কবি ও কবী : বানান বিষয়ক আলাপচারিতা || আরণ্যক টিটো ও রুবি বিনতে মনোয়ার

0

আরণ্যক টিটো—
‘কবি’ শব্দটীর বানান নিয়ে আমার মন ও মননে বিশদ ভাবনা ছিল না, একসময়। কিন্তু, বর্ত্তমানে ভাবনাতাড়িত আমি… যিনি কবিতার রচয়িতা, তিনি কবি? না কি অন্যকিছু? আর কবিতা রচনা করলে তাহাকে কবি বলা হবে-ই-বা কেন? এবং ‘কবি’ ও ‘কবিতা’ এই শব্দদুটির অর্থই-বা কী? …

এই বিষয়ে আমার ভাবনা হাজির করব, পরে … তার আগে
‘কবি’ ও ‘কবিতা’ নিয়ে একাডেমিক অভিধানগুলি কী বলে? আপনার কাছে শুনতে চাই, বিশদ পিপাসা মনে …

রুবি বিনতে মনোয়ার—
কবি শব্দটি বঙ্গভাষিগণ দু’ভাবে তৈরী করেছিলেন—

১। কবি = √কব্ (বর্ণন) + ই — কর্ত্তৃবাচ্যে (বক বক করে যে)।

২। কবি = √কু + ই — কর্ত্তৃবাচ্যে {কু (শব্দ) করে যে}।

একদল হচ্ছেন বক্ বক্ করে বর্ণনাকারী বা কব-ক্রিয়াকারী, এঁরা আবিষ্কৃত ও প্রচলিতকে ধারণ করে পুনরাবৃত্তির চর্চ্চা করেন, অতীতের জ্ঞানকে ধারণ করেন, পালন ও পোষণ করেন, সমস্ত তথ্য ও তত্ত্ব সংকলন ও পুনঃপ্রকাশ করেন। প্রচলিত জ্ঞানপ্রবাহকে সচল রাখার দায়িত্ব তাঁদের। এঁরা রাষ্ট্রশক্তির আশ্রয়ে থেকে জ্ঞানের প্রবাহকে সচল রাখেন। এঁরা দক্ষ এবং প্রকৃতি গুণসম্পন্ন, এবং কবিতা লেখাই ইনাদের একমাত্র কাজ নয়।

আরেকদল হচ্ছেন কু-রবকারী, এঁরা পুরুষ শক্তিসম্পন্ন; কারণ এই শ্রেণীর কবি প্রচলিতের সীমা লঙ্ঘন করে নতুনের ডাক দেন, মানবসভ্যতায় নতুন কিছু যুক্ত করেন। কাজেই ইনারাও কেবল কবিতা বা পদ্য রচনা করেন না, বরং আরও বহুকিছু করেন। …

এবার আপনার ভাবনা উপস্থাপন করুন …

আরণ্যক টিটো—
কবি বিষয়ের আপনার আলাপকে একটু অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যাক—
যেমনঃ আমি আপনাকে বললাম, যা … আপনি যা-এর সাথে ‘ই’ যোগ করে বললেন, যাই। অর্থাৎ আপনি গতিশীল হলেন। অর্থাৎ, যাওয়া গতিশীল হলে হয়, যাই— যে ভাবে খাওয়া গতিশীল হলে খাই, পাওয়া গতিশীল হলে পাই … ইত্যাদি ইত্যাদি …
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক আলোকে— বাঙলা বর্ণমালায় ‘ই’ ধ্বনি গতিকে বরণ করেছে। যে কোন শব্দে ই-এর ব্যবহার থাকলে গতি/গতিশীল ভাবতে হবে … আর ‘ঈ’ হল গতি/গতিশীলের আধার, যাহা প্রকৃতি।
পূর্ব্বজ বাঙলাভাষিগণ, বাঙালীর কণ্ঠনিসৃত ই-ধ্বনিকে দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছে ভাষার আবিষ্কারে, যাহা হ্রস্ব-ই (ই) ও দীর্ঘ-ই (ঈ)— গতি/গতিশীল (প্রত্যয়) ও গতি/গতিশীলের আধার (প্রকৃতি)। যেহুতু এই মহাবিশ্বে শুধু গতিময় না, গতি/গতিশীলের আধার বা প্রকৃতিও।

এই ভাবে, √কব্ + ই = কবি। অর্থাৎ কব্ গতিশীল হলে কবি (কথা কবি কি না ক’), এই কবি হল কওয়া/বলা— যাহা ক্রিয়া, ক্রিয়াকারী, প্রকৃতি না।

√কু অথবা √কব্ ক্রিয়ামূল থেকে উৎসারিত কব্-এর অস্তিত্বনে, (কথা কবি কি না ক) বাক্য শুনে, আপনি কব্-এর সাথে অস্তিত্বন বা ‘অ’ যোগ করে বললেন, ‘কব কথা শিশিরের সনে’। (√কব্ + অ = কব)। এই যে শিশিরের সনে কথা বলা না, কথা বলে যে, আপনি, ক্রিয়া না, ক্রিয়াকারী, প্রকৃতি— অর্থাৎ ঈ। তাই শিশিরের সনে কথা কব কব করা আপনি কব্ + ঈ = কবী, কব্-এর গতিশীল আধার বা প্রকৃতি। যে ভাবে, নব্-এর গতিশীল আধার বা প্রকৃতি হল নবী, শিল্প্-এর গতিশীল আধার বা প্রকৃতি হল শিল্পী … ইত্যাদি ইত্যাদি … কব্-এর অর্থ কী?— ক্রিয়ার কাজলে, বর্ণের কাজলে রঞ্জিত ক-এর অর্থ হল, কারী। আর ব্-এর অর্থ বহন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কব্-এর অর্থ কারীর বহন। আপনি যখন কব্ কব্ করছেন, তখন কারীকে বহন করছেন। কারী হল ভাব/কথা … এই ভাব/কথা হল কারী, এ কারণে যে, এই ভাব/কথাই ক্রিয়া বহন করে শিশিরের মনে, আপনার বলা কথার মাধ্যমে, কব্ … কব্ … কব … কব … শব্দের ব্যঞ্জনায় … কবিতা হল কব্-এর গতিশীল তারী বা তরণের আধার। √কব্ + ই + ত্ + আ = কবিতা, যার রচয়িতা কবী। রচনা করছেন, ‘কব কথা শিশিরের সনে/ ভ্রমরা, নিশিতে যাইও ফুলবনে/ …’

আমার আলাপকে আপনি কী ভাবে দেখছেন?

রুবি বিনতে মনোয়ার—
ধন্যবাদ, আপনি চমৎকার বলেছেন। এই প্রসঙ্গে আমি আরেকটু বলতে চাই। এই বিশ্বজগৎ হচ্ছে পুরুষ প্রকৃতির বিরাট লীলাক্ষেত্র। পুরুষ প্রকৃতির বিষয়টি স্থির কিছু নয়, প্রয়োজনে পুরুষ কখনও প্রকৃতি, আবার প্রকৃতি কখনও পুরুষ অর্থাৎ তারা স্থান বদল করে। পুরুষের কাজ ক্রিয়া সম্পাদন বা করণ, তাই সে কর্ত্তা, সে ক্রিয়াকারীর (প্রকৃতি) সহায়তায় ক্রিয়া সম্পাদন করে। কব শব্দটী ‘কহব’ শব্দের সংক্ষেপ। কব অর্থ বলব, কহিব। এটি মৈথিলী বাংলায় রয়েছে। যার অর্থ কথন। সংস্কৃত √কব্ (স্তব) + ই = কবি। কবি যিনি কবিতা রচয়িতা, পণ্ডিত, বিদ্বান, তত্ত্বজ্ঞ। যেহেতু এটি পুরুষ হিসেবে অভিধানকারকগণ চিহ্নিত করেছেন, কাজেই আমার মনে হয় কবি বানান ভুল হবে না। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে কবির আধার কবী। যা প্রকৃতি হিসেবে সঠিক। কবি আধারস্থ কবী-তে। কবি এমন একটি পুরুষ সত্তা যা অখণ্ড জ্ঞানের অধিকারী।

আরণ্যক টিটো—
‘‘সংস্কৃত √কব্ (স্তব) + ই = কবি। কবি যিনি কবিতা রচয়িতা, পণ্ডিত, বিদ্বান, তত্ত্বজ্ঞ।’’ এই রেফারেন্সটুকুর দিকে একটু আলোকপাত করা যাক—

কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী বিরচিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন বলছে, বাঙলা বর্ণমালায় ‘ই’ হল গতি/গতিশীল আর ‘ঈ’ হল গতি/গতিশীলের আধার।

এখন ‘‘সংস্কৃত √কব্ (স্তব) + ই = কবি” যদি হয়, তাহা হল, কব্-এর গতি/গতিশীল, গতি/গতিশীলকারী না, সুতরাং কবি কব্-এর গতি/গতিশীল (ক্রিয়া) না হয়ে কবিতা রচয়িতা, পণ্ডিত, বিদ্বান, তত্ত্বজ্ঞ হন কী ভাবে? গতি/গতিশীল (কণ্টিনিউয়াস) আর গতি/গতিশীলের আধার (কণ্টিনিউয়াসকারী) তো এক না, কারী না থাকলে ক্রিয়া করে কে?

রুবি বিনতে মনোয়ার—
একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে আমাদের। আদিতে পুরুষ প্রকৃতি এক ছিল, ভিন্ন ছিল না। যেন একদেহে এক প্রাণ। মানুষ যেমন আদিতে সমান ছিল, পরে বিভক্তি এসেছে। পুরুষ প্রকৃতিও তেমনি আলাদা হয়েছে। কবি কবিতা রচনা করেন, তিনি কর্ত্তা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কর্ত্তা কার দ্বারা করণ সম্পাদন করেন। কবি তার অনুভব দিয়ে, তার জ্ঞান দিয়ে মানসলোকে যা সৃজন করেন তাই মুখে বলে কিংবা লিখিত আকারে প্রকাশ করেন। এখানে ক্রিয়াকারী কবির মানসলোক। আমার এরকমই মনে হচ্ছে। …

আরণ্যক টিটো—
তাহলে
আমরা এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি— কবি ও কবী, প্রত্যয় ও প্রকৃতিভেদে দুটি বানানই সঠিক—
যেমনঃ কবি— কথা কবি কি না ক/কহা/বলা (প্রত্যয়/পুরুষ)।

কবী— কব্-এর গতিশীল তারী বা তরণের আধার বা কবিতায়, ‘কব কথা শিশিরের সনে/ ভ্রমরা, নিশিতে যাইও ফুলবনে/ …’ চরণের রচয়িতা (প্রকৃতি/আধার)।

রুবি বিনতে মনোয়ার—
আমারও তাই মনে হয়। প্রত্যয়/পুরুষ সত্তা হিসেবে কবি সঠিক, আর প্রকৃতি হিসেবে কবী বানান সঠিক।

আরণ্যক টিটো—
তাহলে আমরা আশা করতে পারি, কবি ও কবী : বানান বিষয়ক আলাপচারিতা, বিশেষ করে ই ও ঈ বর্ণের ব্যাকররণগত আলো বাঙলাভাষাভাষিগণ ও পণ্ডিতসমাজ উপলব্দি করতে পারবেন, ব্যাবহারের উপযোগিতায় …

রুবি বিনতে মনোয়ার—
আরণ্যক টিটো, আমরা আশা করব … তবে এর দায়ভার বাঙলাভাষাভাষিগণ ও পণ্ডিতসমাজের …

আরণ্যক টিটো—
রুবি বিনতে মনোয়ার, শুভেচ্ছা আপনার জন্য …

রুবি বিনতে মনোয়ার—
আপনার জন্যেও … এবং বাঙলাভাষাভাষিগণ ও পণ্ডিতসমাজের জন্যেও …

 

 

 

আরণ্যক টিটো

আরণ্যক টিটো
জন্ম জুন, ০৬, ১৯৭৭।

জন্মস্থান উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
(শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন) বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে।
প্রকাশিত কবিতার বই
ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)।
প্রকাশিতব্য বই
অর্দ্ধনারীশ্বরবাদ : প্রকৃতিপুরুষতত্ত্ব (নন্দনতত্ত্ব), বটতলার বয়ান (ভাষাতাত্ত্বিক গদ্য) ও উদ্ভিদপ্রতিভা (কবিতা)।
সম্পাদক চারবাক।

 


রুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।

 

প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : মেহেরাজ হাসান শিশির

{কবি ও কবী : বানান বিষয়ক আলাপচারিতা [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাদর্শন (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তী) অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার