ভ্যান গঘকে আজ স্বপ্নে দেখলাম। বলল— আমার “স্টেরি নাইট” ছবিটার বাজারমূল্য এখন কত? …
উসকোখুসকো চুল। গাল ভেঙ্গে গেছে। পরনে পশমের মোটা কাপড়। অস্থির, ক্ষ্যাপাটে ভ্যান গঘকে বললাম— আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি ছবিগুলোর বাজারমূল্য অনেক বেশী। আমার আন্দাজের চেয়েও বেশী!
ভ্যান গঘকে তখন বিষন্ন মনে হল। মনে হল তিনি কাঁদছেন। তার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করার শব্দ আমার কানে হাতুড়ীর আঘাতের মত ভয়াবহ এবং তীব্র মনে হচ্ছে। একবার ভাবলাম তাঁর ভাই থিওর কথা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু ভ্যান গঘ আমাকে আচমকা জড়িয়ে ধরল। জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠল। ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের শরীর কাঁপছে। তর্ তর্ করে বয়স্ক মানুষের মত কাঁপছে গঘ।
আমি অনেকক্ষণ নীরব হয়ে রইলাম। কেননা ভ্যান গঘের ইচ্ছে- “I wish they would only take me as I am.”
আমি ধীরে ধীরে মাথাটা তুলে উপরের আকাশের দিকে তাকালাম! অজস্র নক্ষত্রের আকাশ। চিক চিক করছে রুপালী থালার মত। শহীদ কাদরী যেভাবে বলেছিল— নিগ্রো নারীদের রুপালি অলঙ্কারের মত রাতের আকাশে নক্ষত্ররা! আমার মনে হল— নারীর অশ্রুজলের ফোঁটার মত চকচকে নক্ষত্ররা আকাশে ছুটছে। আকাশের পথে পথে নক্ষত্রের এই বহমান ছুটে চলা দেখে মনে পড়ল— ভ্যান গঘ বলেছিল— “Be clearly aware of the stars and infinity on high. Then life seems almost enchanted after all.”
অন্ধকারে রাতের তারাদের দিকে চোখ পড়লে মনে হয় হারিয়ে যাচ্ছি অতলে। কোথাও যেন সরে যায় মাটি। উড়ে যায় সমস্ত অস্তিত্ব। সবকিছুই যেন ভাসতে থাকে। তুলোর মত। অনার্দ্র একটি পাখীর পালকের মত। অসীম এবং শূণ্যতায় ভরে ওঠে চেতনার সব ঘর, সব উঠোন। যেখানে কেবল মহাশূণ্যের পুরাণ। মহাশূণ্যের মত অনন্ত উৎসব!
গঘের চোখের জলে আমার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ভিনসেন্ট! আমি আরো নিবিড়ভাবে আমার বুকের ভেতর ভ্যানগঘকে জড়িয়ে ধরলাম। শিশুর মত জড়সড় ভিনসেন্টও আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার বুকের ভেতর এক হিমশীতল হৃদপিন্ডের স্পর্শ পেলাম আমি। এই তো, এইই ভ্যান গঘের হৃদপিণ্ড। যার ভুবন, যার চেতনা, যার যাপনে শিল্পই ছিল সত্যি। শিল্পই ছিল ধর্ম্ম। শিল্পই ছিল ঈশ্বর। উচ্চারণ করেছিল— “I dream of painting and then I paint my dream.”
আমি টের পেলাম তাঁর কান্নার শব্দ ম্লান হয়ে আসছে ধীরে। অল্প অল্প ফোঁপাতে ফোঁপাতে আকাশের দিকে তাকাল। কাকতাড়ুয়ার মত দু’হাত শূণ্যে ছড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠল— “I often think that night is more alive and more richly colored than the day.”
হ্যাঁ, হ্যাঁ একদম। রাত্রিই অধিক জীবন্ত। অধিক প্রাণবন্ত। রাতের অন্ধকারেই আমাদের হৃদয়ের অনুচ্চারিত বেদনাগুলো আমরা হাওয়ার দোলনায় ছড়িয়ে দিতে পারি। রাতের নৈঃশব্দেই আমরা নির্দ্বিধায় ভেঙ্গে যেতে পারি নিপুণভাবে। রাতের গভীর এবং গোপণ অন্ধকারেই আমরা নিজেদের দূরবর্ত্তী সকল দ্বীপে নির্ব্বাসন দিতে পারি। রাত হয়ে ওঠে কখনো স্বপ্নের মত মোহাবিষ্ট, কখনো রঙ্গীন পাখীর পালকের মত নরোম এবং কোমল।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম— আপনার পটেটো ইটারস্ ছবিটা আমার ভীষণ প্রিয়। যে পরিবারের ছবি আপনি আঁকতে চেয়েছিলেন সেই পরিবারকেও আমি চিনি।
ভান গঘ কিছুই বলল না। শুধু জিগেস করল— সেগুলোর বাজারমূল্য কত?
আমি ভাবলাম ভ্যান গঘ নিজের শিল্পকর্ম্মের বাজারদর নিয়ে এতো ব্যস্ত কেন? তবু বললাম— অনেক অনেক অনেক বেশী। আমার ধারণারও বাইরে।
ভানগঘ আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। বলল— ঐ যে ঐ আমার ভাই থিও। থিও আমার হৃদয়!
কয়েকটা জোনাকী এসে ভ্যানগঘের খাড়া লালচুলের ওপর যখন বসল— ভ্যান গঘ বলল— জোনাকীর এই সবুজ রংয়ের মানে জানো? আমি বললাম— সবুজ আমার ভীষণ পছন্দের। আমার কাছে সবুজ এক প্রশান্তির প্রতীক।
হো হো করে হেসে উঠল ভান গঘ। একেবারে বাচ্চা ছেলের মত করে। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম— হাসলেন যে?
সবুজ প্রশান্তির প্রতীক হতে যাবে কেন? আমরা সর্ব্বোত্তম প্রশান্তি পাই প্রকৃতির সবকিছু থেকে। সর্ব্বত্রই প্রশান্তি কুড়োতে পারি। “If you truly love nature, you’ll find beauty everywhere.”
তবে সবুজের আলাদা কী মানে?
ভান গঘ বলল— আমার কাছে মনে হয় সবুজ একটি শূণ্যস্থান। যেখানে আমরা যেতে পারি না। তুমি বোধয় জানো আমার শিল্পকর্ম্মে সবুজ বর্ণ প্রায় নেই বললেই চলে। কারণ আমি সুবজে কাছাকাছি কখনো যেতে পারিনি।
তবে প্রকৃতির সবকিছুই হলুদ বর্ণ। রোদ্দুর, গোধূলী, ভোরবেলা কিংবা সর্ষেক্ষেত। কিংবা ধান ক্ষেত কিংবা বসন্তের কড়ই গাছের হলুদ শরীর।
— “There is no blue without yellow and without orange.”
আচ্ছা ভিনসেন্ট— তুমি স্টেরী নাইটের বাজারমূল্য কেন জানতে চাচ্ছিলে বারবার? সবচেয়ে প্রিয় শিল্পকর্ম্ম ওটা এখন মানুষের কাছে। তোমার সেই শিল্পকর্ম্ম নিলামে কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রি হয় প্রতিনিয়তই। তোমার কি সুখবোধ হয়?
তিনি মুখ ভেংচিয়ে জবাব দিল— আমার কাছে এসব একঘেয়েমি, ক্লান্তিকর এবং বিষাদিত মনে হয়। তুমি জানো তো— I would rather die of passion than of boredom. পৃথিবীর মানুষ আজীবনই একঘেয়ে, ক্লান্তিকর এবং নোংরাই রয়ে গেল। তাদের কাছে আজীবন অর্থই যাপনের প্রধান এবং একমাত্র অনুষঙ্গ হয়ে থাকল। তারা না পারল জীবনের কাছে যেতে, না পারল জীবনকে কাছে টেনে নিতে। এভাবে বেঁচে থাকা যায়?
হ্যাঁ, হ্যাঁ ভিনসেন্ট। বাঁচা তো যায় না এভাবে। আমার মনে পড়ল— এই সেই ভিনসেন্ট— একজন বেশ্যাকে রাজী করাতে যে নিজের কান কেটে সেই বেশ্যার হাতে তুলে দিয়েছিল।
তিনি তবু বাঁচতে চেয়েছিলেন। হাজার বৎসর বাঁচতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন সংসার করতে। সংসার সাজাতে।
যে সারাজীবনই চেয়েছিল ভাঙ্গতে। যে বারবার বলেছিল— “I am seeking, I’m Striving, I’m in it with all my heart.”
ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করব, তাঁর প্রাক-যৌবনের প্রেমিকা উরসুলাকে মনে পড়ে কি না। মনে পড়ে কি না কী’ভসকে। যার জন্য মোমবাতীর আগুনে নিজের হাত পুড়িয়েছিল।
পাগলাটে ভানগঘকে আমি জিঙ্গাসা করলাম না কিছুই। ভাবলাম সেই পতিতার কথা জিগেস করব, যাকে গঘ নিজের ঘরে তুলে এনেছিল এবং সেই ক্রিস্তিন— যার গর্ভে অন্য কারো সন্তানের বীজ, তবু গঘ তাকে আগলে রেখেছিল। ভালবেসেছিল। তবু তবু কি হায়, গঘকে ক্রিস্তিন ভালবেসেছিল?
আমি ভানগঘের কাঁধে হাত রাখলাম। ভান গঘকে এখন আরো বিষন্ন মনে হচ্ছে। বললাম- কি ভাবছো ভিনসেন্ট?
বলল— উরসুলাকে ভাবছি। আমার প্রথম প্রেম। আমার প্রথম প্রেমে পড়ার সুখ। আমি জানতামই না যে উরসুলা অন্য কারো বাগদত্তা। আমার হাতে আঁকা ছবি তার জানালায় আমি নিজে সেঁটে দিয়েছি। তবু… তবু …….
গঘ বসে পড়ল ঘাসের মাটীতে। ঘাসের মত নরোম এবং মসৃণ, ভিনসেন্টের দাঁড়িগুলোতে আমি হাত বুলোতে লাগলাম। রাত বাড়ছে। ভীষণভাবে বাড়ছে। ঘনকুয়াশায় আমরা পৃথিবীর কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছি। ধীরে ধীরে কুয়াশায় আড়াল হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্রের আলোকবর্ত্তিকারা। আড়াল হয়ে যাচ্ছে ভিনসেন্টের গাঢ় এবং লাল সুন্দর চুলগুলো। যার মুখে বারবার উচ্চারিত হত— “Art is to console those who are broken by life.” আমাকে আঁকতে হবে। আরো আরো আঁকতে হবে। কেউ কোনকালেই আমার ছবি না কিনুক, তবু আমাকে আঁকতে হবে। কেননা আঁকাটাই যে আমার জীবনবেদ। আঁকাটাই আমার নিজস্ব স্বরুপ। ভ্যান গঘ স্বগতোক্তিতে বলল।
আমি বললাম— তোমার ছবি এখন চড়াদামে বিক্রি হয় ভিনসেন্ট।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। এখন হচ্ছে। কেননা এখন আমি নেই। তোমরা এখন আমার ছবিগুলো দিয়ে বাণিজ্য করছ। শিল্পকে দরাদরিতে নামিয়ে এনেছ। তোমাদের অর্থের জন্য আমার ছবিগুলোই তোমাদের সম্পদ— লুটেপুটে খাচ্ছ, খাও আমার ঘামঝরা সৃষ্টিকর্ম্ম। আমার শিল্পকর্ম্ম। আমার সত্তাকে। ছবির বাণিজ্যমূল্যই সব— “I’m such a nobody. I’m such a nobody……”
রিজবাহ রিজবী
জন্ম—
কুতুবদিয়া, কক্সবাজার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত। বর্ত্তমানে চট্টগ্রাম শহরে বসবাসরত …
Co- Founder
দিয়াশলাই অনলাইন বুকশপ।
মেইল: rijbahrizbi@gmail.com