রোদন অরণ্যেই করুন, অরণ্যই বোঝে মর্ম্ম ব্যথা || শামীম রেজা

0

ছবি: ইণ্টারনেট থেকে

রোদন অরণ্যেই করা উচিৎ। মানুষ মানুষের ভাষা বোঝার সময়, মানবিক পরিস্থিতি হারিয়ে ফেলেছে। বৃক্ষদের দিকে তাকান, যখন মানুষ ছিল না তখনও তারা প্রাণপ্রদায়ী বায়ু, সুশীতল ছায়া, ফল এবং ফুল প্রদান করেছে। তাদের ওপর মানুষের এত অত্যাচার সত্ত্বেও তাদের সেই দানের কমতি পড়ে নাই কোনদিন। বৃক্ষদের ভিতরে গিয়ে মানুষের প্রতি করুনা বিগলিত হয়ে নতুন প্রাণ স্পন্দন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে বর্ষাকালেও গেয়ে উঠতে পারেন “রোদন ভরা এ বসন্ত সখী কখনও আসেনি বুঝি আগে”।

রোদন করতে হলে অরণ্যেই করুন। অরণ্যই বোঝে মর্ম্ম ব্যথা। …

১৯৬৬ সালে Backster Effect (গাছের ধারে কাছে অন্য জীবকে হত্যা করলে গাছের দুঃখ হয়) আবিষ্কার হয়।

আরেক গবেষণায় দেখা গেছে ধ্রুপদী সঙ্গীত অবিরাম শোনালে গমের ফলন ৬০ শতাংশ বেড়ে যায়। এই হল প্রকৃতিজাত হওয়ার গুণ।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, অস্তিত্ববাদী দার্শনিক কিয়ের্কেগার্ড বিশ্বাস করতেন মানুষের ভিতর তিন ধরণের জীবন রয়েছে, ধরণ শব্দটিকে ঠিক সমান্তরাল বা পাশাপাশি বা সমজাতীয় হিসেবে তিনি দেখেন নাই বরং স্তর বা Stage হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন, তিনটা স্তর হল ভোগী স্তর, Aesthetic, নৈতিক স্তর এবং ধর্ম্মীয় স্তর। মানুষের ভিতর তার ক্রিয়াশীল এই চেতনা যা তার জীবন এবং যাপন পদ্ধতি এবং বোধকে নির্ম্মাণ করে। সমাজ এবং রাষ্ট্রের রূপ কেমন হবে, কেমন হবে তার গতি প্রকৃতি তার একটা সরল হিসেব এই তিন স্তরের মানুষের অনুপাত করলে অনুমেয় হবে। কিন্তু বিষয়গুলো এত সহজ নয় বরং আরো একটু জটিল, বলা যায় বেশীই জটিল।

বৃক্ষদের নিজস্ব ধর্ম্ম আছে সে ধর্ম্ম প্রকৃতিজ সেটাকে সরলীকরণ করা যায় এমনকি মানুষ বৃক্ষদের সাথে কী ধরণের আচরণ করলে তারা কী ধরণের আচরণ করবে সেটাও নির্দ্ধারিত। মানুষের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটে না, একজন ব্যক্তি মানুষ জগৎ-সংসারে বিভিন্ন পরিচয় বহন করছে এবং প্রত্যেকটা পরিচয়ের আলাদা আলাদা ব্যক্তি বিচারে মানদণ্ড আছে সে অনুসারে সে ব্যক্তিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক জীবনের আচরণ নির্দ্ধারন করে। সামাজিক নিয়মশৃঙ্খলা, আইনকানুন, সংস্কৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয় সমূহ তার মানদণ্ডের কোষ তৈরী করে। এরপরও কথা থেকে যায় একই পরিবারে, সমাজে রাষ্ট্রে থেকেও ব্যক্তির আচরণ এবং জীবনবোধের এত ভিন্নতা কেন দেখা যায়?
কারণ চেতনা বা মানদণ্ড কোন স্থায়ী বা অপরিবর্ত্তনীয় কোন বিষয় নয়, ব্যক্তি প্রতিক্ষণে জগৎ-সংসারের পরিবর্ত্তনীয় বিষয়গুলোর সাথে মিথষ্ক্রিয়া করে বেঁচে থাকে এক্ষেত্রে যার মতি যেদিকে (গীতা তিন স্তরের কথা বলছে, সত্বঃ, রজঃ, তমঃ) অনুপাত অনুসারে ক্রিয়াশীল হতে থাকে।

ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রণ এবং একটা কাঠামোবদ্ধতার ভিতর নেওয়ার জন্যই তৈরী হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠানের। গোলটা এখানে বেঁধেছে, ব্যক্তি নিজে স্থির কোন মানদণ্ড ঠিক করে নিজের চেতনা দ্বারা পরিচালিত হতে পারছে না কিন্তু সামষ্টিকতার জন্য সে ঔ চেতনাকে খাটিয়ে আদর্শ এবং কাঠামো নির্ম্মাণ করছে ফলে আদর্শ এবং কাঠামোর ভিতর ব্যক্তি হয়ে পড়ছে গৌণ, মানুষ হওয়ার বৈশিষ্ট্যগত কারণেই সে এই গৌণতাকে আবার মেনে নিতে পারছে না আদর্শ এবং কাঠামোকে ভেদ করতে চাইছে সে আবার। এমনিভাবে একটা চক্র চলছে, ঘোরপাকের একটা চক্র, শরীর নাকি মন? আত্মা নাকি চেতনা?

যে কোন কাঠামো অন্যকোন কাঠামো সাপেক্ষেই মৌল এমনকি যদি আপনি কাঠামোহীনতার কথাও ভাবেন সেটাও একটা কাঠামোকেই নির্দ্দেশ করে। ব্যক্তি মৌলবাদীর সমস্যা হল সে আরোপ করতে চায়, আরোপিত যে কোন কিছুই তো অপ্রাকৃতিক। প্রশ্ন হল যার যেমন ইচ্ছে বা সাধ সে কি তেমনিভাবে চলবে নাকি তাকে কোন মানদণ্ড অনুসরন করা উচিৎ। উচিৎ শব্দটা আবার দেশকাল পাত্র নির্দ্ধারন করে। এখানে উচিৎ বলে কিছু থাকছে না বরং দেশকাল বিবেচনায় ব্যক্তিকে একটা মানদণ্ড অবশ্যই অনুসরন করতে হয় এক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের ওপর নিজের সিদ্ধান্ত আরোপ করবে কট্টরভাবে। ব্যক্তিকে একটা মানদণ্ড নির্দ্ধারন করে তার জীবন এবং যাপনের ওপর কট্টরপন্থা অবলম্বন করতেই হয়, এ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তি কট্টরপন্থারও উর্ধ্বে যেতে পারে না। ব্যক্তির এই যে মৌলবাদী হওয়া, কট্টর হওয়া এবং সেটা ব্যক্তির নিজের সাপেক্ষেই পরমভাবে হয়ে যেতে পারার যে অমোঘ পরিণতি তা কোন গতিপথে হবে এবং ব্যক্তি কিভাবে তা নির্দ্ধারন করবে এটার সুরাহা দার্শনিক পথে হতে হয়। আর সেই দার্শনিক সমাধান প্রয়োগ করবে সামষ্টিক চিন্তার সজীব প্রয়োগকারী রাজনীতিবিদরা। মৌলবাদ, কট্টরপন্থা, দার্শনিকতা, রাজনীতি এই শব্দগুলো যে অর্থবাচকতা প্রকাশ করে সেখানে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানগুলো ফাংশন করে। এদের ফাংশনের নিয়ামক মোটাদাগে ধরা হয় মানবিকতার গজকাঠীতে। মানবিকতার সাথে সময় সরাসরি সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ অতীতে মানবিকতা বলতে যেমনটা উপলব্ধি করা হত বর্ত্তমানে তা পাল্টে গেছে আবার ভবিষ্যতে তা পাল্টে যাবে। তবে মানবিকতা শব্দটাও একটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্প্রদায়িক শব্দ। জগৎ-সংসারের কল্যাণ মানুষের কল্যানের পরিপূরক নয় আরো অনেক প্রাণ সম্প্রদায় আছে জগৎ-সংসারে আমরা যদি গোটা জগৎ-সংসারের কল্যাণের কথা ভাবি দেখা যাবে প্রাকৃতিক বিচারে গোটা মানবসমাজ ভীষণ সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী আর কট্টর। কারণ মহাজাগতিক নিয়মকে অস্বীকার করে নিজের নিয়মকে প্রতিষ্ঠা করার এবং ক্ষমতা প্রয়োগ করে আরোপ করার ধৃষ্টতা কেবল মানুষ দেখিয়েছে যা সভ্যতার ইতিহাসে চরম জঘন্য বিষয়। মানুষের ইতিহাস মূলতঃ মৌলবাদীতার ইতিহাস, ক্ষমতা ঘনীভূত এবং আরোপ করার ইতিহাস, এর বাইরে যেসব আর্টকালচারের বিষয় বলা হয়ে থাকে তা এগুলোর বাইপ্রোডাক্ট ছাড়া কিছু নয়। অন্যের ধন চুরি করে নেওয়ার বুদ্ধি যে প্রাণী রপ্ত করতে শিখেছে সেখানে গান, কবিতা শিল্প সাহিত্যও সৃষ্টি করতে শিখবে সে এটাই স্বাভাবিক।

মানুষকে মহান ভেবে মানুষকে মানুষ ভালবাসার কথা বলে গেছে, ভালবাসতে হলে বৃক্ষদের ভালবাসুন তাহলে মানুষের প্রতি ভালবাসা এমনিতেই তৈরী হয়ে যাবে, মানুষকে ভালবাসতে যাওয়াটা জগতে শান্তি আনার ব্যর্থ পথ, শান্তির জন্য বৃক্ষের কাছে যান। বৃক্ষদের ভিতর কিকেয়ার্কেগার্ড নাই, গীতাও নাই তাদের এসবের প্রয়োজন হয় না, কিন্তু বৃক্ষরা গান শুনতে জানে, অন্যের কষ্টে কষ্টও পেতে জানে। মানবিকতা অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং ধ্বংসাত্মক শব্দ, দুনিয়া থেকে মানবিকতাবোধের ধারণাই উঠিয়ে দিতে হবে। মানব সভ্যতার শ্রেষ্ঠ কারচুপি আর দস্যূবৃত্তি বৈধ হয়েছে এই একটা গজকাঠী দিয়ে যা যুগে যুগে ব্যক্তি, গোষ্ঠী কখনও ধর্ম্ম কখনও দর্শন দ্বারা বৈধ করে প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীকে কলুষিত এবং প্রাণ সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছে। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল মানুষ নিজেদের ভিতরই বিভেদ এবং বিভাজন তৈরী করে রেখেছে।

মানবিকতার যে কাঠামো তৈরী হয়েছে সাথে আধুনিকতার সমান্তরাল সম্পর্ক রেখেই তার উন্নয়ন ঘটেছে, আধুনিকতা যে বাজার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে সেখানে ব্যক্তি কোন-না-কোনভাবে ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করতে গিয়ে এতদিনে গড়ে ওঠা তার সাংস্কৃতিক বলয় ভেঙে ফেলছে। ফলে নিত্য নতুন ধারায় নির্ম্মাণ হচ্ছে নব মানবিক কাঠামো, এটা মানুষের যন্ত্র আবিষ্কারের সাথে সাথেই ঘটে আসছে। যন্ত্রকে মানবিকতার সেরা নিদর্শন হিসেবে দেখা যায় কিন্তু যন্ত্র স্বয়ং কোন মানবিক ব্যাপার নয়।

যন্ত্রের অনুগামী হলে যন্ত্রণায় ভূগবে গোটা প্রাণ সম্প্রদায় আর বৃক্ষের অনুগামী হলে যন্ত্র হবে প্রাণ সম্প্রদায়ের অনুগামী। ………….

 

 

 

 

 

শামীম রেজা
জন্ম: ডিসেম্বর, ৩০, ১৯৮৯।
পড়ালেখা : এম এস এস, অর্থনীতি, ইসলামী বিঃ কুষ্টিয়া।
চাকরীর পাশাপাশি “বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট’’-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভ্য এবং চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রধান।

প্রচ্ছদ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{রোদন অরণ্যেই করুন, অরণ্যই বোঝে মর্ম্ম ব্যথা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভবভাবে) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।

— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার