LIBRARY OF BABEL || মাহবুবুল ইসলাম

0

 

“আয়না এবং সঙ্গম উভয়ই পরিত্যাজ্য। কারণ তা সংখ্যা বৃদ্ধি করে”। বোর্হেসের কথাটা লাইব্রেরীর ওপর লেখা দেখে রঞ্জু অবাক হয়ে গেল। জাহিদের মত money minded মানুষের বাড়ীতে এত সুন্দর একটা লাইব্রেরী। জাহিদের motto/মূলমন্ত্র ছিল ‘money is second god’ কিন্তু সময় মানুষকে কী না করে!

একজন নির্দ্দয়, insane হিটলারের পক্ষে যদি my camp লেখা সম্ভব, তো জাহিদের বেলায় কেন নয়?

স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সারভাইভাল instinct প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করে বেশী। ‘The Shawshank redemption’ movie-তে দেখা যায় brook, Red, Andy প্রথমে ঘৃণা করে জেলের বন্দিজীবন, তারপর অভ্যস্ত হয়, পরে এই জীবনকেই এক শৈল্পিক রূপ দেয়। Brook লাইব্রেরীকে এই জেলের ভেতর একটা অলটারনেটিভ জীবন হিশেবে বেছে নিয়েছে। কয়েদীদের বই সাপ্লাই করাই ছিল তার কাজ। সেজন্য জেল হতে বের হয়েও বাইরের জীবনে এতটাই অনভ্যস্ত ছিল যে সে আত্মহত্যা করে। Andy তো সংঙ্গীত, চিঠি লেখা আর বই পড়ার আড়ালে Shawshank redemption-এর দুর্নীতি, মার্ডার আর শোষণের কথা বাইরে জানাতে পেরেছিল।

“কী ভাবছেন, রঞ্জু সাহেব?”—
উইল চেয়ারটায় বসা একজন আপাত নিষ্প্রভ অথচ একজন নির্ভার মানুষ চা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলে—
“আপনি হয়ত ভাবছেন, কেন ডেকে এনেছি?
এই মানুষটাই বা বইয়ের ব্যাপারে এত অনুরক্ত হল কখন? …

রঞ্জু বলল :
আলেয়া কেমন আছে?
— ওপরে আছে। ডাক্তার রেস্টে থাকতে বলছে ঘণ্টা কয়েক।

: লাইব্রেরীটা তো বেশ গোছানো।

— শুধু কি গোছানো? ভালো করে দেখুন। আপনি সাহিত্যের লোক।

জর্জ লুইস বোর্হেস-এর ‘library of Babel’ তো পড়েছেন, নিশ্চয়ই।— এই বলে জাহিদ ভেতরে নিয়ে গেল। রঞ্জু দেখল অসংখ্য hexagonal গ্যালারী আছে। প্রত্যেকটা রুমে চারটা ওয়াল bookshelves-এ পরিপূর্ণ। প্রত্যেকটায় একটা হলওয়ে আছে আর আছে সর্পিল আকারের সিঁড়ী ওপরে নীচে উঠানামা করার জন্য। একদম বোর্হেসের library of babel এর অনুকরণে গড়া।

জাহিদ বলতে লাগল—
আলেয়ার হার্টের প্রবলেম জানেন তো। আমি যখন প্যারালাইজড হই, তখন ভীষণ বিষণ্ণ ও হতাশ হয়ে পড়ি। হসপিটালে দীর্ঘদিন পড়ে থাকি। তখন আমি Shawshank redemption movieটা দেখি আর বোর্হেসের library of babel।
আমাকে মুভিটা খুবই ইনসপায়ারড করে। সত্যিই তো জীবন আইদার get busy living or dying-একটা অপশন বেচে নিতে হবে।
জাহিদ আরও বলল—
আচ্ছা রঞ্জু সাহেব, এই বিশাল পৃথিবীটা কি Shawshank redemption নয় কি? আমরা সবাই তো কোন না কোনভাবে বন্দী।
আমি এই উইল চেয়ারে বন্দী। প্রথম প্রথম ঘৃণা হত, তারপর মানিয়ে নিই। এখন মনে হচ্ছে এটাও একটা gift.
‘‘Parasite” movie-তে Kim বলেছিল এটা।

: রঞ্জু অনেকগুলো movie-এর কালেকশন দেখে বলল, আপনি মুভিও দেখেন? তাও world-class।

— হ্যাঁ। বললাম না, আমি নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি। ব্যবসা বাণিজ্য চলে যাবার পর এই বাড়ীর ভাড়া দিয়েই আমার আর আলেয়ার চলে যায়। যদিও সে একটা স্কুলে চাকরী নিয়েছেল। অবশ্য অসুস্থতার জন্য তাও কনটিনিউ করতে পারে না। এখন আমার বেশিরভাগ সময়ই কাটে লাইব্রেরীতে।

: বলেছিলেন পঙ্গুত্ব একটা আশীর্ব্বাদ।

জাহিদ বলতে লাগল—
হ্যাঁ। আমি দেখেছি আগে যেভাবে জগতকে দেখতাম কিংবা আমাকে অন্যরা যেভাবে দেখত তা এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মানুষের এখন খুব কাছাকাছি যেতে পারি।
আমি এখন বহুমাত্রিক জগতে বাস করি। ওই তো সেদিন পার্কে গিয়েছিলাম। যারা আগে আমাকে দেখলে ভয় পেত, দূর থেকে সালাম দিয়ে চলে যেত, এখন আমার খুব কাছাকাছি এসে তারা আমার এবং তাদের সব ব্যক্তিগত কথা বলতে আর করে না।
ছোট ছেলে মেয়েরা আমার নীচের অংশ এমনভাবে দেখে যেন আমি ভিন্ন কোন উপাঙ্গ নিয়ে জন্মিয়েছি।
এনিয়ে বিভিন্ন narrative ও তৈরী করেছে। শিশুরা আমার উইলচেয়ারে দেখে কেউ কেউ এ্যালিয়েন মনে করল।
যুবতী মেয়ে কিংবা নারী আমার সামনেই সব আলাপ করে। একজন তার বয়ফ্রেন্ডকে বলে, আমাকে cheat করলে এমন অভিশাপ দিব— সারাজীবন উইলচেয়ারে পঙ্গু হয়ে পড়ে থাকবি।
আমি যেন তাদের মাঝে present থেকেও past tense। কেউ কেউ বলে ভদ্রলোকটা বড় ভাল লোক ছিলেন। এরমানে দু’টি পা অকেজো মানে আমি এখন অতীত হয়ে গেলাম। অথচ আমার হাত চোখ, মুখ সবই আছে।
আশলে আমি এখন অন্যপর্ব্বের প্রাণী যে নারীদের জন্য ভয়ংকর নয়। যার যা খুশী বলা যায় করা যায়।

: রঞ্জু বাধা দিয়ে বলে, তাহলে পুংলিঙ্গ বিপজ্জনক জেন্ডার।

— ইকজাক্টলি সৌ। এমনকি পার্কের মালি আমার চোখে চোখে তাকাতে ভয় পেত। সেও এখন আমার খুব কাছে এসে বসে বলে,
স্যার, দুঃখ করবেন না। আপনার তো শুধু পা নেই।
আমাদের কিছুই নেই। চুলো আছে। ভাত নাই। পোলাপাইন দুইবেলা উপোস থাকে। আমার মরদ খালি হুইত্তা দিন কাটায়। আমি পার্কে ঝাড়ু দিয়া আর কত কামামু কন? এই বেটা চারপাঁচটা পোলাপান জন্ম দিছে। সংসারে বড় জ্বালা।

আমি এদের পৃথিবীর সাথে আগে সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিলাম।

: রঞ্জু জাহিদের এসব শোনে বিরক্ত হয়নি তবে জানতে চাইল তাকে এইসব কেন বলছে।

— অনেক্ষণ চুপ থেকে জাহিদ বলল, আপনি কি আলেয়াকে ক্ষমা করেতে পেরেছেন?

: রঞ্জু চিন্তায় পড়ে গেল। এরকম কথা মৃত্যুযাত্রী মানুষের জন্যই বলা হয়। তাহলে আলেয়া কি বাচবে না। শুনেছে মাদ্রাজ দুই দুইবার নিয়ে চিকিৎসা করেও ইম্প্রুভ হয়নি খুব একটা।

সে স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেয়, এতবছর এই প্রশ্নের কী মানে?

— দেখুন, আমি আপনার আর আলেয়ার সবকিছুই জানি। আলেয়া নিয়মিতই আপনার ব্যাপারে কথা বলে। আপনার নাম, যশে সে খুব উচ্ছ্বসিত। তবে তার এই আনন্দের মাঝেও বিষাদ লক্ষ্য করলাম।
মনে হচ্ছে সে অনুশোচনায় ভুগছে।

: রঞ্জু বোর্হেস এর “labyrinth” বইটা শেল্ফে রেখে বলল,
আসলে কি জানেন? আলেয়ার জায়গায় সে ঠিকই ছিল আর আপনিই সঠিক ছিলেন। একটা সত্য হয়ত জানেন না।
জীবন কাউকে পূর্ণ সত্য দেখতে দেয় না।
আপনার সূত্র ধরেই বলি। ঠিক library of babel-এ যেমন অনেকেই আসে জীবনের রহস্য উদঘাটনের জন্য। কিন্তু কেউই পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জ্জন করতে পারে না। আমরা এমন একটা মহাবিশ্বে বাস করি যেখানে আমাদের একটা পুরো ক্যানভাসের আংশিকটা সবাই দেখি। এক অসীম সম্ভাবনার জগতের মাঝে আমরা। Tion গল্পে তো তাই বলেন বোর্হেস। তাই না?
আপনি যেমন বললেন, মানুষ ববহুমাত্রিক জগতে বাস করে। আপনি নিজেও নতুন একটা জগত আবিষ্কার করলেন।
এই কুড়ী বছরে আমিও বহুমাত্রিক জগতের ভেতর দিয়ে গেছি।
গোলাকার এ্যাকুরিয়ামের জেলি ফিশকে দেখিয়ে বলছে,
এই যে জেলিফিশ, সে দেখছে বাইরের পৃথিবী বাঁকা। এটা তার দোষ নয়। গ্লাসটা সোজা হলে, বাহিরটাও সোজা দেখত।
আমরাও এভাবেই এই ত্রিমাত্রিক জগতে বিভিন্নভাবে বন্দী। আমরাও জেলিফিশের মত বাঁকা জিনিশটাই দেখি। বোর্হেস The Aleph গল্পে এটাই বলেন,
space, universe এর মত আমাদের জীবনে একক কোন সত্য নাই। multifarious truth-এর বেড়াজালে বন্দী আমরা।
“I may be enemy to you at one point, may be friend at other point. Truth may be true to me but false to you. Everything varies, changes from time to time, person to person’’
আলেয়া জানত তার ছোট চার ভাই বোনের সংসার। বাবার প্যানশনের টাকায় চলে সংসার। সে মুহুর্ত্তে সে বিয়ে করাটা এই সমাজের প্রেক্ষাপটে ভুল ছিল না।

হ্যাঁ, একসময় আমি খুব কষ্টে ছিলাম, কেঁদেছিলামও। সেটাও ভিন্ন এক আমি ভিন্ন একটা জগৎ। কিন্তু “Time heals everything, makes people sagacious.”

রঞ্জু তারপর দোতলায় গিয়ে দেখে আলেয়া ঘুমিয়ে আছে। একটা মায়াবী আভা ছড়িয়ে আছে সর্ব্বত্র। ঘুমের দৃশ্যে একবার তাকিয়ে ছিল যখন তারা ঢাকা টু সিলেট যায়। তখন রঞ্জু চুমুও খায়।
কিন্ত আজ তাকাতে পারলেও চুমু খেতে পারবে না। আলেয়া এখন অন্য এক আলেয়া অন্যমাত্রার জগতে।
রঞ্জুর মনে হল মানুষের পুরো জীবনটাই একটা ঘুম।মাঝে মধ্যে স্বপ্ন থেকে জেগে ওঠে আর স্বপ্নভঙ্গ হয়।

 

 

 


মাহবুবুল ইসলাম
জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮১।

পৈতৃক নিবাস— মাধবপুর, হবিগঞ্জ। প্রকাশিত গ্রন্থ: জল ও জলোচ্ছ্বাস (কবিতা) (প্রকাশ সাল— ২০১৯, প্রকাশক— চয়ন)। শিশির-হরফ (কবিতা) (প্রকাশ সাল— ২০২০, প্রকাশক— চারবাক)।

 

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{LIBRARY OF BABEL || মাহবুবুল ইসলামের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার