নলখাগড়া ও কলম (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শনের গল্প) || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

ছবি : ইণ্টারনেট থেকে

চমৎকার একটা বিকাল। বাড়ীর বলতে গেলে সবাই উঠানে বের হয়েছে। ওদিকে ছোটচাচার ছেলে তপুকে নিয়ে তন্ময়ের বড় আম্মা আর আম্মা পড়েছে। প্রায় শুকনো উঠানের মাঝখানে ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করা হয়েছে। তারই ওপর কাঠী দিয়ে দাগ টেনে অক্ষরের মত লেখা হচ্ছে, তপুকে শেখানো হচ্ছে কীভাবে লিখতে হয়। তপু কেবল দাগ টানতে পারে, বড় আম্মা চেষ্টা করছেন ৩ লেখা শেখাতে। ৩ লিখতে পারলে আর তিনটা দাগ ঠিকমত বসাতে পারলেই অ হয়ে যাবে। সবাই খুব উৎসাহ দিচ্ছে। দাদী একটা বেঞ্চে বসে কুটনীতে সুপারী কুটছেন, আর কথা বলছেন। তন্ময়ের নজর একদিকে উঠানে, আরেকদিকে দাদীর কথায়। আমাদের সময় আমরা এইভাবে উঠানে দাগ দিয়ে অক্ষর শিখতাম। খাগ দিয়ে লিখতাম। কালিতে চুবিয়ে চুবিয়ে লেখতাম, এখনকার মত সুন্দর সুন্দর কলম ছিল না। দাদী সুপারী কুটে আর এক কথাই বলতে থাকে। অদূরে পাল দাদা দুইটা খাসীকে কাঁঠাল পাতা খাওয়াচ্ছে। বাড়ী জুড়ে উৎসব উৎসব ভাব, বেশ কিছু আত্মীয়-স্বজনও এসেছেন। আগামীকাল তপুর তাক্তী অনুষ্ঠান।

তন্ময়ের মনে অনেক প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর গল্পদাদু ছাড়া আর কে দেবে!

গল্পদাদু একটু পরই নিজের ঘর থেকে বের হলেন। উঠানের মুখর পরিবেশ দেখে নিজেও এককোনায় বসে পড়লেন। তন্ময় আস্তে আস্তে গিয়ে গল্পদাদুর পাশে বসে পড়ে। তন্ময়ের মুখ দেখেই দাদু বুঝতে পারেন সে কিছু বলবে। একটু হেসে বলেন, কী দাদু, কী খবর?

দাদু তপুর তাক্তী অনুষ্ঠান এটা আবার কী? এরকম কিছুর নাম আমি আগে শুনিনি।

দাদু একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নিলেন তারপর শুরু করলেন, আগের দিনে প্রথম কলম ধরলে হাতেখড়ী অনুষ্ঠান হত। এই অনুষ্ঠানে উলুখাগড়ার কলম বা খড়িমাটী দিয়ে লেখার শুভ উদ্বোধন হত। হিন্দু মুসলমান সবাই এই অনুষ্ঠান করত বেশ আড়ম্বর করে, হিন্দুদের হাতেখড়ী আর মুসলমানদের তাক্তী অনুষ্ঠান। মুসলমানরা মৌলভী এনে বাড়ীর শিশুটাকে পিতা, মামা বা হুজুরের কোলে বসিয়ে বাংলা প্রথম অক্ষর বা আরবী প্রথম অক্ষর লিখিয়ে তাক্তী বা হতেখড়ী দিতেন। সনাতন ধর্ম্মাবলম্বীরা সংস্কৃত অক্ষর দিয়ে হাতেখড়ী দিতেন এবং ব্রাহ্মণ বা মাতুল অথবা পিতা মাতা হতে ধরে শিশুকে প্রথম লিখতে শেখান। সনাতন ধর্ম্মাবলম্বীরা মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে অর্থাৎ সরস্বতী পূজার দিন হাতেখড়ীর আয়োজন করত। তাক্তী বা হাতেখড়ী অনুষ্ঠানে ভাল খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হত, লোকজন আসত। আগামীকাল তপু প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে খাগের কলম ধরবে, লিখবে, ইমাম সাহেব দোয়াদরুদ পড়বেন যেন তপুর বিদ্যাশিক্ষা ভাল হয়। তপুর দাদীর শখ নাতীর তাক্তী অনুষ্ঠান করবেন।

তন্ময় মনোযোগ দিয়ে শুনে। দাদু, আগের দিনে কি কলম ছিল না? মানুষ নাকি খাগ দিয়ে লিখত? মাটীতে এঁকে লিখত? আমাকে কলমের গল্পটা বল না দাদু …

দাদু বললেন, বলব বলব, আগে তোর দাদীর বাটা থেকে পান নিয়ে আয়, মুখে একটু রস আনি।

তন্ময় দৌড়ে গিয়ে দাদীর বাটা থেকে পান নিয়ে আসে, দাদু পানটা মুখে পুরে শুরু করেন কলমের গল্প—

কলম শব্দের মূল অর্থ শর বা খাগ। আগের দিনে লোকে শরের কলম ব্যবহার করত। আমরা কলমকে ইংরেজীতে বলি, সেই পেন কোথা থেকে এসেছে তা জান?

তন্ময় না-সূচক মাথা নাড়ে। ‘‘ল্যাতিন আমেরিকার penna থেকে ইংরেজী penna এসেছে। লাতিন ভাষায় এর অর্থ ছিল পাখীর পালক। এ থেকে বোঝা যায় ওরা কলম হিসেবে পাখীর পালক ব্যবহার করত। কোন কোন অভিধানে আছে কলম মানে একপ্রকার ধান, নল, খাগড়া আবার কলম মানে লেখনী। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ অভিধান বলছেন, কলের সীমায়ন বহন করে যে তা হল কলম (সংস্কৃতে যা কলম্ব; কলম্ব = কল + ম্ +ব = কল মিতির বাহী)। মানুষ কথা বলে কল কল করে, যেমন নদীর ধারা কল কল করে বয়েই চলে। মানুষের কল কল করে বলা কথাকে কলম সীমায়িত করে লিখে রাখে। আসলে পৃথিবীর সব ভাষার একই আদিভাষা যে এক তা কলম শব্দটার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি। পাণিনিরও আগে লিখিত উনাদি সূত্রে কলমের উল্ল্যেখ আছে।

তন্ময় অবাক হয়ে জানতে চায়, দাদু, পাণিনি কে?

পাণিনি একজন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ। ধারণা করা হয় তিনি প্রাচীন ভারতীয় লৌহযুগের সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ। পাণিনির যুগ বা কাল নিয়ে কোন নিশ্চিত তথ্য পাওযা যায়নি। ড: আহমদ শরীফের মতে তিনি খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৭ম শতকে বর্ত্তমান ছিলেন। পাশ্চাত্যের গো সু ষ্টুকারের মতে তাঁর কাল ছিল খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৮ম শতাব্দী। জার্মাণ পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার এবং অযবোর মনে করেন পাণিনির সময়কাল খ্রীষ্টপূর্ব্ব ৪র্থ শতাব্দী। অমরকোষ, বৌদ্ধযুগে লিখিত, তাতেও কলম শব্দটা আছে। বহু প্রাচীন গ্রন্হে কলমের উল্ল্যেখ আছে। কলম যে লেখনী তা বহু প্রাচীন অভিধানে আছে। ‘লেখনী’ অর্থে কলম, যা আরবী ভাষার ‘কলম’ থেকে এসেছে। তবে নালী শাক বা ঘাসের ডাঁটা যে লেখনী, অনুরূপ শব্দ ল্যাতিন, গ্রীক, আরবী ভাষায়ও আছে। হিন্দী, তেলেগু, উড়িয়া ও বাংলা ভাষায় লেখনী অর্থে কলম শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। লেখনী অর্থে কলম আরবী থেকেই সংস্কৃতে এসেছে। আগের দিনে শর, খাগ, কঞ্চীর কলম সবই নালিকা। গ্রীক, ল্যাটিন শব্দের মৌলিক অর্থও নল, বেত, নলের কলম।

তন্ময়ের কাছে বিষয়টা কঠিন লাগছে। সে প্রশ্ন করে, তবে কি দাদু মানুষ শুরু থেকেই কলম ব্যবহার করে আসছে?

না দাদু, মানুষ যখন শিকার করত, কাঠী দিয়ে ছবি আঁকত মানুষ। পাতা বা গাছের ডালের কষ দিয়ে গুহার গায়ে পশু বা তার মনের ভাবটী ছবি এঁকে রাখত যাতে অন্যের কাছে তার ভাবনাটী পৌঁছে যায়। কারণ তখন তো মানুষ লিখতে জানত না। কলমের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরানো। প্রাচীন মিশরীয়রা বিভিন্ন গাছের পাতা ও বাকলের ওপর নলখাগড়া শর বা বাঁশের কঞ্চী দিয়ে লিখত। মধ্যযুগে কাগজ আবিষ্কারের পর পালকের কলমের শুরু। ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আলমুইজ-এর আদেশ অনুসারে হাতে কালি লাগবে না অথচ লেখার সময় আপনা থেকে কলমের ডগায় কালি চলে আসবে এমন কলম আবিষ্কার করা হয়। সেই কলমের নাম ছিল ফাউণ্টেন পেন। গ্রীসে ছিল হাতীর দাঁতের কলম। এর নাম ছিল ষ্টাইলাস। লেখার ধরণকে সেজন্য ষ্টাইল বলা হয়।

ছবি : ইণ্টারনেট থেকে

দাদু, নলখাগড়া দিয়ে কীভাবে কলম হয়?

নলখাগড়ার নলের আগাকে চোখা তেরছা করে কেটে কলম বানানো হত। গাছের চারা করা হয় একটা অংশ কেটে আরেক গাছে জোড়া দিয়ে নতুন চারা তৈরীর পদ্ধতিকেও কলম বলে। নলখাগড়ার আগে পাখীর পালকের গোড়ার চোখার অংশ দিয়ে লেখা হত এর পর এল বাঁশের কঞ্চী কলম।

দাদু তুমি বললে কলম মানে ধান, এটা কী রকম?

প্রাচীন কালে বাংলাদেশে ভাল ধানকে ‘কলম’ বলা হত। পরবর্ত্তীকালে এ ‘কলম’ ধানই কলমা ধান নামে পরিচিতি পায়। কালিদাসের এক শ্লোকে এ ‘কলম’ বা ‘কলমা’ ধানের বর্ণনা আছে।

দাদু, এখন তো আমরা সুন্দর সুন্দর বলপেন দিয়ে লিখি।

হ্যাঁ, যুগের পর যুগ কেটে গেছে কলমকে আজকের কলমের আকার নিতে, সে আরেক ইতিহাস। কত রকম যে কলম ছিল আর কতজন যে এই কলমের পিছনে শ্রম দিয়েছেন। বলপেন আবিষ্কারের ইতিহাসও চমকপ্রদ। সে গল্পও তোমাকে একদিন বলব।

তন্ময় মাথা নাড়ে, সন্ধ্যা হই হই, ঘরে যেতে হবে। দাদু আবার বলেন, কলম নিয়ে মজার মজার শব্দ আছে। কলমচী নামে একটী শব্দ আছে, সনদ যারা লিখতেন তাঁদের কলমচী বলা হত। আর বকলম হল এমন একজন লেখাপড়া জানা মানুষ, যিনি লেখাপড়া জানেন না এমন কাউকে চিঠিপত্র লিখে দেন, পড়ে দেন, তার হয়ে স্বাক্ষর করে দেন। বকলম মানে কিন্তু মূর্খ নয়।

তন্ময় এ বিষয়টী জানত না। তার অবাক হবার পালা। কতকিছু যে জানার আছে তার গল্পদাদুর কাছে। তবে আজ আর নয়, মা বকবে, ঘরে যেতে হবে। গল্পদাদু আর তন্ময় দুজনেই নিজেদের ঘরের দিকে পা বাড়ান।

 

 

 

 


রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।

প্রকাশিতব্য বই:
শব্দের ইন্দ্রজাল (গদ্য) [ প্রকাশক : শ্রীহট্ট] ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষার গল্প (গল্প) [প্রকাশক : চারবাক]

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{নলখাগড়া ও কলম || রুবি বিনতে মনোয়ারের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার