বঙ্গ্ থেকে বাংলা || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। শন্ শন্ বাতাস বইছে, মাথার ছাতা যেন উড়িয়ে নিয়ে যেতে চায়। আলপথ ধরে যে মহিলারা যায়, তাদের মাথায় ছাতা, সামনেও ছাতা। রিণি অবাক চোখে ওদের দেখছে। এখানে রিণি, ছিপী তাদের বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে এসেছে। চমৎকার একটা ডাকবাংলোয় তারা ওঠেছে। ছিপীর হাসব্যাণ্ডই সব ব্যাবস্থা করে দিয়েছে। এই জায়গাটা চর এলাকা। নারকেল গাছের সারি, খোলা আকাশ আর বালুময় পথঘাট। সবকিছুই খুব সুন্দর তবে পানী খেতে সমস্যা। লবণাক্ত পানীর জন্য ভাত তরকারী সবই লবণাক্ত লাগে রিণির। বাংলোবাড়ীটা বেশ পুরানো হলেও ভেতরটা নতুনের মতই। বাইরে আছে ফুলের বাগান। সময়টা বেশ কাটছে ওদের। ছিপী আর রিণি দুজনেই বাগানের ভেতর হাঁটছে, এখান থেকে পায়ে চলার পথটা দেখা যায়, সম্পূর্ণ বাংলোবাড়ী বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। একপাশ খালি।

আচ্ছা, বলতে পারিস এই প্যাটার্ণের বাড়ীগুলোকে বাংলো বলে কেন? হঠাৎ ছিপীর প্রশ্ন।

আগে ব-বর্ণটী বুঝতে হবে, বং বুঝতে হবে, তারপর তো বুঝবি বাংলো কাকে বলে— রিণির উত্তর।

সে কীরকম?

বাংলো শব্দটা এসেছে বং থেকে; বং গমন করে বঙ্গ-তে। ব-বর্ণ বাহী কিংবা অতিবাহী, অর্থাৎ দ্বৈতাদ্বৈতবাহী বা দুই-কে বোঝায়। বং হল ব বা বাহী, অতিবাহীর রহস্যরূপ কিংবা দ্বৈতাদ্বৈতবাহীর রহস্যরূপ।

বাহী, অতিবাহী বিষয়টা কী? ছিপীর কণ্ঠে বিস্ময়। …

রিণি মাথাটা নাড়ে, ব বর্ণ নিয়ে একদিন বলেছিলাম, আবারও সংক্ষেপে বলছি। বাংলায় ব বর্ণ দুইটা, অন্যান্য ভাষায়ও ব বর্ণ একাধিক রয়েছে। ব্ = বহন, ব = বাহী। একটা হল বর্গীয় ব, আরেকটা হল অন্তস্থ ব। অন্তস্থ ব = বাহী, এটা বহন করে, তুলে বহন করে। এটা উ বা উ + অ, এসব স্বরবর্ণ যোগ করে তৈরী, যার (ব) অর্থ তুলে রাখা। অন্তস্থ ব সংস্কৃতে ওয়, উঅ উচ্চারিত হয়। বাংলায় তাই হয়েছে অন্তস্থ ব। আবার বর্গীয় ব = ব্-অন করে যে, সে অতিবাহী। কারণ সে বৃদ্ধিসাধনপূর্ব্বক বহন করে। এই ব-কে দেবনাগরী লিপিতে বা পেটকেটে লেখা হত, ৰ— এভাবে। প্রাচীন ব্যাকরণবিদগণ সংস্কৃতরীতি অনুসরণ করে বর্গীয় ব-কে প-বর্গে ফ-এর পরে এবং অন্তস্থ ব-কে ল-এর পরে রেখেছিলেন। শ্রীহরিচরণ তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষে অন্তস্থ ব (ৰ)-কে প-বর্গে এবং বর্গীয় ব (ব)-কে ল-এর পরে অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সেই ধারা বঙ্গীয় শব্দার্থকোষও বজায় রেখেছেন। তাহলে দুইটা ব-এর পার্থক্য হল বর্গীয়-ব বৃদ্ধিসাধনপূর্ব্বক বহন করে, অন্তস্থ-ব তুলে নিয়ে বহন করে, বিকল্প পথে/নতুন পথে বহন করে। কারণ তুলে নিয়ে বহন করার পথ একাধিক। দুই ব-এর দুইটা রূপের পার্থক্য করা জটিল তাই এখন দুইটা ব-কে এক করে ফেলা হয়েছে।

অন্তস্থ ব (ৰ) নিয়ে কিছু শব্দের ব্যাবহার দেখ্— ছাওয়াল এবং ছাবাল দুইটা শব্দের অর্থ এক। ছা-ওয়-া-ল এর ওয় ছাবাল-এ এসে ব-এ রূপান্তরিত হয়েছে। আবার আমরা বলি গবাদী পশু বা গোবাদী পশু। সংস্কৃতে একেই বলে গোয়াদী। এখানে ওয় এসে ব-এ রূপান্তরিত হয়েছে। নবাব শব্দটী নওয়াব হতে এসেছে, যেখানে ওয় পরিবর্ত্তিত হয়ে ব হয়েছে। ভগওয়ান হয়েছে ভগবান, খাওয়ার হয়েছে খাবার, দাওয়ার হয়েছে দাবার, যাওয়া হয়েছে যাবা …। এই ওয়-এর পরিবর্ত্তে ব্যাবহূত ব হল অন্তঃস্থ ব।

আবার সোয়ামী হয়েছে স্বামী, সোয়াদেশ হয়েছে স্বদেশ। স্ব-এর সাথে যুক্ত বর্ণটী হচ্ছে অন্তঃস্থ ব। এ নিয়ে পরে কথা বলা যাবে, কেমন?

ও হ্যাঁ, কী বলছিলাম যেন?

বঙ্গ নিয়ে … ছিপি বলে।

ও আচ্ছা, যা বলছিলাম, বঙ্গ আশ্রিত বঙ্গা-তে। বঙ্গ-এর আধার লালিত বঙ্গাল-এ। দ্বিত্বের রহস্যরূপ লালিত থাকে বাংলা-তে (বাঙলা)। সংস্কৃত বঙ্গ মূল শব্দ তার থেকে বাঙালা, বাঙলা, বাংলা যা কিনা বঙ্গদেশ বোঝায়, বঙ্গভাষা বোঝায় আবার ধনুরাকৃতি টুয়াযুক্ত খড়ে ছাওয়া দো-চালা ঘরকেও বোঝায় যা ঝড়বৃষ্টি ঠেকাতে সাহায্য করে। গ্রামবাংলায় আগে এরূপ ঘর দেখা যেত, এগুলোকে বাঙলা, বাংলা ঘর বলে। কোন কোন স্থানে অবশ্য চারচালা, আটচালা ঘরকেও বাঙলা ঘর বলে। গ্রামবাংলায় মূল বাড়ীর বাইরে বসার ঘর, অতিথিদের জন্য ঘরকে বাংলা ঘর বলে।

ছিপী বলে, আমার তো মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে, বাংলা ঘর শুনেছি, আবার ডাকবাংলাও শুনেছি। কিন্তু এগুলো সম্পর্কে জানি না। আবার বলছিস দ্বৈতাদ্বৈত, আমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে সব।

ঠিক আছে বাবা সব বলছি ধীরে ধীরে, তুই মন দিয়ে শোন। রিণি বলতে থাকে। হ্যাঁ, বড় চালাঘরকে বাংলাঘর বলা হত, সেই ঘরে অতিথি লোকজন থাকত। বলছিস ডাকবাংলোর কথা। ডাকবাংলা বা ডাকবাংলো হল সরকারী অতিথিদের বাসভবন। এখন শৌখিন বাসভবনকে আদর করে বাংলো বলে, ওই যে বড়লোক সাহেবরা থাকেন বাংলোতে। আর বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ বলছেন, ডাকবাংলা মানে যে বাঙ্লা (বাংলো) হইতে ডাকিয়া পাঠান হয়।

ছিপী আবার প্রশ্ন করে, ডাক শব্দের সাথে কি ডাকবাংলার কোন সম্পর্ক আছে? রিণি উত্তর দেয়, অবশ্যই আছে। প্রাচীনকালের ডাক সম্পর্কিত তথ্য আমরা পাই বৈদিক গ্রন্থ অথর্ব্ববেদে। আমাদের এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই সংবাদ আদান-প্রদান করার ব্যাবস্থা যে ছিল তা আমরা জানতে পাই বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্য, লোকগাথা ও ছড়া-কবিতার মাধ্যমে। একজায়গা থেকে অন্যজায়গায় খবর, তথ্য পাঠানোর জন্য দূত এবং কবুতর ব্যাবহার করা হত। প্রাচীনকালে দূতের সামাজিক অবস্থান অনেক উঁচুতে ছিল, দূতকে বন্দী, অত্যাচার বা হত্যা করা হত না। কালিদাস আর ধোয়ী তো আপনজনকে খবর পাঠাতে মৌসুমী মেঘ আর বাতাসকে দূত হিসেবে কল্পনা করেছেন তাঁদের বিখ্যাত গ্রন্থ মেঘদূত ও পবনদূত-এ। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে নল-দময়ন্তীর হাঁস, রামায়ণে হনুমান, মহাভারতে বিদুর এবং আনারকলীর হরিণ এসব প্রাণীকে দূতিয়ালীর কাজে ব্যাবহার হতে দেখা যায়। বাংলা ডাক কথাটার শব্দার্থ আহবান করা অথবা মনোযোগ আকর্ষণ করা। এ শব্দ থেকে ডাকব্যাবস্থা, ডাকঘর, ডাকহরকরা এবং ডাকমাশুল শব্দগুলির জন্ম হয়েছে।

ছিপী বলে ওঠে, অনেক কিছু জানলাম। তুই বিরক্ত হচ্ছিস না তো? সবাই বেড়াতে গেল চরে আর আমি তোকে কেবল প্রশ্ন করেই চলেছি।

রিণি হাসে, আমি এগুলো কষ্ট করে পড়ে জেনেছি, কাউকে জানাতে পারলে বা কেউ প্রশ্ন করলে আমার ভাল লাগে। তারপর শোন, ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্য্যন্ত দিল্লীর প্রথম সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক-এর শাসনামলে ডাক ব্যাবস্থার ক্রমোন্নতির একটা ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি দিল্লী থেকে বাংলাদেশ পর্য্যন্ত আরবদের অনুকরণে এক ধরনের ডাক ব্যাবস্থা (ঘোড়ার ডাক) চালু করেন। ডাক-এর আধুনিক রূপ ডাকব্যাবস্থা, পোষ্টঅফিসকে ডাকঘর বলা হয়। চিঠি আগে আসত ডাকে, এখন আসে মেইলে।

ডাক-এর সাথে ডাকবাংলোর কী সম্পর্ক?

ডাক শব্দটার অর্থ একসময় ছিল অশ্ব, শকটাদিযান ও বাহনের যোগান। আগের দিনে দূরদূরান্তে চিঠিপত্রাদি পৌঁছানোর জন্য ঘোড়া ব্যাবহার হত, পথিমধ্যে স্থানে স্থানে ঘোড়া ও তার চালকের বিশ্রামের জন্য যে ব্যাবস্থা ছিল তাকে বলা হত ডাক। পরবর্ত্তীতে ওইরূপে প্রেরিত চিঠিপত্রাদিই ডাক নামে অভিহিত হতে থাকে। ইংরেজ আমলে ঠিকানা অনুসারে প্রেরিত বা আনীত পত্রাদি বা সামগ্রীকে ডাক বলা হত যা প্রাচীন ডাক-এর আধুনিক রূপ। বর্ত্তমানে মোবাইল, ইমেইল, জিমেইল এসব হচ্ছে ডাক-এর অত্যাধুনিক রূপ। আর ডাকবাংলা তাই সরকারী কর্ম্মচারী বা ভ্রমনকারীর পান্থশালা বা সরাই কারণ ডাক-বাহী ঘোড়ার ও আরোহীর বিশ্রামের ও রাত্রী যাপনের ঘর ছিল বলেই এখনকার দিনে তা সরকারী বিশ্রামাগার।

বুঝলাম, ওই যে বললি— দ্বৈতাদ্বৈত এবং দ্বি এগুলোর মানে কী?

দ্বি হল দুই, সে একইসাথে দুইরকম গুণ নিয়ে চলে। বঙ্গ শব্দটী এই গুণসম্পন্ন বলেই সে দ্বৈতাদ্বৈতবাহী। এখানে দ্বৈত হল বিশেষ্য পদ, যার অর্থ দুই সত্তা, যুগ্ম, দ্বিত্ব। অদ্বৈত হল অদ্বয়, যার দ্বিতীয় নাই। সে ভেদশূন্য; অদ্বিতীয়। দ্বৈত আর অদ্বৈত মিলে দ্বৈতাদ্বৈত, দ্বৈতাদ্বৈত-এর মানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার ভেদাভেদ। মূল অর্থ একের ভিতর দুই। সবকিছুই আসলে এক, থাকে দুই হয়ে, এর একটা পুরুষ অন্যটা প্রকৃতি হয়ে পরস্পরের সঙ্গে কামসূত্রে লিপ্ত থাকে। পুরুষপ্রকৃতির এই অভেদ অবস্থায় উভয়কে আলাদা করে চেনা যায় না।

এবার বঙ্গ সম্পর্কে বল।

বঙ্গ আসলে একটা বিশেষ ধরনের অস্তিত্বের/সত্তার বা গমনপ্রক্রিয়ার বা টিকে থাকার উপায়। এর দ্বৈতাদ্বৈত গুণ আছে বলে সে হতে পারে কোন ধাতু, উদ্ভিদ, মানুষ বা দেশ। যে বঙ্গপ্রক্রিয়া অবলম্বন করে চলে, সে বঙ্গ। এজন্য যে বঙ্গ-এর দর্শনের সাহায্যে চলে সে বঙ্গাল বা বাঙ্গাল বা বাঙ্গালী আর দেশ-এর ক্ষেত্রে তা বঙ্গদেশ।

আর বাংলাদেশ?

ছিপীর উত্তরে রিণি বলে, যে দেশ বাঙলা/বাংলা দিশায় চলে সেই দেশ বাংলাদেশ।

দেশ হিসেবে বঙ্গ নামটীর উৎপত্তি বিষয়ে কিছু বলবি?

দেশ হিসেবে কবে বঙ্গ নামের প্রচলন হয়েছিল তা নিয়ে মহাভারতে কাহিনী আছে। এই বঙ্গদেশ হল পূর্ব্ববঙ্গ যা নদীবহুল ও জলপ্রায় একটা দেশ ছিল। বঙ্গ বা বাংলা নামের উৎপত্তি নিয়ে অনেক মতপার্থক্য রয়েছে। ইতিহাস থেকে যতটুকু পড়েছি তা হল কারো কারো মতে, বঙ্গ নাম থেকেই বঙ্গাল এবং পরবর্ত্তীতে বাঙালা নামের উৎপত্তি হয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, অতীতে বং নামের এক জনগোষ্ঠী এ অঞ্চলে বসবাস করত এবং তাদের নাম অনুযায়ী অঞ্চলটা বঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার অনেকেই মনে করেন জলমগ্ন স্যাঁতস্যাঁতে অঞ্চলকে বঙ্গ বা বাংলা বলা হত। তাই নদী মেঘলা ও জলমগ্ন দক্ষিণাঞ্চল বঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে আসছে। কারো কারো মতে প্রাচীনকালে এর নাম বঙ্গ ছিল, তখনকার রাজারা বড় বড় আল নির্ম্মাণ করতেন, যা থেকে পরে বঙ্গ হয়ে যায় বঙ্গাল। কারো মতে বঙ্গ ও বঙ্গাল নামে দুইটা আলাদা দেশ ছিল, পরে বঙ্গাল থেকে বাংলা নামকরণ। কারো মতে নদীমাতৃক এই দেশে বন্যা ও জোয়ার ঠেকাতে ছোট বড় আল তৈরী হত জমীতে, কালক্রমে বঙ্গ শব্দের সাথে আল যুক্ত হয়ে বঙ্গাল এরপর বাঙালা হয়ে বাংলা।

আবার কারো মতে দেশের নাম ছিল বং। ভদ্রলোকেরা আদর করে বঙ্গ বলে ডাকতেন। ফারসিভাষী নবাবজাদারা সমীহ জাগাতে বলতেন বংআল। যেমন— আল কেমি, আল আরাবিয়া, আল হাদিস ইত্যাদি। ইংরেজীতে বললে বং আল মানে দি বং, The Bong। বং মানে জল। চীনা শব্দ। তিব্বত থেকে ব্রহ্মপুত্রের ধারার সাথে নেমে এসেছে এই শব্দ। অনেক হিন্দু ঐতিহাসিক মহাভারত, পুরাণ, হরিবংশ প্রভৃতি ধর্ম্মশাস্ত্রের ভিত্তিতে উল্ল্যেখ করেছেন যে, বলী রাজার ৫ জন সন্তান ছিল। যাদের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুক্ষ্ম। বলিরাজ এদেরকে ৫টা রাজ্য দেন এবং যে, যে রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন তার নামানুসারে সে রাজ্যের নামকরণ হয়। এদের মধ্যে বঙ্গ এর অধিকারভূক্ত দেশই বঙ্গ নামে পরিচিতি হয়। আবার, মুসলমানদের পুরাণ কাহিনী অনুসারে হযরত নূহ (আঃ)-এর এক পুত্রের নাম ছিল হাম, তার পুত্র হিন্দ, আর হিন্দ-এর দ্বিতীয় পুত্রের নাম ছিল বং। বং ও তার সন্তান সন্ততিগণ যে অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করেন, সেই অঞ্চলই কালক্রমে বঙ্গ নামে পরিচিতি লাভ করে। তাছাড়া কোন কোন ইতিহাসবিদ মনে করেন যে বাংলাদেশের আদিমতম জনগোষ্ঠী সাঁওতাল, কোল ও মুণ্ডাদের এক দেবতার নাম হল বোঙ্গা। এই বোঙ্গা থেকেও বঙ্গ নামের উৎপত্তি হতে পারে। খ্রিষ্টপূর্ব্ব তিন হাজার বছর আগে ঋগ্বেদে বঙ্গ শব্দের উল্ল্যেখ নেই। তবে খ্রিষ্টপূর্ব্ব ৫ম শতকে মুনি কর্ত্তৃক রচিত ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে বঙ্গ নামের সর্ব্বপ্রথম উল্ল্যেখ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার প্রথম স্বাধীন ও সার্ব্বভৌম রাজা শশাংক এই জনপদগুলোকে গৌড় নামে একত্রিত করেন। এরপর বঙ্গদেশ পুণ্ড্র, গৌড় ও বঙ্গ এই তিন জনপদে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সম্রাট আকবর-এর শাসনামলে সমগ্র বঙ্গদেশ সুবহ-ই-বঙ্গালহ নামে পরিচিত হয়েছিল। বাঙালা নামটী মুসলমান শাসকদের সৃষ্টি। বঙ্গ শব্দটার সঙ্গে ফার্সী আল প্রত্যয় যোগ করে। এতে নাম দাঁডায় বাঙাল বা বাঙ্গালাহ্। সুতরাং ফারসী বঙ্গালহ শব্দ থেকে পর্তুগীজ Bengala এবং ইংরেজী Bengal শব্দ এসেছে। পরবর্ত্তিকালে বাঙালা কিংবা বাংলা যা ব্রিটিশ শাসকগণ ইংরেজী ভাষায় বেঙ্গল (Bengal) এবং ভাষাকে বেঙ্গলী (Bengali) বলেই প্রায় দুইশত বছর চালিয়েছে। এভাবে কালক্রমে বঙ্গ > বঙ্গাল > বাঙ্গালা > সুবা-ই-বাঙ্গালা > পূর্ব্ববঙ্গ > পূর্ব্ব পাকিস্তান > বাংলা নামের উৎপত্তি।

‘তাহলে বঙ্গই হল আমাদের এই বাংলাদেশ।’ ছিপীর কণ্ঠে বিস্ময়!

হুম। এ নিয়ে শব্দার্থকোষে আরো তথ্য আছে। অঙ্গ হল যে জাতি উত্তরাধিকার অনুসারে চলে। যে জাতির নিজস্ব অর্জ্জন থাকে আবার উত্তরাধিকার মিলিয়ে নিয়েও চলে তাকে বঙ্গ বলা যায়। যে জাতি কলির সঙ্গে উত্তরাধিকার মিলিয়ে চলে তাকে বলে কলিঙ্গ। আসলে এর সব ব্যাবস্থাই জনগণ থেকে রাজাদের বিভিন্ন পন্থায় খাজনা আদায়ের এক এক ধরনের কৌশল। বঙ্গ-এর সর্ব্বোচ্চ বিকাশ শ্রীচৈতন্যের আমলে, তাঁর দর্শন ছিল দ্বৈতাদ্বৈতবাদী।

রিণি একনাগাড়ে কথা বলা শেষ করে। ছিপী ভাবনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। এই বং থেকে বাংলা, বঙ্গ থেকে বাঙ্গালা কত ইতিহাস জড়িয়ে আছে পরতে পরতে। তার কতটুকুই বা জানা হল। কত রাজা কত বেনিয়া এল, এই বঙ্গে। কত যুদ্ধ কত বিগ্রহ করল বহিরাগতরা এই দেশে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। সবশেষে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষে এই সোনার বাংলাদেশ। ছিপী দূরে তাকায়, কত সুন্দর এই দেশ। সন্ধ্যা হয়ে আসল প্রায়, শীতের পাখীরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। একটু যেন শীত শীত লাগছে। রিণি আর ছিপী দুজনেই এবার বাংলোর দিকে পা বাড়ায়। …

 

 

 

রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারী চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।
শব্দের ইন্দ্রজাল (গদ্য) [প্রকাশক : শ্রীহট্ট]

প্রকাশিতব্য বই:
ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষার গল্প (গল্প) [প্রকাশক : চারবাক]

অলঙ্করণ: হিম হৃতব্রত
প্রচ্ছদ: মেহেরাজ হাসান শিশির

{বঙ্গ্ থেকে বাংলা || রুবি বিনতে মনোয়ারের গল্প [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার