মানবমনের অভ্যন্তরে চলা শব্দ-প্রকরণ পদ্ধতিগুলির তুলনামূলক বিচার করার চেষ্টা করব।

           ১) শব্দ-প্রকরণ : মূল শব্দসম্ভার— মানবমনে সর্ব্বপ্রথম যে শব্দ-বীজের জন্মায়, বর্ণ শব্দের (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) অর্থে তাদের চিনতে পারা যায়। ধারণাকে বরণ করে নিয়ে উচ্চারিত হয় যে ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি, তাকেই বলে বর্ণ। স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক মানুষের যখন ধারণা-বাহক ধ্বনির নিতান্ত প্রয়োজন হয় তখনই তার মনের গভীরে সেই বর্ণ আপনি জন্মায়। এটি একটি চিরন্তন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। মানুষের হাতে যখন একটিও শব্দ ছিল না, তখন এই প্রক্রিয়াতেই শব্দসমূহ সৃজিত হয়েছিল। এই প্রকারে সৃজিত আদি শব্দসম্ভারই সকল দেশের সকল ভাষার শব্দসম্ভারের আদি জননী। আজ, যখন মানুষের হাতে অনেক শব্দ রয়েছে, তখনও, হাতে থাকা শব্দসম্ভারে না কুলোলে এবং নতুন শব্দের প্রয়োজন হলে, মানবমনে আজও এই প্রক্রিয়াতেই নতুন শব্দ সৃজিত হয়ে থাকে।

             শব্দের প্রথম জন্মলাভের এই প্রক্রিয়ায় জাত শব্দগুলিই বিশ্বের সকল ভাষার আদি চেতনার হাতিয়ার, আদি শব্দসম্ভার, আদি শব্দভাণ্ডার। এই শব্দভাণ্ডার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে নিজের নিজের আদি শব্দসম্ভার নিয়ে প্রত্যেক ভাষাই তার যাত্রা শুরু করেছে। স্বভাবত এই আদি শব্দভাণ্ডারের শব্দগুলি বিভক্তি-প্রত্যয়-উপসর্গাদি-হীন সদ্যোজাত মানবশিশুর ন্যায় উলঙ্গ, প্রাণবন্ত, বহু সম্ভাবনাময়, ক্রিয়াভিত্তিক, বহুরৈখিক। যতদূর বোঝা যায়, আদিম যৌথ-মানবসমাজ এই শব্দসম্ভার সৃজন করেছিল। নানা ঐতিহাসিক কারণে ইংরেজী সহ পাশ্চাত্যের প্রায় কোনো ভাষার হাতে এই মূল শব্দোৎপাদন প্রক্রিয়ার উত্তরাধিকারের স্মৃতি নেই। সেকারণে অধিকাংশ ইংরেজী শব্দের আদিরূপ কী ছিল, কোনো ইংরেজ পণ্ডিতই তা বলতে পারেন না। এদিকে বাংলাভাষার গৌরব এই যে, তার হাতে সেই স্মৃতি এখনও পুরোদমেই রয়েছে। ‘রবি’ শব্দের মূলে কেন ‘রব্’ (রু-অ) ছিল, তার মানে কী ছিল, কেন সেরূপ মানে ছিল, তা আজ আমরা সুস্পষ্টভাবে জানি; কিন্তু ইংরেজী sun শব্দের মূলে কেন sunne, sunna, sunno (শূন্যে, শূন্য, শূন্যো) ছিল, ইংরেজ তা জানে না। আমাদের ‘বন্ধন’ শব্দের ভিতরে কী অর্থ কীভাবে আছে, আমরা কেবল সেটুকুই জানি না, সেই ‘বন্ধন’ শব্দ কেমন করে ‘বন্ধু’ শব্দে পরিণত হল, তাও জানি। কিন্তু ইংরেজ পণ্ডিত কিছুতেই বলতে পারেন না তাঁর bind, sit, write, speak, choose, grieve, hot, blood, fund, knot, sale, breath, bath … প্রভৃতি শব্দের ভিতরে ঠিক কী আছে, কীভাবে আছে; কেমন করেই বা সেই শব্দগুলি যথাক্রমে bond, seat, writ, speech, choice, grief, heat, bleed, feed, knit, sell, breathe, এবং bathe … প্রভৃতি শব্দে পরিণত হল। মোটকথা, অধিকাংশ বাংলা শব্দের আদিরূপ কী ছিল, আমরা তা কমবেশি বলে দিতে পারি। এখন, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি হাতে আসার পর, আমরা তা আরও ভালভাবে পারি। এমনকি, ইংরেজী সহ বিশ্বের নানা ভাষার পণ্ডিতগণকে তাঁদের ভাষার শব্দের হারানো অতীত সম্পর্কে বহু কথা এখন আমরাই তাঁদের বলে দিতে পারি।

…………………………………………………………………………………………………

 সংস্কৃতপ্রেম না ফারসিপ্রেম— কেউ কেউ বাংলাভাষা কতখানি সংস্কৃত কিংবা কী পরিমাণ আরবি-ফারসি প্রভাবিত তাই নিয়ে ভাবিত থাকেন। এ বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, প্রাচীন বাংলার ও তার ভাই-ভাগারীদের কাছ থেকে হাত পেতে সমস্ত উপাদান নিয়ে যে ভাষা গড়ে ওঠেছিল, তাকেই সংস্কৃত ভাষা বলে। (নিম্নে সংস্কৃতভাষার স্বরূপ দেখুন)। তাই, সংস্কৃত ভাষাকে ‘প্রাচীন বাংলা’ বলা যেতে পারে। আর, প্রকৃতপক্ষে বিদেশী ভাষা বলে কিছু হয় না। কেননা, বিশ্বের সব ভাষাই মূলে একই উৎস থেকে জন্মলাভ করেছে। জলমাটির গুণে প্রত্যেকটি ভাষার ভিতরে তার প্রবাহপথের নিজস্বতা থাকে এবং ভ্রাতৃসম ভাষা-নদীর জল এসে পড়লেও সে তার সব নিজস্বতা হারায় না।

……………………………………………………………………………………………………..

         আমাদের প্রাচীন ভাষাবিদগণ এই প্রক্রিয়ায় সৃজিত শব্দের নাম দিয়েছিলেন প্রকৃতি (ধাতু ও প্রাতিপদিক)। তাঁরা সেই সত্য উপলব্ধি করে বিভিন্ন গ্রন্থে তা লিপিবদ্ধ করে গিয়ে থাকলেও এবং পরবর্ত্তীকালের বিভিন্ন গ্রন্থে সেই সকল গ্রন্থের উল্লেখ থাকলেও গ্রন্থগুলির অধিকাংশই পাওয়া যায় না; একমাত্র পাওয়া যায় যাস্ক-এর নিরুক্ত। পাণিনির প্রায় ২০০ বছর (মতান্তরে ৪০০ বছর) আগেই নিরুক্ত লিখিত হয়েছিল বলে একালের পণ্ডিতগণের অনুমান। ঐ গ্রন্থে প্রথম দেখানো হয়, কী নিয়মে মানুষের প্রাপ্ত বা অর্জ্জিত ধারণাকে প্রক্রিয়াকরণ করে শব্দে রূপান্তরিত করা হয়। অর্থাৎ, প্রথম শব্দ জন্মায় কীভাবে এবং কোন নিয়মে শব্দের (আওয়াজের) ভিতরে অর্থ প্রবেশ করানো ও নিষ্কাশন করা হয়।

             কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হল, আধুনিক যুগের ভাষা-গবেষকগণ নিরুক্ত পড়বার কৌশলটাই ভুলে যান। ফলে, মানবমস্তিষ্ক কেমন করে ধারণার প্রক্রিয়াকরণ করে প্রথম শব্দ বানায় বা চেতনার প্রথম হাতিয়ার প্রস্তুত করে, সেটিই একালের ভাষাচিন্তকদের অজানা থেকে যায়। তাঁরা অতীতহারা পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের পোঁ ধরে ঘোষণা করে দেন— শব্দের ভিতরে শব্দের কোনো মানে নেই; সব মানেই আরোপিত এবং সেই মানে আরোপ করারও কোন নিয়ম নেই; শব্দ মাত্রেই ‘খামখেয়ালি’ (আর্বিট্রারি) অর্থ ধারণ করে। এই ভুল সিদ্ধান্তের অত্যন্ত মন্দ প্রভাব পড়ে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনসমাজে। ধারণা-প্রক্রিয়াকরণের গোড়াটাই তাঁদের নিকট অধরা থেকে যায়।

          আমরা দেখেছি, সর্ব্বপ্রকার শব্দের ভিত্তিতে যে সকল মূল শব্দ (বিভক্তি-প্রত্যয়হীন ধাতু ও প্রাতিপদিক), সেগুলি সাধারণ মানুষের মুখ দিয়ে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিকভাবেই বেরিয়ে আসে। আমাদের প্রাচীন ভাষাবিদগণ সেই সমস্ত ব্যাপারটিকে তাঁদের ব্যাপক অনুভূতি ও বিচারশক্তির জোরে উপলব্ধি করে সে বিষয়ে বিস্তারিত লিখে রেখে গেছেন। সেই ধারার লিখিত উত্তরাধিকারই রয়েছে যাস্কের নিরুক্তে। আমরা দুজন তাঁর সেই রীতিনীতিকে পুনরুদ্ধার করে চলেছি এবং এতদিন ধরে ‘ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি’ শিরোনামে লেখালেখির মাধ্যমে সেসব কথাই বলে চলেছি। …

       তা সে যাই হোক, দেখা যাচ্ছে, শব্দ-প্রকরণের আদি, মূল ও প্রধান শব্দসৃজনকারী পদ্ধতির উত্তরাধিকারটাই পাশ্চাত্যের কোন ভাষার হাতে নেই। প্রাচ্যের ভাষাগুলির সেই উত্তরাধিকার কমবেশি থাকলেও সবচেয়ে বেশি রয়েছে বাংলাভাষার। সেই সুবাদে, এই ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রায় সব ভাষার তুলনায় বাংলাভাষা অবশ্যই অধিক সম্পদশালী ভাষা।

           ২) শব্দ-প্রকরণ : প্রতীকী শব্দসম্ভার— আদি শব্দভাণ্ডার থেকে নিজেদের শব্দসম্ভার উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করার পর, সেগুলির বহুরৈখিক অর্থকে সাধারণত একটি মাত্র অর্থধারী শব্দে (প্রতীকী শব্দে) পরিণত করে নিয়ে মানবমনের সমভূমির (সমদক্ষ-মনোভূমির) উপর দিয়ে ভাষার যে প্রবাহ শুরু হয়, একালের প্রায় সকল ভাষার সূচনা সেখান থেকেই। আমরা দ্যু, গো, ক্রিয়েৎ (অর্থাৎ যথাক্রমে, ‘নবরূপে উত্তীর্ণের প্রদান’, ‘যে যায়’, ‘… উৎপাদন’)২ দিয়ে আগেই তো যাত্রা শুরু করেছিলাম, ইংরেজের সঙ্গে সাক্ষাতের পর জানতে পারলাম তাঁরা চলেছেন do, go, create … (অর্থাৎ যথাক্রমে ‘করা’, ‘যাওয়া’, ‘সৃষ্টি করা’) ইত্যাদি হাতে নিয়ে। তার মানে, তাঁদের হাতে শব্দগুলি নিজ নিজ বহুরৈখিকতা হারিয়ে ফেলেছে। সভ্যযুগের দাবিও ছিল সেরকম। অগত্যা আমরাও আদিম উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ আমাদের দ্যু, গো, ক্রিয়েৎ-কে কেটে-ছেঁটে একার্থবাচক (দেবতা, গরু, করিৎকর্মা) করে নিয়ে চলার চেষ্টা চালাতে থাকি। যৌথসমাজ ভেঙে সম্প্রদায় পেরিয়ে ছোট ছোট পরিবারে পরিণতি লাভের দিকে যত দ্রুত সমাজ চলতে শুরু করে, তত দ্রুত ভাষার এই রূপান্তর ঘটে। শুধু ইংরেজী বাংলা নয়, আজকের দুনিয়ার প্রায় সমস্ত ভাষাই যে সকল শব্দের সাহায্যে তাদের মনোভাব লেনদেনের কাজ চালায়, সেই শব্দগুলি মূলত এই প্রতীকী স্বভাবের শব্দ। এই শব্দগুলির সাধারণ গুণ হল, (ক) এদের কোনো অতীত নাই, থাকলেও নাই বলে ধরে নেওয়া হয়; (খ) কোনো প্রকার অর্থই এই প্রকার শব্দের সহজাত নয়, সেরকম সহজাত অর্থ থাকলেও নেই; কেননা, এরা কোনো মানে নিয়ে জন্মায়নি, কিংবা, সেভাবে জন্মালেও সে অতীত এদের নাই, থাকলেও নাই বলে ধরে নেওয়া হয়; (গ) এই শব্দগুলি প্রত্যেকেই সাধারণভাবে এক একটি আরোপিত অর্থের ধারক-বাহক, অনেকটা উপনিবেশের মত, যে, বিদেশী রাজাকে ধারণ-বহন করে; (ঘ) এই শব্দগুলির অর্থ তাই শব্দের ভিতরে পাওয়া যায় না, শব্দগুলির অর্থ মনে রাখতে হয়, অর্থাৎ মনের বোঝা-স্বরূপ বহন করতে হয়, অথবা, কাউকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হয়, কিংবা, অর্থগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে স্মৃতিবাহিত হয়, অথবা, অভিধানে দেখে নিতে হয়। এই ধরণের শব্দসম্ভার নিয়েই অতঃপর ভাষা তার যাত্রা শুরু করে।

তার মানে, উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ বিভক্তি-প্রত্যয়-উপসর্গাদি-যোগহীন শব্দসমূহের বর্ণভিত্তিক-ক্রিয়াভিত্তিক বহুরৈখিক অর্থকে ছেঁটে দিয়ে তাকে একটি মাত্র অর্থবাচক শব্দ করে নিতে পারলে এবং এই শব্দের নির্ম্মাণসূত্রটি ভুলে গেলে, তবেই সেটি সম্পূর্ণভাবে প্রতীকী শব্দ হয়। এই বিচারে ইংরেজী শব্দ সম্পূর্ণ প্রতীকী, কিন্তু বাংলা শব্দ পশ্চাৎপটের স্মৃতিসম্পন্ন প্রতীকী শব্দ। ইতিহাসের মারে এই প্রতীকী শব্দসম্ভার নিয়ে অন্য সব ভাষার মত বাংলা এবং ইংরেজী ভাষারও যাত্রা শুরু হয়। যৌথসমাজ ভেঙে পরিবারভিত্তিক (ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী-ব্যক্তিমালিকানাবাদী) সমাজের দিকে দৌড় শুরু করায় একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিকারী দক্ষসমাজের (সভ্যসমাজের) রমরমা ও টান শুরু হয়। এক শব্দের বহু অর্থ থাকলেও একটি শব্দকে তার যে কোনো একটি অর্থে বারংবার পুনরাবৃত্ত করার পরিবেশ তৈরি হয়। অতীত ত্যাগের মহামারী লাগে। শব্দের আঙুরথোকা ছিন্নবিচ্ছিন্ন অতীতহারা হয়ে শুকনো কিসমিসে পরিণত হতে থাকে। এতে ইংরেজীর অসুবিধা হয় না, কেননা, ইতোপূর্ব্বে আদিম যৌথসমাজ ভেঙে পড়ার মহাপ্রলয়কালে সে তার শব্দের অতীত হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু বাংলার অসুবিধা হয়। কারণ তার শব্দের অতীত-স্মৃতি ছিল এবং দক্ষযুগের (সভ্যযুগের) এই সমাজে সেই স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে চলার অসুবিধা ছিল। তার বহুরৈখিক অর্থকে নিয়ে চললে দক্ষভূমি আপত্তি তোলে, তাকে নিয়ে চলা যায় না, ছেড়েও যাওয়া যায় না; অগত্যা, তাকে, তার অতীতকে যতদূর সম্ভব বস্তাবন্দী করা, গোপন করা, ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হয়। কিন্তু অতীতহারা অনাথ ও অতীতবাহী সনাথ— এই দুই স্বভাবের দুই ভাষাকে যদি একই সমতলভূমির (দক্ষভূমির, সভ্যযুগের মনোভূমির) উপর দিয়ে বয়ে যেতে হয়, ইতরবিশেষ হতেই পারে। নিজগৃহে জাত নিজস্ব শিশুসন্তান ও দত্তক নেওয়া শিশুসন্তান, এই দুই রকমের শিশুসন্তানকে বড় করার ক্ষেত্রে যদি কোনো ফারাক সুস্পষ্ট থেকে থাকে, বাংলা ভাষার প্রতীকী শব্দসম্ভার ও ইংরেজী ভাষার প্রতীকী শব্দসম্ভারের লালনপালন ও বিকাশসাধনের মধ্যে সেই ফারাক সুস্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। আমরা যে শব্দসম্ভারকে লালন করি, তাকে দিয়ে আমাদের ধারণা লেনদেনের কাজ সারি, তার অতীত সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি। ইংরেজ যে শব্দসম্ভারকে লালন করেন, তা দিয়ে তাঁদের ধারণা লেনদেনের কাজ সারেন, তার অতীত সম্পর্কে তাঁরা সম্যক অবহিত নন; ইতিহাসের মারে তাঁরা সেসব হারিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের গৌরব এই যে, তাঁরা তাঁদের আদি শব্দসম্ভারকে যে অবস্থায় পেয়েছিলেন, হুবহু সেই অবস্থাতেই ধরে রেখেছেন, বলতে গেলে, আজও। কোন শব্দ তাঁরা তাঁদের টিউটনিক জারমানিক উত্তরাধিকার থেকে পেয়েছেন, কোনটা ল্যাটিন, ফরাসি, গ্রীক… প্রভৃতি সূত্র থেকে পেয়েছেন, তার যেটুকু যা সংবাদ তাঁদের জানা ছিল, তা সবই তাঁরা গুছিয়ে লিখে রেখেছেন। এমনকি অনুচ্চারিত বর্ণধারী শব্দ (know, gnat, psyche…), দ্বিত্বমূলক শব্দ (battle, muddle, stagger …), সবই তাঁরা বয়ে নিয়ে চলেন অকাতরে।

…………………………………………………………

সংস্কৃতভাষার স্বরূপ— বিশ্বের প্রায় সব প্রচলিত ভাষাই মানুষের মুখ দিয়ে প্রকৃতির বা নেচারের বানানো ভাষা। সংস্কৃত শব্দটিই বলে দেয়, সংস্কার করে এই ভাষা বানানো হয়েছিল; এটি স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক বা ‘নেচারাল’ ভাষা নয়। ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে পুরাণাদির অর্থ নিষ্কাশন করে জানা গেছে, ১৮০০ খ্রিস্টপূর্ব্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত তৎকালের ভাষাগুলিকে সংস্কার করে সেকালের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা এই সংস্কৃত, সর্ব্বমান্য, আদি সরকারী ভাষা, বানিয়েছিলেন। প্রচলিত ভাষাগুলি থেকে তাঁরা কেবল তাদের উপকরণগুলিই সংগ্রহ করেননি, ভাষাগুলির ভিতরে প্রকৃতির যে নিয়মগুলি সক্রিয় ছিল, সেগুলি আবিষ্কার করে সেগুলিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাই, সংস্কৃত ভাষার মধ্যে নিহিত রয়েছে ভাষার প্রাকৃতিক নিয়ম বা ভাষাবিজ্ঞানের সত্য। আর, সেই সত্যগুলি আকাশ থেকে আবিষ্কার করা হয়নি, সেকালের মানুষের মুখের ভাষাগুলি থেকেই আবিষ্কার করা হয়েছিল। তার মানে, মানুষের কথাবার্ত্তার ভিতরেই শব্দরূপ, ধাতুরূপ, বিভক্তি, প্রত্যয়, সন্ধি, সমাস… ইত্যাদি প্রকরণগুলি রয়েছে। আবিষ্কৃত হয়ে যাওয়ার পর এই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিশ্বের সকল মানুষের সম্পত্তি। যাঁরা এই জ্ঞানকে অপাঙক্তেয় বলে দূরে রাখেন, তাঁরা যেমন ভুল কাজ করেন, তেমনি যাঁরা এই জ্ঞানকে ‘একমাত্র আমাদের’ ভাবেন, তাঁরাও একই রকমের ভুল করেন।

………………………………………………………………………………………………………

আর আমরা? আমাদের আধুনিক বাংলা ভাষাবিদগণ? তাঁরা কী করছেন? তাঁদের হাতে শব্দের সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব উত্তরাধিকার রূপে লিখিতভাবে থাকলেও তাঁরা সেই সমস্ত তথ্য ও তত্ত্বকে সাধ্যমত অবহেলা করেছেন এবং করেন, আজও। অতীতের সঙ্গে তাঁদের ‘একান্ত আত্মবিচ্ছেদ’ চাই; শব্দের দ্বিত্ব বর্জ্জন করা চাই; ‘ভদ্র’কে ‘বঢরা’ বলা চাই; অতীতের সঙ্গে লেশমাত্র সম্পর্কও থেকে যায় এমন সব পথ বন্ধ করা চাই! অনাথ মানুষ নিজের অতীত সম্পর্কে কথা বলতে লজ্জা পায়, পাছে লোকে তার বাপের নাম জিজ্ঞাসা করে বসে। আর, এ যে দেখি, ‘আমার কোন বাপ নাই, আমি বেজন্মা, ভুঁইফোড়’… একথা বলার জন্যই ছটফট করছেন বাংলাভাষার এক শ্রেণীর ভাষাবিদ ও তাঁদের চেলারা। তার ওপর আধুনিক যুগে ইংরেজী ভাষা আমাদের রাজা হয়ে দেখা দেয়। সেই রাজার যেহেতু অতীত নাই, লেজ নাই, আমাদের থাকলেও নাই; বাংলা ভাষার সমস্ত শব্দের লেজ কেটে দাও, ইংরেজী শব্দের মত বাংলা শব্দগুলিকেও লেজহীন করে দাও! ‘যে যায়’ তেমন প্রত্যেক সত্তাকেই আমাদের ‘গো’ শব্দ অনায়াসে বুঝাতে পারত। এবার তার সেই স্বভাব নষ্ট করে তাকে শুধুমাত্র ‘গরু’ বানিয়ে ফেলা হল। গো শব্দের অর্থ থেকে বাকি গমনশীলেরা বাদ পড়ে গেলে। ওদিকে ইংরেজ তার অতীত ভুলে গিয়ে তাকেই বানিয়ে ফেলেছিল ‘যাওয়া’ (go)। অর্থাৎ, আদি শব্দের বহুরৈখিকতা নষ্ট করে তাকে একটি মাত্র অর্থে স্থির অনড় অটল করে দিয়ে তাকে প্রতীকী শব্দ বানিয়ে ফেলে ইংরেজীর সঙ্গে বাংলা ভাষারও জয়যাত্রা (?) শুরু হল।

…………………………………………………………………………………………..

সংস্কৃতভাষা কি নিপীড়কের ভাষা?— সংস্কৃত ভাষা অন্য প্রচলিত ভাষাগুলির মত স্বাভাবিক-প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত জনসাধারণের ভাষা নয়; গুরু-শিষ্য পরম্পরায় বিদ্বান মানুষদের মধ্যেই তার প্রবাহ ক্রমক্ষীয়মাণ রূপে চলতে থাকে। প্রস্তুত হওয়ার পাঁচ-সাতশো বছর পরে এ ভাষাও নিপীড়কের ভাষায় পরিণত হয় এবং ক্রমশ শক্তি হারায়। পরবর্ত্তিকালে সেই সংস্কৃতকে নিপীড়কের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার কিছু কিছু প্রমাণ আছে। ইংরেজী এসেছিল নিপীড়কের হাত ধরে, গান্ধী সুভাষের হাতে সেটিই নিপীড়িতের হাতিয়ার হয়ে যায়। তাই বলি, ভাষার নিজস্ব কোনো ইচ্ছা থাকে না। যে তাকে ব্যবহার করে, ভাষা তার হয়েই কাজ করে। কেননা, শেষ বিচারে ভাষা মনোভাব পরিবহনের উপায় বা হাতিয়ার মাত্র। হাতিয়ারের ভালমন্দ হয় না। যে সেটি ব্যবহার করে, তার উপরই নির্ভর করে সেটি মানুষের ভাল করবে কি মন্দ করবে।

……………………………………………………………………………………………..

           এই পরিস্থিতিতে, ভাষার পশ্চাতে থাকা সামাজিক শক্তির আনুকূল্য পেয়ে ইংরেজী ভাষার হল রমরমা।৩ কুলপরিচয়হীন অনাথের মত হাজার হাজার (বিচ্ছিন্ন শুকনো কিসমিস স্বরূপ) একার্থবাচক শব্দের ভাণ্ডারে ভরে উঠতে লাগল ইংরেজীর শব্দভাণ্ডার। আর, বাংলাভাষা তার অ্যাকাডেমির বা লেখাপড়ার দুনিয়ায় ‘আঙুরথোকার ভাণ্ডারস্বরূপ বিশাল শব্দভাণ্ডারের কোনটা রাখব, কোনটা ফেলব’ করতে করতে সবকিছু এলোমেলো করে বসল বটে, কিন্তু তার বাস্তবের সামাজিক ব্যবহারে কোনো কিছুই খুব একটা ফেলা গেল না। অর্থাৎ, জনসাধারণের ব্যবহারে তার সমস্ত স্মৃতিসহ পশ্চাৎপটের স্মৃতিসম্পন্ন প্রতীকী শব্দসম্ভার কমবেশি অক্ষতই থেকে গেল। হ্যাগো, কিগো বাংলাভাষী জনসাধারণ আজও বলে থাকেন।

            এতক্ষণ মূল শব্দসম্ভার ও প্রতীকী শব্দসম্ভার, এই দুই শব্দ-প্রকরণ নিয়ে যে আলোচনা আমরা করলাম, তা আসলে ঘরে থাকা বিভক্তি-প্রত্যয়াদিহীন নিষ্ক্রিয় শব্দ নিয়ে আলোচনা মাত্র। মাস্টার ডাক্তার উকিল কেরানী রিকশাওয়ালা কুলি মজুর… ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষেরা (ঘরে যেমন পোষাকেই থাকুন না কেন, কাজে বেরোনোর সময় যে যার) ভিন্ন ভিন্ন পোষাক পরিধান করে কাজে বেরোন; গিয়ে যে যার নিজ নিজ সামাজিক কর্ম্মযজ্ঞে যোগদান করেন। শব্দও তেমনি বিভক্তি প্রত্যয় প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন পোষাক পরে বেরিয়ে বাক্যে প্রযুক্ত হয়ে মনোভাব লেনদেনের কাজ সারে। এখন আমরা সেইরূপ কার্য্যকরী বা সক্রিয় শব্দ-প্রকরণের আলোচনায় যাব।

            ৩) শব্দ-প্রকরণ : বিভক্তিযোগ— একটি হাতিয়ারকে যদি আপনি কলম, ছুরি, সুঁচ, নখকাটার যন্ত্র, বোতল খোলার যন্ত্র ইত্যাদি পাঁচ রকম ভাবে ব্যবহার করতে পারেন, তাহলে হাতিয়ার একটি মাত্র হলেও তার কার্য্যকারিতা পাঁচগুণ বেড়ে যায়। শব্দের ক্ষেত্রেও সেরকম হয়। আপনার হাতে একটি মাত্র শব্দ আছে— ‘মানুষ’। আপনি তাকে মানুষ, মানুষগণ, মানুষটি, মানুষটির, মানুষের, মানুষদের, মানুষকে, মানুষদিগকে, মানুষে… ইত্যাদি বেশ কিছু শব্দে বদলে ফেলতে পারেন। এ হল একই শব্দকে বহু রকম পোষাক পরিয়ে ফেলার মত ব্যাপার। এর জন্য শব্দটির সঙ্গে যে শব্দাংশ যোগ করা হয়, সেটিকেই বিভক্তিযোগ বলে। এই বিভক্তি যোগ করে ক্রিয়া, বিশেষ্য, বিশেষণ প্রভৃতি সমস্ত শব্দকেই বহু রূপে বদলে ফেলা যায় বা নবরূপে সৃজন করা যায়। যেমন ধরুন, আপনার হাতে একটি ক্রিয়াপদ আছে— কর। তাকে আপনি করা, করি, করে, করেন, করিয়া, করিত, করিতে, করিতেন, করিব, করিবে, করিবেন, করিল, করিলে, করিলেন… ইত্যাদি যতভাবে ব্যবহার করবেন, তত রকম ধারণা সে ধারণ করতে বা নাড়াচাড়া করতে পারবে। (তার ওপর উপসর্গ ব্যবহার, ক্রিয়াজোড়ের ব্যবহার… এসব জুড়লে তো এই একটি শব্দ থেকেই আপনি শতাধিক শব্দ পেয়ে যাবেন। তবে সে ব্যাপারে আমরা পরে আসছি।) তার মানে, ঐ একটি হাতিয়ারের বিচিত্র ব্যবহারের কারণে আপনি একটি হাতিয়ার দিয়েই একশোটি হাতিয়ারের কাজ করে নিতে পারছেন। বাংলাভাষায় এই বিশাল শব্দ-প্রকরণের নির্ম্মাণযজ্ঞ চালান হয় সব সময় এবং জনসাধারণই তাঁদের মনের গভীরে সেই কর্ম্মযজ্ঞ চালান। বৈয়াকরণের ভাষায় শব্দের এই রূপান্তর প্রক্রিয়া বা নবরূপে সৃজন প্রক্রিয়াকে বলা হয় শব্দরূপধাতুরূপ। বাংলাভাষায় বিপুল শব্দসম্ভার তৈরি হয় এই প্রক্রিয়ায় এবং জনসাধারণই তা করে থাকেন।

…………………………………………………………………………

কে ঋণী?— বাংলাভাষার অব্যয় শব্দগুলির (অথবা, বা, এবং, সুতরাং, অতএব… প্রভৃতির) দিকে নজর করলেই বুঝা যায়, সেগুলি বাংলার নিজস্ব শক্তি ও প্রকৃত-সম্পদের অংশ। হিন্দুস্থানী ও তার সহোদর ভাষাগুলিতেও ঐ অব্যয় শব্দগুলি কমবেশি রয়েছে। সংস্কৃত ভাষাতে সেগুলি হুবহু রয়েছে। যেহেতু সংস্কৃতভাষা প্রচলিত ভাষাগুলি থেকে ঘোষিতভাবে সম্পদ আহরণ করেছিল, সেগুলির জন্য সংস্কৃতই অন্য ভাষাগুলির কাছে ঋণী; বাংলা বা হিন্দুস্থানী ভাষাগুলি নয়। সেগুলি তো জনসাধারণের ভাষা, তারা সংস্কৃতভাষা সৃষ্টির আগেও ছিল, পরেও আছে; বয়ে চলেছে আপন গতিতে, আপন পথে, আজও। তবে একথাও ঠিক যে, কোন কোন ভারতীয় ভাষা, বিশেষত যাদের অর্জ্জিত সম্পদ তুলনায় অধিক (যেমন বাংলার), তাদের প্রবাহের মাঝপথে সংস্কৃতের কৃত্রিম খালের জল এসে তাতে কিছু কিছু পড়েছে এবং সেই ভাষাকে খানিক প্রভাবিতও করেছে। কিন্তু তাতেও সেই ভাষাকে ঋণী বলা যাবে না। সংস্কৃত তা করে থাকলে সে তো গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজাই করেছে।

……………………………………………………………………………………………….

           শব্দোৎপাদনের এই প্রক্রিয়া একালের ইংরেজীর নেই বললেই চলে। এই প্রক্রিয়া ল্যাটিন ভাষায় Accidence নামে কম পরিমাণে হলেও প্রচলিত ছিল; গ্রীক ভাষারও ছিল। গ্রীক ও ল্যাটিনের তুলনায় অনেক পরবর্ত্তীকালে লিখনের বাঁধনে ধরা পড়া প্রাচীন (৬০০ থেকে ১০০০ খ্রিস্টাব্দ) ইংরেজীতেও কিছু মাত্রায় Accidence ছিল, কিন্তু কালের ধর্ম্মে ইংরেজী ভাষার পক্ষে শব্দের এই রূপান্তর প্রক্রিয়া সুবিধের হয়নি। চরিত্রের দিক থেকে ইংরেজী ভাষা গ্রীক প্রভৃতি ভাষার থেকে ভিন্ন স্বভাবের হয়ে গেছে। ল্যাটিন ও গ্রীক ছিল বাংলার মত Flexional ভাষা, অর্থাৎ এমন ভাষা যেখানে শব্দের Inflexion [= শব্দরূপ (Declension) + ধাতুরূপ (Conjugation)]  নামক ব্যবস্থাটির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজীতে কিন্তু বিশেষ্য বা ক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত শব্দের রূপান্তর হয়ে থাকে অনেক কম। ৬০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেকার ইংরেজী গদ্য-পদ্যের নমুনা থেকে বুঝা যায়, ইংরেজী ভাষা কী দ্রুত হারে তার প্রাচীন Flexional রূপ (প্রাচীন জারমান থেকে আগত স্বভাব) থেকে বর্ত্তমান Analytic রূপের দিকে এগিয়ে এসেছে। প্রাচীন ইংরেজী শব্দের শেষে থাকত প্রত্যয় (flexional endings)। তাকে অতি দ্রুত হারে ক্রমাগত মোচন করে বা বাতিল করে ইংরেজী ভাষা ছুটেছে Analytic ভাষাদের দলে নাম লেখাতে। ভাষাতত্ত্বের চর্চ্চাকারীরা জানেন, Inflexion-রহিত ভাষার পারিভাষিক পরিচয় Analytic বা Isolating (স্বাতন্ত্র্যধর্মী বা আত্মবিচ্ছেদগ্রস্ত) ভাষা। আধুনিক ইংরেজী ভাষা সেই Analytic স্বভাবের খুব কাছে এসে গিয়েছে। ফলত, শব্দ-প্রকরণের এই প্রক্রিয়াটি তার বলতে গেলে স্তিমিত। তাই যেখানে বাংলায় আপনি একটি বিশেষ্য বা ক্রিয়াপদের বহু রূপ পাবেন (উপরে ‘মানুষ’ ও ‘কর’ শব্দের রূপগুলি দেখুন), ইংরেজীতে সেখানে পাবেন সাকুল্যে পাঁচটি— do, does, did, done, doing। কর মানে যদি make বলেন, পাবেন আরও কম— make, makes, made, making। আবার কর-এর বদলে যদি work ধরেন, তাহলেও ঐ চারটি— work, works, worked, working। বাংলায় শুধুমাত্র ‘কর’ শব্দেরই প্রায় ১০৮টি রূপ দিয়ে গেছেন ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’কার শ্রী হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়; রইল বাকি ‘গড়া’, ‘রচা’, ‘বানানো’ প্রভৃতি প্রায় সমার্থক শব্দ-পরিবারের সদস্যদের সংখ্যার কথা।

           এখান থেকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হয় আমাদের। সবাই বুঝবেন, মনোভাব লেনদেনের বাস্তব পরিস্থিতি সব ভাষার কাছেই তাদের ক্রিয়ামূলক শব্দের বা ক্রিয়াপদের বহু রূপ দাবি করে। ইংরেজী বা ইংরেজীর মত ভাষাগুলি তাদের বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদের অত কম রূপ নিয়ে বাস্তবের দাবি পূর্ণ করছে কীভাবে?

           এর উত্তর পাওয়া যায় ইংরেজী ভাষার নিজস্ব স্বভাব থেকে। বিশেষ্য পদের বেলায় ইংরেজী তার বিশেষ্য পদের রূপান্তরহীনতা সামাল দেয় in, to, at, on, of, from, by ইত্যাদি বিশ-ত্রিশটি preposition-কে কাজে লাগিয়ে। আর, ক্রিয়াপদের সঙ্গে সে be, been, being, am, is, are, was, were, has, have, had, shall, will, should, would ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার করে অবস্থা সামাল দেয়। তার পরও যখন পারে না, তখন আমদানি করে group-verb বা phrasal verb-এর। ফল দাঁড়ায় এই যে, শুরু থেকেই ইংরেজী ভাষা বৈশাখীনির্ভর (ক্রাচনির্ভর) হয়ে চলতে শুরু করে। ইংরেজীতে যখন বলা হয় He is going, তখন কথাটি আসলে সরাসরি ‘সে যাইতেছে’ বলা হয় না; বলা হয় ‘সে হয় যাওয়ন্ত’। তাকেই বুঝে নিতে হয় ‘সে যাইতেছে’ বলে। সমগ্র ইংরেজী ভাষাটিই এইরকম খোঁড়া বাক্যের স্তূপ। এমনিতেই ইংরেজী ভাষার আরোপিত অর্থধারী প্রতীকী শব্দের প্রথম সমস্যা হল, তার অর্থ বীজগণিতের ‘ফরমুলা’র মত মনে রাখতে হয়, চর্চ্চায় থাকতে হয়; যা কিনা মনের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। phrasal verb এসে ইংরেজিভাষীর সেই মনের বোঝা আরও বাড়িয়ে দেয়। রোজকার চর্চ্চায় না থাকলে মানেই বুঝা যাবে না।… রইল বাকি বাক্যে শব্দের আসন-সংরক্ষণ ব্যবস্থা।

           বিভক্তিনির্ভর রূপান্তরের ব্যবস্থা থাকায় বাংলা ভাষাতে শব্দের আসনের স্থানবদল না করেও বলা যায়— ‘মানুষটিকে বাঘটি মারিল’ কিংবা, ‘মানুষটি বাঘটিকে মারিল’। কিন্তু ইংরেজীতে সে ব্যবস্থা না থাকায় শব্দের বসার স্থান বদল করে অবস্থা সামাল দিতে হয়— The tiger killed the man, এবং The man killed the tiger। সেকারণে ইংরেজীর তুলনায় বাংলায় বক্তব্যকে অনেক বেশি সূক্ষ্মতায় প্রকাশ করা যায়।

           এই অধ্যায়ে আমরা দেখলাম, মূল শব্দসম্ভারপ্রতীকী শব্দসম্ভার-এর শব্দেরা সক্রিয় হতে গেলেই বিভক্তি যু্ক্ত হয়ে নতুন নতুন অজস্র শব্দ তৈরি করে। এই শব্দ-প্রকরণ প্রক্রিয়ায় প্রচুর শব্দ সৃষ্টি হয় বাংলাভাষায়। ইংরেজী ভাষায়, কম পরিমাণে হলেও, এই প্রক্রিয়ায় কিছু শব্দের সৃষ্টি হত; শিল্পবিপ্লবোত্তর যুগে তাদের সেই শব্দসৃষ্টির প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। অবস্থা সামাল দেওয়া হচ্ছে phrasal verb–এর রমরমা দিয়ে। তার পরও যদি বলা হয়, বাংলাভাষায় শব্দসংখ্যা বড়োই কম, সে কি ঠিক কথা?

           ৪) শব্দ-প্রকরণ : প্রত্যয়যোগ— বৈয়াকরণদের হিসেবে প্রায় ২০০টি প্রত্যয় রয়েছে বাংলাভাষার হাতে। এই ২০০টি প্রত্যয় যুক্ত হয়ে বিভক্তিহীন শব্দেরা অজস্র নতুন নতুন শব্দের জন্ম দিয়ে থাকে। যথা, (অন) চলন, বলন; (অন্ত) জীবন্ত, উঠন্ত; (তি) চলতি, উঠতি; (আই) চড়াই, সেলাই; (আনী) শুনানী, উড়ানী; … এরকম অজস্র। এর সঙ্গে রয়েছে প্রাচীন কাল থেকে আসা উত্তরাধিকার সূত্রে লব্ধ প্রত্যয়যুক্ত শব্দসমূহের বিশাল সম্ভার। যেমন, (তব্য) কর্ত্তব্য, দাতব্য; (অনীয়) করণীয়, চয়নীয়… এরকম অজস্র— ভোজ্য, বাহ্য, পেয়, দেয়, বহমান, দীপ্যমান, আরাধ্য, বিচার্য্য, আলোচ্য, বৈধ, বৈষ্ণব, কানীন, মাধ্যমিক, পৌরুষেয়, জনতা, দৈনিক, মাসিক, বার্ষিক, নাগরিক, মানসিক, জলীয়, তৈজস… ইত্যাদি অজস্র প্রত্যয়যুক্ত শব্দগুলি আমরা নিত্য ব্যবহার করে থাকি, ব্যাকরণ না পড়েই। বলা ভাল, পরমাপ্রকৃতি সাধারণ বাংলাভাষীর মুখে শব্দের সঙ্গে প্রত্যয় যোগ করিয়ে এইরূপ নতুন নতুন হাজার হাজার শব্দ সৃষ্টি করে থাকেন। বৈয়াকরণ খুঁজে খুঁজে বের করেন, কোন শব্দের সঙ্গে কী প্রত্যয় যোগ করে পরমাপ্রকৃতি বাংলাভাষীর মনের গভীরে বসে এই নব নব শব্দ-সৃজনের কাজটি করে থাকেন। সেই খোঁজের ফল তিনি লিখে রাখেন তাঁর ব্যা-করণ গ্রন্থে। এ এক বিশাল যোগসাধন কর্ম্মযজ্ঞ। ঘরে ঘরে মায়েরা যেমন তাঁদের শিশুসন্তানকে জামাকাপড় পরিয়ে সাধের গোপালকে সাজিয়ে দেন, এ যেন সেই রকম পরিবর্ত্তন সাধন। বাংলাভাষার এই সম্পদের পরিমাণ বিভক্তিযুক্ত শব্দের মতই বিপুল। যে কোনো বাংলা ব্যাকরণের বই খুললেই পাঠক বাংলার প্রত্যয় ও সেই প্রত্যয়যুক্ত শব্দের বিশাল তালিকা দেখে নিতে পারবেন।…

           এক্ষেত্রে ইংরেজী ভাষার পরিস্থিতি, পরিমাণের বিচারে, বাংলার সমান না হলেও অনেকটাই বাংলার মত। যদিও বাংলার মত তার প্রত্যয়ের বোধ সুস্পষ্ট ও সুবিন্যস্ত নয়। আমাদের বৈয়াকরণেরা জানিয়ে গেছেন— প্রত্যয় হল পুরুষ, যে কিনা শব্দের (প্রকৃতির) মনে বিশ্বাস যোগায়, তাকে পথ দেখায়, শব্দের অর্থ কোনদিকে যাবে, তা দেখিয়ে দেয়। ইংরেজী ব্যাকরণ এই সুস্পষ্টতায় বিষয়গুলিকে রাখতে না পারলেও প্রত্যয় বা Suffix-এর ক্ষেত্রে ইংরেজীর শব্দ-প্রকরণ বা শব্দোৎপাদন নেহাৎ কম নয়। একদিকে রয়েছে তাদের স্ববংশীয় প্রত্যয়যুক্ত শব্দ, অপর দিকে রয়েছে ল্যাটিন বা ল্যাটিন বংশীয় ফরাসি প্রত্যয়যুক্ত শব্দের সম্ভার। যেমন স্ববংশীয় Germanic/Teutonic প্রত্যয় (Suffix) যোগে সৃষ্ট শব্দগুলির নমুনা হল— (er) teacher, tailor… (dom) wisdom, freedom… (hood) childhood, manhood… (ness) goodness, smallness… (ship) friendship, worship… (th) health, depth… (en) wooden, earthen… (ful) truthful, beautiful… (ish) boyish, English… (ly) friendly, kindly… (less) hopeless, worthless… (some) handsome, troublesome… etc. পাশাপাশি তাঁদের Latin বা তদ্বংশীয় French প্রত্যয় (Suffix) যোগে সৃষ্ট শব্দগুলির নমুনা হল— (ary) secretary, dictionary… (ee) devotee, payee… (er) engineer, soldier… (or) monitor, actor… (tive) captive, native… (ant/ent) servant, student… (age) bondage, marriage… (nce) disturbance, absence… (ency) urgency, frequency… (tion) action, translation… (sion) conversion, occasion… (ment) movement, nourishment… (our) favour, honour… (ry) slavery, machinery… (tude) aptitude, longitude… (acy) privacy, accuracy… (ty) falsity, beauty… (al) trial, mortal… (ate) private, accurate… (ble) stable, double… etc.

           ইংরেজী ও বাংলা ভাষার প্রত্যয়যোগ প্রকরণে উভয় ভাষার শব্দোৎপাদন নেহাৎ কম নয়। প্রাচ্যের ও পাশ্চাত্যের অনেক ভাষাতে এই শব্দ-প্রকরণ কমবেশি আছে।

           ৫) শব্দ-প্রকরণ : উপসর্গযোগ— বাংলা ভাষায় ৫০-এরও অধিক উপসর্গ রয়েছে বলে আমাদের মনে হয়। অতীতে সংস্কৃতকারগণ সেগুলির ২১টিকে উদ্ধার করে আলাদা করে দেখাতে পেরেছিলেন। সুনীতিবাবু বাংলাভাষীদের বয়ান থেকে আরও ২৯টি উপসর্গ উদ্ধার করে সেগুলিকে ‘দেশী’ ও ‘বিদেশী’ বলে চিহ্ণিত করেছেন। এছাড়াও আরও কিছু উপসর্গ-সম শব্দ রয়েছে, যেগুলি উদ্ধার করা দরকার। যেমন, সৎ (সৎমা, সৎভাই… ইত্যাদি), অধঃ (অধঃশিরা, অধঃপাত, অধোগামী… ইত্যাদি)…। একটি ক্রিয়াবাচক শব্দকে উপসর্গযোগ যে কী পরিমাণ পরিব্যাপ্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, উপসর্গযুক্ত শব্দগুলির দিকে তাকালেই সেকথা টের পাওয়া যায়। ‘কর’ বা ‘চর’ শব্দ দুটির কথাই ধরুন। উপসর্গযুক্ত হয়ে সে আকর, নিষ্কর, তস্কর… আকরণ, প্রকরণ, পুরস্করণ… প্রকৃত, বিকৃত, সংস্কৃত… আকৃতি, বিকৃতি, প্রকৃতি… অধিকার, অপকার, আকার, আবিষ্কার উপকার চীৎকার তিরস্কার ধিক্কার পরিষ্কার পুরস্কার প্রকার বিকার সংস্কার… ইত্যাদি অজস্র; এবং আচরণ বিচরণ সঞ্চরণ… অপচার অভিচার আচার বিচার উপচার প্রচার সঞ্চার… ইত্যাদি অজস্র নতুন শব্দের স্রোতধারা সৃষ্টি করে দেয়। ইংরেজীতেও এর ব্যবহার ছিল এবং আছে, যদিও বাংলার তুলনায় পরিমাণে অনেক কম।

           ইংরেজীর স্ববংশীয় Germanic/Teutonic উপসর্গ (Prefix) যোগে সৃষ্ট শব্দগুলির নমুনা হল— (a) awake, arise… (be) become, behold, below, besides … (for) forget, forsake … (fore) forecast, foresee, forehead, foreman… (in) into, insight… (mis) misdeed, mistake… (out) outlook, outcome… (over) overflow, overlook… (to) today, towards… (un) unreal, untold… (under) undergo, undertake… (up) uphold, upon… (with) withdraw, withstand… etc. ইংরেজীতে প্রচলিত Latin বা তদ্বংশীয় French উপসর্গ (Prefix) যোগে সৃষ্ট শব্দগুলির নমুনা হল— (ab) abuse, absurd… (ad) advice, adopt… (ac) accustom, accept… (a) affirm, affix…; একই নিয়মে— aggravate, aggregate; announce, annual; approach, appear; arrive, arrest; assent, assure; attend, attract… এইরকম বেশ কিছু শব্দ তৈরি হয়ে থাকে। এখানে স্মর্তব্য যে, বাংলায় যেমন ঋ-যুক্ত ক্রিয়াপদগুলি (ঋ-জন = অর্জ্জন, গর্জ্জন ইত্যাদি) সবসময় দ্বিত্ব রূপ লাভ করে, ইংরেজীতেও তেমনি ff, gg, nn, pp, rr, ss, tt প্রভৃতি বর্ণগুলি দ্বিত্ব অর্জ্জন করেছে। এই দ্বিত্ব ইংরেজ পণ্ডিতেরা বর্জ্জনযোগ্য বলে মনে করেননি।

           এছাড়াও রয়েছে com-, con-, contra-, de-, dis-, ex-, inter-, post-, pre-, retro-, pro-, sub-… প্রভৃতি ল্যাটিন উপসর্গ; রয়েছে গ্রীক উপসর্গ (Prefix) যোগে সৃষ্ট ইংরেজীতে বহুল প্রচলিত শব্দগুলিও। সেই উপসর্গগুলি হল— anti-, apo-, cata-, dia-, dys-, epi-, exo-, endo-, hyper-, hypo-, meta-, mono-, poly-, peri-, para- … প্রভৃতি। আর, সেগুলি দিয়ে প্রচুর শব্দও তৈরি হয়েছে ইংরেজীতে।

           সর্ব্বোপরি এইসব উপসর্গের অধিকাংশই যে মানবজাতির আদি শব্দভাণ্ডার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে সব জাতির ভাষাই কমবেশি পেয়েছে, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে সেকথা আজ সুস্পষ্টরূপে জানা যায়। বলে রাখা ভাল, এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর দাদা বেশ কিছু কাজ করে রেখে গিয়েছেন। তাঁরা দেখেছিলেন, ইংরেজীর pro-যুক্ত প্রায় সমস্ত শব্দেই ইংরেজী pro বাংলা ‘প্র’ উপসর্গের সমার্থক রূপে সক্রিয় থাকে।

           ৬) শব্দ-প্রকরণ : ক্রিয়াদিযোগ— এ এক অদ্ভুত শব্দ-প্রকরণ প্রক্রিয়া, যার দ্বারা ক্রিয়ামূলক ধারণাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রূপে ধারণ করে প্রকাশ করা যায়। এতে দুই বা তিনটি ক্রিয়াপদকে যুগপৎ সক্রিয় রেখেই একত্রে জুড়ে প্রকাশ করা হয়। যেমন, ধরে নাও, ধরে দাও, ধরে রাখ, ধরে ছাড়, ধরে ফেল, ধরে মার, ধরে বাঁধ, ধরে সাজাও, ধরে সরাও, ধরে মোছ, ধরে বোলাও, ধরে কাট, ধরে সাঁট…; অথবা, করে ফেলে রাখো, করে দিয়ে যেয়ো, করে নিয়ে যেয়ো, ভেবে চিন্তে দেখো, ধুয়ে মুছে সাফ করো… ইত্যাদি। বহু ক্ষেত্রে এই যোড়-ক্রিয়ার ব্যঞ্জনা সেই ক্রিয়ার পরিণামের দিকে পর্য্যন্ত ইঙ্গিত দেয়। যেমন, ‘সে কী বলে বসবে তার ঠিক নেই’; কিংবা, ‘সে দেখে ফেলেছে’। এই ক্রিয়াগুলি এমন নয় যে, এদের পৃথকভাবে (ইংরেজী ভাষার বাক্য নির্ম্মাণ পদ্ধতিতে প্রস্তুত) করা যায়। করলে (অর্থাৎ, ‘সে কী বলবে এবং বসবে তার ঠিক নেই’; কিংবা, ‘সে দেখেছে এবং ফেলেছে’; করলে) ভুল মানে হয়ে যায়। যে কোন কাজকে একত্রে ‘অখণ্ড’ ভাবে বুঝবার ও বলবার একটা প্রবণতা এই ক্ষেত্রে স্পষ্ট দেখা যায়। এই শব্দ-প্রকরণ পদ্ধতি প্রমাণ করে, মানবজাতির যৌথতার বা অখণ্ডতার উত্তরাধিকার এমনকি শব্দ-প্রকরণের মাধ্যমেও আমাদের হাতে আজও প্রবহমান রয়েছে। বাংলাভাষার এ এক অমূল্য সম্পদ। পরের শব্দ-প্রকরণে, শব্দজোড়ে, বাংলাভাষার এই অখণ্ডতামুখী-চেষ্টা আবারও দেখব আমরা।

           ইংরেজীতে এরকম হয় না, বরং বিপরীতটাই হয়। তাতে ‘ধরে নাও’কে বলা হয় ‘ধর এবং নাও’; ‘ধরে দাও’কে বলা হয় ‘ধর এবং দাও’… ইত্যাদি। এইরকম খণ্ড খণ্ড করে বোঝার ও বলার প্রবণতা ইংরেজী ভাষায় অত্যধিক; এবং আধুনিক ইংরেজী ভাষাবিদগণ মনে করেন, সেটিই তাঁদের গৌরব! ‘বলে বসবে’, ‘দেখে ফেলেছে’, ‘করে দিয়ে যেয়ো’ জাতীয় শব্দবন্ধ তো ইংরেজীতে বোঝানই যায় না। বলতে কী, তাঁদের ঐরূপ খণ্ড করে বোঝা ও বলার ফলে বহু অখণ্ড ধারণাই বরবাদ হয়ে যায় এবং ইংরেজিভাষীগণ সেই অখণ্ড-ধারণা তাঁদের শব্দ-প্রকরণে ধরতেই পারেন না আর। যেমন, ‘ধরে ফেল’র পরিবর্ত্তে যদি বলা হয়, ‘ধর এবং ফেল’ তাহলে ধারণাটির সূক্ষ্ম বোধের প্রকাশ তো দূরের কথা, বাক্যটিই নিরর্থক হয়ে যায়। তার মানে, এই ধরনের ক্রিয়াদিযোগ-এ প্রসূত কোন বাংলা শব্দের (বাক্যের) ইংরেজী অনুবাদ করা অসম্ভব। অর্থাৎ কিনা, ক্রিয়ার যে সূক্ষ্মতায় বাংলাভাষা যেতে পারে, ইংরেজী ভাষা সে সূক্ষ্মতাকে ধরতেই পারে না।

           এখান থেকে ইংরেজী ভাষার স্বাতন্ত্র্যের, খণ্ডতার, দোকানদারীর স্বভাব একেবারে স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তার প্রতিটি ক্রিয়াপদের দু-চারটে যা রূপ রয়েছে, সেগুলিকে সঙ্কুচিত করে এক একটি পাটাতনের মত একটি মাত্র শব্দে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারলে ইংরেজী ভাষা স্বস্তি পায়। কেননা, পাটাতনের চাকা, সামনের হ্যান্ডেল, বেল, ব্রেক… ইত্যাদি পনেরোটি auxiliary অংশ (be, been, being, am, is, are… প্রভৃতি) সে পৃথকভাবে বানিয়ে রেখেছে। ‘‘যার যখন যেটা দরকার, সেটি নাও আর অপরিবর্ত্তনীয় ক্রিয়াপদরূপী পাটাতনটির আগে পেছনে যেখানে জোড়া দেওয়া দরকার, সেখানে জুড়ে দাও! বাক্যের গাড়ি চলতে শুরু করে দেবে।’’ এভাবে ইংরেজী ভাষাতে যৌথতাবিরোধী স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা ঊর্দ্ধে তুলে ধরা হয়েছে; খণ্ডতার জয়গান গাওয়া হয়েছে। একেই তাঁদের ভাষাতাত্ত্বিকরা সগৌরবে ঘোষণা করছেন Isolating (স্বাতন্ত্র্যধর্মী বা আত্মবিচ্ছেদগ্রস্ত) ভাষা। এই স্বাতন্ত্র্যের পক্ষে তাঁদের সৃষ্ট phrasal verb (যার রমরমা বেড়েছে গত দুশো বছরে) আরও সাহায্য করে থাকে। একে পঞ্চানন্দ, তায় ধুনোর গন্ধ!

           কিন্তু আমাদের বাংলার উলটো স্বভাব। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই গেছেন, ‘স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজা আমার নহে’। তাঁর মতে — ‘অখণ্ডকে চাই, খণ্ডকেও চাই’। অখণ্ডকে ধরে প্রকাশ করা বাংলাভাষার স্বভাব। আবার, প্রয়োজনে সে কত বেশি খণ্ড নিখুঁত হতে পারে, সে তো আমরা ক্রিয়াদিযোগ-এর বেলাতেই দেখতে পেলাম; ইংরেজী ভাষা সে সূক্ষ্মতায় যেতেই পারে না। তাছাড়া, ‘পাঁচটি ছেলে যাচ্ছে’ বাক্যকে ইংরেজীতে যখন Five boys are going লেখা হয়, তখন স্পষ্ট দেখা যায়, ইংরেজীতে তিনটি ক্ষেত্রে বহুবচনের উল্লেখ করতে হচ্ছে — ‘Five’, ‘boys’, ‘are’; যখন কিনা বাংলায় শুধু ‘পাঁচ’ সংখ্যায় বহুবচনের উল্লেখ লাগছে। অর্থাৎ, বাংলাভাষা অখণ্ডকে অক্ষত রেখে খণ্ডের চূড়ান্তে যেতে পারে, কিন্তু ইংরেজী ভাষা খণ্ডের সাধনা করতে গিয়ে অখণ্ডকে ত্যাগ করায় নিজের অগ্রগতিকে ‘একঝোঁকা’ করে ফেলে এবং ফলত বিপদ ডেকে আনে। ইংরেজী ভাষার এই যে স্বভাব, auxiliary verb-এর বা ‘সাহায্যকারী ক্রিয়া’র সহায়তা ছাড়া যার ক্রিয়াপদের চলবার ক্ষমতা থাকে না; সে ভাষা তো গোড়া থেকেই খোঁড়া। এই দিক থেকে ইংরেজী ভাষা বড়ই দুর্ভাগা। আর, আধুনিক বাংলাভাষাও দুর্ভাগা অন্য দিক থেকে। তার কিছু শিক্ষাবিদ-ভাষাবিদ ইংরেজীর ‘একঝোঁকগ্রস্ততা’ বা দুর্ভাগ্যকে সৌভাগ্য বিবেচনা করে তারই অন্ধ আরাধনা করছেন, বিদেশের কুকুরের পূজা করছেন ‘স্বদেশের ঠাকুর ফেলিয়া’৤

           ৭) শব্দ-প্রকরণ : সম্পূরকযোগ (জোড়শব্দ) — বাংলাভাষার এই একটি বিপুল শক্তি, প্রকৃত-সম্পদ। এ সম্পদ হয়তো-বা একমাত্র বাংলাভাষারই আছে। ইংরেজী ভাষার এই শক্তি নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে, বাংলা ভাষার তুলনায় তা নগণ্য। এ হল দুটো সাঁড়াশির ন্যায় দুটো পরিপূরক, পরস্পরনির্ভর, সহোদর, একাধিক-বোধক ‘ধারণা’ ধারী শব্দকে জুড়ে একটি পূর্ণাঙ্গ ধারণাধারী শব্দে পরিণত করা। বাংলাভাষায় এই প্রকরণের অন্তত চার রকম প্রক্রিয়া রয়েছে। সেগুলি নিম্নরূপ : —

           (ক) পরিপূরক জোড় : আশেপাশে, আয়-উপায়, সভ্যভব্য, যত্নআত্তি, বিষয়আশয়, রাতদিনে, ডালপালা, ছুতোনাতা, কলকব্জা, লালনপালন, লুকোচুরি, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, ছলচাতুরি… ইত্যাদি অজস্র। কোনো বৈয়াকরণ এখনও এই শব্দগুলির পৃথক সঙ্কলন করেননি; আমাদের করে নিতে হবে। এই শব্দগুলির বিশেষত্ব হল, এতে দুটি করে এমন শব্দ পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয়, যারা পরস্পরের পরিপূরক। যেমন, ‘আশে’ হল সেই সকল বস্তু বা বিষয়, মানুষ যাকে মন দিয়ে ছুঁতে বা আশা করতে পারে; এবং ‘পাশে’ হল সেই সব বস্তু বা বিষয়, মানুষ যাকে তার শরীর বা শরীরাংশ (হাত) দিয়ে স্পর্শ করতে পারে। ‘আশেপাশে’ শব্দটি স্বভাবতই মানুষের দেহের ও মনের চারপাশ ঘিরে থাকা সব বিষয় ও বস্তুকেই বোঝাতে পারে এমন ধারণাধারী চেতনা-হাতিয়ার বা শব্দ হয়ে গেল। একই নিয়মে, ‘আয়’ হল যা স্বাভাবিকভাবে মানুষের কাছে আসে; আর ‘উপায়’ হল উপ-আয় বা সহকারী আয়; যেমন চাষের আয়ের পাশাপাশি কখনো কখনো অন্যের জমিতে মজুর খেটে উপায় বা রোজগার করা; কিংবা, কেরানির চাকরির আয়ের পাশাপাশি টিউশনি করে উপায় করা। স্বভাবতই ‘আয়-উপায়’ শব্দটি মূল আয়ের পাশাপাশি অন্যান্য আয়ের ধারণাকে ধরবার চেতনা-হাতিয়ার রূপে সক্রিয় হতে পেরেছে। আবার, ‘সভ্য’ হল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে সজারুর মত দূরত্বমূলক ঘনিষ্ঠতা রক্ষা করে চলায় অভ্যস্ত হওয়া; এবং ‘ভব্য’ হল যা কিছু জগতে জন্মেছে, তাদের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকায় অভ্যস্ত হওয়া। শহুরে শিক্ষিতেরা সাধারণত সভ্য হন, ভব্য হন না; গ্রামের ‘অশিক্ষিতেরা’ সাধারণত ভব্য হন, সভ্য হওয়ার দরকার পড়ে না তাঁদের। বাংলাভাষী মনে করে মানুষের ‘সভ্যভব্য’ হওয়া উচিত।

           (খ) পুরুষ-প্রকৃতি জোড় : যে কোনো বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদকে এই রীতিতে জুড়ে ফেলা যায়। তাতে বলতে গেলে এক নতুন ধারণাধারী শব্দরূপে জোড়টি সক্রিয় হয়ে যায়। বিশেষ্য শব্দের ক্ষেত্রে যেমন, হাতাহাতি, কানাকানি, লাঠালাঠি… এরকম বহু শব্দ তৈরি করা হয়; তেমনি ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রেও প্রচুর জোড়শব্দ তৈরি করা হয়। যথা : ধরাধরি, মারামারি, হাসাহাসি, বলাবলি… ইত্যাদি। যেহেতু প্রায় সব ক্রিয়াবাচক শব্দকে এবং হাজার হাজার বিশেষ্য শব্দকে এই প্রক্রিয়ায় নতুন শব্দে রূপান্তরিত করে ফেলা যায়, তাই এই প্রকরণে অতি বিপুল পরিমাণ শব্দ তৈরি করা যায়। বাংলাভাষীগণ তা করেনও; কেননা, দেখাদেখি চাষ আর লাগালাগি বাসই যে তাঁদের উত্তরাধিকার। এধরনের শব্দজোড়কে আমরা ‘পুরুষ-প্রকৃতি জোড়’ নাম দিয়েছি। তার কারণ হল, এধরনের জোড়ের প্রথম শব্দটি প্রকৃতি স্বভাবের এবং দ্বিতীয় শব্দটি পুরুষ স্বভাবের।

           (গ) সহোদর জোড় : বাংলাভাষার এ এক অতুলনীয় শব্দ-প্রকরণ প্রক্রিয়া। একই ক্রিয়ার গর্ভ থেকে জন্মায় বলে এদের এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় যে শব্দসমূহ উৎপাদিত হয়, সেগুলির নমুনা হল— কাটকুট, খুটখাট, গোলগাল, ঘোঁতঘাঁত, চুপচাপ, ছুটছাট, জটাজুট, ঝালঝোল, টুপটাপ, ঠুনঠান, ডাগরডোগর, ঢিলেঢালা, তুকতাক, থুপথাপ, দুড়দাড়, ধুমধাম, পিটপাট, ফিটফাট, বসবাস, ভুটভাট, মিটমাট… প্রভৃতি অজস্র। এই শব্দ-প্রকরণে দেখা যায়, একটি ক্রিয়াপদেরই দুটি রূপ পরস্পরের সহযোগী হয়ে উচ্চমানের ধারণাধারী শব্দ হয়ে জন্ম লাভ করছে। যেমন, কাটা একরকম কাজ, আর কুটি কুটি করা একই ক্রিয়ার আর একরকম রূপ। তাকে একত্র করে বলা হয় ‘কাটকুট’ করা। ইংরেজীতে এরকম শব্দ কি তৈরি হয়? আমরা যতদূর জানি, হলেও খুব সামান্য পরিমাণে হয়।

           (ঘ) অনুকারী জোড় : এটি একটি অদ্ভুত জোড়করণ প্রক্রিয়া। এতে যে কোনো শব্দের সঙ্গে তার অনুকারী শব্দ জুড়ে দিয়ে সাধারণভাবে ‘এবং অন্যান্য’  অর্থটি মূল শব্দটির পেছনে যোগ করে দেওয়া হয়। যেমন, ভাত-টাত, জল-টল, মন্ত্রী-টন্ত্রী…। এমন শব্দ খুব কমই হয়, যাকে এই প্রক্রিয়ায় নতুন শব্দে রূপান্তরিত করা যায় না। তার মানে, বাংলাভাষায় যত শব্দ হয়, এই প্রক্রিয়া তাকে মুহূর্ত্তে দ্বিগুণ করে দিতে পারে! অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। আর, প্রতিটি শব্দে ধরে রাখা ধারণা যেহেতু আলাদা, তার ‘এবং অন্যান্য’ ও আলাদা স্বভাবের হতে বাধ্য। ‘-টাত’ বললে যে ‘এবং অন্যান্য’দের বোঝায়, ‘-টল’ বললে সেরকম ‘এবং অন্যান্য’দের বোঝায় না, আলাদা ‘অন্যান্য’দের বোঝায়। ইংরেজী কেন, কোনো ভাষাতেই এরকম প্রক্রিয়ার খবর আমরা এখনও পাইনি।

           ইংরেজীতে এইরূপ সম্পূরকযোগ-এর কোন প্রকরণ নেই তা নয়। আছে, খুবই কম পরিমাণে আছে। যেমন : dilly-dally, hanky-panky, hocus-pocus, helter-skelter, knick-knack, namby-pamby, willy-nilly… ইত্যাদি। বাংলার শব্দজোড় প্রকরণের সঙ্গে সংখ্যার দিক থেকে এর তুলনাই চলে না।

           ৮) শব্দ-প্রকরণ : বিন্দুযোগ— বিশ্বব্যবস্থাকে মানুষের নিজের দেহটুকুর মধ্যে ধরে সেই ধারণাকে প্রকাশ করা হয় যে সকল শব্দে, এখন আমরা তার কথাই বলব। এ যেন বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন করে নিয়ে তার কথা বিন্দুর সাহায্যে বলা। বাংলাভাষায় মানবশরীরের যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে, তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কিত ধারণাধারী শব্দও আছে। যেমন, মাথা, কপাল, চোখ, কান, নাক, মুখ, জিভ, দাঁত, গাল, গলা, ঘাড়, বুক, হাত, আঙুল, পেট… ইত্যাদি। কিন্তু ঐরূপ এক একটি ধারণাধারী অর্থে শব্দগুলির ব্যবহার করেই তাদের ফেলে দেওয়া হয় না। শব্দগুলিকে অন্যভাবেও ব্যবহার করা হয়। ‘মাথা’ শব্দের ক্ষেত্রে যেমন, মাথা-খাওয়া, মাথা-কুটা, মাথা-ঘামান, মাথা-চালা, মাথা-চুলকান, মাথা-ঠেকান, মাথা-তোলা, মাথা-নোয়ান… ইত্যাদি বেশ কিছু শব্দ রয়েছে। এদের স্বভাব দেখুন, একেবারে স্বতন্ত্র কিন্তু অদৃশ্য-সত্তা-বিষয়ক ধারণাকে ধরে নাড়াচাড়া করার ক্ষমতা ধরে এই শব্দজোড়গুলি। হাত করা, হাত মারা, হাত কামড়ান, হাত খোলা, হাত গণা, হাত গোটান, হাত চলা, হাত চালান, হাত ছাড়ান, হাত তোলা, হাত থাকা, হাত ধরা, হাত ধোয়া, হাত পাকান, হাত পাতা, হাত বাড়ান, হাত লাগান… ইত্যাদি। চোখ, কান, নাক, মুখ, গলা, বুক, পেট, পা— সব ক্ষেত্রেই এরকম অজস্র শব্দ তৈরি করা হয়েছে, যা বিশ্বের আর কোনো ভাষায় আছে বলে আমাদের জানা নেই। ইংরেজীর কিছু রয়েছে তার heading towards, handing over… জাতীয় কয়েকটি শব্দে।

           ৯) শব্দ-প্রকরণ : সন্ধিযোগ— এই প্রকরণে দুই বা ততোধিক শব্দকে জুড়ে নতুন শব্দ বানানো হয়। আর, সন্ধি যোগে কত বিপুল পরিমাণ নতুন শব্দ বাংলাভাষায় উৎপাদিত হয়, পাঠক তা নিশ্চয় জানেন। তবুও উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি নমুনা দিয়ে যাওয়া যাক— দেবালয়, বিদ্যালয়, হিমালয়, অতীব, প্রতীক্ষা, দেবেন্দ্র, পূর্ণেন্দু, নীলোৎপল, মহর্ষি, অত্যাচার, ইত্যাদি, উদ্ধত, উল্লিখিত, পরিচ্ছদ, বৃক্ষচ্ছায়া… ইত্যাদি অজস্র। বাংলা ভাষার কত শব্দ যে এই প্রক্রিয়ায় বানানো, তা আলাদা করে আজও হিসাব করা যায়নি, করা যাবে বলেও মনে হয় না। নব নব শব্দ বানানোর প্রক্রিয়ার বিচারে এ যেন একটি ‘ধারণা’কে দুটো চিমটা দিয়ে ধরা। ইংরেজীতে এই সন্ধি প্রক্রিয়াটির প্রচলন নেই বললেই চলে। অন্তত ইংরেজী ভাষার বৈয়াকরণিক ধ্যান-ধারণার জগতে সমাস বিষয়ক আবছা কিছু ধারণা থাকলেও সন্ধি বিষয়ক কোনো ধারণাই নাই; যদিও ভাষার ব্যবহারে দুটি শব্দ যোগ করার অচিহ্নিত কিছু উপায় রয়েছে। তবে শব্দ-প্রকরণ রূপে তাকে উল্লেখ করা এবং প্রমাণ করা কঠিন কাজ।

           ১০) শব্দ-প্রকরণ : সমাসযোগ— এ এক বিশাল সরোবর, চেতনার হাতিয়ার-সম্ভারের সরোবর। এ হল সম্পূর্ণ একটি বাক্যকে একত্রিকরণের একটি বিশেষ প্রক্রিয়ার বা সমাসের মাধ্যমে বানানো শব্দসম্ভার। বাংলাভাষার সমগ্র শব্দসমুদ্রের একটি বিশাল অংশ এই প্রক্রিয়ায় বানানো হয়ে থাকে। যথা— অতিক্রান্ত, অপরাহ্ণ, আসমুদ্রহিমাচল, কাপুরুষ, পাটলিপুত্র, ত্রিগঙ্গা, রাজপথ, কালপেঁচা, ঘনশ্যাম, ঠাকুরদাদা, অকৃতকার্য্য, কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ়, ভুঁইফোড়, দিশাহারা, চণ্ডিদাস… এরকম অজস্র।

           সমাসযোগে যে বিপুল পরিমাণে নব নব শব্দসৃজন বাংলা ভাষায় হয়ে থাকে, ইংরেজী ভাষাতে তার সেরকম কোনো বিধিবদ্ধ ব্যবস্থার সুযোগ নাই। যেটি আছে তাকে তাঁরা Compound Words-এলাকার বিষয় বলে মনে করেন। সেইভাবে তৈরি হওয়া Compound Words নামে প্রচলিত ইংরেজী সমাসবদ্ধ বিশেষ্য ও ক্রিয়াপদ বেশ কিছু আছে। যথা, railway, workshop, breakfast, shoemaker, income, break-up, farewell, lock-up, salesman, afternoon, … (to) browbeat, hoodwink, safeguard, make-believe, overhear, backbite, whitewash … ইত্যাদি। তাছাড়া ইংরেজীর এমন কিছু Compound Words আছে, যাদের ‘ইংরেজী ভাষার গুপ্ত সমাস’ বলাই সমীচীন। যেমন : killer instinct, school committee, survey report … ইত্যাদি।

           অর্থাৎ, শব্দ-প্রকরণ-এর সমাসযোগ-এর ব্যাপারটি ইংরেজীতে বোধ্যরূপে বিধিবদ্ধ হয়ে নেই; রয়েছে খানিকটা অচেতনভাবে এবং গুপ্তভাবে, পরিমাণেও খুবই কম। আর সেটি যে ইংরেজী ভাষার দুর্বলতা সেকথা মিলটন প্রমুখ বড় মানুষেরা কেউ কেউ জানতেন। তবে তিনি চাইলেও বাকি ইংরেজগণ এই শব্দজোড়ার কাজটি করতে চাননি। কেননা, স্বাতন্ত্র্যের ধ্বজাধারীরা তো জোড়া জিনিসকে ভেঙে দেওয়ার লোক; তাঁরা খণ্ডদের জুড়তে চাইবেন কেন। খণ্ডতার, স্বাতন্ত্র্যের, দোকানদারির সাধক ইংরেজ সেকারণে সন্ধি ও সমাসের যোগসাধনা করেনি।

           ১১) শব্দ-প্রকরণ : বাগ্‌ধারাযোগ— এখন আমরা যে চেতনার হাতিয়ার-সম্ভারের মুখোমুখি হচ্ছি, ভাষার সাহায্যে কথাবলা জাতি মাত্রে তাতে তাঁদের অর্জ্জিত শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা বা অতি উচ্চ মানের জ্ঞানকে ধরে জনশ্রুতির মাধ্যমে ধারা রূপে প্রবাহিত রাখেন। সাধারণভাবে এগুলিকে ‘বাগধারা’ বলা হয়ে থাকে। এগুলি প্রকৃষ্টরূপে বানানো এক বা একাধিক শব্দের জ্ঞানমূলক শব্দবন্ধ বা বাক্যাংশ। সাধারণত দুই বা ততোধিক ছোট ছোট শব্দ নিয়ে এগুলি গড়ে ওঠে এবং বাংলাভাষায় এগুলির সংখ্যা প্রচুর। যথা, পুকুর চুরি, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, আঙুল ফুলে কলাগাছ, কলা দেখানো, বুদ্ধির ঢেঁকি, খাল কেটে কুমীর আনা… ইত্যাদি। চেতনার এই হাতিয়ারগুলি শুধুমাত্র গভীর জ্ঞানমূলক ধারণাকেই ধারণ করে না, ইতিহাসকেও ধারণ-বহন করে। তাছাড়া, এই বাগধারাগুলিতে কথিত শব্দের অর্থ, আর, তাদের প্রতিপাদ্য অর্থ প্রায়শ একেবারেই আলাদা। এমনকি বহু ক্ষেত্রে এই বাগধারাগুলির কথিত শব্দের দৃশ্য কোনো অর্থই হয় না, যদিও প্রতিপাদ্য অর্থটি অত্যন্ত বাস্তব এবং অত্যন্ত জ্ঞানমূলক।

           যেমন, যথাক্রমে, (‘পুকুর চুরি’র ক্ষেত্রে) লুকিয়ে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, এমন পুকুর দেখতে পাওয়া অসম্ভব; এমন আকাশকে দেখতে পাওয়াও অসম্ভব যে কিনা ভেঙে গিয়ে মানুষের মাথায় পড়ে; কিংবা, কারও আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে টিকিট করেও তো দর্শক ঠেকানো যাবে না; এমন ঢেঁকিশাল কেউ দেখেনি যেখানে বুদ্ধির ঢেঁকির দেখা মেলে; এমন ঘটনাও দেখতে পাওয়া কঠিন যাতে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ খাল কেটে কুমীর নামক জলজ প্রাণীটিকে সেই খাল ধরে ডেকে ডেকে নিয়ে আসছেন। অর্থাৎ, এই বাগধারাগুলির দৃশ্য অর্থ অসম্ভব, অবাস্তব। নিশ্চয় বাংলাভাষী এই বাগ্‌ধারাগুলির অদৃশ্য অর্থই বুঝতেন, বোঝেন এবং বোঝাতে চান।

           তবে কিনা, ‘আধুনিকতা’র প্রকোপে আজকাল এ ধরনের বাগধারার অর্থ অনেকেই ভুলে গেছেন। যেমন, প্রশ্ন করে দেখুন— ‘পুকুর চুরি’র মত (দৃশ্যত অবাস্তব, কিন্তু অদৃশ্যত অত্যন্ত বাস্তব) ধারণা বাংলাভাষী অর্জ্জন করলেন কীভাবে? এই বাগধারার প্রকৃত অর্থ কী? দেখবেন, উত্তরটা অ্যাকাডেমির বাংলা-বিশেষজ্ঞগণ কেউই জানেন না।

           বাংলাভাষার ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি চর্চ্চার দৌলতে আজ আমরা জেনেছি, ‘পুকুর চুরি’র ধারণাটি একটি ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার। সংক্ষেপে, প্রাচীন ভারতে সমাজের যৌথসম্পদ রাখা হত মহর্ষির এখতিয়ারে এবং মহর্ষি-রক্ষিত সেই সম্পদভাণ্ডারকে বলা হত ঋষিকুল্যা বা ঋষির পুকুর। সমাজে ব্যক্তিমালিকানার আবির্ভাবের পর সেই যৌথসম্পদ বা পুকুর চুরি হতে শুরু করে। তারই উত্তরাধিকার বাংলার এই ‘পুকুর চুরি’। যেহেতু একালে যৌথসম্পদ বলতে সরকারী সম্পত্তিকে বোঝায়, সেকারণে যথেষ্ট পরিমাণে সরকারী সম্পদ লুঠ করাকেই একালে ‘পুকুর চুরি’ বলা হয়ে থাকে।

           বাংলাভাষীর মনের গভীরে তাঁদের ভাষা-চেতনা অত্যন্ত সক্রিয়। সক্রিয় বলেই তাঁরা ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’র মত শব্দ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। মধ্যযুগেও এই শব্দের জন্ম হয়নি, হয়েছে স্বাধীনতার প্রাক্কালের বাংলাভাষীর মুখে। এই ‘বুদ্ধি’ হল অ্যাকাডেমি-শিক্ষালব্ধ বিদ্যা। এই বিদ্যার গৌরব হল, সে ইতোপূর্ব্বে আবিষ্কৃত বহুপরীক্ষিত ও বহুব্যবহৃত একই জ্ঞানকে তজ্জনিত কর্ম্মের প্রয়োগের মাধ্যমে জগৎকে রাতারাতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু তার অত্যন্ত অগৌরব হল, কাল বদলে গেলে কিংবা কোনো নতুন পরিস্থিতিতে পড়ে গেলে সে কিছুই করতে পারে না; তখন, ‘বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই’-এর সব বিদ্যাবুদ্ধি ‘ষোলো আনাই মাটি’ বলে প্রমাণিত হয়। কেননা, সে ঢেঁকির মত একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিতেই অভ্যস্ত। অ্যাকাডেমির বাঁধা-জ্ঞানের বাইরে এই বুদ্ধির ঢেঁকিরা যেতেই পারেন না। সাধারণভাবে এঁরা বিদ্যার শাখার শাখা, তস্য শাখায়, তার প্রশাখায় ‘বিশেষজ্ঞ’ রূপে বিচরণ করেন বলে এঁদের ‘কাণ্ডজ্ঞান’ থাকে না, এবং এঁদের স্বভাব হয় যন্ত্রের মত, ঢেঁকির মত, জড়ের মত। হিন্দুসমাজ যাঁদের ‘শূদ্র’ বলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের শূদ্র বলেননি, এই ঢেঁকির মত জড়দেরই শূদ্র বলেছেন; বলেছেন, ‘জড়ই তো শূদ্র’! আজকের মানবসভ্যতার সমস্ত দুঃখের কারণ ‘অ্যাকাডেমিতে অতি উচ্চশিক্ষিত’ এই যন্ত্রবৎ ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’রা। এঁরাই এখন বহু দেশের বা জাতির পরিচালক নেতানেত্রীদের পরামর্শদাতা রূপে কাজ করেন; এমনকি প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হয়েও বসেন; যাঁদের হাঁটা-চলা অবধি যন্ত্রের মত। প্রচুর ডিগ্রিওয়ালা এই ধরনের মানুষের পক্ষেই কেবল বলা সম্ভব যে, বর্ত্তমান ভারতে যাঁরা দিনে ২৩ টাকার বেশি রোজগার করেন, তাঁরা ধনী। যিনি এই ধরনের কথা বলতে পারেন, তেমন মানুষকে ‘বুদ্ধির ঢেঁকি’ ছাড়া আর কীই বা বলা যায়! ‘বুদ্ধি’ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক অর্থ থেকেও একথা নিশ্চিত রূপে জানা যায়। সর্ব্বোপরি, কোনো পুরাণেই নারদের বাহনস্বরূপ ঢেঁকির উল্লেখ নেই; কিন্তু বাঙালীর জনশ্রুতিতে রয়েছে। তার মানে, এটি বাঙালী জাতির নিজস্ব অর্জ্জন। বাঙালী জেনেছে, ঢেঁকির ন্যায় জড়বৎ এই উচ্চশিক্ষিত যন্ত্রগুলো ‘হরিগুণ গায়’ (‘স্ট্যাটাস-কো মেইনটেইন করো, এভাবেই থাকা সবচেয়ে ভাল’ এই কথা বলে) এবং বিরোধীদের মধ্যে ঝগড়া বাধায়; যাতে ‘সমাজের দুধসর চেটেপুটে যারা খায়’ তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারে।… যাই হোক, এই নিবন্ধের অবয়বের কথা ভেবে ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া’, ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’… ইত্যাদি বাগধারার ব্যাখ্যা এখানে করব না আমরা।

           ইংরেজী ভাষারও বাগধারার বিপুল সম্ভার ছিল— Pound of flesh; Pandora’s box; Trojan horse; Apple of discord; (to) carry coal to Newcastle; (to) fish in troubled water; a bull in a China shop; Snake in the grass; Bolt from the blue; Hobson’s Choice … ইত্যাদি। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ইংরেজীতে বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচনের বিপুল ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়; এখন তার পরিমাণ অনেক কম। ইংরেজীর এই বাগধারাগুলির আধিক্য প্রমাণ করে, এককালে পাশ্চাত্যের মানুষের চেতনাতেও বাগধারা-স্বরূপ চেতনার হাতিয়ারগুলি যথেষ্ট পরিমাণে সক্রিয় ছিল। কিন্তু ‘তাহাদের সেই সুদিন গিয়াছে’। কর্পোরেট-পুঁজি শাসিত বর্ত্তমান যুগের ইংরেজী ভাষা এই ধরনের বাগধারাকে বলতে গেলে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিয়েছে। ফলে, আজকের ইংরেজী ভাষা হয়ে উঠেছে ‘কাজ চালানো ভাষা’, দোকানদারির ভাষা। পরিণতি এই হয়েছে যে, আজকের ইংরেজী ভাষা দিয়ে উচ্চ মানের জ্ঞানচর্চ্চার কাজ চালান কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে; তার জন্য প্রাক-শিল্পবিপ্লব যুগের ইংরেজীর শরণাপন্ন হতে হয়। অবশ্য কথাটি একালের অ্যাকাডেমি-ব্যবহৃত বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও কমবেশি খাটে।

           যাই হোক, বাগধারা নামক চেতনার হাতিয়ারের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, এই প্রকরণ বাংলাভাষার বিপুল পরিমাণে ছিল, এবং এখনো সাধারণ বাংলাভাষীদের মধ্যে তার প্রচলন কমবেশি রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, তাঁদের চেতনায় এই চেতনার হাতিয়ার-সম্ভার আজও সম্পূর্ণ সক্রিয়। ইংরেজীর ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, এই ভাষাশক্তি অতীতে তাদেরও ছিল; এখন নেই বললেই চলে এবং বড় কথা হল, ইংরেজিভাষী সাধারণ মানুষের চেতনাতেও তার উপস্থিতি আজকাল চোখে পড়ে না। ভারতীয় ভাষাগুলিতেও এই বাগধারার প্রাবল্য বিদ্যমান। এই ভাষাগুলি ছাড়া অন্য কোন ভাষা আপনি যদি জানেন, সে ভাষায় এই ভাষাশক্তি কতখানি রয়েছে, সে তুলনা নিজেই করে নিতে পারবেন আশা করি।

           ১২) শব্দ-প্রকরণ : প্রবাদপ্রবচনযোগ— ধারণার বাহক এই চেতনার হাতিয়ার বা শব্দগুলি আসলে অর্দ্ধবাক্য, বাক্যাংশ, বা পূর্ণবাক্য রূপে প্রবাহিত হয়ে আসছে। যথা — অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ, অতি চালাকের গলায় দড়ি, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট, অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী… এরকম অজস্র। অনেকগুলি ছোট ছোট ধারণাধারী শব্দ নিয়ে এগুলি গড়ে ওঠে, যেন-বা একাধিক আংটায় ঝোলানো লম্বা চেরা শালকাঠ। এক একটি বিশেষ ও সম্পূর্ণ ধারণাকে ধারণ করে এরা বয়ে নিয়ে চলে। স্বভাবে এগুলি প্রকৃষ্টরূপে বানানো এক বা একাধিক শব্দের বাণী। বহু যুগের বহু মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে অতি-সংক্ষিপ্ত করে বানানো হয়েছে এই বাণীগুলি এবং তারপর সেগুলিকে জনশ্রুতিতে প্রবাহিত করে দেওয়া হয়েছে। শাস্ত্রে বলে, এই জনশ্রুতি বেদ-এরও ঊর্ধ্বে; অর্থাৎ, বেদজ্ঞানের চেয়েও এদের মর্য্যাদা বেশি। লক্ষ্যণীয় যে, সাধারণত অত্যন্ত উচ্চমানের অদৃশ্য-সত্তা-বিষয়ক ধারণাকে এই প্রবচনগুলি বহন করে নিয়ে চলে। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এই প্রবচনগুলির কথিত শব্দগুলির অর্থের সঙ্গে তাদের সামগ্রিকভাবে প্রতিপাদ্য অর্থের পার্থক্য রয়েছে। বৈয়াকরণের ভাষায়, এদের অভিধার্থের পাশাপাশি লক্ষণার্থ ও ব্যঞ্জনার্থ থাকে। ফলে, যাঁরা এগুলির ব্যবহার করেন, তাঁরা নিজেদের অজান্তেই উচ্চমানের জ্ঞানচর্চ্চা করে চলেন। আর সেকারণেই বাংলাভাষী মানুষ তাঁর ভাষার মাধ্যমে কথা বলতে বলতেই যথেষ্ট কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন জ্ঞানী হয়ে উঠতে পারেন; সেজন্যে অ্যাকাডেমি-শিক্ষার প্রয়োজন হয় না তাঁদের। রবীন্দ্রনাথ গ্রামবাংলার চণ্ডীমণ্ডপের জ্ঞানচর্চ্চার যে উচ্চ প্রশংসা করতেন, সে এই কারণেই।

বাংলাভাষায় এই ধরনের উচ্চ মানের চেতনার হাতিয়ারের বা প্রবাদ-প্রবচনের দাপট এত বেশি যে, গ্রামবাংলায় এমন বহু মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁরা, বলতে গেলে, কথাই বলেন প্রবাদ-প্রবচনের মাধ্যমে। ইংরেজী ভাষাতেও এরকম প্রবাদ-প্রবচন ছিল, যেমন— A bird in hand is worth two in the bush; Nearest to Church, farthest from God; The pot calls the kettle black; Don’t put all your eggs in one basket; Every dog has his day; All roads lead to Rome… ইত্যাদি। কিন্তু তাদের সংখ্যা বাংলাভাষার প্রবাদ-প্রবচনের তুলনায় কম। শিল্পবিপ্লবের আগে ইংরেজগণ তাঁদের কথাবার্ত্তায় সেই সকল প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার করতেন। শেকসপীয়রের সমসাময়িক কালের বা তারও আগের ইংরেজের ভাষাই তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। শিল্পবিপ্লবোত্তর পশ্চিমী আধুনিকতা সাধারণ মানুষের এইরূপ জ্ঞানচর্চ্চাকারী ভাষা-ব্যবহারের ঘোর বিরোধী। তারই প্রকোপে আধুনিক ইংরেজী ভাষা থেকে তাদের প্রবাদ-প্রবচন ব্যবহারের অভ্যাস ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে। ফলে, একালের ইংরেজ জনসাধারণের মধ্যে প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার কমে গেছে। সেই কারণে তাঁদের চর্চ্চিত একালের ইংরেজী ভাষা তাঁদেরকে আর আগের মত জ্ঞানচর্চ্চাকারীতে উন্নীত করতে পারে না। তাদেরই প্রভাবে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালীও বাংলার এই প্রবাদ-প্রবচনকে হীন চোখে দেখে। বাংলায় বিগত তেষট্টি বছরের ‘আধুনিক’ শাসকদের শাসনকালে বাংলার এই ভাষাশক্তিকে যথেষ্ট খর্ব্ব করা হয়েছে; শহরের ক্ষেত্রে এই খর্ব্বকরণ হয়েছে গ্রামের তুলনায় বহুগুণ বেশি। যদিও তা সত্ত্বেও এমনকি শহুরে শিক্ষিত বাংলাভাষীদের মধ্যেও এখনো এই প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার কম পরিমাণে হলেও বেঁচে রয়েছে। এখনো শিক্ষিত শহুরে বাঙালীর মুখে শোনা যায়— চোরের মায়ের বড় গলা; ধর্ম্মের কল বাতাসে নড়ে… ইত্যাদি। বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে তাঁদের ভাষা চর্চ্চিত এই প্রবাদ-প্রবচনের সম্ভার এখনো তাঁদেরকে জ্ঞানী মানুষে উন্নীত করে। অবশ্য যাঁরা অ্যাকাডেমীর ইংরেজী ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ও অত্যন্ত প্রভাবিত হয়ে নিজের নিজের মনটাকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন, তেমন বাঙালীদের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। মোটকথা, সকল ভাষাতেই আধুনিকতা যে পর্য্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পেরেছে, সেই পর্য্যন্ত ভাষায় প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার খর্ব্ব করে ফেলা গেছে। আমরা দেখেছি, শুধুমাত্র ইংরেজী ও বাংলাই নয়, একথা বর্ত্তমান বিশ্বের অধিকাংশ ভাষার ক্ষেত্রেই কমবেশি খাটে। এর ফলে, আধুনিকতা-দষ্ট ভাষার ব্যবহারকারীগণ তাঁদের ভাষাচর্চ্চার মাধ্যমে আর জ্ঞানী মানুষে উন্নীত হতে পারেন না।

           যাই হোক, এক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, প্রবাদ-প্রবচন নামক চেতনার হাতিয়ার বাংলার ছিল, এখনো বহুল পরিমাণে আছে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাভাষী জনগণের চেতনায় এই চেতনার হাতিয়ার বা প্রবাদ-প্রবচন এখনো সক্রিয় রয়েছে। বাংলাভাষার তুলনায় কম থাকলেও ইংরেজী ভাষারও প্রবাদ-প্রবচন যথেষ্ট পরিমাণে ছিল, কিন্তু এখন তাদের পরিমাণ এত কমে গেছে যে, একালের ইংরেজী কথাবার্ত্তায় বা লেখালেখিতে তার উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় কদাচিৎ। সর্ব্বোপরি, ইংরেজিভাষী জনসাধারণের চেতনায় একে আর বিশেষ সক্রিয় দেখা যায় না।

           শব্দসম্ভার ছাড়া আরও অনেক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে যে কোনো ভাষার প্রকাশক্ষমতা। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি হল — (ক) শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য গঠনের রীতি (Syntax); (খ) ভাষার ভিতর স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের ব্যবহারের ভিতর দিয়ে পরিস্ফুট ভাষার ধ্বনিগত চরিত্র (Phonology); (গ) শব্দ ও বাক্যের মধ্যে স্বরের ওঠানামা (Intonation), শ্বাসাঘাত (Accent) এবং অক্ষরের দৈর্ঘ্য বা মাত্রা (Quantity)। এসবের দিক থেকেও দেখা যায়, বাংলার পাশে ইংরেজী ভাষার তুলনামূলক হীনতা। এই বিষয়গুলি নিয়ে সন্তোষজনক আলোচনা করার মত ব্যাপ্ত পরিসর এই প্রবন্ধে নেই। তবে এ বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ আভাস দেওয়া যেতে পারে। ইংরেজী ভাষায় বাক্য ও বাক্যে ব্যবহৃত পদ, দুয়েরই প্রবণতা ব্যঞ্জন ধ্বনিতে শেষ হওয়া। ফলে, আ-কার, ই-কার, উ-কার জাতীয় বিভিন্ন রকমের কারিতায় শব্দ ও বাক্য শেষ হতে পারে না। ফলত, সতত পরিবর্ত্তনশীল বিশ্বের ক্রিয়াময়তা বাংলার তুলনায় ইংরেজী ভাষায় কম প্রতিফলিত হয়। এবং বহু শতাব্দী ধরে ইংরেজী ভাষার শব্দভাণ্ডারের স্বরান্ততা থেকে ব্যঞ্জনান্ততার দিকে সরে আসা, উচ্চারণের কালে স্বরের ওঠানামাকে যতদূর সম্ভব কমিয়ে আনা এবং শব্দ ও বাক্য উভয় ক্ষেত্রে অক্ষরের মাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি থেকে শ্বাসাঘাতের উপর বেশি নির্ভর করা (যার অনিবার্য্য পরিণামে বাক্যটি হয়ে যায় কয়েকটি খণ্ডের সমষ্টি)— এই সবকিছুই সূচিত করে এক বিশেষ মানসিকতা। সে হল বিশ্বকে চলমান প্রবাহ হিসেবে না দেখে তাকে অগণিত স্থিতিশীল খণ্ডের পারম্পর্য্য বলে দেখা।

           এই খণ্ডবাদী দৃষ্টির লক্ষণই হল, ক্রিয়ার চেয়ে ক্রিয়ার আধারকে, অর্থাৎ কর্তা ও অন্যান্য কারককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া। শব্দ নির্ব্বাচন এবং বাক্যগঠন, এই দুই এলাকাতেও ইংরেজীর এই চরিত্র ধরা পড়ে। বাংলার ‘প্রস্তাব পেশ করা’, ‘পরিস্থিতি সামাল দেওয়া’, ‘কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে যাওয়া’, এবং ইংরেজীর ‘table a resolution’, ‘handle a situation’, ‘elbow one’s way through a crowd’— এই তিনটি প্রস্থের বাক্যাংশ থেকে বুঝা যায়, ক্রিয়ার চেয়ে ক্রিয়ার আধারের দিকে ইংরেজীর বেশি নজর। আবার, ‘তার একটি বন্ধু আছে’, ‘আমার এটি ভাল লাগে না’, ‘তোমার এটি সহ্য হবে না’… ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করুন ইংরেজীর ‘He has a friend’, ‘I don’t like it’, ‘You can’t stand it’— এখানে দেখা যাচ্ছে, বাক্যে কোন কর্ত্তা না দেখালে চলবে না, এই অনড় বোধ থেকে বাংলার তুলনায় ইংরেজীতে কত ভ্রান্তিকরভাবে কর্ত্তৃত্বের আরোপণ হয়েছে।

 শব্দ-প্রকরণ : বাংলা বনাম ইংরেজী

এতক্ষণ আমরা মানুষের লব্ধ ধারণাদি প্রক্রিয়াকরণ করে ভাষণে পরিণত করার মূল যে কারিকা, সেই শব্দ-প্রকরণ বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজী মূলত এই দুই ভাষার প্রক্রিয়াগুলি অধ্যয়ন করার চেষ্টা করলাম। অর্থাৎ, বাংলা ও ইংরেজী ভাষার কর্ম্মশালায় (ওয়ার্কশপে) কত প্রকারের এবং কী পরিমাণে চেতনার হাতিয়ার বা শব্দ বানানোর ব্যবস্থা সচল আছে; তা পরিদর্শন করলাম। এই পরিদর্শন থেকে যা পাওয়া গেল, তার সারসংক্ষেপ করলে আমরা পাই:

শব্দ-প্রকরণ (১ম লাইন)

বাংলা ভাষায় (২য় লাইন)

ইংরেজী ভাষায় (৩য় লাইন)

১২

প্রবাদ-প্রবচন

আছে, বিপুল পরিমাণে। শুধু উচ্চশিক্ষিত মুষ্টিমেয় শহুরে বাঙালী, কম ব্যবহার করে (বাংলা ভাষায়)

আগে ছিল, এখন প্রায় মৃত; খুব কম ব্যবহার হয়। (ইংরেজী ভাষায়)

১১

বাগ্‌ধারা

আছে, বিপুল পরিমাণে। শুধু উচ্চশিক্ষিত মুষ্টিমেয় শহুরে বাঙালী, কম ব্যবহার করে (বাংলা ভাষায়)

আগে ছিল, এখন প্রায় মৃত; খুব কম ব্যবহার হয়। (ইংরেজী ভাষায়)

১০

সমাসযোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে। (বাংলাভাষায়)

আছে, অতি অল্প পরিমাণে, অন্য নামে। তুলনায় ১ শতাংশ। (ইংরেজী ভাষায়)

সন্ধিযোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে। (বাংলা ভাষায়)

নাই। (ইংরেজী ভাষায়)

বিন্দুযোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে। (বাংলাভাষায়)

আছে, অল্প পরিমাণে। ১ শতাংশ।

জোড়-শব্দসম্ভার

আছে, বিপুল পরিমাণে। (বাংলাভাষায়)

যৎসামান্য আছে। ১ সহস্রাংশ। (ইংরেজী ভাষায়)

ক্রিয়াদিযোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে। বাংলাভাষায়)

নাই। (ইংরেজী ভাষায়)

উপসর্গযোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে। (বাংলাভাষায়)

আছে, যথেষ্ট পরিমাণে। (ইংরেজী ভাষায়)

প্রত্যয়যোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে। (বাংলাভাষায়)

আছে, বিপুল পরিমাণে। (ইংরেজী ভাষায়)

বিভক্তিযোগ

আছে, বিপুল পরিমাণে।

আছে, কম। কাজ চালানোর অন্য ব্যবস্থা রয়েছে। (ইংরেজী ভাষায়)

প্রতীকী-শব্দসম্ভার

আছে, অতীতসহ বর্ত্তমান। (বাংলাভাষায়)

আছে, অতীতহারা হয়ে। (ইংরেজী ভাষায়)

মূল-শব্দসম্ভার

আছে, চিহ্ণিত করা গেছে। (বাংলাভাষায়)

নাই। (ইংরেজী ভাষায়)

           এই তুলনামূলক আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, ১২ রকম শব্দ-প্রকরণের মধ্যে ইংরেজী ভাষার ৩ রকম শব্দ-প্রকরণ একেবারেই নাই; আরও ৫ রকম প্রকরণ নাই বললেই চলে; বাকি ৪ রকম শব্দ-প্রকরণ উভয় ভাষার থাকলেও বাংলা ভাষার রয়েছে পরিমাণে বেশি এবং সজীব। সুতরাং, চেতনার হাতিয়ার বা শব্দ তৈরির চলমান প্রকৌশল ইংরেজী ভাষার তুলনায় বাংলাভাষার যে অনেক অনেক বেশি, তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কার্য্যত, বাংলাভাষীর মনের গভীরে চলমান উপরোক্ত বারোটি শব্দসৃজন কর্ম্মশালায় যে পরিমাণ শব্দ তৈরির ব্যবস্থা রয়েছে, তাকে এক কথায় বলা যায়, অসীম সংখ্যক শব্দ বানানোর ব্যবস্থা। মানতে হবে, ইংরেজী ভাষার শব্দ বানানোর যে ব্যবস্থা রয়েছে, বাংলা ভাষার শব্দ বানানোর ব্যবস্থার তুলনায় তা খুবই কম প্রজননশীল। ইংরেজী ভাষার তুলনায় বাংলা ভাষা বহুগুণ সম্পদশালী বা শক্তিশালী ভাষা। এবং আরো বড় কথা এই যে, সেই ভাষা ব্যবহার করার যোগ্যতা অধিকাংশ বাংলাভাষীর এখনও আছে।

           প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার যে, বিশ্বের প্রতিটি ভাষারই এইরকম নিজ নিজ শব্দ-প্রকরণ ব্যবস্থা বা শব্দসৃজন কর্ম্মশালা রয়েছে। আমাদের বিচারে ভারতীয় ভাষাগুলির অধিকাংশেরই ৮-১০টি কর্ম্মশালা রয়েছে। কেউ কোন নতুন ভাষা শিখলে, দেখতে হবে, তিনি সেই ভাষার রম্যবাক্য বা রম্যরচনা বুঝতে পারেন কি না। যদি পারেন, বুঝতে হবে, তিনি তাঁর নিজের ভাষার কর্ম্মশালার পাশাপাশি নবার্জ্জিত ভাষাটির কর্ম্মশালাও নিজের মনের ভিতরে প্রতিষ্ঠা করে নিতে পেরেছেন। আগের কালে যাঁরা একাধিক ভাষা শিক্ষা করতেন, তাঁদের অনেকেরই এই যোগ্যতা ছিল। বোধ করি, বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর মত মানুষদের মনের গভীরে দেশী বিদেশী মিলিয়ে নিশ্চয় আরও অনেকগুলি শব্দ-প্রকরণ কর্ম্মশালা থেকে থাকবে। তাঁরা যখন যে ভাষায় কথাবার্ত্তা বলতেন, তখন তাঁদের মনের গভীরে থাকা সেই ভাষার শব্দ-প্রকরণ কর্ম্মশালাগুলি সক্রিয় হয়ে উঠত। সত্যজিৎ রায়, নীরদ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল প্রমুখ মানুষদের মনের গভীরেও বাংলা ইংরেজী উভয় প্রকারের শব্দ-প্রকরণ কর্ম্মশালা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল বলেই আমাদের মনে হয়েছে।

           অবশ্য ভাষার প্রকৃত সম্পদ দিয়ে মানবসমাজে ভাষার সামাজিক শক্তির বিচার হয় না। সমাজে একটি ভাষা শক্তিধর হয়, তার পিছনে কীরূপ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক শক্তি সক্রিয় রয়েছে তার উপর নির্ভর করে। তবে, সে প্রসঙ্গ এখন নয়।

ভাষার অর্জ্জিত সম্পদ : বাংলা বনাম ইংরেজী

যদিও ভাষার প্রকৃত সম্পদ নিয়েই আমরা কথা বললাম, ভাষার অর্জ্জিত সম্পদ নিয়েও কয়েকটি কথা এখানে বলে রাখা দরকার। আমাদের সমকালের অর্ব্বাচীন ইংরেজী-প্রেমীদের অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, ‘বাংলার এমন কী আছে, যা ইংরেজীর নাই?’ এক্ষেত্রেও তাঁরা আঙুরথোকা ও কিসমিসের গুনতির নীতি প্রয়োগ করে থাকেন। ইংরেজীর বেলায় শুরু করেন সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর ‘ওল্ড ইংলিশ’ থেকে, কিন্তু বাংলার বেলায় হিসেব শুরু করেন মঙ্গলকাব্য, কৃত্তিবাস-কাশীরাম, কীর্ত্তন-পদাবলী সাহিত্যাদিকে বাদ দিয়ে; কেননা, তাঁদের বিচারে পাশ্চাত্যের মধ্যযুগ যেহেতু আকালের যুগ, বাংলার মধ্যযুগ বাংলাভাষার স্বর্ণযুগ হলেও তা অবশ্যই আকালের যুগ। ইংরেজী সাহিত্যে যে যুগে উল্লেখযোগ্য বড় সৃষ্টি বেশি নাই, সে যুগে বাংলার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হয়ে থাকলেও হয়নি। এই খণ্ডজ্ঞানীসুলভ বোধকে সাহায্য করেন পাশ্চাত্যের আধুনিকতার মোহে আচ্ছন্ন বাংলার শিক্ষক-অধ্যাপকদের একটি বড় অংশ। তাঁরা বাংলার অর্জ্জন হিসাব করতে শুরু করেন রামমোহন থেকে এবং শেষ করেন মহাশ্বেতায়।

           আমরা বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্য এবং তার ইতিহাস আগাগোড়া কমবেশি পড়েছি। ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির সাহায্যে মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্য্যন্ত পড়ার পর আমরা মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করছি, ভাষার অর্জ্জিত সম্পদ রূপে পাশ্চাত্যের যা আছে, তার চেয়ে কম নয় বরং অনেক বেশিই আছে বাংলা সাহিত্যে। তবে সেই সত্যটি চোখে ধরা পড়ে বর্ত্তমানে প্রচলিত দেহবাদী দর্শনের ঠুলিটি চোখ থেকে খুলে যাবার পর। দেহবাদী দর্শন কোন কিছুর শ্রেষ্ঠতা মাপে কলেবর বা বপুর প্রসারের হিসাবে; সেই দর্শন অন্যান্য অনেক কিছুর মত সাহিত্য বিচারকেও অনেক নীচে নামিয়ে আনে। এ নিয়ে এখানে বিস্তৃত আলোচনা সম্ভব নয়। তবে আমাদের বক্তব্য খণ্ডন করে কেউ যদি কলম ধরেন, আমরা দুজন একত্রে যতদিন বেঁচেবর্ত্তে আছি ততদিন আমরা অবশ্যই দেখিয়ে দিতে পারব যে তাঁর ধারণা ঠিক নয়। তবে, দয়া করে আনন্দবাজার বা ঐরকম কোন পত্রিকার আড়াল নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করবেন না। কেননা, তেমন বিষোদ্গারের উত্তর আমরা দিলেও ঐ পত্রিকাগুলি তা ছাপবে না, ছাপে না। ফলে, ব্যাপারটি একেবারেই একতরফা এবং নীচ আক্রমণ মাত্র হয়ে যায়। অতীতে, একজন সেইরূপ কুকর্ম্ম করেছেন। আর একজন তাঁর লিখিত বিরোধিতা আমাদের কাছে দিয়েছিলেন, আমরা তার উত্তর দিয়ে বলেছিলাম, তাঁর লেখা ও আমাদের উত্তর দুটোই একত্রে ছাপা হোক। ভদ্রলোক গোপনে দেখা করে প্রায় কান্নাকাটি করে নিজের লেখাটি ফেরত নিয়ে নেন।

উপসংহার

           হ্যাঁ, বাংলাভাষা যে অত্যন্ত শক্তিশালী সম্পদশালী ভাষা তা নিয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। কিন্তু সম্পদশালী ভাষা হলেই তো হবে না, এমনকি তা ব্যবহার করার দক্ষতা থাকলেও হবে না, সে ভাষা ব্যবহার করার ইচ্ছা থাকা চাই। আর, আজকাল মাঝেমধ্যে প্রায়ই একটা হৈচৈ শোনা যাচ্ছে যে, বাংলাভাষী জাতিটি নাকি আর বাংলাভাষা ব্যবহার করতে চাইছে না; ইংরেজী ভাষার পিছনে ছুটছে! এখন তাহলে কী হবে?

           সত্যিই তো! নিজের মহাশক্তিশালী অস্ত্রশস্ত্র আছে, সেগুলি চালানোর দক্ষতাও আছে; কিন্তু সেগুলি চালিয়ে কোন কিছু অর্জনের ইচ্ছা নাই; বরং সেসব ফেলে দিয়ে অন্য দিকে ছুটছে সে। এমন হলে কী হবে?

           সর্ব্বনাশ হবে! তবে কিনা, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মানুষ সেরকম করতে পারে না, করে না। একমাত্র সুনামিতে পড়ে গেলে মানুষ তার সকল বাহ্যসম্পদ ও সেসব অর্জ্জনের উপায়সমূহ ত্যাগ করে পালাতে পারে এবং অন্য কিছু ধরে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারে। সকল মানসসম্পদ ও সেই মানসসম্পদ অর্জ্জনের হাতিয়ারসমূহ ত্যাগ করে পালানোর জন্য কমপক্ষে সেরকম একটা মানসিক সুনামি লাগার কথা। বাংলাভাষী জাতিটি কি সেরকম কোনো মানসিক সুনামিতে পড়ে গেছে? পরবর্ত্তী নিবন্ধে আমরা সে কথায় যাব।

 

59988119_1370063993133849_5472995070590320640_nরবি চক্রবর্ত্তী
জন্ম: ২৪শে অক্টোবর ১৯২৯, কোন্নগর, হুগলী।

রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. India Rediscovered (2002)
২. দিগন্তের টানে : The Lure of Horizon (২০১২)

কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)

23669107_991937210946531_3818214380102258710_o (1)কলিম খান
জন্ম: ০১ জানুয়ারী ১৯৫০ মামুদাবাদ (মেদিনীপুর)। মৃত্যু: ১১ জুন ২০১৮ কলকাতা।

কলিম খান’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে (১৯৯৫)
২. দিশা থেকে বিদিশায় : নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশবার্তা (১৯৯৯)
৩. জ্যোতি থেকে মমতায় : ফ্রম এনলাইটেনমেন্ট টু…. (২০০০)
৪. পরমাভাষার সংকেত (২০০১)
৫. আত্নহত্যা থেকে গণহত্যা : আসমানদারী করতে দেব কাকে (২০০২)
৬. পরমা ভাষার বোধন উদ্বোধন : ভাষাবিজ্ঞানের ক্রিয়াভিত্তিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (২০০২)

কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার